২০১৮ সালে ভারতীয় পুলিশ দাবি করে, তারা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে হত্যা ও সরকার পতনের এক বিস্ময়কর ষড়যন্ত্র উদঘাটন করেছে। কিন্তু তিন বছর বাদে, ক্রমশই তথ্য-প্রমাণের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে, যার ফলে পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে যে সেই কথিত ষড়যন্ত্র ছিল নিছকই কাল্পনিক, এবং সেই কল্পকাহিনী রচনায় মুখ্য ভূমিকা ছিল ইসরায়েলি স্পাইওয়্যার পেগাসাসের। দ্য গার্ডিয়ানে প্রকাশিত, সিদ্ধার্থ দেবের শ্বাসরুদ্ধকর লং-রিডের বাংলা অনুবাদ তুলে ধরা হচ্ছে রোর বাংলার পাঠকদের সামনে। আজ থাকছে তিন পর্বের ধারাবাহিকের শেষ পর্ব।
(দ্বিতীয় পর্বের পর)
১৪.
ভীমা কোরেগাঁওয়ের সেই সহিংসতার পর, বামপন্থী ষড়যন্ত্রের গুজব ডালপালা মেলতে শুরু করে পুলিশের কাছে দায়ের করা একটি অভিযোগের মাধ্যমে, যার নেপথ্যে ভূমিকা ছিল এক স্থানীয় ব্যবসায়ীর। তিনি দাবি করেন যে ওই সহিংসতা শুরু হয়েছিল এলগার পরিষদে মাওবাদীদের বক্তব্য রাখার মাধ্যমে। একই ধরনের অভিযোগ করা হয় ইন্টিগ্রেটেড ন্যাশনাল সিকিউরিটি (আইএনএস) ফোরামের পক্ষ থেকেও। জানিয়ে রাখা প্রয়োজন, এটি হলো এমন একটি থিংকট্যাংক, যেটি গঠিত হয়েছে সাবেক সেনা সদস্যদের নিয়ে, এবং এর নেতৃত্বে রয়েছেন শেষাদ্রি চারি। তিনি একজন আরএসএস কর্মী, পাশাপাশি বিজেপি-র জাতীয় নির্বাহী কমিটিরও সদস্য।
২০১৮ সালের এপ্রিল নাগাদ, পুলিশের তদন্ত পুরোপুরি মনোনিবেশ করে ওই তথাকথিত ষড়যন্ত্রে। তারা পরপর অসংখ্য তল্লাশি চালায় ও অনেককে জিজ্ঞাসাবাদ করে। জুন নাগাদ, রণা উইলসনসহ সক্রিয় কর্মীদের প্রথম দলকে গ্রেপ্তার করা হয়।
২০১৯ সালের নভেম্বরে, বিজেপি মহারাষ্ট্রের রাজ্য নির্বাচনে হেরে যায়। মহারাষ্ট্রের নতুন জোট সরকার যখন জানতে পারে যে বিকে ১৬-এর তদন্তে অনিয়ম ও গোলমাল করা হয়েছে, তখন তারা এই মামলার ব্যাপারে নতুন করে অনুসন্ধানের ঘোষণা দেয়। ঠিক তখনই, কেন্দ্রীয় সরকার দ্রুততম সময়ের মধ্যে মামলাটি এনআইএ-র কাছে স্থানান্তর করে দেয়। এর ফলে নতুন করে অনুসন্ধানের বীজ অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয় যায়।
এনআইএ-র প্রধান হলেন ওয়াইসি মোদি। না, তিনি নরেন্দ্র মোদির আত্মীয় নন। তবে প্রধানমন্ত্রী মোদির সঙ্গে তার পূর্ব ইতিহাস রয়েছে। কেননা তিনিই সেই পুলিশ অফিসার, যার উপর বর্তেছিল রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন গুজরাট দাঙ্গায় নরেন্দ্র মোদির ভূমিকা কী ছিল, সে বিষয়ক তদন্তের দায়ভার। ওয়াইসি মোদির নেতৃত্বাধীন প্যানেলটি তাদের তদন্তে নরেন্দ্র মোদির কোনো দোষ খুঁজে পায়নি।
১৫.
এবার, এনআইএ যখন ভীমা কোরেগাঁও মামলার তদন্ত শুরু করে, তখন আরেক দফা ধরপাকড় শুরু হয়। এবার নতুন করে আটককৃতদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন গৌতম নাভলাখা (৬৮), একজন সাংবাদিক ও নাগরিক অধিকার কর্মী, এবং আনন্দ তেলতুম্বদে।
দিল্লি ইউনিভার্সিটির মুসলিম অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বন্দিদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে কাজ করা হ্যানি বাবুও (৫৫) গ্রেপ্তার হন। মহারাষ্ট্র ভিত্তিক দলিত সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর সদস্য সাগর গোরখে (৩৪), রমেশ গায়চোর (৩৭) এবং জ্যোতি জগতাপ (৩৩)-ও জামিন অযোগ্য গ্রেপ্তারের শিকার হন। তাদের গ্রেপ্তারের ধরন এই মুহূর্তে খুবই চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, বিশেষত চলমান করোনা মহামারির ব্যাপারে মোদি সরকারের খুব একটা হেলদোল না থাকায়। আর যে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট এই মুহূর্তে সবচেয়ে ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, সেটিও তো প্রথম আবিষ্কৃত হয়েছে মহারাষ্ট্রেই।
মহামারির প্রথম ঢেউ যখন তুঙ্গে, ঠিক তখনই, ২০২০ সালের ৮ অক্টোবর, পুলিশ হানা দেয় ভারতের পূর্বাঞ্চলের শহর রাঁচিতে, ৮৩ বছর বয়সী স্ট্যান স্বামীর এক কামরার বাসায়। পারকিনসন’স ডিজিজের কারণে তার অবস্থা এতটাই খারাপ ছিল যে তিনি গ্লাসে পানি ঢেলেও পান করতে পারতেন না। তাই গ্রেপ্তারের পর তাকে আদালতের কাছে আপিল করতে হয় যেন তাকে পানি পানের জন্য স্ট্র ও সিপার কাপ দেয়া হয়। তার এই অনুরোধ অনুমোদন করতে প্রায় দুই মাস সময় লেগে যায়। তবে বিচারক স্বামীর জামিনের আবেদন নাকচ করে দেন। কেননা তার মতে, স্বামীর ‘তথাকথিত অসুস্থতা’-র চেয়েও ‘সম্প্রদায়ের সামষ্টিক কল্যাণ’ নিশ্চিত করা বেশি জরুরি। তাই স্বামীকে বন্দি অবস্থাতেই থাকতে হয়, এবং গত বছরের মে মাসে যখন তার শরীরে কোভিড-১৯ এর বিভিন্ন লক্ষণ ধরা পড়ে, তখন তাকে নিয়ে যাওয়া হয় একটি চার্চ-পরিচালিত হাসপাতালে। তিনি সেখানেই কাস্টোডিতে থাকেন, জুলাই মাসে মৃত্যুর আগপর্যন্ত।
স্বামীর এমন প্রয়াণ ছিল একটি খুবই বড় ধাক্কা। ফাদার জোসেপ জেভিয়ার নামের একজন জেসুইট যাজক আমাকে বলেন,
“আমি তাকে বিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে চিনতাম। এবং একদম অন্তিম লগ্ন অবধি, তার মনে স্বাধীনতার ধারণা কেবল আদালত থেকে জামিন লাভেই সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং তিনি চাইতেন সেসব আদিবাসীদের স্বাধীনতা, যাদের তিনি ভালোবাসতেন, যাদের জন্য তিনি লড়াই করেছেন, এবং যাদের সঙ্গে তিনি কাজ করে গেছেন সারাজীবন।”
১৬.
জেলে বন্দি অবস্থায় বিকে ১৬-এর আরো ছয়জনের করোনা পজিটিভ এসেছে। হ্যানি বাবুর পার্টনার, জেনি রোয়েনা আমাকে বলেন,
“তাজোলায় তিন হাজারের মতো কয়েদি রয়েছে, কিন্তু নেই একজনও ডাক্তার। সেখানে রয়েছেন কেবলই তিনজন আয়ুর্বেদিক বিশেষজ্ঞ, যারা পশ্চিমা চিকিৎসা ব্যবস্থা সম্পর্কে অবগত নন। অথচ তাদের প্রেসক্রাইব করা ওষুধই সেবন করতে হচ্ছে সবাইকে।”
অবস্থা ঠিক একই রকম শোচনীয় বাইকুলা নারী জেলে অবস্থানরত তিন বন্দির – সুধা ভরদ্বাজ, যার জন্ম যুক্তরাষ্ট্রে কিন্তু যিনি আমেরিকান নাগরিকত্ব ছেড়ে এসেছেন যেন ভারতে একজন শ্রমিক অধিকার কর্মী ও মানবাধিকার আইনজীবী হিসেবে কাজ করতে পারেন; সোমা সেন, সাহিত্য অধ্যাপক, যিনি একজন দলিত ও নারী অধিকার কর্মী; এবং জ্যোতি জগতাপ, দলিত সঙ্গিতশিল্পী ও সক্রিয় কর্মী, যিনি মোটরসাইকেলে চেপে কাজে যাওয়ার সময় ট্রাফিক লাইটে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন।
উল্লিখিত উভয় গোষ্ঠীই জেল ব্যবস্থার নির্মমতা-নিষ্ঠুরতার শিকার। প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সেবা, যথাযথ খাবার, স্বাস্থ্যকর স্যানিটারি প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ মানবাধিকার থেকে তারা বঞ্চিত। এছাড়াও না আছে তাদের পড়ার মতো বইপত্র, কিংবা পরিবারের সদস্য ও আইনজীবীদের সঙ্গে যোগাযোগের সুযোগ।
১৭.
শালিনি গেরা, ভরদ্বাজের সহকর্মী ও তার আইনজীবী দলের একজন, আমাকে জানান যে রাজনৈতিক বন্দি হিসেবে ভরদ্বাজ ও সেনকে পুনেতে মৃত্যুদণ্ডাদেশ প্রাপ্ত আসামীদের মতো সলিটারি সেলে রাখা হয়েছে। তাদেরকে খুবই সামান্য একটু জায়গা দেয়া হয়েছে শরীরচর্চার জন্য। কিন্তু কখনোই একত্রে তা করতে দেয়া হয় না তাদের। ভরদ্বাজ ও সেন উভয়েই ইতোমধ্যে শিকার হয়েছেন মৃত্যুদণ্ডাদেশ প্রাপ্ত, মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন কয়েদিদের আক্রমণের। ভরদ্বাজ যখন আদালতের কাছে আপিল করেন যেন তাকে এক মাসে দুটির বেশি বই রাখার অনুমতি দেয়া হয়, তখন কিছুদিনের জন্য কয়েদিদের বই সরবরাহই বন্ধ করে দেয়া হয়।
এই মামলার সঙ্গে জড়িতদের যে শুধু জেলের ভেতরেই ভয়ভীতি প্রদর্শন চলছে, তা মোটেই নয়। গেরা আমাকে জানান, তিনি ২০১৯ সালের অক্টোবরে ভরদ্বাজের মামলায় কাজ করতে গিয়ে সিটিজেন ল্যাব কানাডা মারফর জানতে পারেন যে তার নিজের হোয়াটঅ্যাপ অ্যাকাউন্টও নাকি পেগাসাসের মাধ্যমে টার্গেট করা হয়েছে।
“ভারতের অধিকাংশ সক্রিয় কর্মীর মতোই, আমিও সবসময়ই ভেবে এসেছি যে আমার ইমেইল, টেক্সট, ফোন কলও অনিরাপদ। কিন্তু তবুও আমার এ ব্যাপারটি হজম করতে কিছুটা সময় লেগেছে যে এই ধরনের উচ্চমানের, অত্যন্ত দামি সফটওয়্যারের নজরদারির ভেতরও আমাকে রাখা হয়েছে!”
১৮.
পেগাসাস বিষয়ক তথ্য ফাঁস কিংবা স্বামীর মৃত্যুর পর ওঠা শোরগোলের ফলেও বিকে ১৬ কিংবা তাদের সমর্থক, সাহায্যকারীদের প্রতি এ ধরনের ভয়ভীতি, নজরদারি কিংবা ফাঁদে ফেলার হুমকি বিন্দুমাত্র কমেনি। একজন বিচারক যখন স্বামীর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেন, তখন এনআইএ-র পক্ষ থেকে তাকে তিরস্কার জানানো হয়; বলা হয় তিনি নাকি এনআইএ-র কর্মকর্তাদের আত্মবিশ্বাসে আঘাত হেনেছেন। শেষমেশ ওই বিচারক বাধ্য হন ক্ষমা চাইতে এবং তার মন্তব্য ফিরিয়ে নিতে।
নিউ ইয়র্কভিত্তিক লেখক ও ব্যারিস্টার সুচিত্রা বিজয়ন, যিনি ভারত সফরকালে বিক্ষোভ কর্মসূচিগুলো অনুসরণ করছিলেন, এভাবে নিজের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন :
“প্রতিটি প্রতিষ্ঠানই তাদের গ্রহণযোগ্যতা হারিয়ে ফেলেছে। একটি স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থার মূল বৈশিষ্ট্য হলো সমালোচকদের কণ্ঠস্বরকে থামিয়ে দেয়া, এবং এখানে আমরা ঠিক সেটিই হতে দেখছি। তার পাশাপাশি আবার রয়েছে প্রাতিষ্ঠানিক অবক্ষয়ও। আগে তারা কখনোই আইনজীবীদের পেছনে লাগত না, কিন্তু এখন সেটি করতেও বাদ রাখছে না। ভারতীয় পুলিশের তো তথ্য-প্রমাণ লুকিয়ে রেখে কাউকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে দেয়ার ইতিহাস অনেক পুরনো। তবে এখন তারা সেটি করছে আরো বিশ্বাসযোগ্যভাবে, উন্নত প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে। বোঝাই যাচ্ছে তাদের পেছনে কত বড় বড় শক্তির হাত রয়েছে। বিচার বিভাগও এসব অন্যায় কাজে ইন্ধন দিচ্ছে।”
১৯.
গোটা ভারতজুড়ে, গণতন্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ প্রথাগুলোকে ক্রমশ নিশ্চিহ্ন করে ফেলা হচ্ছে।
নাগরিক অধিকার প্রচারক নাদিম খান আমাকে বলেন,
“আপনার উচিত উত্তর প্রদেশে এসে দেখা কী পরিমাণ মানুষকে জেলে আটকে রাখা হয়েছে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলায়।”
এভাবে রাষ্ট্রদ্রোহী হিসেবে বিরোধী মতাদর্শীদের জেলে পুরে রাখার জন্য সহায়ক বেশ কিছু আইন রয়েছে। তাদের মধ্যে কয়েকটি আবার সেই ঔপনিবেশিক যুগের। ফলে জনগণকে অবদমনের জন্য সরকারের হাতিয়ারের অভাব হচ্ছে না। ২০১৯ সালের আগস্টে যখন স্বায়ত্তশাসনের বিশেষ মর্যাদা দেয়ার আইনটি বাতিল করা হয়, তখন বিক্ষোভে ফেটে পড়ে কাশ্মীর। সেই বিক্ষোভ দমনের জন্য পাঁচ সহস্রাধিক মানুষকে আটক করে পুলিশ। তাদের অনেককেই দেয়া হয়েছে এমন এক জননিরাপত্তা আইনের মামলা, যা নির্দিষ্টভাবে কেবল কাশ্মীরের জন্যই প্রযোজ্য।
তবে, ইউএপিএ-ই হয়ে উঠেছে সরকারের সবচেয়ে মূল্যবান অস্ত্র। এই আইনকে পুঁজি করেই সরকার কেড়ে নিতে পারছে যেকোনো নাগরিকের মৌলিক অধিকার, এবং সেটি বিদ্যমান আইনানুগ ব্যবস্থাকে সুরক্ষিত রেখেই। ফলে যেখানেই মোদির বিরোধিতা করা হচ্ছে, সেখানেই কঠোরভাবে প্রয়োগ করা হচ্ছে এই আইনটি।
২০১৯ সালের শেষ পর্যন্ত কাশ্মীরে ২৫৫টি মামলা করা হয়েছে জঙ্গীবাদ-বিরোধী আইনে, যা ভারতের রাজ্যগুলোর মধ্যে তৃতীয় সর্বোচ্চ। এদিকে ভারতের উত্তর-পূর্ব রাজ্য আসামের ডানপন্থী হিন্দু বিরোধী কৃষকনেতা অখিল গগৈকে জঙ্গীবাদের অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয় ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে। (গগৈ জেলে বসেই রাজ্য নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন এ বছরের মে মাসে, এবং জয়লাভও করেন; তাকে জুলাই মাসে মুক্তি দেয়া হয় এবং তার বিরুদ্ধের অভিযোগগুলো থেকে রেহাই দেয়া হয় তাকে)। ২০২০ সালের আগস্টে উত্তর প্রদেশে ইউএপিএ আইনের অধীনে গ্রেপ্তার করা হয় কেরালার মুসলিম সাংবাদিক সিদ্দিক কাপ্পানকে; তার অপরাধ: তিনি ১৯ বছর বয়সী এক দলিত নারীর ধর্ষণ ও হত্যার প্রতিবেদন করার চেষ্টা করেছিলেন। কেন্দ্রীয় ভারতীয় রাজ্য ছত্তিশগড়ের আদিবাসী সক্রিয় কর্মী হিডমে মারকামকে মার্চ মাসে গ্রেপ্তার করা হয় জঙ্গীবাদ-বিরোধী আইনে, যখন তিনি অংশ নিচ্ছিলেন আন্তর্জাতিক নারী দিবসের একটি আয়োজনে।
২০.
দেশাই কয়েকটি কথা বলেন আমাকে।
“এনআইএ ও পুলিশ আসলে প্রমাণ নিয়ে খুব একটা ভাবে না, যখন মামলা হয় ইউএপিএ-র অধীনে। তাদের চিন্তা থাকে একটিই, তা হলো গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিকে যত বেশিদিন সম্ভব জেলে বন্দি করে রাখা। একটি খুবই পরিচিত দৃশ্য হলো পুলিশ কর্তৃক বিকৃত বা পুনর্নির্মিত সাক্ষ্য-বিবৃতি উপস্থাপন করা, যেখানে সাক্ষীদের বিস্তারিত পরিচয় গোপন রাখা হয়। ইউএপিএ-র অধীনে, জামিন আবেদনের ক্ষেত্রে সাক্ষ্য-প্রমাণের ব্যাপারে আলোচনার কোনো পথই খোলা নেই। কেবল শুনানির সময়ই সেটি সম্ভব হতে পারে, এবং যেমনটি সকলেই দেখতে পাচ্ছে, শুনানির তারিখ আসতে কয়েক বছর লেগে যায়।”
ইউএপিএ আইন আসারও অনেক আগে থেকেই বিভিন্ন জঙ্গীবাদ-বিরোধী আইন ছিল বটে, কিন্তু সেগুলোতে ভুল করে কাউকে গ্রেপ্তারের ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণের ব্যাপার ছিল। ইউএপিএ আইনের অধীনে সেসব কিছু নেই। মিথ্যা কারণে বা ভুল করে কাউকে আটকের কারণে ক্ষতিপূরণের মামলা হয়তো করা যায়, কিন্তু সেগুলোর শুনানির ক্ষেত্রেও ভারতের প্রেক্ষাপটে কয়েক দশক সময় লেগে যেতে পারে। এই বছরের জুনে দুজন মুসলিম ব্যক্তিকে মুক্তি দেয়া হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে পর্যাপ্ত প্রমাণের অভাবে। কিন্তু এভাবে দীর্ঘদিন পর যারা মুক্তি পায়, তারা খুব কম ক্ষেত্রেই ক্ষতিপূরণের মামলা করে, কেননা তারা ভয় পায় যে এ কাজ করলে হয়তো আবারো কোনো মিথ্যা মামলায় তাদেরকে ফাঁসিয়ে দেয়া হবে।
যদি বিকে ১৬ এর মামলাটি ভারতের অসংখ্য রাজনৈতিক বন্দিদের মামলার থেকে আলাদা হিসেবে গণ্য হয়, তার প্রধান কারণ এই যে, এই মামলা আমাদেরকে জানান দেয় ভারত কোন পথে হাঁটছে। এই মামলাটি কেবলই ভীমা কোরেগাঁওয়ে সেই স্মরণ উৎসবকে কেন্দ্র করে দলিত অধিকারের প্রশ্নে ডানপন্থী হিন্দুদের প্রতিক্রিয়া নয়। বরং এটি হলো এমন একটি নিদর্শন, যেখানে মোদি সরকার সুযোগ পেয়ে সেরকম কিছু মানুষকে জেলে পুরে দিয়েছে, যাদেরকে তারা অনেক আগে থেকেই হুমকি হিসেবে চিহ্নিত করেছিল, কেননা এই মানুষগুলো নাগরিক অধিকার ও সমতা প্রতিষ্ঠার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিল।
এই গ্রেপ্তারগুলো পরিপল্পিত, এবং নজরদারি, ফাঁদ ও কারাদণ্ডের সুদূরপ্রসারী প্রকল্প দিয়ে সুসজ্জিত। সেই প্রকল্পটি এখনও জীবিত, এবং এখনও সেই প্রকল্পের অধীনে সেসব মানুষের ডিভাইসে ঢুঁ মারা হচ্ছে, যারা চুপ করে বসে নেই, বরং সিদ্ধান্ত নিয়েছে শিরদাঁড়া উঁচু করে দাঁড়ানোর।