সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম যেমন: ফেসবুক, টুইটার, ইন্সটাগ্রাম আমাদের সামাজিকভাবে আরও কাছাকাছি আনার স্লোগান নিয়ে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। বেশিরভাগ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নিজেরা কোনো কন্টেন্ট তৈরি না করলেও অসংখ্য কন্টেন্টের ভাণ্ডার হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে। ভিডিও, আর্টিকেল, ছবি সবকিছুই কন্টেন্টের আওতায় পড়ে। কোটি কোটি কন্টেন্টের মাঝে কিছু থাকে, যাদেরকে আমরা বলে থাকি ভাইরাল কন্টেন্ট। জনপ্রিয়তার বিচারে এসব কন্টেন্ট অন্য সকল কিছুর চেয়ে আক্ষরিক অর্থেই চূড়ায় অবস্থান করে। তেমনই একটি ভাইরাল হওয়া কন্টেন্ট, যেখানে দর্শককে জিজ্ঞেস করা হচ্ছে একটি তুলনামূলক সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার জন্য।
ছবিটিকে বলা হয় মুলার-লায়ার ইলিউশন। জার্মান সমাজবিজ্ঞানী ফ্রানৎস কার্ল মুলার-লায়ার এই ভ্রমটির প্রবর্তক হিসেবে গবেষণার ইতিহাসে বিখ্যাত হয়ে আছেন। আপনার কাছে যদি জানতে চাওয়া হয়, বাম পাশের দুটি রেখার মাঝে কোনটি বড় বা ছোট, তবে উত্তর কী হবে? যেহেতু এই লেখাটি পড়ছেন, তাই এটি ধারণা করে নেওয়া খুব বেশি অযৌক্তিক হবে না যে আপনি তথাকথিত আধুনিক বিশ্বের একজন বাসিন্দা। অর্থাৎ বিশ্বায়ন, ইন্টারনেট, প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ সাধন ইত্যাদি বহুল আলোচিত বিষয়ের মাঝে আমার মতো আপনিও ডুবে আছেন। আধুনিক সভ্যতার একজন মানুষ হিসেবে সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে ,আপনার কাছে বাম পাশের দু’টি রেখার মাঝে নিচের রেখাটিকে উপরেরটির তুলনায় বড় লাগবে। এবার কোনোভাবে দুটি রেখা থেকেই যদি শেষ প্রান্তে ব্যবহৃত তীর চিহ্নগুলো মুছে দেওয়া যায়, তাহলে আপনি অবাক হয়ে লক্ষ করবেন যে, দু’টি রেখার দৈর্ঘ্যই প্রকৃতপক্ষে সমান; এতটুকু কমবেশি নেই।
প্রশ্ন হচ্ছে, আধুনিক সভ্যতার সাথে ভ্রমের সম্পর্ক কী? চলুন এবারে ঘুরে আসা যাক নামিবিয়া থেকে। নামিবিয়ার উত্তর পশ্চিমাঞ্চলের উপত্যকা ঘেরা একটি জায়গা কিউনেন। কিউনেনের রাজধানী ওপুয়ো। আধুনিক সভ্যতার সকল সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত এই ওপুয়োতে সর্বসাকুল্যে ১২,০০০ লোকের বসবাস। ওপুয়ো তার বুক পেতে দিয়েছে আফ্রিকার এক প্রাচীন অধিবাসী হিম্বা সম্প্রদায়ের মানুষের জন্য। ওপুয়োর এক প্রান্তে রয়েছে কিছুটা মফস্বলের ছোঁয়া আর অন্য প্রান্তে রয়েছে পুরোপুরি গ্রামাঞ্চল। গ্রামাঞ্চলে বসবসকারী হিম্বা জনগোষ্ঠী আক্ষরিক অর্থেই প্রযুক্তি, আধুনিকতা, ডিজিটালাইজেশন ইত্যাদি থেকে বিচ্ছিন্ন। আশ্চর্যজনক হলেও সত্য তারা কাগজ কিংবা কলমের সাথেও একেবারেই পরিচিত নয়। তাদের প্রধানতম পেশা হচ্ছে গৃহপালিত পশুপালন।
শহুরে জীবনযাত্রায় প্রকৃতির ছোঁয়া একেবারেই কম। ঝাঁ চকচকে আলোকসজ্জা, প্রচুর আসবাবপত্র, যন্ত্রপাতি, যানবাহন ইত্যাদি নানা কিছুর উপস্থিতিতে মানুষের চিন্তন দক্ষতা (cognitive function) উল্লেখযোগ্যভাবে পরিবর্তিত হয়। ইউনিভার্সিটি অভ স্যান ডিয়েগোর সাইকোলজিক্যাল সায়েন্সেস বিভাগের শিক্ষক কেনেথ ডি কেইথ তার একটি গবেষণায় ভিজুয়াল ইলিউশন বা দৃষ্টিগত ভ্রম সম্পর্কে আলোচনা করেন। তার বিশ্লেষণ অনুযায়ী, আধুনিক সভ্যতায় বসবাসকারীরা ঘরের ভেতর অধিক সময় কাটায়। ঘরের ভেতর স্বাভাবিকভাবেই আসবাবপত্রের সংখ্যা থাকে প্রচুর এবং যেকোনো আসবাবপত্র বা যন্ত্রপাতির কিনারা বা ধার থাকে।
এই বিষয়টিকে তিনি উল্লেখ কার্পেন্টার্ড কর্নার হিসেবে। একটু খেয়াল করলেই বোঝা যাবে যে, ঘরের অভ্যন্তরে আমরা যতটা কোণ প্রত্যক্ষ করে থাকি, ঘরের বাইরে গেলে কিন্তু সে সুযোগটা কমে যাচ্ছে। কোনো একটি বস্তু বা গঠনে উপস্থিত কিনারা বা ধার যদি পর্যবেক্ষকের সাপেক্ষে বাইরের দিক মুখ করে থাকে, (ঘরের যে কোনো দু’টি দেয়াল যে জায়গায় এসে মিলিত হয়), তাহলে সেটি অপেক্ষাকৃত দূরবর্তী মনে হয়। অন্যদিকে কোনো গঠনে উপস্থিত কিনারা যদি দর্শকের দিকে মুখ করে থাকে (টেবিলের দু’টি ধার যেখানে এসে একত্র হয়), তাহলে সেটি অপেক্ষাকৃত নিকটবর্তী মনে হয়।
এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, আমাদের মস্তিষ্ক এই দক্ষতাটি অর্জন করেছে মূলত ভালোর জন্যই; কারণ এ দক্ষতার কারণেই আমাদের চোখ থেকে ভিন্ন ভিন্ন দূরে অবস্থিত অসংখ্য দ্রব্য, বস্তু, নকশা, ইমারতের তুলনামূলক আকার সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু যখন কোনো ভ্রম আমাদের মস্তিষ্কের দৃষ্টিগোচর হয়, তখন এই দক্ষতাটির কারণেই আমরা নিখুঁত হিসেব করতে ব্যর্থ হই। প্রকৃতির সান্নিধ্য থেকে ক্রমেই দূরে সরে আসার কারণে আমাদের মস্তিষ্ক একটি নির্দিষ্ট বস্তুর খুঁটিনাটির দিকে মনোযোগ দেওয়ার বদলে বস্তুটির সামগ্রিক আকার-আকৃতি সম্পর্কে ধারণা লাভ করতে অধিক দক্ষ হয়ে উঠেছে।
মুলার-লায়ার ভিজুয়াল ইলিউশনটিকে হিম্বা সম্প্রদায়ের সদস্যদের কাছে উপস্থাপন করলে তারা কিন্তু দ্বিধাহীনভাবে জবাব দিয়েছিল, দু’টি রেখার দৈর্ঘ্যই প্রকৃতপক্ষে সমান। কারণ তাদের জীবনযাত্রা এখনও প্রকৃতিকে ঘিরে। আর প্রকৃতির সাথে এক অদ্ভুত সৌহার্দ্যপূর্ণ সহাবস্থান তাদের। তারা গ্রামের যে জায়গাটিতে গৃহপালিত পশুদের যত্ন-আত্তি করে, সেটিকে বলা হয় ক্রাল। তাদের ঘরবাড়ি থেকে শুরু করে জীবনযাত্রার প্রতিটি স্তরেই আধুনিক সভ্যতার ন্যূনতম কোনো সংস্পর্শ নেই। ফলাফল হিসেবে যেকোনো বিষয়ের প্রতি পূর্ণ মনোযোগ দেওয়া এবং খুঁটিনাটি বিষয় সম্পর্কে একেবারে নিখুঁত ধারণা লাভের ক্ষমতা দু’টিই তাদের রয়েছে ষোল আনা। যেকোনো ধরনের ভ্রম সম্পর্কে তাদেরকে মন্তব্য করতে বলা হলে পশ্চিমাদের তুলনায় তারা বহুলাংশে সঠিক মন্তব্য করতে সক্ষম বলে প্রমাণিত হয়েছে এবং ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিষয়ের বদলে সামগ্রিক আকার-আকৃতি সম্পর্কেও তারা নির্ভুল পরিমাপ করতে সক্ষম।
গবেষণার যেকোনো শাখাতেই স্যাম্পল বা পপুলেশন নির্বাচন করার ক্ষেত্রে পশ্চিমা বিশ্ব সাধারণত উইয়ার্ড (WEIRD) নীতি অনুসরণ করে থাকে। অর্থাৎ, কোনো না কোনোভাবে গবেষণার জন্য নির্ধারিত জনগোষ্ঠীটি Western (পাশ্চাত্য), Educated (শিক্ষিত), Industrialized (শিল্পায়ন নির্ভর), Democratic (গণতান্ত্রিক)- এই পাঁচ শ্রেণির যেকোনো একটি হয়ে থাকে। অন্যদিকে আদিবাসী কিংবা সম্পূর্ণভাবে সভ্যতা বিবর্জিত সম্প্রদায়কে নিয়ে তেমন কাজ হয়নি পৃথিবীতে। এই প্রথাটি ভাঙলেন গোল্ডস্মিথস ইউনিভার্সিটি লন্ডনের অধ্যাপক জুলস ডেভিডফ।
তিনি এবিংহস ইলিউশন নিয়ে কাজ করলেন হিম্বা সম্প্রদায়ের ওপর। মুলার-লায়ার ইলিউশনের মতো এবারও তারা পশ্চিমাদের তুলনায় নির্ভুলভাবে এই পরীক্ষাতেও সফলতার সাথে উত্তীর্ণ হলেন। ডেভিডফ বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করলেন দু’ভাবে।
প্রথমত, শহুরে জীবনযাত্রার তুলনায় ওপুয়োর অধিবাসীদের মাঝে মনোযোগ বা বিশ্লেষণী ক্ষমতায় ব্যাঘাত ঘটানোর জন্য প্রয়োজনীয় বিক্ষেপ (distraction) একেবারেই নেই। কোনো সূক্ষাতিসূক্ষ্ম বিষয়ে তারা দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে চাইলে তাদের মনোযোগে ছন্দপতন ঘটানোর মতো উপাদান নিতান্তই নগণ্য। নির্দেশনানুসারে, তারা যেকোনো ছবি, দৃশ্যের সামগ্রিক এবং ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পরিবর্তন উভয় সম্পর্কেই সুস্পষ্ট ধারণা প্রদান করতে সমান পারদর্শী।
দ্বিতীয়ত, তাদের জীবনযাত্রা যেহেতু গৃহপালিত পশুপালন ভিত্তিক তাই তাদেরকে প্রতিটি প্রাণী সম্পর্কে পৃথক পৃথকভাবে ধারণা রাখতে হয় জীবনের তাগিদে। গরুর একটি পালের মাঝে থাকা প্রতিটি গরুকেই তারা স্বতন্ত্রতার ভিত্তিতে আলাদা করে চিহ্নিত করতে পারে এবং তাদের জীবনযাত্রার ধরনের কারণে তারা এ বিদ্যাটি রপ্ত করে নিয়েছে। এর কারণে তাদেরকে সাধারণত কোনো ভিজুয়াল ইলিউশন দিয়ে পরাস্ত করা যায় না।
সভ্যতার অগ্রযাত্রার সাথে হিম্বা সম্প্রদায়ও তাল মেলাতে শুরু করেছে। হিম্বা সম্প্রদায়ের তরুণ জনগোষ্ঠী ইতিমধ্যেই শহুরে জীবনযাত্রার প্রতি অভ্যস্ত হচ্ছেন। ওপুয়োর গ্রামাঞ্চল ছেড়ে শহরমুখী হচ্ছেন অনেকেই যাদের ক্ষেত্রে একই পরীক্ষার পুনরাবৃত্তি ঘটানোর পর সম্পূর্ণ বিপরীত ফলাফল মিলেছে। এমনকি যারা কেবলই কয়েকবারের জন্য গ্রাম ছেড়ে শহরে যাতায়াত করেছেন, তাদের দৃষ্টিশক্তি ও মনোযোগ প্রদানের ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। হায় সভ্যতা! হায় প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ!