ইউক্রেনের ন্যাটোতে যোগদানের ইচ্ছা, ও তার রুশ প্রতিক্রিয়ার অংশ হিসেবে ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি দুই দেশের মধ্যে ভয়াবহ লড়াই শুরু হয়। সামরিক শক্তির বিরাট পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও পশ্চিমা মিত্রদের বিপুল সামরিক সাহায্য পেয়ে যুদ্ধে এখনও টিকে আছে ইউক্রেন। অন্যদিকে, ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হলেও একটু একটু করে নিজেদের দখলকৃত ভূমির পরিমাণ বাড়াচ্ছে রাশিয়া। যুদ্ধের ফলাফল শেষ পর্যন্ত কী হবে তা সময়েই বলে দেবে। অবধারিতভাবেই চলমান যুদ্ধে বেশ কিছু কৌশলগত ভারী অস্ত্র ব্যবহার হচ্ছে। চলুন জেনে নেয়া যাক এর উল্লেখযোগ্য কয়েকটি সম্পর্কে। প্রসঙ্গত বলতে হচ্ছে যে- ইউক্রেন ও রাশিয়া সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ ছিল। ফলে অনেক ক্ষেত্রে দুটি দেশ একই মডেলের ভারী অস্ত্র ব্যবহার করে। এছাড়া এই লেখায় অবধারিতভাবেই বিভিন্ন মিসাইল নিয়ে আলোচনা হবে। তাই শুরুতেই সব ধরনের মিসাইল ও তাদের কার্যপদ্ধতি নিয়ে জানতে এই লেখাটি পড়ে নিন,
মিসাইল নিয়ে যত কথা
ট্যাংকবিধ্বংসী রকেট ও মিসাইল
চলমান যুদ্ধে ইউক্রেন তার পশ্চিমা মিত্রদের কাছ থেকে বিভিন্ন মডেলের বিপুল সংখ্যক অ্যান্টি ট্যাংক রকেট/মিসাইল পেয়েছে। মূলত এগুলোর কারণেই রাশিয়ার ট্যাংকসহ অন্যান্য আর্মাড ভেহিকেলগুলো এত বেশি সংখ্যক ধ্বংস হচ্ছে। ইউক্রেনের দাবি অনুযায়ী- তারা ১,২০০+ রুশ ট্যাংক ধ্বংস করেছে। এসব ট্যাংকবিধ্বংসী অস্ত্রের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো যুক্তরাষ্ট্রের FGM-148 Javelin। এটি বর্তমান যুগের সেরা অ্যান্টি ট্যাংক গাইডেড মিসাইল (ATGM)। টপ অ্যাটাক মুডে এটি ফায়ারের পর সোজা আকাশে উঠে যায়। তারপর ট্যাংকের ঠিক মাথার উপরে গিয়ে আছড়ে পড়ে।
ট্যাংকের চারপাশের তুলনায় উপরের দিকে আর্মারের পরিমাণ কম। এজন্য জ্যাভলিনের সাফল্যের হার অন্যান্য এটিজিএম-এর চেয়ে বেশি। মিসাইলটি ইউক্রেনকে এতটাই সুবিধা দিচ্ছে যে তারা একে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার সাথে খ্রিষ্টধর্মের সাধুপুরুষদের ন্যায় ‘সেইন্ট জ্যাভলিন’ নামে ডাকছে।
এছাড়া ব্রিটিশ NLAW-এর নাম আপনারা সংবাদ মাধ্যমে শুনে থাকবেন। এর পূর্ণরূপ হচ্ছে Next generation Light Anti-tank Weapon, যা জ্যাভলিনের মতোই হামলা করে। ইউক্রেন এই পর্যন্ত সাত হাজার জ্যাভলিন, সাড়ে চার হাজার NLAW মিসাইল পেয়েছে। এছাড়া সুইডেনের Carl Gustaf M2, AT4, জার্মানির Panzerfaust 3, ইসরাইলের Spike, সিঙ্গাপুরের MATADOR, স্পেনের Alcotán-100, যুক্তরাষ্ট্রের M141 BDM, M72 LAW রকেট ও বিভিন্ন মডেলের সোভিয়েত/রাশিয়ান রকেট প্রপেল্ড গ্রেনেড (RPG) মিলিয়ে প্রায় ২৫ হাজারের মতো অ্যান্টি ট্যাংক রকেট ও মিসাইল পেয়েছে ইউক্রেন! এসব অস্ত্র ট্যাংক ও অন্যান্য সাঁজোয়া যান ছাড়াও মেশিনগান বাংকার বা এ ধরনের দুর্ভেদ্য শত্রু প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গুঁড়িয়ে দিতে কাজে লাগে। এগুলোর ব্যাপক ব্যবহারের কারণে রাশিয়ার ট্যাংক ও অন্যান্য সাঁজোয়া যানের ক্ষয়ক্ষতি বেশি হচ্ছে। জ্যাভলিন ফায়ারের কমব্যাট ফুটেজ দেখুন এখানে।
তবে রাশিয়ার হাতেও একই ধরনের অস্ত্র রয়েছে। উপরে বর্ণিত ইউক্রেনের অস্ত্রের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ হস্তগত করা ছাড়াও তাদের 9K111 Fagot, 9M133 Kornet, 9K115-2 Metis-M অ্যান্টি ট্যাংক মিসাইলসহ এগারো ধরনের আরপিজি রয়েছে।
মেইন ব্যাটল ট্যাংক (MBT)
ট্যাংক ছাড়া আধুনিক যুগের যুদ্ধ যেন কল্পনাও করা যায় না। চলমান রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধে দুই পক্ষই প্রচুর ট্যাংক ও অন্যান্য সাঁজোয়া যান ব্যবহার করছে। ইউরোপের সবচেয়ে বেশি সংখ্যক ট্যাংকের মালিক হচ্ছে যথাক্রমে রাশিয়া ও ইউক্রেন। এসব ট্যাংকের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো T-72 ট্যাংক। এটি রাশিয়া-ইউক্রেন উভয়েই ব্যবহার করে।
সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রায় ২৫ হাজার টি-৭২ ট্যাংক বানিয়েছিল, যা ৪০টির বেশি দেশের কাছে বিক্রি করা হয়। যুদ্ধের আগে রাশিয়ার হাতে এ ধরনের ট্যাংক দুই হাজারের বেশি অ্যাক্টিভ ও আনুমানিক সাত হাজার রিজার্ভে ছিল। অন্যদিকে, ইউক্রেন সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের সময় প্রায় ১৩০০+ টি-৭২ ট্যাংক ভাগে পেয়েছিল, যার বেশিরভাগই পরে বিক্রি করে দিয়েছিল। ২০১৪ সালে রুশপন্থী বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সাথে যুদ্ধ শুরুর আগে আনুমানিক ৪৫০+ টি-৭২ মডেলের ট্যাংক ইউক্রেনের হাতে ছিল।
বর্তমানে চলমান যুদ্ধে উভয় পক্ষ প্রচুর টি-৭২ ট্যাংক ব্যবহার করছে এবং প্রতিনিয়ত পরস্পরের হাতে ধ্বংস হচ্ছে। সম্প্রতি ভাইরাল এক ভিডিওতে দেখা যায়, নিজেদের ভেবে একটি রুশ টি-৭২ ট্যাংকের আগমন পাত্তা না দিয়ে একদল ইউক্রেনীয় সৈনিক ধরা পড়া রুশ সাঁজোয়া যানের সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তোলায় ব্যস্ত ছিল। পরে রুশ ট্যাংকটি খুব কাছে এসে গোলা ছুড়ে তাদের হত্যা করে। এছাড়া ইউক্রেনের অ্যান্টি ট্যাংক মিসাইলে রুশ সাঁজোয়া যানের ধ্বংস হওয়ার ভিডিও বেশ নিয়মিতভাবে ইউটিউবে আপলোড হচ্ছে। মিসাইল থেকে বাঁচতে রুশ টি-৭২ ট্যাংকের উপর লোহার খাঁচা ব্যবহারের ছবি দেখা গিয়েছে। তবে উক্ত ট্যাংকের টারেটের নিচে পেছন দিকে অ্যামুনিয়েশন স্টোরেজ। ফলে মিসাইল হামলা হলে সেখানে আগুন ধরে নিজের গোলাবারুদে বিস্ফোরণ ঘটায় সহজেই ধ্বংস হচ্ছে টি-৭২। রুশ ট্যাংক বহরের উপর একটি মিসাইল হামলার ঘটনা দেখুন ড্রোন ফুটেজে।
এছাড়া এই যুদ্ধে রাশিয়া টি-৮০, টি-৯০ মডেলের প্রচুর ট্যাংক ব্যবহার করছে। গত ২৫ মে রিজার্ভ থেকে পুরনো টি-৬২ ট্যাংক যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠানোর ভিডিও বের হয়। এতে বোঝা যায়- রাশিয়া তাদের দ্বিতীয় সারির বিপুল সংখ্যক ট্যাংক চলমান যুদ্ধে হারিয়েছে। ইউক্রেন টি-৭২ এর পাশাপাশি টি-৬৪ ও টি-৮০ ট্যাংক ব্যবহার করে। পুরনো টি-৮০ ট্যাংকগুলোকে আপগ্রেড করে নিজস্ব টি-৮৪ মডেলে উন্নীত করে ব্যবহার করা হচ্ছে।
সাঁজোয়া যান (Armoured Vehicles)
ট্যাংক ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের সাঁজোয়া যান এই যুদ্ধে ব্যবহৃত হচ্ছে। Infantry Fighting Vehicles (IFV) নামে পরিচিত এসব আর্মাড ভেহিকেল সেনাদের নিরাপদে যুদ্ধক্ষেত্রে পৌঁছে দেয়ার কাজ করা ছাড়াও হেভি মেশিনগান ও অন্যান্য অস্ত্র দিয়ে ট্যাংকের বিকল্প হিসেবে ফায়ার সাপোর্ট দেয়। এ ধরনের ভেহিকেলের মধ্যে BMP সিরিজের তিনটি মডেল রুশ-ইউক্রেন সেনাবাহিনীতে কয়েক হাজার ইউনিট সক্রিয় রয়েছে। এগুলো ৭+ জন সেনা পরিবহনের পাশাপাশি বিভিন্ন কনফিগারেশন অনুযায়ী ৩০ মিলিমিটার হেভি মেশিনগান, ১০০ মিলিমিটার কামান, অ্যান্টি ট্যাংক মিসাইল, অটোমেটিক গ্রেনেড লঞ্চারসহ বিভিন্ন ক্যালিবারের মেশিনগান দিয়ে পদাতিক সেনাদের ফায়ার সাপোর্ট দিতে সক্ষম। এছাড়া উভয়পক্ষ বিপুল সংখ্যক BTR, MT-LB, BRDM সিরিজের বিভিন্ন মডেলের Armoured Personnel Carrier (APC) ব্যবহার করে যা মূলত সেনা পরিবহনের কাজে ব্যবহৃত হয়। এর বাইরে Kamaz Typhoon (রাশিয়া), BMD (ইউক্রেন) উল্লেখযোগ্য। এসব আর্মাড ভেহিকেল ৭-১৬ জন সেনা পরিবহন ও লাইট/মিডিয়াম মেশিনগান দিয়ে সাপোর্ট দিতে পারে।
সারফেস টু এয়ার মিসাইল (SAM)
যুদ্ধের শুরুতেই রাশিয়া ইউক্রেনের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল। ধ্বংস করা বিমানবিধ্বংসী মিসাইলগুলোর বেশিরভাগই ছিল S-300, S-125। এছাড়া ইউক্রেনের 9K31 Strela, 9K33 Osa, 9K37 Buk, 9K330 Tor শর্ট ও মিডিয়াম রেঞ্জ মিসাইল ব্যাপক সংখ্যায় ধ্বংস হলেও এখনো অনেকগুলো ইউনিট সক্রিয় রয়েছে। একই মডেলের মিসাইলগুলো ইউক্রেনে মোতায়েন করেছে রাশিয়া। তবে চলমান যুদ্ধে সবচেয়ে কার্যকর হয়ে দেখা দিয়েছে MANPADS মিসাইল। শর্ট রেঞ্জের এই মিসাইলগুলো কাধে বহনযোগ্য বিধায় যেকোনো স্থানে সহজে বহন এবং ব্যবহার করা যায়। রাশিয়া তাদের বেশিরভাগ যুদ্ধবিমান-হেলিকপ্টার হারিয়েছে এদের হাতেই। ইউক্রেনের পশ্চিমা মিত্ররা ট্যাংক বিধ্বংসী মিসাইলের ন্যায় এ ধরনের কয়েক মডেলের ম্যানপ্যাড মিসাইল সরবরাহ করেছে। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের FIM-92 Stinger, ফ্রান্সের Mistral, ব্রিটেনের Starstreak-সহ জার্মানির স্টকে থাকা সোভিয়েত আমলের বিপুল সংখ্যক Strela-2 ম্যানপ্যাড ইউক্রেনের কাছে সামরিক সাহায্য হিসেবে পাঠানো হয়েছে। এছাড়া স্লোভাকিয়া ও গ্রিস তাদের এস-৩০০ লংরেঞ্জ সারফেস টু এয়ার মিসাইলগুলো অনুদান হিসেবে ইউক্রেনে পাঠিয়েছে।
ইউক্রেনের অনুরূপ মিসাইলগুলো রাশিয়াও চলমান যুদ্ধে ব্যবহার করেছে। এর মধ্যে আলাদা করে Buk-M3 ও Pantsir-S1 এর কথা বলতে হবে। শেষোক্ত বিমান বিধ্বংসী মিসাইলটি নিয়ে রাশিয়া যুদ্ধের আগে বিক্রির জন্য ব্যাপক মার্কেটিং চালিয়েছিল। কিন্তু সিরিয়ার পর ইউক্রেন ফন্টেও এটি বেশ বাজে পারফম্যান্স দেখিয়ে দেশটির ইমেজ সংকট সৃষ্টি করেছে। ইউক্রেনের ড্রোন হামলায় বেশ কিছু রাশিয়ান শর্ট ও মিডিয়াম রেঞ্জ সারফেস টু এয়ার মিসাইল সিস্টেম প্রতিরোধ গড়তে ব্যর্থ হয়েছে। তবে দেশটি প্যান্তসির এস-১ কে এখন পর্যন্ত ভূপাতিত করা বেশিরভাগ ইউক্রেনিয়ান ড্রোন ধ্বংসের ক্রেডিট দিয়ে থাকে। উল্লেখ্য, বাক মিসাইল দিয়েই ২০১৪ সালে মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্সের যাত্রীবাহী বিমান ধ্বংস করে ২৯৮ জন বেসামরিক ব্যক্তিকে হত্যা করেছিল দোনেস্ক অঞ্চলের রুশপন্থী বিদ্রোহীরা। এছাড়া, রাশিয়া 9K38 Igla, 9K333 Verba ম্যানপ্যাড মিসাইল ব্যবহার করে। রুশ মিসাইল সিস্টেম ধ্বংসের ভিডিও দেখুন এখানে।
আর্টিলারি
কামান ছাড়া আধুনিক যুদ্ধ যেন কল্পনাও করা যায় না। চলমান যুদ্ধে দুই পক্ষের সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত কৌশলগত অস্ত্র হচ্ছে আর্টিলারি। ফিল্ড হাউটজার, রকেট আর্টিলারি এবং সেল্প প্রপেল্ড আর্টিলারি– কামান সাধারণত এই তিন ধরনের হয়ে থাকে। চলমান ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির মুখে ইউক্রেন জরুরি ভিত্তিতে ন্যাটো দেশগুলোর কাছে সাহায্য চেয়ে M777 লংরেঞ্জ হাউটজার কামান পায়। এছাড়া 2A36, D-30, D-20 প্রভৃতি মডেলের কামান ব্যবহার করে ইউক্রেন। রাশিয়াও উক্ত ফিল্ড আর্টিলারিগুলোর পাশাপাশি Giatsint-B, Msta-B প্রভৃতি কামান ব্যবহার করছে। এছাড়া, দুই পক্ষই শত্রুর উপর রকেট বৃষ্টি নামাতে BM-21 Grad, BM-30 Smerch, BM-27 Uragan প্রভৃতি মডেলের মাল্টিপল রকেট লঞ্চ সিস্টেম ব্যবহার করছে। এর মধ্যে আলাদাভাবে TOS-1 এবং Tornado-G এর কথা বলতে হবে। সম্প্রতি আজভস্তল স্টিল কারখানায় প্রতিরোধ গড়ে তোলা ইউক্রেনিয়ান মেরিন সেনাদের বিরুদ্ধে থার্মোবোরিক রকেট ও ইন্সেন্ডিয়ারি প্রজেক্টাইল ব্যবহার করেছে। এগুলো ফায়ারের পর আতশবাজির ন্যায় ছোট ছোট ক্লাস্টারে বিভক্ত হয়ে টার্গেট এরিয়ায় আগুন ধরিয়ে দেয় যা পানি নিয়ে নেভানো কষ্টসাধ্য।
এছাড়া দুই পক্ষের প্রচুর সেলফ প্রপেল্ড আর্টিলারি এই যুদ্ধে ব্যবহৃত হচ্ছে। এদের মধ্যে 2S3 Akatsiya, 2S19 Msta, 2S5 Giatsint-S মডেলের কামানগুলো দুই দেশই ব্যবহার করে। এ ধরনের কামানগুলো কোনো স্থানে গিয়ে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে প্রস্তুতি নিয়ে অটোমেটিক সিস্টেমের মাধ্যমে একাধিক গোলা ছুড়তে পারে। আবার প্রথম গোলাটি টার্গেটে হিট করার আগেই দ্রুত স্থান পরিবর্তন করতে পারে। ফলে কাউন্টার আর্টিলারি রাডার (গোলার গতিপথ বিশ্লেষণ কামানের অবস্থান শনাক্ত করে) সাহায্য নিয়ে পাল্টা হামলা চালানো খুব কঠিন। ব্যাপক সামরিক সাহায্যের অংশ হিসেবে চেক প্রজাতন্ত্রের DANA, জার্মানির Panzerhaubitze 2000, ফ্রান্সের CAESAR সেলফ প্রপেল্ড আর্টিলারি পেয়েছে। এর বাইরে দুই পক্ষই বিভিন্ন ধরনের শর্টরেঞ্জ মর্টার ও গ্রেনেড লঞ্চার ব্যবহার করে। ছোট্ট একটি ভিডিওতে বিএম-২১ রকেট লঞ্চারের শক্তিমত্তা দেখুন:
সারফেস টু সারফেস মিসাইল
আধুনিক যুদ্ধে মিসাইলের ব্যবহার হবে না এমনটা ভাবা বোকামি। রাশিয়া যেন তাদের মিসাইলের গোডাউন ইউক্রেনের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছে। দেশটির হাই ভ্যালু টার্গেটগুলো কয়েকশো কিলোমিটার দূর থেকে উড়ে আসা মিসাইলগুলোর হামলায় প্রতিনিয়ত ধ্বংস হচ্ছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো 3M-54 Kalibr ক্রুজ মিসাইল। ২,৫০০ কিলোমিটার রেঞ্জের এই মিসাইল রুশ যুদ্ধজাহাজ, সাবমেরিন, বোমারু বিমান থেকে লঞ্চ করা যায়। এটি এতটাই নিখুঁত যে টার্গেট ভুল হলে বড়জোর ৩ মিটার আশেপাশে হিট করবে! তাই বেসামরিক কিছু এলাকায় রাশিয়া ভুল করে মিসাইল ছুড়েছে এমনটি বলা যাবে না।
যুদ্ধের শুরুতেই ৩০টি মিসাইল ছুড়ে ইউক্রেনের সামরিক বাহিনীর কমান্ড সেন্টার, অস্ত্রগুদাম উড়িয়ে দিয়েছে রাশিয়া। পরবর্তীতে প্রয়োজন অনুসারে আরো অনেক মিসাইল ছুড়েছে। এছাড়া বন্দর নগরী ওডেসাতে K-300P bastion অ্যান্টিশিপ মিসাইল দিয়ে ভূমিতে হামলা করেছে। এছাড়া উক্ত বন্দরসহ ন্যাটো সীমান্তের ইউক্রেনিয়ান ভূগর্ভস্থ অস্ত্রগুদাম ও ফুয়েল ডিপো ধ্বংস করতে প্রথমবারের রাশিয়া তাদের Kh-47M2 Kinzhal হাইপারসনিক মিসাইল ব্যবহার করেছে। এটি শব্দের চেয়ে ১২ গুণ গতিতে উড়তে সক্ষম। স্পিড আসলে কত বেশি তা ভিডিও না দেখলে বোঝা যায় না।
এই মিসাইল সর্বোচ্চ তিন হাজার কি.মি. দূর থেকে উড়ে এসে টার্গেট পয়েন্টের ১০ মিটারের মধ্যে আঘাত করতে পারে। এছাড়া রাশিয়া 9K720 Iskander হাইপারসনিক ব্যালিস্টিক মিসাইলও চলমান যুদ্ধে ব্যবহার করেছে। এর বাইরে OTR-21 Tochka শর্টরেঞ্জ ট্যাকটিক্যাল ব্যালিস্টিক মিসাইল ইউক্রেন-রাশিয়া দুই পক্ষই পরস্পরের বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছে। এছাড়া সম্প্রতি ডুবে যাওয়া রাশিয়ার প্রধান যুদ্ধজাহাজ (ফ্ল্যাগশিপ) মস্কোভা ক্রুজারটি ইউক্রেনের R-360 Neptune অ্যান্টিশিপ মিসাইলের হামলায় ডুবেছে দাবী করেছে দেশটি। এছাড়া ডেনমার্ক থেকে Harpoon কোস্টাল ডিফেন্স ব্যাটারি অনুদান হিসেবে পেয়েছে দেশটি, যা জাহাজ বিধ্বংসী মিসাইলের মধ্যে বিশ্বের সেরা বলে বিবেচিত।
অ্যাটাক হেলিকপ্টার
যুদ্ধে নিজেদের সেনাদের ক্লোজ এয়ার সাপোর্ট দিতে হেলিকপ্টারের জুড়ি মেলা ভার। চলমান যুদ্ধে ইউক্রেন বিমানবাহিনীর বেশিরভাগ যুদ্ধবিমান রুশ হামলায় শুরুতেই ক্ষতিগ্রস্ত/ধ্বংস হওয়ায় হেলিকপ্টার ব্যতীত তাদের এখন কোনো উপায় নেই। ইউক্রেন Mil Mi-24 অ্যাটাক হেলিকপ্টার ব্যবহার করে রাশিয়ার অভ্যন্তরে তেলের ডিপোতে হামলা করার দুঃসাহস দেখিয়েছে। এটি সহ Mil Mi-8, Mil Mi-17 মডেলের অ্যাটাক/ট্রান্সপোর্ট হেলিকপ্টার রাশিয়াও ব্যবহার করে। কিছুদিন আগে একটি ড্রোন ফুটেজে দেখা যায় কৃষ্ণ সাগরের স্নেক আইল্যান্ডে একটি এমআই-৮ হেলিকপ্টার থেকে দড়ি বেয়ে সেনা অবতরণ করানোর সময় এটি শত্রুর মিসাইল হামলায় ধ্বংস হয়। কিন্তু দুই পক্ষই দাবী করছে যে এটি অপরপক্ষের হেলিকপ্টার ছিল। এর বাইরে রাশিয়ার Kamov Ka-52, Mil Mi-28 অ্যাটাক হেলিকপ্টারগুলোর প্রতিনিয়ত ইউক্রেনিয়ান টার্গেটে রকেট-মিসাইল হামলা চালাচ্ছে। এর মধ্যে বেশ কিছু রুশ হেলিকপ্টার ইউক্রেনিয়ান ম্যানপ্যাড মিসাইলের হামলায় ধ্বংস হয়েছে, যার অনেকগুলো ভিডিও ইউটিউবে পাওয়া যাচ্ছে।
ফাইটার জেট
শক্তিশালী বিমানবাহিনীর জোরে রাশিয়া ইউক্রেনকে প্রথমে দুর্বল করে ফেলেছিল। ধ্বংস/ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল বেশিরভাগ জেট। কিন্তু পশ্চিমা সাহায্য পেয়ে আবার মেরামত করে কিছু বিমান আকাশে উড়িয়েছে। মিত্রদের তরফ থেকে পুরোনো কিছু সোভিয়েত যুদ্ধবিমান ও পার্টস সাপ্লাই পেয়েছে। বর্তমানে ইউক্রেনের হাতে অজানা সংখ্যক Sukhoi Su-27, Su-24, Su-25, MiG-29 যুদ্ধবিমান রয়েছে। একই মডেলের বিমানগুলো রাশিয়াও এই ব্যাপক হারে যুদ্ধে ব্যবহার করেছে। এছাড়া রুশদের Tupolev Tu-22M, Sukhoi Su-34 বোমারু বিমান ইউক্রেনে হামলা করতে দেখা গেছে। তবে শক্তিশালী বিমানবাহিনী থাকার পরও সমগ্র ইউক্রেনের আকাশে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করতে শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছে রুশ বিমানবাহিনী।
ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার
ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার আধুনিক যুদ্ধের নতুন সংযোজন। আড়ি পেতে শত্রুপক্ষের গোপন তথ্য সংগ্রহ বা রেডিও যোগাযোগে বাধা প্রদান, রাডার, ড্রোনসহ শত্রুর যাবতীয় রেডিও-ইলেকট্রনিক ডিভাইস জ্যামিং করে অচল করে দেয়া, স্যাটেলাইট যোগাযোগ বাধাগ্রস্থ করা ইত্যাদি কাজ করা হয় ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ারে। প্রথমে এতে তেমন গুরুত্ব না দিলেও ইউক্রেনের ড্রোন ও রাডার গাইডেড বিভিন্ন মিসাইল হামলা বেড়ে যাওয়ায় বাধ্য হয়ে ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার ডিভাইস ব্যবহার শুরু করে রাশিয়া। এক্ষেত্রে 1RL257 Krasukha-4 উল্লেখযোগ্য। এগুলো ২৫০-৩০০ কিলোমিটার রেঞ্জের মধ্যে রেডিও ডিভাইস, রাডার, এয়ারবোর্ণ ড্রোন ও তার কন্ট্রোল ইউনিট, রাডার গাইডেড মিসাইল, স্যাটেলাইট ফোন, এমনকি সেলফোন সিগন্যালও বাধাগ্রস্থ করতে পারে! ইউক্রেনের হাতে এ ধরনের কোনো অস্ত্র আছে কিনা সেই সম্পর্কে পরিস্কার তথ্য নেই। তবে সম্প্রতি Borisoglebsk-2 একটি ইলেক্ট্রনিক ওয়ারফেয়ার ভেহিকেল তারা রুশ বাহিনীর কাছ থেকে হস্তগত করেছে।
Unmanned Aerial Vehicles (UAV)
ড্রোন ছাড়া এই যুগে যুদ্ধে সুবিধা করাই যেন মুশকিল। রিমোট কন্ট্রোল পাইলটবিহীন এসব যান যুদ্ধকে ঝুঁকিমুক্ত করার পাশাপাশি ক্ষেত্রবিশেষে সহজ করে দিয়েছে। ইউক্রেন যুদ্ধে ড্রোনের কথা বলতে গেলে প্রথমে আসবে Bayraktar TB2 অ্যাটাক ড্রোনের কথা। আজারবাইজান-আর্মেনিয়া যুদ্ধের ব্যাপক আলোচিত এই তুর্কি ড্রোন ইউক্রেন ৪৮টি কিনেছিল। রুশ মিসাইল ও জ্যামারের হামলায় এখন পর্যন্ত ২০টি টিকে আছে বলে দাবী করা হয়। সন্দেহ করা হয়, তুরস্ক রাশিয়ার চাপ এড়িয়ে গোপনে আরো টিবি-২ ড্রোন সাপ্লাই দিয়েছে। এটি প্রথমদিকে রাশিয়ার জন্য বিভীষিকা হয়ে দেখা দেয়। রুশ সারফেস টু এয়ার মিসাইল ও ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার ভেহিকেল ধ্বংস করার ভিডিও ছড়িয়ে পড়ার পর বহির্বিশ্বে রুশ সমরাস্ত্রের ব্যাপক ইমেজ সংকট সৃষ্টি হয়। পরবর্তীতে এই ড্রোনের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে সক্ষম হলেও প্রোপাগান্ডা যুদ্ধে কিন্তু ইউক্রেনের আপাত বিজয় ঘটেছে। কেননা, প্রতিনিয়ত এই ড্রোনের সফল হামলার ফুটেজ ইন্টারনেটে ভাইরাল হচ্ছে। ফলে বিশ্বব্যাপী জনমত সৃষ্টি হচ্ছে এবং প্রচুর সামরিক সাহায্য আসছে। উপরে উল্লেখিত নেপচুন মিসাইল মেরে রুশ যুদ্ধজাহাজ ডুবিয়ে দেয়ার ঘটনায় টিবি-২ ড্রোন ব্যবহার করে রুশ নৌবাহিনীকে ধোঁকা দিয়েছে বলে দাবী করেছে ইউক্রেন। দেশটি বায়রাক্তার টিবি-২ এর এতটাই গুণমুগ্ধ যে সম্প্রতি তারা এই ড্রোনকে নিয়ে একটি মিউজিক ভিডিও প্রকাশ করেছে।
এর বাইরে লয়টারিং মিউনিশন নামে খ্যাত Warmate, Switchblade নামক আত্মঘাতী ড্রোন পেয়েছে ইউক্রেন। এগুলো রুশ রাডার, কমান্ড সেন্টার, মিসাইল ব্যাটারির উপর আছড়ে পড়ে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করছে। এছাড়া রাশিয়া-ইউক্রেন দুই পক্ষই শত্রুর উপর নজরদারি, আর্টিলারি হামলার সহায়ক হিসেবে বিভিন্ন ধরনের রিকনসিস ড্রোন ব্যবহার করছে। এ কথা সত্য যে, নব্বইয়ের দশক থেকে পশ্চিমাদের তুলনায় ড্রোন টেকনোলজিতে তুলনামূলক কম মনোযোগ দেয়ায় পিছিয়ে রয়েছে রাশিয়া। দেশটির শক্তিশালী বিমানবাহিনীর তুলনায় তেমন ভালোমানের অ্যাটাক ড্রোন উল্লেখযোগ্য পরিমাণে নেই। ইসরাইলের Forpost ড্রোন রাশিয়ার ড্রোন বহরের প্রধান অস্ত্র।
সংক্ষেপে এই ছিল রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সমরাস্ত্রের তালিকা। এর বাইরে অসংখ্য অস্ত্র এই যুদ্ধে ব্যবহার হচ্ছে। এর মধ্যে বিভিন্ন ধরনের এয়ার সার্চ রাডার, কাঁধে বহনযোগ্য ম্যানপ্যাক জ্যামার ও রাডার (স্বল্প রেঞ্জে চলমান মানুষ, ড্রোন শনাক্ত করতে পারে), বিভিন্ন ধরনের রেডিও যোগাযোগ ডিভাইসসহ অসংখ্য মডেলের অ্যাসল্ট রাইফেল, মেশিনগান, স্নাইপার রাইফেলসহ বিভিন্ন ক্ষুদ্রাস্ত্র ব্যবহার হচ্ছে। এর মধ্যে অ্যান্টি ট্যাংক এবং অ্যান্টি পার্সোনেল মাইনের কথা আলাদাভাবে বলতে হচ্ছে। রুশ বাহিনীর চলাচলে বিঘ্ন সৃষ্টি করতে ইউক্রেনিয়ান সেনারা প্রচুর পরিমাণে এ ধরনের বিশেষ বিস্ফোরক ডিভাইস যেখানে-সেখানে রোপণ করছে। এতে শত্রুর ক্ষয়ক্ষতির পাশাপাশি নিজেদের বেসামরিক লোকজনের ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়া রুশ বাহিনী কেমিক্যাল, বায়োলজিক্যাল, এমনকি নিউক্লিয়ার ওয়ারহেড এই যুদ্ধে ব্যবহার করতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
সব মিলিয়ে যুদ্ধ যত দীর্ঘ হচ্ছে, দুই পক্ষের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বাড়ছে। বিশেষ করে রুশ সাঁজোয়া যান ধ্বংসের পরিমাণ প্রতিনিয়ত বাড়ছে। যেকোনো যুদ্ধে আক্রমণকারী দেশের ক্ষয়ক্ষতি বেশি হবে, এমনটি স্বাভাবিক। অন্যদিকে, চতুর্থ প্রজন্মের যুদ্ধকৌশলে প্রোপাগান্ডা একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। চলমান যুদ্ধে দুই পক্ষই মিডিয়া প্রোপাগান্ডা করলেও এগিয়ে আছে প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির ইউক্রেন। ফলে রুশ বাহিনীর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির কথা আমরা জানতে পারলেও ইউক্রেনের সামরিক ক্ষয়ক্ষতি কিন্তু নেহাত কম নয়। এই যুদ্ধ আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে যে, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বিষয়ক ধারণাগুলো কতটুকু সত্য। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মতো যদি দীর্ঘমেয়াদী এবং পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহার ব্যতীত পূর্ণমাত্রার যুদ্ধ হয়, তবে প্রথম তিন বছরের মধ্যেই বেশিরভাগ দেশের অধিকাংশ ট্যাংক ও অন্যান্য সাঁজোয়া যান, যুদ্ধজাহাজ, ফাইটার জেট ধ্বংস হয়ে যাবে। খাদ্য ও অর্থনৈতিক সংকটে মারা যাবে যুদ্ধে লিপ্ত নয় এমন দেশের বহু মানুষ। চলমান রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে টালমাটাল বিশ্ব অর্থনীতি যেন সেই ইঙ্গিত দিচ্ছে। যুদ্ধ আরো দীর্ঘায়িত হলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে পুরো বিশ্ব।