ধরুন, ঘুম থেকে উঠতে আজ আপনার বেশ দেরি হয়ে গেছে। কিন্তু সকালে ফ্রেশ হয়েই আপনার দরকার ‘কফি’। আপনার সঙ্গী বা পরিবারের সবাই বেড়াতে গেছেন কোথাও। এদিকে অফিসে যেতে হবে, কিচেনে যাবার সময় নেই। কী করবেন?
নাহয় মনে করুন, কোনো এক সন্ধ্যায় মনটা আপনার ভীষণ খারাপ। খুব করে চাইছেন বিরহের একটা গান যদি মনের অজান্তে বেজে উঠতো… কেউ যদি শোনাতো! অথবা কোনো এক পূর্ণিমা রাতে ঘুম আসি আসি করেও আসছে না, আর চার ঘন্টার ডিপ স্লিপ দিয়েই পরদিন প্রেজেন্টেশনের জন্য আপনাকে প্রস্তুত থাকতে হবে। এ ছোট ছোট সমস্যার সমাধানে আপনার পাশে প্রযুক্তি, ডিজিটালাইজেশন তো আছেই। এগুলোর পাশাপাশি বন্ধুর মতো হাত বাড়িয়ে দিতে চাইছে ভার্চুয়াল রিয়েলিটি আর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। একটি বিপ্লব। চতুর্থ শিল্প বিপ্লব।
চতুর্থ শিল্প বিপ্লব আসলে কী
সহজ কথায়, ‘ডিজিটাল রেভল্যুশন’ বলতে আমরা সাধারণত যা বুঝি, হাতে কলমে সেটাই চতুর্থ শিল্প বিপ্লব। তবে এ বিপ্লব একদিনে আসেনি। বাষ্প ইঞ্জিনের আবিষ্কার, বিদ্যুৎ শক্তির ব্যবহার ও আইসিটির ব্যাপকতায় প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শিল্প বিপ্লবের সূত্রপাত ঘটেছিল। প্রথম ও দ্বিতীয় শিল্পবিপ্লব অনেক আগে ঘটলেও তৃতীয়টি খুব বেশি দিন আগের নয়। মূলত বিদ্যুতের আবিষ্কার না ঘটলে ইলেকট্রনিক সামগ্রী, কম্পিউটার তথা আইসিটি’র ব্যবহার শুরু হতো না, অন্যদিকে এগুলোর যথেষ্ট উন্নতি না হলে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রসার হতো না। তাই দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ শিল্প বিপ্লবকে একটি চেইন ম্যানেজমেন্ট অথবা ‘পুরোনো বোতলে নতুন মদ’ বলা যেতে পারে।
একটি নতুন ইতিহাস
বিশ্ব অর্থনীতি ফোরামের চেয়ারম্যান ক্লস শোয়াব তার ‘দ্য ফোর্থ ইন্ডাস্ট্রিয়াল রেভল্যুশন’ বইতে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব নিয়ে বিশদ আলোচনা করেছেন। তিনিই প্রথম এ শিল্প বিপ্লবের কথা জানান। মূল নিয়ামকরূপে কাজ করছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, দক্ষতা, সর্বেোপরি ডিজিটাল, ফিজিক্যাল ও বায়োলজিক্যাল সিস্টেমের এক অপূর্ব সমন্বয়। পূর্বের শিল্প বিপ্লবগুলো ছিল বেশিরভাগ ফিজিক্যাল সিস্টেমনির্ভর, অথচ ইতিহাসে এই প্রথম মানসিক দক্ষতা ও ডিজিটাল সিস্টেমকে প্রাধান্য দিয়ে একটি শিল্প বিপ্লবের সূচনা ঘটল।
ফিউচার জব রিপোর্ট অনুসারে, চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের কারণে বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় যে কয়টি কর্মদক্ষতা প্রয়োজন, তার মধ্যে প্রথম দশটি হলো-
- সমস্যা সমাধানের দক্ষতা
- বিশ্লেষণাত্মক চিন্তাশক্তি
- সৃজনশীলতা
- মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা
- সমন্বয় সাধন
- আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা
- বিচার করার এবং সিদ্ধান্ত নেবার দক্ষতা
- কাজের বিন্যাস
- বিতর্ক ও উপস্থাপনার সামর্থ্য
- জ্ঞানগত নমনীয়তা
এখন প্রশ্ন হলো, এসব কর্মদক্ষতা কেন প্রয়োজন? আমাদের চাকরির বাজারে স্থান করে নিচ্ছে কম্পিউটারভিত্তিক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। যুগের সাথে পাল্লা দিয়ে চলতে তাই এসব দক্ষতার বিকল্প আপাতত ভাবা যাচ্ছে না।
যেভাবে আমরা পরিবর্তন লক্ষ্য করছি
পরিবর্তন দেখার জন্য আমাদের খুব বেশি দূর যেতে হবে না। বর্তমানে আমাদের সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স আসে গার্মেন্টস ও আর.এম.জি. ক্ষেত্র হতে। কয়েকদিন পরপরই আমরা দেখতে পাচ্ছি, গার্মেন্টসগুলো তাদের শ্রমিক ছাঁটাই করছে, আবার বাইরে থেকে রোবট নিয়ে আসছে। ফলে যেখানে ১০০ জন শ্রমিক লাগত, সে কাজ পাঁচ-ছয়জনেই সেরে নেওয়া যাচ্ছে। রেস্তোরাঁগুলোতেও রোবটের ব্যবহার চালু হয়েছে। আজকাল রোবোটিক্স আমাদের দেশে অনেকটা ফ্যাসিনেশন হিসেবে কাজ করলেও খুব বেশিদিন নেই, যখন এটাই বাস্তবতা হিসেবে মানুষ প্রত্যক্ষ করবে।
আরেকটা বিষয় চোখে পড়ার মতো। আমরা হয়তো চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের ভুল বাটনে প্রেস করে বসে আছি। তরুণ সম্প্রদায়ের একটি বিরাট অংশ আজকাল সময় কাটায় সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে, ফেসবুকিং, ইউটিউবিং করে। গভীর রাতের নির্জন সময়ের সাক্ষী হয় অ্যান্ড্রয়েড বা আইওএস মুঠোফোন। এর ফলে যুবসমাজ দিনকে দিন হয়ে উঠছে অলস ও কর্মহীন। দক্ষতাসম্পন্ন গ্র্যাজুয়েট বা প্রযুক্তির কর্মমুখী জ্ঞানসম্পন্ন শিক্ষিত সমাজ থেকে আমরা এখনো পিছিয়ে। খুব কম সংখ্যক ব্যক্তিই এসবের সদ্ব্যবহার করছে। আমাদের সঠিক সময়ে সঠিক পথে এগিয়ে যাওয়া উচিত।
যা করা দরকার
চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের প্রভাব সারা বিশ্বে সমানভাবে পৌঁছায়নি, পৌঁছাবে না- এটাই স্বাভাবিক। তবে সোনার হরিণ ভেবে বসে থাকলেও চলবে না, হাতের নাগালে যা কিছু আছে, তা নিয়ে দৌড়ে অংশ নিতে হবে। এজন্য আমাদের-
- বাজারে আসা নিত্যনতুন প্রযুক্তিগুলোকে কাজে লাগাতে হবে। প্রযুক্তির সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যেতে হবে।
- প্রয়োজনীয় অনুযায়ী বিশ্বময় পরিবর্তিত হচ্ছে শিক্ষাব্যবস্থা। তরুণ সম্প্রদায় ঝুঁকছে ইন্টারনেটভিত্তিক শিখন প্রক্রিয়ার দিকে। তাই এ পথকে তাদের জন্য উপযুক্ত ও সহজ করে দিতে হবে।
- সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর ব্যবহারকে সুনির্দিষ্ট কাঠামোর আওতায় নিয়ে আসতে হবে।
- ই-কমার্স, ডিজিটাল মার্কেটিং, ইন্টারনেট ব্যাংকিং- এ খাতগুলোকে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য সহজলভ্য করে দিতে হবে।
- কৃষি, শিল্প ও সেবাখাতে রোবোটিক ইঞ্জিনিয়ারিং, বিশেষ করে জেনেটিক্স, থ্রিডি প্রিন্টিং, কোয়ান্টাম কম্পিউটিং, ব্লকচেইন ইত্যাদির সুবিধাগুলো গ্রহণ করে নিতে হবে।
বাস্তবায়নের পথে চ্যালেঞ্জগুলো
নিত্যনতুন প্রযুক্তির ভিড়ে আমাদের বহুদিনের ব্যবহৃত জ্ঞান ও বিজ্ঞানের সমন্বয় ঘটাতে আমাদের আরো আগেই সচেতন হওয়া উচিত ছিল। জামদানি, শীতলপাটি, মসলিনের দেশে হাতে বোনা কাপড়ে সামান্য প্রযুক্তির ছোঁয়া দিলে সেটা কীভাবে দেশের অর্থনীতিতে প্রভাব রাখত, তা বলাই বাহুল্য। অথচ ডিজিটালাইজেশনের ভিড়ে এ সম্পদগুলো নিয়ে আবারো নতুন করে ভাবতে হচ্ছে। ফেসবুক আসক্তি থেকে তরুণ সমাজকে রুখতে হলে তাদের সামনে আরো চমকপ্রদ পথ মেলে ধরতে হবে।
কিন্তু অবকাঠামোগত উন্নয়ন (প্রযুক্তির প্রসার, কাঁচামালের ব্যবহার, ফান্ডিং, ডিজিটাল সেবা) বিলম্ব হলে তা সম্ভব হবে কি? স্মার্ট কার্ড, ডিজিটাল পরিচয়পত্র প্রদানে আমরা প্রশংসা নিলেও যেটা মাথায় রাখতে হবে- ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক তথ্যের সুরক্ষা নিশ্চিতকরণ। যে হারে আমরা অটোমেশনের পথে ধাবিত হচ্ছি, তার চেয়ে কয়েকগুণ দ্রুতগতিতে আমাদের কর্মসংস্থান হ্রাস পাচ্ছে, এ ব্যাপারটাও আমাদের ভেবে দেখা এখন সময়ের দাবি।
সর্বোপরি চ্যাটবট, রিকমেন্ডেশন সিস্টেম, অটোমেটেড নোটিফিকেশন, রোবট ও ড্রোন সিস্টেম ইত্যাদির মাধ্যমে দক্ষ মানবসম্পদ মোকাবেলা, নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচনসহ দেশে বিদ্যমান কর্মসংস্থান সমস্যার মোকাবেলায় চতুর্থ শিল্প বিপ্লব যেভাবে সুযোগ করে দেবে, তা লুফে নিতে যা যা দরকার, সকল ব্যবস্থাই আমরা গ্রহণ করতে চাই; তবে সবার আগে যে প্রশ্নটা আসে- তৃতীয় শিল্প বিপ্লবের সকল সুবিধাই যে দেশে এসে পৌঁছায়নি, সেখানে আমরা সত্যিই এ শিল্প বিপ্লবের জন্য প্রস্তুত তো?