দ্য গ্রেটেস্ট শো অন আর্থখ্যাত ফিফা (FIFA) বিশ্বকাপ ২০২২ আয়োজনের জন্য কাতার মনোনীত হয় ২ ডিসেম্বর ২০১০ সালে। এ পর্যন্ত কাতারই প্রথম কোনো আরব ও মেনাভুক্ত (MENA) রাষ্ট্র যে বিশ্বকাপ আয়োজন করেছে।
বিশ্বকাপ আয়োজনের দায়িত্বপ্রাপ্তির পরই কাতার শুরু করে কর্মযজ্ঞ। শুরু হয় স্টেডিয়াম নির্মাণ, হোটেল, যাতায়াতব্যবস্থা নিশ্চিতকরণ। বিবিসির তথ্যমতে, কাতার বিশ্বকাপের জন্য সাতটি স্টেডিয়াম তৈরি করেছে। সেই সাথে একটি নতুন বিমানবন্দর, মেট্রো সিস্টেম, অনেকগুলো রাস্তা এবং প্রায় ১০০টি নতুন হোটেলও তৈরি করেছে। সর্বোপরি, একটি নতুন শহর নির্মাণ করেছে লুসাই স্টেডিয়াম ঘিরে, যেখানে অনুষ্ঠিত হয় ফাইনাল ম্যাচ। কাতার সরকারের তথ্যমতে, শুধু এসব স্টেডিয়াম তৈরি করতেই ৩০ হাজার শ্রমিক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। দ্য গার্ডিয়ানের মতে, ২০১০ সালের পর থেকে কাতারে ৬,৫০০ শ্রমিক মৃত্যুবরণ করে। তাছাড়া, কাতারের উপর আসে শ্রমিক নির্যাতন, শ্রমে বাধ্য করার অভিযোগ। অভিযোগ আছে দুর্নীতি করে বিশ্বকাপ আয়োজক হওয়ার, নারী ও LGBTQ ইস্যু নিয়ে হতে হয়েছে প্রশ্নবিদ্ধ।
কাতার স্টেডিয়াম (৬.৫ বিলিয়ন), অবকাঠামো (২০০ বিলিয়ন) সহ সব মিলিয়ে ২২০ বিলিয়ন ডলার ( বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের মতে ৩০০ বিলিয়ন) খরচ করে। প্রাথমিকভাবে কাতার বিশ্বকাপ থেকে আয় করবে ১৭ বিলিয়ন ডলার (আরব নিউজ), কিন্তু এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়বে কাতারের অর্থনীতিতে।
১৯৭১ সালে ব্রিটিশদের হাত থেকে স্বাধীনতা লাভের পর পেট্রোলিয়াম এবং প্রাকৃতিক গ্যাসসমৃদ্ধ দেশ কাতার দ্রুত উন্নয়ন ঘটায় তার অর্থনীতির, পৌঁছায় সর্বোচ্চ মাথাপিছু আয়ের দেশে। কিন্তু রাজনৈতিকভাবে কাতার বিশ্বে ততটা প্রভাবক ছিল না। আরব ও GCC-ভুক্ত দেশগুলোর সাথে কাতারের সম্পর্কের টানাপোড়েন শুরু আরব বসন্তের পর। আরব বসন্তের সময় কাতার ইসলামপন্থী দলগুলোর সাথে যুক্ত হয়, যেগুলো সৌদি, মিশরীয় এবং আমিরাতীদের কাছে হুমকি হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল।
সমস্যা আরও বৃদ্ধি পায় ২৪ মে ২০১৭ সালে, যখন কাতার তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমালোচনা করে ও ইরানের প্রশংসা করে। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সৌদি আরব সফরের পরই ৫ জুন ২০১৭ সালে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন এবং মিশর কাতারের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে, এবং কাতার-নিবন্ধিত বিমান ও জাহাজকে তাদের আকাশসীমা ও সমুদ্রপথ ব্যবহার নিষিদ্ধ করে। কাতারের একমাত্র স্থলসংযোগ সৌদি আরবের সাথে, যা সৌদি আরব বন্ধ করে দেয়। পরে ২০২১ সালে এর মীমাংসা হয়। সব মিলিয়ে ফিফা বিশ্বকাপ কাতারের জন্য বিভিন্নভাবে সংকট কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করবে। এই বিশ্বকাপ কাতারের জন্য যেসকল সুফল বয়ে আনতে পারে, চলুন সেসব সম্পর্কেই এবার আলোচনা করা যাক।
অর্থনীতির বৈচিত্র্যকরণ
মধ্যপ্রাচ্যের জিসিসিভুক্ত দেশ কাতার আরবের পূর্বে অবস্থিত একটি উপদ্বীপ, যা পারস্য উপসাগর ও সৌদি আরবের সীমান্তবর্তী। কাতার ভৌগলিকভাবে এমন একটি কৌশলগত স্থানে রয়েছে যেখানে আছে বিশাল পরিমাণে পেট্রোলিয়াম এবং প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুদ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পূর্ব কাতার ছিল একটি দরিদ্র দেশ, যার জনসংখ্যার বেশিরভাগ মুক্তা কাটা, মাছ ধরা ও ব্যবসায় নিয়োজিত ছিল।
কাতারে প্রথম পেট্রোলিয়াম আবিষ্কৃত হয় ১৯৩৯ সালে। দেশটির মোট রাজস্বের বেশিরভাগই আসে এলএনজি, অপরিশোধিত তেল এবং পেট্রোলিয়াম পণ্যের রপ্তানি থেকে (জিডিপির প্রায় ৪০%)। অর্থাৎ কাতার মোটাদাগে পেট্রোলিয়াম এবং প্রাকৃতিক গ্যাসের উপর নির্ভরশীল। ট্যুরিজম খ্যাত থেকে আসে জিডিপির ১০.৩ % যা অন্য আরব রাষ্ট্র থেকে তুলনামূলক কম। ফিফা বিশ্বকাপ কাতারের ট্যুরিজম খাতে দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব রাখবে। সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে বার্ষিক ৬ মিলিয়ন পর্যটক প্রত্যাশা করছে, যা কাতারের ট্যুরিজম খাতকে করবে আরও শক্তিশালী। তাছাড়া, অবকাঠামোগতও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের দ্বারা ফিফা বিশ্বকাপ এনে দেবে প্রচুর বৈদেশিক বিনিয়োগ, যা কাতারের শিল্প ও বিনিয়োগ খাতকে করবে আরও শক্তিশালী। সর্বোপরি, ফুটবল বিশ্বকাপ দেশটির অর্থনীতির বৈচিত্র্যকরণ করবে।
আরব ও জিসিসি-ভুক্ত দেশের সাথে সম্পর্কোন্নয়ন
আরব বসন্তের সময় কাতার ইসলামপন্থী যারা অন্য জিসিসি-ভুক্ত দেশের জন্য হুমকি ছিল, তাদের সমর্থন দেয়। সৌদি আরব, মিশর এবং আমিরাত জানিয়েছে, কাতার মৌলবাদ এবং চরমপন্থীদের ইন্ধন দিয়ে আসছে। দীর্ঘদিন ধরে রক্ষণশীল, চরমপন্থী বা এমনকি সন্ত্রাসী হিসেবে বিবেচিত গোষ্ঠীগুলোকে আর্থিক ও নৈতিক সমর্থন প্রদান করছে।
তারা মনে করত, কাতার অন্যদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের মাধ্যমে এই অঞ্চলে অস্থিতিশীলতা তৈরি করতে চায়। তখন থেকেই কাতারের সাথে অন্য আরব দেশের সম্পর্কের অবনতি ঘটতে থাকে। এর একপর্যায়ে কাতারকে একযোগে অবরোধ করে আরবের কয়েকটি দেশ। এই বিদ্বেষে আরেক মাত্রা যোগ করে হোয়াইট হাউজের অনুমোদন। ২০১৭ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে প্রতিবেশি দেশগুলো কাতারের উপর অবরোধ আরোপ করে, যা ব্যাপক ভূ-রাজনৈতিক অশান্তি তৈরি করে। কাতারের এখন অন্যতম কাজ আরব দেশগুলোর সাথে সম্পর্কোন্নয়ন। কাতারে অনুষ্ঠিত ফিফা বিশ্বকাপ এনে দিয়েছে সেরকম এক সুযোগ।
কাতার বিশ্বকাপ ইতোমধ্যেই বিমান চলাচল এবং পর্যটন পরিষেবা ইত্যাদি খাতে তার প্রতিবেশীদের অর্থনীতিকে উপকৃত করছে, যার দরুন আরব দেশগুলোর রাজস্ব বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
গত এক দশক ধরে মধ্যপ্রাচ্য বলতে যে তীব্র শত্রুতা, প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং প্রক্সি যুদ্ধের ক্ষেত্র হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে, ফিফা বিশ্বকাপের মাধ্যমে সেটা পরিবর্তনের সুযোগ কাজে লাগাবে কাতার। তাছাড়া, আরব বিশ্বের গতানুগতিক ইমেজ পরিবর্তন করবে কাতার, বিশ্ববাসীকে পরিচিত করাবে আরব সংস্কৃতির সাথে। এর দ্বারা প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্কোন্নয়ন ঘটাবে কাতার। ২০০২ সালের ফিফা বিশ্বকাপ আয়োজনের মধ্য দিয়ে জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া আঞ্চলিক শক্তি চীনের সাথে ব্যাপক সম্পর্কোন্নয়ন ঘটিয়েছিল।
গ্লোবাল ইমেজ
কাতার ফিফা বিশ্বকাপ আয়োজনের মাধ্যমে নিজেদের বিশ্বব্যাপী ইতিবাচক ইমেজ তৈরি করবে। কাতার বলতে যে মরুভূমির উষ্ণ, সাগরবেষ্ঠিত কোনো দেশ- এমন গতানুগতিক ইমেজ দূর করতে ফিফা বিশ্বকাপ যুগান্তকারী ভূমিকা রাখবে। দেশটি বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ করে দেখিয়েছে- মরুভূমির গরম কোনো বাধা না। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম বলছে- নিজেদের প্রদর্শন করতে যেসকল প্রকল্প ১০ বছর পর শুরু করার কথা, কাতার বিভিন্ন উপায়ে তা ১০ বছর আগে অর্থাৎ বিশ্বকাপের আগে শেষ করিয়েছে। সুদর্শন অবকাঠামো, সহজ যাতায়াতব্যবস্থা, থাকার জন্য নান্দনিক হোটেল, সর্বোপরি একটি শহর নির্মাণ করে কাতার নিজের ইমেজ তৈরি করতে যাচ্ছে।
সংস্কৃতি প্রচার ও ইসলামোফোবিয়া রোধ
একটি দেশ যেমন অন্য দেশের অভ্যন্তরে সম্পত্তি কিনে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে লাভবান হয়, তেমনি নিজ সংস্কৃতি প্রচার ব্যতীত কোনো দেশ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রভাবশালী হতে পারে না। এজন্য একবিংশ শতাব্দীতে অন্যতম আলোচিত শব্দ হচ্ছে সাংস্কৃতিক যুদ্ধ ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসন। কাতার মধ্যপ্রাচ্য তথা বিশ্বের অন্যতম প্রভাবক রাষ্ট্র হতে নিজ সংস্কৃতি প্রচারে ফিফা বিশ্বকাপকে কাজে লাগাবে। ২০০২ সালে দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপান ফিফা বিশ্বকাপ আয়োজনের মাধ্যমে নিজেদের সংস্কৃতির প্রচার করেছিল, যা বিশ্বব্যাপী তাদের সুনাম আরও বাড়িয়ে তুলেছিল।
কাতারে ফিফা বিশ্বকাপের আরেকটি আলোচিত দিক হচ্ছে ইসলামোফোবিয়া দূরীকরণ। অনেক নারী দর্শককে বলতে শোনা যায়- তারা আগে ইসলামি দেশ হিসেবে কাতারকে যা ভাবতো, বাস্তবে কাতার নারীদের জন্য নিরাপদ রাষ্ট্র। সর্বোপরি, কাতার বিশ্বকাপ ইসলামোফোবিয়া দূরীকরণে ব্যাপক প্রভাব রাখবে।
ভূ-রাজনৈতিক সুবিধা ও নিরাপত্তা
ফুটবল বিশ্বকাপের আয়োজক হয়ে কাতার ভূ-রাজনীতিতে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়ে পরিণত হবে। এ বিশ্বকাপের মাধ্যমে কাতার নিজেদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতা দেখাবে, যার বিনিময়ে পাবে প্রচুর বৈদেশিক বিনিয়োগ ও সুনাম। ১৯৩৬ সালের অলিম্পিক আয়োজনের মধ্য দিয়ে হিটলার যেমন নিজের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা বিশ্ববাসীকে দেখিয়েছিলেন, কাতার তেমনই নিজেদের প্রদর্শন করে রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রভাবশালী হয়ে উঠবে।
প্রতিবেশী আরব দেশসমূহের সাথেও সম্পর্কোন্নয়নে আরও শক্তিশালী হবে কাতার। বিশ্বকাপ ফুটবলের দর্শক হয়ে এসে বিশ্বের বড় বড় নেতাদের আগমন তৈরি করে দেবে দ্বিপাক্ষিক সুবিধা নিয়ে আলোচনার পথ, যা কাতারকে শুধু অর্থনৈতিক দিক থেকেই লাভবান করবে না, বরং পারস্পরিক সহযোগিতা, নিরাপত্তা প্রভৃতি ক্ষেত্রেও উন্নয়ন ঘটাবে।
বিশ্বকাপের মাধ্যমে কাতার অর্থনীতিতে প্রাকৃতিক গ্যাস ও পেট্রোলিয়ামের নির্ভরতা কমিয়ে নিরাপত্তাকে করবে আরও জোরদার। নিজেদের প্রচার করে বিশ্বে দেশটি স্বীয় ভূরাজনৈতিক অবস্থান করবে আরও শক্ত। তারা ইতোমধ্যে যুক্তরাজ্যের অনেক সম্পত্তি ক্রয় করেছে যার পরিমাণ রাজা তৃতীয় চার্লসের সম্পত্তির থেকেও বেশি। ফ্রান্সের অস্ত্রের ৩০ শতাংশ ক্রয় করে কাতার, যা কাতারকে রাজনৈতিক দিক থেকে সুবিধা দিয়ে থাকে। কাতারকে নিয়ে শ্রমিক মৃত্যুর জন্য মানবাধিকার প্রশ্নে ফ্রান্স জানিয়েছে, “এটি কাতারের অভ্যন্তরীণ বিষয়”, যা দেশটির রাজনৈতিক সুবিধাপ্রাপ্তি নিশ্চিত করছে।
সর্বোপরি, ফুটবল বিশ্বকাপের এই আয়োজনের মাধ্যমে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক, সাংস্কৃতিক ইত্যাদি নানা সুবিধা কাতারকে মধ্যপ্রাচ্য তথা বিশ্বের অন্যতম প্রভাবক হিসেবে আবির্ভূত করাতে পারে।