গভীর রাত, শহরের বুকে শুনশান নীরবতা। রাতের নিস্তদ্ধতা ভেঙে তীব্র শব্দে ছুটে আসে আঁধার কালো চইকা। শোনা যায়, খানিকটা ধ্বস্তাধস্তির শব্দ, খানিকটা চাপা চিৎকার। রাতের অন্ধকারেই হারিয়ে যায় কিছু মানুষ। না তাদের পরিণতি জানা যায়, না পাওয়া যায় সন্ধান। শহরে ভেসে বেড়ায় গুজব, রাষ্ট্রদ্রোহীদের শেষ আশ্রয়স্থল ছিলো হিম শীতল লুবিয়াঙ্কা কারাগার।
আর দেশ ও দেশের বাহিরে রাষ্ট্রদ্রোহীদের নিশ্চিহ্ন করার দায়িত্বে ছিলো কেজিবির দুর্ধর্ষ গুপ্তচরেরা। সোভিয়েত পলিটবুর্যোর সদস্যরা কেজিবিকে একইসাথে প্রতিরক্ষার ঢাল ও তলোয়ার বলে দাবী করতেন। ১৯৫৪ সাল থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত অখন্ড সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পূর্ব পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলো কেজিবি। কেজিবি ছিলো এমন এক গুপ্ত সংস্থা, যা দেশের অভ্যন্তরে সিক্রেট পুলিশ হিসেবে কাজ করতো, আর বহির্বিশ্বে চালাতো গুপ্তচরবৃত্তি। রাশিয়ান ভাষায় কেজিবির পূর্ণ রূপ Komitet Gosudarstvennoy Bezopasnost (KGB), ইংরেজিতে যাকে বলে কমিটি ফর স্টেট সিকিউরিটি (Committee for State Security)। রাশিয়ার বর্তমান প্রেসিডেন্ট পুতিন ছিলেন কেজিবির একজন দুর্ধর্ষ গুপ্তচর।
কথিত রয়েছে, সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন বর্তমান রাশিয়ার অভ্যন্তরে ৯০,০০০ বা তার বেশি স্টাফ অফিসার অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তাজনিত হুমকির বিরুদ্ধে পাহারা দেয় এবং একইসাথে যে সকল কারাগারে রাজনৈতিক বন্দী আছে সেগুলোর তত্ত্বাবধান করে। সীমান্ত বরাবর ১,৭৫,০০০ সীমান্তরক্ষী ও সামরিক বাহিনীর সক্রিয় সদস্যরা ৪১,৮০০ মাইল সীমান্তের পাহারায় নিয়োজিত। সোভিয়েত সীমান্তের বাইরে প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ অপারেটররা পশ্চিমা দেশগুলোর সর্বশেষ গোপন উদ্ভাবনের খোঁজে নিয়োজিত। একইসাথে ‘বৈধ-অবৈধ’ যেকোনো উপায়ে বিদেশি গুপ্ত সংস্থায় অনুপ্রবেশের চেষ্টারত।
কেজিবি যেন সরকারের ভেতরে অবস্থানরত আরেক সরকার। যদিও বলা হয়, আজ কেজিবির কোনো অস্তিত্ব নেই। কিন্তু অতীতের সেই কেজিবি লুপ্ত হয়ে আজ বিশ্ববাসীর সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে এফএসবি বা ফেডারেল সিকিউরিটি সার্ভিস নামে। গুপ্তচরবৃত্তি অবশ্যই শুধুমাত্র সাফল্য বা ব্যর্থতার সাথে সংশ্লিষ্ট পেশা নয়। এ এক জীবন-মরণ খেলা, যেখানে পদে পদে গুপ্তহত্যা, মিথ্যা, দলবদলের খেলা বা রহস্যজনক মৃত্যু জড়িয়ে রয়েছে। এমনটাই এক সাক্ষাতকার প্রদানকালে তুলে ধরেন অবসরপ্রাপ্ত সিআইএ কর্মকর্তা মিল্টন বেয়ার্ডন। তিনি তার সোভিয়েত প্রতিপক্ষ লিওনিড শেবারশিনকে স্মরণ করেন, যিনি ২০১২ সালের মার্চ মাসে ৭৭ বছর বয়সে সন্দেহজনকভাবে আত্মহত্যা করেছিলেন।
তদন্তের রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছিলো, তিনি নিজ পিস্তলের গুলিতে নিহত হন। লিওনিড ছিলেন কেজিবির বৈদেশিক গুপ্তচর বিভাগের সাবেক প্রধান। যিনি কেজিবি চেয়ারম্যান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ১৯৯১ সালে লিওনিডের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা যখন ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থান পরিচালনার দায়ে অভিযুক্ত হন, তখন লিওনিড কেজিবির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি সারা জীবন সংস্থার প্রতি অনুগত ছিলেন এবং রহস্যজনক আত্মহত্যার পূর্বে কেজিবি থেকে অবসরের দিনগুলো নীরবে-নিভৃতে মস্কোতে কাটাচ্ছিলেন। কিন্তু তবু তার শেষরক্ষা হয়নি।
অকালমৃত্যুর হাতেই যে কেজিবির বেশিরভাগ গুপ্তচর পরাস্ত হয়েছেন এমনটা বলা যাবে না। অনেকেই রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদে অধিষ্ঠিত হয়েছেন। আবার অনেকে সোভিয়েত গুপ্ত সংস্থার জন্য ডেকে এনেছেন অশনি সংকেত। ডাবল এজেন্ট হয়ে যুক্তরাজ্য বা যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়ে গিয়েছেন।
আজকের এই লেখাতে তুলে ধরা হবে অতীত কেজিবির দুর্ধর্ষ কিছু গুপ্তচরের উত্থান-পতনের বাস্তব উপাখ্যান।
ড. ওলেগ কালুগিন
গুপ্তচর জীবনে স্লিপিং এজেন্ট, ডাবল এজেন্ট ও ডিরেক্ট এজেন্টের দেখা পদে পদেই মিলে। অনেকটা এমন গল্পই বাস্তবতা হয়ে দেখা দিয়েছিলো কেজিবির সর্বকনিষ্ঠ জেনারেল ও প্রেসিডেন্ট পুতিনের কার্যক্রমের কঠোর সমালোচক ওলেগ কালুগিনের জীবনেও। ১৯৫১ সালে লেনিনগ্রাদ বিশ্ববিদ্যালয় হতে স্নাতক শেষ করে ওলেগ যোগদান করেছিলেন কেজিবিতে। প্রশিক্ষণ শেষে ওলেগকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো হয়। মেধাবী ওলেগ খুব সহজেই ফুলব্রাইট স্কলারশিপ নিয়ে উচ্চশিক্ষার্থে চলে আসেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে।
গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিষয়ে ভর্তি হন কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে। শিক্ষাজীবন সমাপ্তি শেষে নিউ ইয়র্কে সাংবাদিক হিসেবে পেশাজীবন শুরু করেন। পাশাপাশি সোভিয়েত গুপ্তসংস্থার হয়ে নেমে পড়েন স্পর্শকাতর তথ্য সংগ্রহের কাজে। কর্মনৈপুণ্য দেখিয়ে খুব দ্রুতই তিনি ওয়াশিংটন ডিসিতে অবস্থিত সোভিয়েত দূতাবাসের আস্থাভাজন তথ্যদাতা ও পরামর্শক হয়ে ওঠেন। ১৯৭৪ সালে তিনি কেজিবির জেনারেল পদ পাবার জন্য সুপারিশপ্রাপ্ত হন।
কিন্তু ঘটনার মোড় ঘুরতে সময় লাগেনি। তৎকালীন কেজিবি প্রধান ভ্লাদিমির ক্রিয়েচকভ (Vladimir Kryuchkov), যিনি পরবর্তীতে সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী মিখাইল গরবাচেভের সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন, তিনি ওলেগ কালুগিনের বিরুদ্ধে মার্কিন গোয়েন্দা নিয়োগ করার অভিযোগ করেন। এই অভিযোগের দায় মাথায় নিয়ে ওলেগকে রাশিয়ায় ফিরে আসতে হয়। সেখানে ওলেগকে সোভিয়েত নাগরিকদের সাক্ষাতকার নিয়ে তাদের মধ্যে বিশ্বাসঘাতক চিহ্নিত করার দায়িত্ব দেওয়া হয়।
উপরন্তু, সন্দেহের চাপে রাশিয়ায় বিরক্তিকর সময় পার করতে থাকেন জেনারেল ওলেগ কালুগিন। শেষ পর্যন্ত ওলেগ কেজিবির সকল রকম দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলা শুরু করেন। পরবর্তীতে ১৯৯০ সালে ওলেগকে এজেন্সি থেকে বরখাস্ত করা হয়। ১৯৯১ সালে তিনি তৎকালীন কেজিবি প্রধান ভ্লাদিমির ক্রিয়েচকভ (Vladimir Kryuchkov) পরিচালিত বিদ্রোহের বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। বিদ্রোহ পরবর্তী সময়ে তিনি পুনরায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে আসেন। সেখানে তিনি ক্যাথলিক ইউনিভার্সিটি অব আমেরিকায় শিক্ষকতা শুরু করেন।
শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি তার কেজিবি জীবনের অভিজ্ঞতাকে পুঁজি করে ১৯৯৪ সালে লিখে ফেলেন Spymaster: My Thirty-two Years in Intelligence and Espionage Against the West ও The First Directorate নামক দুটি বই। শুধু বই লিখেই ওলেগ ক্ষান্ত হননি। নিজের বহুমুখী প্রতিভার পরিচয় দিতে তিনি ১৯৯৬ সালে তিনি Spy Craft: The Great Game নামে একটি ভিডিও গেম ডেভেলপ করেন। গেমটির মুখ্য চরিত্র এক সিআইএ এজেন্ট যে নিউক্লিয়ার ওয়ারহেড চুরির ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করার পাশাপাশি মার্কিন প্রেসিডেন্টের হত্যাকান্ডে বাধা দেয়।
কোনো এক সাক্ষাতকারে ওলেগ উল্লেখ করেছিলেন, রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন কেজিবিতে তার পাঁচ স্তর নিচের ফিল্ড অপারেটিভ ছিলেন, যিনি এমনকি ওলেগের সামনে রিপোর্ট করার এখতিয়ারও রাখতেন না। ওলেগের এই মন্তব্যে প্রেসিডেন্ট পুতিন এতটাই রেগে যান যে, তিনি ওলেগকে রাষ্ট্রদ্রোহী হিসেবে ঘোষণা দেন। ২০০২ সালে রুশ আদালত ওলেগের ১৫ বছর সশ্রম কারাদণ্ডের ঘোষণা দেয়, যা তাকে কখনোই ছুঁতে পারেনি। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত ওলেগ কালুগিন ওয়াশিংটন ডিসির সেন্টার ফর কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স এন্ড সিকিউরিটি স্টাডিজে অধ্যাপনা করছেন এবং ইন্টারন্যাশনাল স্পাই মিউজিয়ামের বোর্ড মেম্বার হিসেবে নিয়োজিত রয়েছেন। বর্তমানে তার বয়স ৮৪ বছর।
অলড্রিচ আমেস
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অধিবাসীদের চোখে আমেস সম্ভবত সবচেয়ে অখ্যাত কেজিবি গুপ্তচর। অল্ড্রিচ আমেস সিআইএতে দীর্ঘ ৯ বছর ধরে সোভিয়েত তথ্য পাচারকারী হিসেবে কাজ করেছেন। পরবর্তীতে তিনি ধরা পড়ে বিচারের মুখোমুখি হন এবং গুপ্তচরবৃত্তির দায়ে দোষী সাব্যস্ত হন। আমেসের বাবা কার্লটন সেসিল আমেস ছিলেন সিআইএ’র গুপ্ত কর্মকর্তা, যিনি ১৯৫০-এর দশকে বার্মায় গোপন মিশনের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন।
তিনি আমেসকে গুপ্তচর হতে উৎসাহিত করে তোলেন। এমনকি গুপ্তচর হবার হাতেখড়িও আমেস পেয়েছিলেন তার বাবার কাছে থেকে। ১৯৬২ সালে তার বাবা তাকে সিআইএ’র কাজে নিযুক্ত করেন। কিন্তু আমেস তার প্রথম মিশনে এতটাই শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হন যে, পরবর্তীতে খুবই বিষণ্ণ হয়ে পড়েন। নিজ পরাজয়ের দায় তিনি যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র নীতির উপর চাপিয়ে দেন।
কেজিবিকে তথ্য প্রদানের জন্য তিনি একটি বাদামী খামে ৫০,০০০ ডলার পেয়েছিলেন। এই ঘটনার কয়েক সপ্তাহ পরই আমেস পুনরায় সোভিয়েত ইউনিয়নে মার্কিন গুপ্তচরবৃত্তির কাজে নিয়োজিত গুপ্তচরদের একটি তালিকা কেজিবিকে পাঠান। কথিত রয়েছে, তালিকায় তার সেরা বন্ধুদের একজন সের্গেই ফেডোরেঙ্কোর নামও ছিল। জানা যায়, আমেস ২৫ জন সিআইএ কর্মীকে শনাক্ত করার কাজে কেজিবিকে সহায়তা করেন, যাদের মধ্যে ১০ জনকে মৃত্যুদন্ডে দণ্ডিত করা হয়েছিলো।
আমেসকে বিশ্বের সবচেয়ে উচ্চমূল্যে প্রাপ্ত গুপ্তচর বলা হয়। সহকর্মীদের পরিচয় ফাঁস করার বিনিময়ে প্রায় ৪ মিলিয়ন ডলার উপার্জন করেন। ১৯৮৩ সালে আমেসকে সিআইএর সোভিয়েত কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স শাখার প্রধান হিসেবে পদোন্নতি দেওয়া হয়। তার হাতে তখন রাশিয়ায় অবস্থানরত সকল এজেন্টের পরিচয় সম্বলিত ফাইল চলে আসে। এদিকে আমেসের ব্যক্তিগত জীবনে তখন বয়ে চলেছে তীব্র ঝড়।
একদিকে স্ত্রীর সাথে চলছে বিবাহ বিচ্ছেদের আইনী লড়াই, অপরদিকে রক্ষিতার বিশাল অঙ্কের ঋণের দায়। পরে স্বীকার করেন সেই মুহূর্তে তার প্রায় ৫০,০০০ ডলারের প্রয়োজন ছিল এবং কেজিবি তাদের হয়ে গুপ্তচরবৃত্তি করার জন্য সিআইএর কর্মীদের একই পরিমাণ অর্থ প্রদান করতে চেয়েছিলো। ১৯৮৫ সালে আমেস কেজিবির সাথে যোগাযোগ করে সিআইএর তিনজন ডাবল এজেন্টের পরিচয় ফাঁস করার প্রস্তাব দেন। আমেস ভেবেছিলেন, তিনি যা করছেন তা অনৈতিক নয়। কারণ টেকনিক্যালি যে তিনজনকে তিনি ধরিয়ে দিচ্ছেন তারা প্রথমে কেজিবির এজেন্ট ছিলেন।
অবশেষে ১৯৯৪ সালে এফবিআই পরপর দুবার ব্যর্থতার পর অল্ড্রিচ আমেসকে গ্রেফতার করতে সমর্থ হয়। গুপ্তচরবৃত্তি ও রাষ্ট্রীয় স্পর্শকাতর তথ্য পাচারের দায়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দন্ডিত হন। বর্তমানে তিনি পেনসিলভানিয়ার ম্যাক্সিমাম সিকিউরিটি কারাগারে সাজা খাটছেন।
অ্যালেক্সান্ডার লিটভিনেঙ্কো
ভূতপূর্ব কেজিবি এজেন্ট অ্যালেক্সান্ডার লিটভিনেঙ্কো সাহসীকতার সাথে গুপ্তসংস্থাটির অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও অনৈতিকতার এমন কিছু তথ্য বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরেন যা তার অকাল ও কষ্টকর মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
লিটভিনেঙ্কো ১৯৮৮ সালে কেজিবিতে কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স স্পাই হিসেবে যোগ দেন এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙার পূর্ব পর্যন্ত ফিল্ড এজেন্ট হিসেবে কাজ করেন। এরপর তিনি ফেডারেশন সিক্রেট সার্ভিস এফএসবি এর সবচেয়ে গোপন বিভাগে যোগ দেন ও চেচনিয়ান সন্ত্রাসবাদ ও সংগঠিত অপরাধের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। কিন্তু ১৯৯৮ সালে লিটভিনেঙ্কোর দেওয়া এক সরকারি বিবৃতিতে চারদিকে যেন মহা গোলযোগের সৃষ্টি হয়। লিটভিনেঙ্কো উচ্চপদস্থ এক এফএসবি অফিসারের বিরুদ্ধে রাশিয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী ও অভিজাত পরিবারের সদস্য বোরিস বেরেজভস্কিকে হত্যার আদেশ দেওয়ার অভিযোগ উত্থাপন করেন।
উচ্চপদস্থ অফিসারের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনায় ক্ষমতা ও দায়িত্বের অপব্যবহারের অভিযোগে লিটভিনেঙ্কোর বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা দায়ের করা হয়। অভিযুক্ত লিটভিনেঙ্কো নিজেকে এফএসবির কারাগারে বন্দিত্ব বরণের দ্বারপ্রান্তে খুঁজে পান। মিথ্যে মামলা ও হয়রানির হাত থেকে রক্ষা পেতে লিটভিনেঙ্কো লন্ডনে পালিয়ে যান। তার অনুপস্থিতেই তার বিরুদ্ধে মামলার রায় বের হয়।
লন্ডনে অবস্থানকালীন লিটভিনেঙ্কো দুটি বই প্রকাশ করেন Blowing Up Russia: The Secret Plot to Bring Back KGB Terror এবং Lubyanka Criminal Group; উভয় বইতেই রুশ জনগণের বিরুদ্ধে চলমান অপরাধের জন্য তিনি এফএসবিকে দায়ী করেন এবং দ্বিতীয় বইয়ের ক্ষেত্রে আল কায়েদার জঙ্গিদের প্রশিক্ষণ প্রদান এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৯/১১ হামলায় এফএসবি ভূমিকা পালন করেছে বলে উল্লেখ করেন।
২০০৬ সালের নভেম্বরে ৪৩ বছর বয়সে লিটভিনেঙ্কো রহস্যময় এক রোগে মারা যান। ময়নাতদন্তে মৃত্যুর কারণ হিসেবে তেজস্ক্রিয়তা প্রয়োগের উল্লেখ পাওয়া যায়। কিন্তু কীভাবে লিটভিনেঙ্কো বিষাক্ত তেজস্ক্রিয় পদার্থের সংস্পর্শে এলেন তা অজানাই রয়ে যায়। মৃত্যুর বছর দুয়েক পূর্বে ২০০৪ সালে লিটভিনেঙ্কো নিউ ইয়র্ক টাইমস এর প্রতিনিধিকে বলেছিলেন, ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ভিক্টর ইউশচেঙ্কোর বিষ প্রয়োগে হত্যার পেছনে এফএসবির হাত ছিল। তেজস্ক্রিয় উপাদান প্রয়োগে লিটভিনেঙ্কোর রহস্যজনক মৃত্যুই বিশ্ববাসীর সামনে এফএসবিকে হবার হাত থেকে বাঁচিয়ে দেয়।
বোরিস কারপিকোভ
বোরিস কারপিকোভ, ক্রেমলিনের সাথে মতভেদ ঘটা কেজিবির প্রাক্তন গুপ্তচর। উচ্চপদস্থদের সাথে মতবিরোধের ফলে বোরিস ডাবল এজেন্ট হয়ে যান। এবং পরে লন্ডনে আত্মগোপন করতে বাধ্য হন। অবসরগ্রহণের পর আজও তিনি লন্ডনে একাকী বসবাস করছেন। প্রতিমুহূর্তে তাকে নজর রাখতে হয় যেন তিনি অজ্ঞাত আততায়ীর গুপ্তহত্যার শিকার না হন। তার পেশাই তাকে এমন করে তুলেছে।
১৯৮৪ সালে কেজিবি লাটভিয়ায় জন্মগ্রহণকারী কারপিকোভের সাথে যোগাযোগ করে। তখন তিনি একটি মহাকাশ যন্ত্রাংশ কারখানায় মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। গুপ্তসংস্থাটি বোরিসকে বেলারুশের মিনস্কে কেজিবি একাডেমিতে প্রশিক্ষণের জন্য পাঠিয়েছিলো যেখানে তাকে গুপ্তহত্যায় প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারিতে গার্ডিয়ানকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এভাবেই বোরিস স্মৃতিচারণ করেছিলেন। ধীরে ধীরে তিনি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হয়ে ওঠেন এবং পরবর্তীতে মেজর হিসেবে পদোন্নতি পেয়ে লাটভিয়ায় সেকেন্ড ডিরেক্টরেট নামক কেজিবির এলিট কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত হন।
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর, যখন স্বাধীন প্রজাতন্ত্র হিসেবে লাটভিয়ার জন্ম হয়, একজন দেশপ্রেমিক হিসেবে বোরিস তখন লাটভিয়ার নিজস্ব ইন্টেলিজেন্স এজেন্সিতে যোগদান করেন। ক্রেমলিন ও লাটভিয়া তখন প্রতিপক্ষে পরিণত হয়েছে। নিজ দেশের গুপ্ত সংস্থায় যোগ দিলেও বোরিস তখনো রাশিয়ার গুপ্তসংস্থার অধীন। তাই নিতান্ত বাধ্য হয়েই তিনি ডাবল এজেন্টের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। ডাবল এজেন্ট হিসাবে, কারপিকোভ সিআইএ-কে ভুল তথ্য দিতে থাকেন। একই সময় তিনি ব্রিটিশদের অবস্থা জানতে এক অনুষ্ঠানে অংশ নেবার ছলে রিগায় ব্রিটিশ দূতাবাসে অনুপ্রবেশ করে লিসেনিং ডিভাইস স্থাপন করেন। ঠিক এমনই দুঃসাহসের অধিকারী ছিলেন তিনি।
কিন্তু ১৯৯৫ সালের দিকে, কারপিকোভের সাথে দুর্নীতিবাজ এফএসবির মতবিরোধ ঘটে। তিনি দাবি করেন, তার প্রাপ্য পাওনা তাকে পরিশোধ করা হচ্ছে না। এদিকে লাটভীয় গুপ্তসংস্থা বোরিস কারপিকোভের সাথে রাশিয়ান এফএসবির সম্পর্কের কথা জেনে যায়। দ্রুতই লাটভিয়া ত্যাগ করে কারপিকোভ অল্প সময়ের জন্য রাশিয়ায় ফিরে আসেন। পরবর্তীতে তিনি জাল পাসপোর্ট ব্যবহার করে রাশিয়া থেকে ব্রিটেনে প্রবেশ করেন এবং তারপর কখনও পিছু ফিরে তাকাননি।
বর্তমান সময় কেমন কাটছে বোরিসের? গার্ডিয়ানের লুক হার্ডিংকে সাক্ষাতকার প্রদানকালে বোরিস বলেন, রাশিয়ায় ঘটা ঘটনাগুলোর উপর তিনি তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখেন। কখনো বা মুহূর্তের নোটিশে তিনি হারিয়ে যান অজ্ঞাত গন্তব্যে, কোথায় যান কী করেন সে সম্পর্কে কোনো ব্যাখ্যা দিতে তিনি রাজী নন। তবে তিনি তার বাসস্থানের সামনে রাশিয়ান নাম্বার প্লেট লাগানো কূটনীতিকদের গাড়ির আনাগোনা দেখতে পান। অনেকবার তিনি লিসেনিং ডিভাইসও খুঁজে পেয়েছেন নিজ আবাসে। এমনকি অজ্ঞাতনামাদের কাছ থেকে পেয়েছেন মৃত্যুর হুমকি। নিজেকে নিয়ে তিনি ভীত নন, কিন্তু তিনি তার স্ত্রী এবং সন্তানদের নিরাপত্তা সম্পর্কে চিন্তিত, যদিও তারা এখন প্রাপ্তবয়স্ক।
ভাসিলি মিত্রোখিন
মিত্রোখিন পছন্দের ক্যারিয়ার হিসেবেই গুপ্তচরবৃত্তি বেছে নিয়ে কেজিবিতে যোগদান করেছিলেন। মিত্রোখিন নিজেই এক সিক্রেট মিশন শুরু করেছিলেন, তা-ও কেজিবির অভ্যন্তরে। তিনি কেজিবির আর্কাইভ হতে স্পর্শকাতর তথ্য ও দলিল পাচার করা শুরু করেন। মিত্রোখিনের এই তথ্য পাচার সম্পর্কে ১৯১৯ সালে একটি বইও প্রকাশিত হয়, নাম The Sword and the Shield, যা তিনি ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ ক্রিস্টোফার অ্যান্ড্রুের সাথে যৌথভাবে লিখেছিলেন। ১৯৪৮ সালে মিত্রোখিন কেজিবিতে যোগ দেন এবং ১৯৫৬ সালে কেজিবির আর্কাইভগুলো স্থানান্তর হবার আগপর্যন্ত নিজেকে একজন উদ্যোগী ও করিতকর্মা এজেন্ট হিসেবে সকলের সামনে তুলে ধরেন।
১২ বছর ধরে মিত্রোখিন আর্কাইভ থেকে হাজার হাজার নথিপত্র চুরি করেছিলেন। তিনি রাতের বেলা দপ্তর ত্যাগের পূর্বে গুরুত্বপূর্ণ নথি নিজের জুতার চোরা কুঠুরিতে লুকিয়ে বের হতেন। বাসায় ফিরে তিনি নিজ হাতে প্রতিটি নথির কপি করতেন। পরবর্তীতে কপিকৃত নথি তিনি দুধের পাত্রে লুকিয়ে বাগানে গর্ত খুঁড়ে বা বাড়ির মেঝেতে পুঁতে রাখতেন। এমনকি নিজের স্ত্রীকেও বুঝতে দিতেন না কত বড় ধরনের ঝুঁকি তিনি প্রতিনিয়ত নিচ্ছেন।
১৯৯২ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ঘটে এবং কেজিবি ছেড়ে চলে যাওয়ার ৮ বছর পর, রাশিয়ান আর্কাইভের কর্তাব্যক্তিরা লাটভিয়ায় সিআইএ কর্মকর্তাদের কাছে যান এবং তাদের অনুরোধ করেন মিত্রোখিনকে যেন বাধ্য করা হয় পাচারকৃত সকল তথ্যের খোঁজ দিতে। কিন্তু মিত্রোখিনের সাথে যোগাযোগ করলে তিনি তাদের প্রস্তাব পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করে এমআই-৬ এ যোগ দেন। এমআই-৬ এজেন্টরা মিত্রোখিনকে তার স্ত্রীসহ যুক্তরাজ্যে নিয়ে যান এবং পরবর্তীতে মিত্রোখিনের বাড়ি থেকে কেজিবির লুকোনো নথি খনন করে উদ্ধার করা হয়। কথিত রয়েছে, সকল নথি উদ্ধার করে যুক্তরাজ্যে প্রেরণ করতে ব্যবহৃত হয়েছিলো ৬টি বড়সড় স্যুটকেস। ব্রিটিশরা মিত্রোখিন ও তার স্ত্রীকে পুলিশ সুরক্ষা ও জাল পরিচয়ে যুক্তরাজ্যে আশ্রয় দেয়।
পরবর্তীতে এফবিআই মিত্রোখিনের অবদানকে ‘তৃতীয় উৎস থেকে প্রাপ্ত সর্বাধিক সম্পূর্ণ ও বিস্তৃত বুদ্ধিমত্তার অভিযান’ হিসেবে বর্ণনা করে। বিবিসি যখন মিত্রোখিনের সাক্ষাতকারকালে জিজ্ঞাসা করে, কেন তিনি সমস্ত দলিল কপি করার ঝুঁকিমূলক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, মিত্রোখিন তখন বিবিসিকে ব্যাখ্যা করেন, “আমি অনৈতিক এক রাষ্ট্রযন্ত্রকে নিজের দুর্দান্ত প্রচেষ্টায় কী করা সম্ভব তা দেখাতে চেয়েছিলাম এবং বিবেক ও নীতি ভুলে শাসন শোষণের রাজত্ব কায়েম করলে একজন দেশপ্রেমিক নাগরিক কী করার ক্ষমতা রাখে তার প্রমাণ দিতে চেয়েছিলাম।” ২০০০ সালে ৮১ বছর বয়সে মিত্রোখিন নিউমোনিয়ায় মৃত্যুবরণ করেন।
ওলেগ লায়লিন
ওলেগ লায়লিন গুপ্তচরদের ইতিহাসে দলবদলের জন্য বিশেষভাবে স্মরণীয়। একজন কেজিবি অফিসার হয়েও তিনি ব্রিটেনের সিকিউরিটি সার্ভিস এমআই ফাইভের পক্ষে কাজ করেছিলেন। তার দলবদলের কারণে যুক্তরাজ্যে কর্মরত ১০৫ জন সোভিয়েত কর্মকর্তার পরিচয় ফাঁস হয়ে যায়। তাদের বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগ এনে যুক্তরাজ্য থেকে বহিষ্কার করা হয়।
লায়লিন সোভিয়েত বাণিজ্য প্রতিনিধিদলের কর্মকর্তা হিসেবে ১৯৬০-এর দশকে যুক্তরাজ্যে এসেছিলেন। এর পূর্বে তার জীবন সম্পর্কে তেমন কোনো তথ্য জানা যায়নি। এমআই ফাইভ এজেন্টরা ১৯৭১ সালে লায়লিনকে নিয়োগ দেয় যখন তারা জানতে পারে যে, লায়লিন তার একান্ত সচিব, ইরিনা টেপলাকোভার সাথে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক লিপ্ত, যা প্রকাশ পেলে সোভিয়েত কর্তৃপক্ষ কখনোই দুজনকে ক্ষমা করবে না। এই তথ্য জানার কয়েক মাস পরে, লায়লিনকে মাতাল হয়ে গাড়ি চালনার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়।
সেই রাতে পুলিশ যখন বন্দী লায়লিনকে গাড়িতে উঠাচ্ছিলো তখন লায়লিন কর্তব্যরত অফিসারের কাঁধে পা তুলে চিৎকার করছিলেন, তুমি আমার সাথে কথা বলতে পারবে না, তুমি আমাকে মারতে পারবে না, আমি কেজিবি কর্মকর্তা।
গ্রেপ্তার হবার পর লায়লিন দ্রুত তার এবং ইরিনার প্রাণ রক্ষার্থে কেজিবি সম্পর্কে তথ্য প্রকাশ করার প্রস্তাব দেন। এভাবে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী লায়লিন ছিলেন প্রথম কেজিবি গুপ্তচর যিনি পক্ষবদল করেছিলেন। জনপ্রিয় দৈনিক গার্ডিয়ানের মতে, সোভিয়েত কূটনীতিক ও বাণিজ্য কর্মকর্তাদের বৃহত্তর বহিষ্কারের ঘটনা সেটাই প্রথম, যা কোনো পশ্চিমা সরকার মস্কোর বিরুদ্ধে নিতে সক্ষম হয়েছিলো।
পরবর্তীতে লায়লিন এবং ইরিনা তাদের পরিচয় পরিবর্তন করে বিয়ে করলেও সেই সম্পর্ক বেশিদিন টিকেনি। ১৯৯৫ সালে, দীর্ঘ অসুস্থতার সাথে লড়াইয়ের পর ৫৭ বছর বয়সে লায়লিন মারা যান। লায়লিন মারা যাওয়ার সময় কোথায় ছিলেন বা কী ধরনের অসুস্থতায় তিনি মারা যান সে সম্পর্কে সুস্পষ্ট কোনো তথ্য জানতে পারা যায়নি। নিউ ইয়র্ক টাইমসের সূত্রানুসারে, উত্তর ইংল্যান্ডের কোনো এক অজ্ঞাত স্থানে তার সমাধি রয়েছে।