পৃথিবীর অনেক দেশেরই একটি সাধারণ সমস্যা হচ্ছে ‘মাদক’। পৃথিবীর সব দেশেই নাগরিকেরা মাদক গ্রহণ করেন। তবে কিছু দেশে মাদক গ্রহণের পরিমাণ এত বেশি যে, সেই দেশগুলোর বিভিন্ন সামাজিক সমস্যার পেছনের মূল কারণ হিসেবে দায়ী করা হয় অত্যধিক মাদক গ্রহণকে। সাধারণত একজন মানুষ ব্যক্তিজীবনের বিভিন্ন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সাময়িক সন্তুষ্টি লাভের আশায় মাদক গ্রহণ করেন, এবং একপর্যায়ে এই মাদকের নেশায় পুরোপুরি আচ্ছন্ন হয়ে পড়েন। রাষ্ট্রের বিভিন্ন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে প্রয়োজন হয় কর্মক্ষম জনশক্তির। কিন্তু কর্মক্ষম জনশক্তি যদি মাদকের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকে, তাহলে রাষ্ট্র উন্নয়নমূলক কার্যক্রম পরিচালনার প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহে ব্যর্থ হয়৷ এভাবেই একটি রাষ্ট্রের উন্নতি থমকে দাঁড়াতে পারে। এজন্য পৃথিবীর প্রতিটি দেশেরই সরকার সতর্ক থাকে যেন মাদক সেই দেশের সমাজকে একেবারে গ্রাস করে ফেলতে না পারে।
লাতিন আমেরিকার অনেকগুলো দেশেরই অন্যতম প্রধান সমস্যা হচ্ছে মাদক। এই মহাদেশেরই একটি দেশ কলম্বিয়া কোকেইনের সবচেয়ে বড় উৎপাদক। সম্প্রতি পেরু কোকা গাছ উৎপাদনের দিক থেকে কলম্বিয়াকে টপকে গেলেও প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে কোকা গাছ উৎপাদনে শীর্ষস্থান ধরে রেখেছিল লাতিন আমেরিকার এই সম্ভাবনাময় দেশ।
মূলত গত শতাব্দীর ষাটের দশকে পৃথিবীব্যাপী এই মাদকের বিশাল চাহিদা তৈরি হয়। কলম্বিয়ার কৃষকরা এই বৈশ্বিক চাহিদার সাথে তাল মেলাতে গিয়ে ব্যাপক হারে কোকা গাছ চাষ শুরু করেন। সেই থেকে এখনও কলম্বিয়ায় কোকেইন উৎপাদন চলছে। কলম্বিয়ায় উৎপাদিত কোকেইনের সবচেয়ে বড় বাজার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। দেখা গিয়েছে, কলম্বিয়ায় কোনো প্রান্তিক চাষীর স্থানীয় ল্যাবরেটরিতে তৈরি করা কোকেইন পাউডার যেখানে মাদক ব্যবসায়ীরা প্রতি কেজি মাত্র ১,৫০০ ডলার দরে কিনছেন, সেই কোকেইন পাউডার আমেরিকায় গিয়ে বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৫০,০০০ ডলার দরে! কলম্বিয়ার মাদক ব্যবসায়ীরা স্বাভাবিকভাবেই বিশাল অর্থ আয়ের এই সুযোগ হাতছাড়া করছেন না।
কলম্বিয়ার যে সমস্যা, সেটির কারণে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে আমেরিকা কিংবা ইউরোপের দেশগুলোও। কারণ, নানা উপায়ে এই কোকেইন পাচার হয়ে আসছে এই দেশগুলোতে। এজন্য অন্যান্য দেশের মতো কলম্বিয়াতেও যখন ‘ওয়ার অ্যাগেইন্সট ড্রাগ’ এর ফলশ্রুতিতে ‘ওয়ার অ্যাগেইন্সট কোকেইন’ শুরু হয়, তখন ইউরোপের দেশগুলো ও আমেরিকার পক্ষ থেকে আর্থিক, সামরিক এবং কৌশলগত সহায়তা প্রদান করা হয়েছে।
উদাহরণ হিসেবে ‘প্ল্যান কলম্বিয়া’র কথা বলা যায়। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের সময় এই পরিকল্পনার আওতায় দেশটির ড্রাগ কার্টেল এবং বামপন্থী সশস্ত্র আন্দোলনগুলো দমিয়ে রাখার জন্য এই পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়। বর্তমানে এসব পরিকল্পনার ফলে দেশটিতে কোকেইনের উৎপাদন আগের তুলনায় কিছুটা কমিয়ে আনা সম্ভব হলেও একেবারে থামানো সম্ভব হয়নি। উল্টো, পর্যাপ্ত সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অভাবে বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, সামনের দিনগুলোতে কলম্বিয়ায় আবারও কোকেইনের উৎপাদন উদ্বেগজনক হারে বেড়ে যেতে পারে।
কোকা গাছ মূলত উৎপাদন করা হয় কলম্বিয়ার শহরাঞ্চল থেকে দূরে, জঙ্গলের ভেতরে। জঙ্গল পরিষ্কার করে কোকা গাছ চাষের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করা হয়। সেখানকার গ্রামীণ সমাজে অসংখ্য পরিবার কোকা গাছ চাষের মাধ্যমেই জীবিকা নির্বাহ করে। তবে কলম্বিয়ার নারকোটিক পুলিশের জন্য তারা গাছের চারা রোপণের পর অতটা স্বস্তিতে থাকতে পারেন না।
দেশটির নারকোটিক পুলিশের মূল কাজ কোকা গাছ ধ্বংস করা। এই গাছ নিধনের ক্ষেত্রে তারা অভিনব কৌশল অবলম্বন করেন। প্রথমে ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের কাছ থেকে তারা জেনে নেয় সম্ভাব্য কোন কোন জায়গায় কোকা ফার্ম থাকতে পারে। এরপর নারকোটিক পুলিশের সদস্যরা হেলিকপ্টারে করে সেসব জায়গায় অবতরণ করে খুঁজতে শুরু করেন কোকা গাছ আছে কিনা। যদি গাছ পান, তাহলে সেগুলো মূলোৎপাটন করেন, এবং সাথে যদি শুকনো কোকা পাতা পাওয়া যায়, সেক্ষেত্রে সবগুলো একত্র করে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। এছাড়া কোকা গাছ চাষের জন্য যেসব সামগ্রী উপস্থিত থাকে, সেগুলোও ধ্বংস করে ফেলা হয়।
এছাড়া আরেকটি উপায় রয়েছে, যার মাধ্যমে কোকা গাছ ধ্বংস করা হতো। কলম্বিয়ার নারকোটিক পুলিশ বিমানে করে কোকা ফার্মের উপরে গাছ নিধন করার কীটনাশক ছিটিয়ে দিত। এভাবে অসংখ্য কোকা ফার্ম ধ্বংস করে ফেলা হয়েছিল। কিন্তু এই পদ্ধতির ক্ষতিকর দিকও ছিল অনেক।
দেখা যাচ্ছিল, উড়ন্ত বিমান থেকে কীটনাশক ছিটিয়ে কোকা গাছ নষ্ট করার এই পদ্ধতির জন্য অনেক সময় বৈধ ও প্রয়োজনীয় ফসলও নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল৷ শুধু ফসলই নয়, যেসব জায়গায় কোকা গাছ চাষ করা হতো, তার আশেপাশের রেইন ফরেস্টও এই কীটনাশকের কবলে পড়ে ধ্বংস হয়ে যেতে শুরু করেছিল৷ এটি সেখানকার জীববৈচিত্র্য ও বাস্তুতন্ত্রের জন্য ছিল ভয়াবহ বিপদজনক। এটি কলম্বিয়ার জনগণের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার করে। এছাড়াও আরেকটি ভয়াবহ ক্ষতি হচ্ছিল। গবেষণায় উঠে আসে এই কীটনাশক ছিটানোর কারণে স্থানীয় জনগণের দেহে ক্যান্সারের হার বেড়ে যাচ্ছে৷ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও জাতিসংঘের প্রতিবেদনেও এই তথ্য উঠে আসে। এজন্য ২০১৫ সালে কলম্বিয়া সরকার এই পদ্ধতি থেকে সরে আসে।
২০১৫ সালেই কোকা গাছ চাষ থেকে যেন কলম্বিয়ার চাষীরা মুখ ফিরিয়ে নেয়, সেদিকে উৎসাহিত করার জন্য কলম্বিয়ার সরকার ‘ক্রপ সাবস্টিটিউশন প্রোগ্রাম’ হাতে নেয়। এই পরিকল্পনার মূল বিষয়বস্তু ছিল- যেসব চাষী বিদ্যমান কোকা গাছ উপড়ে ফেলে কোনো বৈধ ফসল চাষ শুরু করবে, তাকে মাসে এক লাখ পেসো (৩২৭ ডলার) দেয়া হবে৷ কিন্তু এই অনুদানেও চাষীরা কোকা বাদ দিয়ে কমলা, আনারস কিংবা আলুর মতো বৈধ ফসল চাষে আগ্রহী নয়।
কারণ হিসেবে দেখা যায়, কলম্বিয়ার পরিবহনব্যবস্থা খুবই বাজে। একজন কৃষকের দেয়া তথ্যানুযায়ী, বাজারে এক কেজি ইয়ুকা (একধরনের ফসল) বিক্রয়ের মাধ্যমে তারা আয় করেন ৪০০০ পেসো, যেখানে এই এক কেজি ইয়ুকা পরিবহনে তাদের খরচ হয় ৩০০০ পেসো। কৃষকেরা বৈধ ফসল চাষের মাধ্যমে যা আয় করেন, তার চেয়ে পণ্য পরিবহন, বীজ ক্রয়, কীটনাশক ইত্যাদির ব্যয় অনেক বেশি। এছাড়াও এসব অঞ্চলে সামগ্রিক নিরাপত্তার তেমন কোনো সংগঠিত ব্যবস্থা নেই, নির্ভরযোগ্য বাজারব্যবস্থা নেই। কেন্দ্রীয় সরকারের কোনো ভূমিকাই সেখানে দেখা যায় না। অর্থাৎ, গ্রামীণ অঞ্চলগুলোতে যদি কোনো কৃষক বৈধ ফসল চাষাবাদ করেন, তবে প্রায় প্রতি বছরই তাকে লোকসানের মুখ দেখতে হবে।
সামগ্রিক দিক থেকে দেখলে মনে হবে, কলম্বিয়ার গ্রামীণ অর্থনীতির প্রতি দেশটির সরকারের আগ্রহের কোনো জায়গা নেই৷ কৃষকদের উৎপাদিত ফসল পরিবহনের জন্য সবচেয়ে মৌলিক প্রয়োজন স্বাভাবিক রাস্তাঘাট ও নির্ভরযোগ্য বাজারব্যবস্থা। এগুলো ঠিকঠাক না থাকলে কৃষকদের স্বাভাবিক চাষাবাদের প্রতি আগ্রহী করা সম্ভব নয়।
কলম্বিয়ার গ্রামীণ সমাজে দুঃখজনকভাবে এই দুটো বিষয় একেবারেই অনুপস্থিত। মূলত এ কারণে গত দশকের শুরুর দিকে কোকা গাছের চাষ কমে আসলেও পরবর্তীতে আবারও ব্যাপকহারে শুরু হয়েছে, নিয়মিত সরকারের নারকোটিক পুলিশের অভিযানের পরও। ফলে ‘ওয়ার অ্যাগেইনস্ট কোকেইন’ এর সফলতা থমকে গিয়েছে আবারও।