স্যামুয়েল লিটল, বিগত শতাব্দীর ভয়ঙ্করতম সিরিয়াল কিলারদের একজন। ৯৩ জন নারীকে খুন করেছে সে। তা প্রায় পঞ্চাশ বছর আগেকার কথা। কিন্তু বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, এই এতগুলো বছর পরও, নিজের ‘শিকার করা’ প্রতিটি নারীর মুখচ্ছবিই আজও তার মানসপটে ভাস্বর।
লিটলের বয়স এখন ৭৮ বছর। সম্প্রতি টেক্সাস জেলে বসে নিজ হাতে খুন করা ১৬ জন নারীর রঙিন ছবি এঁকেছে সে। এবং সেই আঁকায় ফুটে উঠেছে প্রতিটি নারীরই সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিবরণ। তাদের মুখের গড়ন, চোখের রঙ, তারা কোন সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত- কোনো কিছুই বাদ যায়নি। ছবিগুলো এতটাই নিখুঁত যে, ধারণা করা হচ্ছে সেগুলো দিয়ে হয়তো এখনো পুলিশের পক্ষে সম্ভব লিটলের হাতে খুন হওয়া অনেক নাম না জানা নারীর পরিচয় খুঁজে বের করা। তাদের পরিচয় অজানা থাকার কারণ হলো, তাদের বেশিরভাগই ছিল পতিতা কিংবা মাদকাসক্ত। লিটলের আঁকা ছবির মাধ্যমে ইতোমধ্যেই দুটি পুরনো মামলা আবার নতুন করে প্রাণ ফিরে পেয়েছে। ভবিষ্যতে এ সংখ্যা আরো বাড়ার জোর সম্ভাবনা রয়েছে।
তবে কেউ যেন আবার ভাববেন না, লিটল তার শিকারদের সবকিছুই মনে রেখে দিয়ে বসে আছে। যেমন তার শিকারদের নাম কী, কিংবা কখন সে তাদেরকে মেরেছে, এমন ‘অপ্রয়োজনীয়’ তথ্য সে মনে রাখার প্রয়োজন বোধ করেনি।
আর সে যে তার শিকারদের অন্যান্য সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিবরণ মনে রেখেছে, একে একদমই বিস্ময়কর কোনো ঘটনা বলে মনে করছেন না সমাজবিজ্ঞান এবং অপরাধবিজ্ঞানের অধ্যাপক জ্যাক লেভিন, যিনি কয়েক দশক ধরে সিরিয়াল কিলারদের মনস্তত্ত্ব, অভিসন্ধি এবং কাজের ধরন নিয়ে কাজ করছেন।
এ অ্যান্ড ই রিয়েল ক্রাইমের কাছে দেওয়া এক সাম্প্রতিক সাক্ষাৎকারে তিনি ব্যাখ্যা করেছেন, কীভাবে সিরিয়াল কিলাররা তাদের শিকারদের কথা মনে রাখে, এবং কেন এসব সূক্ষ্ম বিবরণ তাদের কাছে এত বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সাক্ষাৎকারে বলা লেভিনের কথার সূত্র ধরেই আমরাও জানার চেষ্টা করব, কী সেই অন্তর্নিহিত কারণসমূহ।
সিরিয়াল কিলাররা শিকারকে কতটা মনে রাখে, কেন মনে রাখে?
সিরিয়াল কিলারদের মনস্তত্ত্ব সাধারণ অপরাধীদের চেয়ে অনেকটাই আলাদা। অধিকাংশ অপরাধীই ঝোঁকের মাথায় কোনো একটি অপরাধ করে ফেলে, এবং পরবর্তীতে সেটি নিয়ে তারা গভীর অনুশোচনা ও অনুতাপে ভোগে। কিন্তু অপরাধবোধে ভোগা তো দূরে থাক, সিরিয়াল কিলারদের কাছে তাদের কৃত অপরাধগুলোই হলো তাদের জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন। সাধারণ মানুষ যেমন তাদের জীবনের শ্রেষ্ঠ অর্জনগুলোর কথা কখনো ভুলতে পারে না, সেই অর্জন সংশ্লিষ্ট প্রাসঙ্গিক সকল তথ্যই মনে রাখে, সিরিয়াল কিলারদের ক্ষেত্রেও সেই একই কথাই প্রযোজ্য।
একজন সিরিয়াল কিলার তার শিকারের সাধারণ বৈশিষ্ট্যসমূহ মনে রাখে, কারণ সে চায় তার অপরাধকর্মটির কথা মনে মনে কল্পনা করতে। সে চায় শিকারকে দেয়া কষ্ট ও যন্ত্রণার কথা স্মরণ করে নিজে মানসিক প্রশান্তি অনুভব করতে। কখন, কোথায় বসে সে অপরাধটি করেছে, তা তার কাছে একদমই গৌণ তথ্য। যেটি তার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তা হলো, অপরাধটি সম্পাদনের আগে তার শিকারকে কেমন দেখাচ্ছিল, এবং অপরাধটি সেরে ফেলার পর শিকারের ভেতর কেমন পরিবর্তন এসেছিল। এবং এ কারণেই, ক্রিকেট ম্যাচ শেষে জয়ী দলের ক্রিকেটাররা যেমন স্মারকস্বরূপ ম্যাচে ব্যবহৃত স্টাম্প কিংবা বল সংগ্রহ করেন, সিরিয়াল কিলাররাও স্মারক হিসেবে তার শিকারের ব্যবহৃত কোনো একটি জিনিস নিজের সংগ্রহের জন্য নিয়ে যায়। পরবর্তীতে যখন তারা এসব স্মারকের দিকে তাকায়, তাদের মনে অদ্ভুত ভালোলাগার সৃষ্টি হয়।
শিকারের মুখ কেন সিরিয়াল কিলারের মনে গেঁথে যায়?
একজন সাধারণ মানুষ কখনোই কয়েক দশক ধরে কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তির মৌখিক অভিব্যক্তি, বৈশিষ্ট্য, গড়ন ইত্যাদি বিশদে মনে রাখবে না। কিন্তু সেটি যদি এমন কোনো ব্যক্তির হয়, যাকে সামনে রেখে সে তার জীবনের সবচেয়ে আনন্দময় মুহূর্তগুলোর একটি কাটিয়েছে, তাহলে তার ব্যাপারে খুঁটিনাটি সবকিছু মনে রাখা অসম্ভব কিছু নয়। ঠিক এ কারণেই সিরিয়াল কিলারদের মনে শিকারদের মুখ গেঁথে যায়।
সিরিয়াল কিলাররা কি তাদের শিকারকে মানুষ বলে মনে করে?
একজন সিরিয়াল কিলার তার শিকারকে পরিপূর্ণ মানুষের পরিবর্তে অর্ধমানব ভাবতেই বেশি পছন্দ করে। বিশেষত সে তার শিকারকে তার চেয়ে নগণ্য বা অধঃস্তন প্রজাতির কোনো জীব বলে মনে করে। তবে সে তার শিকারকে খুব নিম্ন প্রজাতির কেউ বলেও মনে করে না, কারণ তাতে তার শিকারের আত্মপ্রসাদ অনেকাংশেই হ্রাস পাবে। একজন শিকারী বাঘ বা সিংহ শিকার করে যেমন মানসিক শান্তি পায়, সিরিয়াল কিলার কোনো মানুষকে হত্যা করে প্রায় সেই মাত্রার শান্তিই পেয়ে থাকে।
সংরক্ষিত স্মৃতি কি সিরিয়াল কিলারদের মনে অনুশোচনা জাগায়?
না, অধিকাংশ সিরিয়াল কিলারই তার কৃতকর্মের জন্য বিন্দুমাত্র অনুতাপ বোধ করে না। যদিও দুয়েকটি ব্যতিক্রম আছে। অনুতাপ বোধ করতে হলে চাই বিবেক। কিন্তু একজন সিরিয়াল কিলার কখনোই বিবেকবোধসম্পন্ন মানুষ নয়। কারণ বিবেকবোধ থাকলে সে তো কখনো অপরাধ করার কথা চিন্তাও করতো না। বা প্রাথমিক অবস্থাতেই সেই চিন্তাকে নাকচ করে দিতো। তারা সোশিওপ্যাথ বলেই, তাদের মধ্যে কোনো সহানুভূতি কাজ করে না। একজন শিকারের আর্তচিৎকার কিংবা ছটফটানির স্মৃতি তাদের মনে কোনো নেতিবাচক প্রভাব ফেলে না, বরং সেই স্মৃতি তাদেরকে উৎফুল্ল করে থাকে। এভাবে সরাসরি সহানুভূতি না পেলেও, তারা বিপরীত সহানুভূতি পেয়ে থাকে।
সিরিয়াল কিলারদের কি ফটোগ্রাফিক মেমোরি থাকে?
না, একজন সিরিয়াল কিলারের মধ্যে ফটোগ্রাফিক মেমোরি থাকার সম্ভাবনা খুবই কম। তবে সব সিরিয়াল কিলারেরই কিছু না কিছু বিশেষত্ব থাকে। যেমন কোনো একজন সিরিয়াল কিলারের হয়তো বুদ্ধিমত্তা অনেক বেশি, আবার কোনো সিরিয়াল কিলারের স্মরণশক্তি হয়তো স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি। তবে সাধারণ ‘জিনিয়াসদের’ মধ্যে যে প্রবণতা থাকে, তা একজন সিরিয়াল কিলারের মধ্যেও থাকতে পারে। যেমন একজন সিরিয়াল কিলার হয়তো তার প্রতিটি শিকারের মুখাবয়বই মনে রেখেছে, কিন্তু সেই শিকারের নাম কী, তা তার একদমই মনে নেই।
সিরিয়াল কিলারদের সাথে সাধারণ কিলারের পার্থক্য কী?
সবচেয়ে বড় পার্থক্যটা হলো মস্তিষ্কে। বুদ্ধিমত্তায় যেমন সিরিয়াল কিলাররা অনেক এগিয়ে, তেমনই তারা প্রচণ্ড ঠাণ্ডা মাথায় কাজ করতেও সক্ষম। তাই একজন সাধারণ খুনির মতো সে ঝোঁকের মাথায় কোনো কাজ করে বসে না। বরং তার কাজ হয় অনেক সাজানো-গোছানো, সুপরিকল্পিত। তাই অধিকাংশ খুনের মামলায় যেমন ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই খুনিকে ধরে ফেলা যায়, কিংবা অন্তত খুনিকে তা আন্দাজ করা যায়, সিরিয়াল কিলারের করা খুনে তা হয় না। সিরিয়াল কিলাররা খুনের সকল চিহ্নই মুছে দেয়। তাই বেশিরভাগ সিরিয়াল কিলারই পুলিশের হাতে ধরা না পড়ে টানা এত এত খুন করে চলতে পারে।
সিরিয়াল কিলারদের আরেকটি গুণ হলো নিষ্পাপ সেজে থাকা। অধিকাংশ সিরিয়াল কিলারই এত বেশি ধূর্ত হয় যে, সাধারণভাবে তাদেরকে প্রচণ্ড নিষ্পাপ বলে মনে হয়। ফলে কেউ ধারণাও করতে পারে না যে এই লোকটির পক্ষে কোনো ভয়াবহ খুন করা সম্ভব হতে পারে। পাশাপাশি তারা মানুষের দুর্বলতারও খুব ভালো রকম সুযোগই নিতে পারে। তাদের কাছ থেকে তারা সহানুভূতি আদায় করে নিতে পারে। তাই সিরিয়াল কিলাররা সবার শেষ সন্দেহভাজন হিসেবে প্রতিপন্ন হয়।
সিরিয়াল কিলার কেন পুলিশকে সাহায্য করে?
একজন সিরিয়াল কিলার যেহেতু অনেক বুদ্ধিমান হয়ে থাকে, তাই সে খুব ভালো করেই জানে যে তার পক্ষে ছাড়া পাওয়ার আর কোনো সম্ভাবনাই নেই। তাই সে সাধারণ অপরাধীদের মতো নিজের দোষ গোপন করতে মরিয়া হয়ে পড়ে না। বরং খুশি মনে নিজের দোষ স্বীকার করে নিতে প্রস্তুত থাকে। কেননা, যতই সে নিজের দোষের কথা কারো সামনে বর্ণনা করে, তার মনে অপরাধ করার সময়কার সুখস্মৃতি ভেসে ওঠে। সাধারণ মানুষ যেমন নিজের কোনো সুখের কথা অন্যকে বলে আরাম পায়, ঠিক একই রকম আরাম একজন সিরিয়াল কিলার পায় পুলিশ বা অন্য কারো কাছে রসিয়ে রসিয়ে নিজের কৃতকর্মের বর্ণনা দিয়ে।
তাছাড়া আরেকটি বড় কারণ হলো, একজন সিরিয়াল কিলার নিজের কৃতকর্ম নিয়ে এত বেশি গর্বিত থাকে যে, সে সেগুলো আড়াল করার চেষ্টা করে না; বরং চায়, তার অপরাধের কথা প্রচার হোক, এবং সবাই তার অর্জনের কথা জানতে পারুক। অনেক সিরিয়াল কিলার আবার এতটাই আচ্ছন্ন হয়ে যায় যে, যে খুনটা সে করেনি, সেই খুনের দায়ভারও সে নিজের কাঁধে তুলে নিতে চায়। কারণ তখন সে চায়, তার নামে খুনের অভিযোগের সংখ্যা যাতে বাড়ে। শাস্তি যখন অনিবার্য, তখন যত বেশি খুনের দায় নেয়া যায় ততই ভালো, এমনটিই মনে করে একজন সিরিয়াল কিলার।
চমৎকার সব বিষয়ে রোর বাংলায় লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: roar.media/contribute/