বিতর্ক বা উপস্থিত বক্তব্যের মতো বিষয়গুলোর তুলনায় মডেল ইউনাইটেড নেশনস বা MUN বা ছায়া জাতিসংঘ শব্দটির সাথে হয়তো আমাদের সবাই খুব বেশি পরিচিত নয়। অনেকে হয়তো বা পরিচিত, তবে যারা এ শব্দটির সাথে পরিচিত, তাদের অনেকেই আবার পরিষ্কার-বিশদ ধারণা রাখেন না এ ব্যাপারে।
মডেল ইউনাইটেড নেশন কী, কেমন করে পরিচালিত হয়- ছায়া জাতিসংঘ সম্পর্কিত এমন সকল প্রশ্নের উত্তর নিয়েই আজকের এ আয়োজন।
মডেল ইউনাইটেড নেশন হচ্ছে মূলত জাতিসংঘের একটি কার্যকরী প্রতিরূপ। জাতিসংঘে যেভাবে বিভিন্ন বিশেষায়িত কমিটিতে বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা নির্দিষ্ট কিছু কার্যাবলি নিয়ে আলোচনা করেন, মডেল ইউনাইটেড নেশনেও তাই। ছায়া জাতিসংঘকে মূল জাতিসংঘের মাস্টার কপি বলা চলে। অর্থাৎ এখানে প্রতিযোগিরা বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরূপে বিভিন্ন এজেন্ডায় দুই, তিন, এমনকি চারদিনব্যাপী আয়োজনে অংশ নেয়।
যা-ই হোক, এবারে ছায়া জাতিসংঘের মূল পদ্ধতিগত নিয়মকানুনে আসা যাক। বিভিন্ন ধরনের ছায়া জাতিসংঘে নির্দিষ্ট পরিমাণ কমিটি ও সে সকল কমিটির সদস্য রাষ্ট্রগুলোর ডেলিগেট হওয়ার সুযোগ থাকে। ডেলিগেট বলা হয় সে সকল প্রতিযোগীদের, যারা ছায়া জাতিসংঘে একেকটি দেশকে প্রতিনিধিত্ব করে থাকেন।
প্রতিযোগিতা শুরু হওয়ার বেশ কিছুদিন পূর্বেই প্রতিযোগীদের নিজস্ব পছন্দ ও খালি থাকা সাপেক্ষে তাদের প্রত্যেকের জন্য একটি করে নির্দিষ্ট দেশ ও কমিটি বরাদ্দ করা হয়। মাঝের এ কয়দিন সময়ে তারা প্রদত্ত এজেন্ডার উপর তার কমিটি ও দেশ নিয়ে বিস্তারিত গবেষণা ও তথ্য সংগ্রহের সুযোগ পান।
মূল ছায়া জাতিসংঘ প্রতিযোগিতা শুরুর পূর্বেই প্রতিযোগীদের আরো কিছু কাজ করতে হয়। যার মাঝে একটি হচ্ছে ‘পজিশন পেপার‘ সাবমিশন। পজিশন পেপার বলতে বোঝায় উক্ত রাষ্ট্রের কূটনৈতিক অবস্থানের লিখিত রূপ।
একজন প্রতিযোগী তার কমিটির জন্যে নির্ধারিত এজেন্ডা নিয়ে একটি নির্দিষ্ট ফরম্যাটে পজিশন পেপার লিখে তা পূর্বেই জমা দিয়ে দেন। ছায়া জাতিসংঘ প্রতিযোগিতার মূল কার্যক্রম শুরু হয় সকল কমিটির ডেলিগেটদের নিয়ে ‘প্ল্যানারি অধিবেশন’ এর মাধ্যমে। প্ল্যানারি অধিবেশনে অতিথিদের বক্তব্য প্রদানের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিযোগিতা পর্ব শুরু করা হয়।
প্ল্যানারি শেষে সকল ডেলিগেট নিজ নিজ কমিটি সেশনে চলে যান। একজন চেয়ারপার্সন, একজন ভাইস চেয়ারপার্সন ও ডিরেক্টরের সমন্বয়ে গঠিত ‘এক্সিকিউটিভ বডি’র নিয়ন্ত্রণে শুরু হয় কমিটিগুলোর অধিবেশন। তবে ক্ষেত্রবিশেষে এক্সিকিউটিভ বডি মেম্বারদের সংখ্যা কম বা বেশি হতে পারে।
কমিটির অধিবেশনে প্রদত্ত এজেন্ডার উপর বিভিন্ন ডেলিগেটের দ্বারা মোশন উত্থাপিত হয়। সর্বোচ্চ ভোটে বিজয়ী মোশনের ওপর নির্দিষ্ট সময়জুড়ে আলোচনার সুযোগ প্রদান করা হয় ডেলিগেটদেরকে। তিন-চারদিন জুড়ে চলে এ ধরনের সেশন।
এবার আরেকটু ভেতরে প্রবেশ করা যায়, জেনে আসা যাক, কমিটি সেশনে মূলত কী কী হয়।
জেনারেল স্পিকার লিস্ট (GSL)
জেনারেল স্পিকার লিস্ট বলতে বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিত্বকারী প্রতিযোগী ডেলিগেটরা নিজের নাম চেয়ারপার্সনের কাছে নিবন্ধনপূর্বক নির্দিষ্ট সময়ের জন্যে বক্তব্য প্রদানের অনুমতি পাবেন।
সাধারণত কমিটি সেশনের শুরুতেই চেয়ারপার্সন জেনারেল স্পিকার লিস্ট ওপেন করেন এবং জিএসএলে ফ্লোর নিতে আগ্রহী ডেলিগেটদেরকে তাদের প্ল্যাকার্ড তুলে ধরতে বলেন। আগ্রহীদের নাম লিস্টেড হওয়ার পরে একজন একজন করে ডেলিগেট আলোচ্য এজেন্ডার উপর তার দেশের অবস্থান, গৃহীত পদক্ষেপ বা মতামত ইত্যাদি তুলে ধরেন।
মডারেটেড ককাস (Mod)
জেনারেল স্পিকার লিস্টের বক্তব্য শেষে বা সবার বক্তব্য শেষ হওয়ার পূর্বে কোনো এক সময় জিএসএল স্থগিত রেখে কমিটির চেয়ারপার্সন মডারেটেড ককাস এর জন্যে প্রস্তাব তুলতে কমিটির ডেলিগেটদের প্রতি আহ্বান জানান।
মডারেটেড ককাসে মূলত এজেন্ডার উপর নির্ভর করে আলোচনা করার জন্যে বিভিন্ন প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়। একাধিক ডেলিগেট কর্তৃক প্রস্তাবনা উত্থাপিত হলে ভোটাভুটির মাধ্যমে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটপ্রাপ্ত প্রস্তাবটি মডারেটেড ককাসের আলোচ্য বিষয় হিসেবে নির্ধারিত হয়।
তবে এ ভোটের ক্ষেত্রে কিছু নিয়ম অনুসরণ করা হয়ে থাকে। একজন ডেলিগেট যখন কোনো একটি প্রস্তাবনা উত্থাপন করেন, তখন তাকে একইসাথে মডারেটেড ককাসটি কত সময় দীর্ঘ হবে এবং প্রত্যেক ডেলিগেট বক্তব্য প্রদানের জন্যে কতক্ষণ করে সময় পাবে- তা উল্লেখ করে দিতে হয়। একাধিক প্রস্তাবনা উত্থাপন সাপেক্ষে যে প্রস্তাবটি সবচেয়ে কম সময়-দৈর্ঘ্যের জন্যে উত্থাপিত হয়, সেটির জন্যে আগে ভোট হয়ে থাকে।
একটি উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছি। ধরে নিন, একটি কমিটির দুজন ডেলিগেট আলাদা দুটি প্রস্তাবনা বা দুজনই একই প্রস্তাবনা উত্থাপন করলো, যেখানে একজন ডেলিগেট মডারেটেড ককাসের জন্যে ১৫ মিনিট সময় ও দ্বিতীয় ডেলিগেট ২০ মিনিট সময় চাইলো। সেক্ষেত্রে ভোটের জন্যে প্রথমে ১৫ মিনিট মডের প্রস্তাবটি উত্থাপিত হবে। তবে তা সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট না পাওয়া সাপেক্ষে দ্বিতীয় প্রস্তাবনাটির উপর ভোট করা হবে।
আনমডারেটেড ককাস (Unmod)
মডারেটেড ককাসে এজেন্ডা ভিত্তিক বিভিন্ন সমস্যার কারন, সম্ভাব্য সমাধান ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করা হয়ে থাকে। মডের পর সাধারণত আনমড সেশনের জন্যে প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়। এ সময়টাতে স্বাভাবিক কমিটি সেশন বন্ধ থাকে। ডেলিগেটরা এ সময়টায় নিজেদের মাঝে আলোচনা ও নেগোসিয়েশনের মাধ্যমে এজেন্ডার উপর প্রতিনিধিত্ব করা দেশের রাষ্ট্রনীতির উপর ভিত্তি করে সমমনা দেশগুলো একসাথে বিভিন্ন ব্লক (Block) তৈরি করে। যে কারণে আনমডারেটেড ককাসকে Lobbying Session -ও বলা হয়ে থাকে। মড সেশনের মতোই আনমড সাধারণত দশ-পনেরো মিনিটের মতো দীর্ঘস্থায়ী হয়ে থাকে।
ওয়ার্কিং পেপার
মড ও আনমড সেশনগুলো শেষে বিভিন্ন ব্লক তাদের নিজেদের সমাধানগুলোর একটি খসড়া লিস্ট তৈরি করে তা উপস্থাপন করেন। এ লিস্টকে ওয়ার্কিং পেপার বলা হয়ে থাকে। ওয়ার্কিং পেপার প্রেজেন্ট করার সময় ডেলিগেট বা এক্সিকিউটিভ বডি মেম্বারেরা (চেয়ারপার্সন, ভাইস চেয়ারপার্সন, ডিরেক্টর) বিভিন্ন প্রশ্ন তুলতে পারেন বা বিভিন্ন সংশোধনীর ব্যাপারে পরামর্শ দিতে পারেন।
ড্রাফট রেজ্যুলিউশন
Draft Resolution হচ্ছে একটি কমিটির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তিনদিন বা চারদিনের কমিটির যাবতীয় আলোচনা, বিশ্লেষণ, বিতর্কের ফলাফল আনুষ্ঠানিকভাবে রূপ পায় ড্রাফট রেজ্যুলিউশন পাশ হওয়ার মাধ্যমে।
সাধারণত বিভিন্ন ব্লকগুলো আলাদা আলাদা কিংবা সবাই মিলে একটি ড্রাফট রেজ্যুলিউশন তৈরি করে থাকে। ড্রাফট রেজ্যুলিউশন পাশ করানোর জন্যে ভোট শুরু করার পূর্বে অবশ্য আরো কিছু কাজ করে নিতে হয়।
শুরুতে নির্ধারণ করা হয় স্পন্সর ও সিগনেটরি বা স্বাক্ষরকারী দেশগুলোকে। ড্রাফট রেজ্যুলিউশনের সবগুলো পয়েন্টের সাথে যেসকল দেশ একমত থাকবে, শুধুমাত্র তারাই স্পন্সর কান্ট্রির ডেলিগেট হতে পারবে। অর্থাৎ, ড্রাফট রেজ্যুলিউশনের কোনো একটি ধারা বা উপধারার সাথে যদি কোনো দেশের রাষ্ট্রনীতিগত অবস্থান সাংঘর্ষিক হয়, তবে তারা স্পন্সর হতে পারবে না।
অপরদিকে, যেসকল দেশের ডেলিগেটরা ন্যূনতম একটি পয়েন্টের সাথেও সহমত পোষণ করে, তারা সিগনেটরি কান্ট্রি হিসেবে ড্রাফট রেজ্যুলিউশনে নিজের নাম যোগ করতে পারবে।
ড্রাফট রেজ্যুলিউশনে উত্থাপন করার পর অন্য সকল ডেলিগেট বিভিন্ন অ্যামেন্ডমেন্টের জন্যে আবেদন করতে পারেন। প্রচলিতভাবে অ্যামেন্ডমেন্ট মূলত তিন প্রকার: Addition, Deletion ও Modification। কোনো ডেলিগেট কর্তৃক উত্থাপিত অ্যামেন্ডমেন্ট যদি স্পন্সর দেশগুলো কর্তৃক গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হয়, তবে তা ফ্রেন্ডলি অ্যামেন্ডমেন্ট হিসেবে গণ্য করা হয়।
কিন্তু কোনো কারণে যদি স্পন্সর দেশগুলোর ডেলিগেটরা উত্থাপিত অ্যামেন্ডমেন্টকে গ্রহণ না করে, তবে কমিটির চেয়ারপার্সন উক্ত অ্যামেন্ডমেন্টের পক্ষে-বিপক্ষে ভোট করেন। কমিটির উপস্থিত সদস্যদের দুই-তৃতীয়াংশের ভোট সাপেক্ষে অ্যামেন্ডমেন্ট গৃহীত হয়।
অ্যামেন্ডমেন্ট উত্থাপন শেষে এবার শুরু হয় কমিটি সেশনের সর্বশেষ কার্যক্রম, ভোটিং ফর ড্রাফট রেজ্যুলেশন।
উপস্থিত ডেলিগেটদের মাঝে সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোট ব্যতিরেকে ড্রাফট রেজ্যুলিউশন পাশ হয় না। কোনো একটি কমিটিতে যদি একটিও ড্রাফট রেজ্যুলিউশন পাশ না হয়, তবে সে কমিটি ফেইল করেছে বলে গণ্য করা হয়। পাশ করা ড্রাফট রেজ্যুলিউশনকে শুধু রেজ্যুলিউশন হিসেবে পরবর্তীতে ক্লোজিং প্ল্যানারিতে কমিটি চেয়ারপার্সন উপস্থাপন করে থাকেন।
মোটামুটিভাবে এই ছিল কমিটি সেশনের সকল কার্যক্রম। কয়েক দিনব্যাপী পরিচালিত কমিটি সেশনে অংশগ্রহণকারী ডেলিগেটদের কার্যক্রম, অবদান, কমিউনিকেশন ও নেগোসিয়েশন স্কিল, পজিশন পেপার ইত্যাদির উপর ভিত্তি করে প্রতি কমিটিতে সাধারণত চারটি পুরষ্কার দেয়া হয়ে। পুরষ্কারগুলো হচ্ছে যথাক্রমে বেস্ট ডেলিগেট অ্যাওয়ার্ড, আউটস্ট্যান্ডিং ডেলিগেট অ্যাওয়ার্ড, স্পেশাল মেনশন অ্যাওয়ার্ড ও বেস্ট পজিশন পেপার অ্যাওয়ার্ড।
জাতিসংঘের কার্যাবলি, কার্যপদ্ধতি ইত্যাদির সাথে পরিচিত করার জন্যেই মূলত ছায়া জাতিসংঘের ধারণাটি এসেছে। বর্তমান সময়ে ধীরে ধীরে এর জনপ্রিয়তাও বাড়ছে। সহশিক্ষামূলক কার্যক্রম হিসেবে চাইলেই কিন্তু দুই-একটি MUN এর অভিজ্ঞতা নিয়ে নেওয়াই যায়। তাছাড়া, অ্যাওয়ার্ড পেয়ে গেলে তো একদম সোনায় সোহাগা!