ইরান ও আজারবাইজানের মধ্যে মিল আছে বেশ কিছু বিষয়ে। দুটো দেশেই শিয়া মতাদর্শে বিশ্বাসী মানুষেরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। এছাড়া দুটো দেশের মধ্যে ভাষাতাত্ত্বিক ও ইতিহাসগত মিল রয়েছে অনেক দিক থেকে। একসময় আজারবাইজান বলে স্বতন্ত্র কোনো দেশ ছিল না, এটি ছিল আজকের ইরানেরই একটি অংশ। উনিশ শতকে রাশিয়ার সাথে যুদ্ধে পরাজয়ের পর রুশরা আজারবাইজান দখল করে নেয়। আবার সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর ১৯৯১ সালে আজারবাইজান স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। দুটো দেশের জ্বালানি তেলের বড় মজুদ রয়েছে। দুটো দেশের মাঝে এত মিল থাকার পরও ইরান ও আজারবাইজানের কূটনৈতিক সম্পর্ক কখনোই খুব একটা ভালো ছিল না। সাম্প্রতিক বেশ কিছু ঘটনার কারণে দুটো দেশের সম্পর্ক আরও তলানিতে নেমেছে।
এ বছরের জানুয়ারি মাসে একজন বন্দুকধারী তেহরানের আজারবাইজান দূতাবাসে একজন বন্দুকধারী হামলা চালায়৷ এই ঘটনার পর ইরানের নিরাপত্তা বাহিনী সেই বন্দুকধারীকে গ্রেফতার করে এবং জিজ্ঞাসাবাদ চালায়। ইরান দাবি করে, সেই বন্দুকধারী ব্যক্তিগত ক্ষোভ থেকে হামলা চালিয়েছে, তার সাথে রাষ্ট্রীয় কোনো সম্পৃক্ততা নেই৷ ইরানের এই দাবি আজারবাইজানকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি। একজন জ্যেষ্ঠ আজারবাইজানি কূটনীতিক ইরানের দাবিকে ‘উদ্ভট’ হিসেবে অভিহিত করেন। আজারবাইজানের সরকারপন্থী গণমাধ্যম ‘ক্যালিবার’ নাম উল্লেখ করা ব্যতীত কয়েকজন সরকারি কর্মকর্তার উদ্ধৃতি দিয়ে বলে, ইরানের ‘বিশেষ বাহিনী’র পরিকল্পনা অনুসারেই এই হামলা পরিচালনা করা হয়েছে। দূতাবাসে হামলার পরিপ্রেক্ষিতে আজারবাইজান সরকার তেহরানস্থ দূতাবাস বন্ধ করে দেয় এবং সেখানে কর্মরত ব্যক্তি ও তাদের পরিবার দেশে ফিরিয়ে আনে। এছাড়াও ইরান ভ্রমণের ক্ষেত্রে আজারবাইজানের নাগরিকদের সতর্কবার্তা জারি করা হয়। দুটো দেশের সম্পর্ক আরও সংকুচিত হয়ে পড়ে।
ইরানের নাগরিকদের একটি বড় অংশ নৃতাত্ত্বিকভাবে আজারবাইজানি। ধারণা করা হয়, ইরানের মোট সাড়ে আট কোটি নাগরিকের এক-তৃতীয়াংশ নৃতাত্ত্বিকভাবে আজারবাইজানি। ইরান বরাবরই এই নৃতাত্ত্বিকভাবে আজারবাইজানি জনগোষ্ঠীর বিচ্ছিন্নতাকামী মনোভাব নিয়ে শঙ্কিত ছিল। ইরানের নীতিনির্ধারকরা মনে করেন, এই নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর মনোভাব কাজে লাগিয়ে প্রতিবেশী আজারবাইজান তার স্বার্থোদ্ধারে নেমে যেতে পারে। অপরদিকে আজারবাইজান দাবি করে- এই সংখ্যালঘু জনগণের মৌলিক অধিকার হরণ করেছে ইরান। যেমন তারা দাবি করে এই সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর সদস্যরা তাদের মাতৃভাষায় শিক্ষা লাভ করতে পারছে না। এছাড়াও আজারবাইজান মনে করে, ইরান দীর্ঘসময় ধরে দেশটির নাগার্নো-কারবাখ অঞ্চলের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। প্রতিদ্বন্দ্বী আর্মেনিয়ার সাথে ইরানের সুসম্পর্ক কখনোই আজারবাইজানিদের স্বস্তিতে থাকতে দেয়নি৷
২০২০ সালে ইসরায়েল ও তুরস্কের সহায়তায় আর্মেনিয়ার বিরুদ্ধে আজারবাইজান যু্দ্ধে জয়ী হয় এবং ইরানের সীমান্তবর্তী বেশ কিছু জেলা পুনরুদ্ধার করে নিজেদের সীমান্তের সাথে সংযুক্ত করে, যেগুলো তারা গত শতকের নব্বইয়ের দশকে প্রতিদ্বন্দ্বী আর্মেনিয়ার কাছে হারিয়েছিল। আজারবাইজান যে জেলাগুলো দখল করেছে, সেগুলোর ভেতর দিয়ে নির্মিত রাস্তা দিয়ে ইরান ও আর্মেনিয়ার মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চলতো এতদিন ধরে। দখলের পর আজারবাইজান সেই রাস্তায় ইরানি পণ্যবাহী গাড়িগুলোর উপর বিশাল অংকের কর আরোপ করে। এছাড়াও দুজন ইরানি গাড়িচালককে গ্রেফতার করে আজারবাইজানের সীমান্তরক্ষী বাহিনী৷ এর ফলে দু’পক্ষের বাণিজ্য একপ্রকার বন্ধই হয়ে যায়। আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট দুই দেশের বাণিজ্য বন্ধ করার পেছনে কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন যে, ইরান এই পথ ব্যবহার করে নাগার্নো-কারবাখ অঞ্চলের বিচ্ছিন্নতাকামীদের সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন করছে। ইরান তার প্রতিবেশী আজারবাইজানের এই কর্মকাণ্ডে খুবই ক্ষুব্ধ হয়।
আজারবাইজানের সাথে ইরানের শক্ত আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বী ইসরায়েলের সুসম্পর্ক ইরানের মাথাব্যথার আরেকটি কারণ। বর্তমানে আজারবাইজানের সেনাবাহিনীর হাতে যেসব অত্যাধুনিক অস্ত্র রয়েছে, তার বড় অংশের সরবরাহকারী হচ্ছে ইসরায়েল। ইরানের বন্দুকধারী তেহরানস্থ আজারবাইজান দূতাবাসে হামলা চালানোর কয়েক সপ্তাহ আগে আজারবাইজানের পার্লামেন্টে ইসরায়েলের দূতাবাস খোলার প্রস্তাব অনুমোদিত হয়। বিগত অনেক বছর ধরেই আজারবাইজান ইসরায়েলের সাথে কূটনৈতিক ও সামরিক সুসম্পর্ক বজায় রাখলেও ইহুদি রাষ্ট্রটিতে দূতাবাস খোলার পরিকল্পনা করেনি, কারণ এতে ইরানের সাথে সম্পর্কে নেতিবাচক প্রভাব পড়তো। কিন্তু বর্তমানে তারা সেই অবস্থান থেকে সরে এসে আরও বেশি করে ইসরায়েলের দিকে ঝুঁকছে। এর পাশাপাশি বিগত অনেক বছর ধরেই ইরান সন্দেহ করছে যে আজারবাইজানের সীমান্তবর্তী অঞ্চলকে ব্যবহার করে ইসরায়েল ইরানের উপর নজরদারি চালাচ্ছে। সম্প্রতি ইরানের বেশ কিছু সামরিক স্থাপনায় হামলা চালানো হয়েছে। কারা এই হামলায় জড়িত– তা এখনও পরিষ্কার না হলেও এটা অনুমান করা সহজ যে ইসরায়েলই এই হামলা চালিয়েছে।
ইরান অনেকবার দাবি করেছে যে ইরান-আজারবাইজান সীমান্তে আজারবাইজানের ভূমি ব্যবহার করে ইসরায়েল তার প্রতিদ্বন্দ্বী ইরানের উপর কড়া নজরদারি চালাচ্ছে। বলে রাখা ভালো, আজারবাইজানের সীমান্তরক্ষাকারী বাহিনী ইসরায়েলের অত্যাধুনিক বিভিন্ন সরঞ্জাম ও ড্রোনের ক্রেতা। ইরানের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে আজারবাইজান দুই দেশের সীমান্তের পাঁচশো কিলোমিটার দূরে আরেক মিত্র তুরস্কের সাথে সামরিক মহড়ার আয়োজন করে। এর পাল্টা জবাব হিসেবে ইরানও দুই দেশের সীমান্তের কাছাকাছি সামরিক মহড়ার আয়োজন করে। এর পাশাপাশি সীমান্তে আরও বেশি জনবল ও অস্ত্রশস্ত্র মজুদ করে। ফলে দুই দেশের সম্পর্ক আরও বেশি করে তলানিতে নেমে গিয়েছে।
যদি কখনও দুটো দেশের মধ্যে সামরিক সংঘাত শুরু হয়ে যায়, তবে অবধারিতভাবে আজারবাইজানের পক্ষে তুরস্কের আবির্ভাব ঘটবে যুদ্ধক্ষেত্রে। দুটো দেশের মধ্যে ‘মিউচুয়াল মিলিটারি প্যাক্ট’ রয়েছে। অর্থাৎ সংকটকালে দুটো দেশই একে অপরকে সহযোগিতার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। ২০২০ সালে আর্মেনিয়ার বিরুদ্ধে তুরস্ক অস্ত্র এবং সামরিক উপদেষ্টা সরবরাহের মাধ্যমে আজারবাইজানের বিজয়ে অবদান রেখেছে। এছাড়াও যুদ্ধবিরতি পর্যবেক্ষণের জন্য রাশিয়ার পাশাপাশি তুরস্কও নাগার্নো-কারবাখ অঞ্চলে প্রায় ২,০০০ সৈন্য পাঠিয়েছে। তুরস্ক যদি আজারবাইজানের পক্ষে যুদ্ধে জড়িয়ে যায়, ইরানের পক্ষে আর্মেনিয়া এবং রাশিয়ার সমর্থন পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আর্মেনিয়ায় রাশিয়ার একটি সামরিক ঘাঁটি রয়েছে এবং দুই দেশের মধ্যে ‘ডিফেন্স প্যাক্ট’ও রয়েছে। অর্থাৎ যদি সামরিক সংঘাত শুরু হয়েই যায়, তাহলে সেটি মাত্র দুটো দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না, এখানে আরও বেশ কিছু দেশ জড়িয়ে যাবে। স্বাভাবিকভাবে এই ক্ষেত্রে দুটো দেশের মধ্যে সামরিক সংঘাত শুরু হওয়ার সম্ভাবনা অনেক কম।
সম্প্রতি রাশিয়া-ইউক্রেইন যুদ্ধ শুরুর পর পশ্চিমাদের জ্বালানি সংগ্রহের একটি বড় উৎস হচ্ছে আজারবাইজান। রাশিয়ার শূন্যস্থান পূরণে আজারবাইজান এগিয়ে এসেছে। পশ্চিমা জ্বালানি উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলো ১৯৯৪ সালের পর থেকে প্রায় ৭০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে আজারবাইজানে। সুতরাং ইরান ও আজারবাইজানের মধ্যে যদি সামরিক সংঘাত শুরু হয়, তবে এর প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়বে বিশ্ব অর্থনীতিতে। জ্বালানি তেলের দাম যে হু হু করে বাড়বে, তা বলাই বাহুল্য। অর্থাৎ সামরিক সংঘাত এই দুটো দেশ ও তার মিত্রদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও এর পরোক্ষ প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষ। যেমন ইউক্রেন এবং রাশিয়ার মধ্যে যুদ্ধ হলেও জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় পণ্যের দামবৃদ্ধিতে ভুগতে হয়েছে পৃথিবীর সব দেশকেই। সুতরাং দক্ষিণ ককেশাসে কোনো সামরিক সংঘাত কোনোভাবেই কাম্য নয়।