বর্তমানে বিশ্বের অন্যতম এবং এশিয়ার সবচেয়ে বড় পরাশক্তি চীন। বিশ্ব মিডিয়ার বড় একটা জায়গা দখল করে রেখেছে এই দেশটি। হরহামেশাই খবরের শিরোনাম হচ্ছে চীনের সামরিক, পররাষ্ট্র, অর্থনীতি কিংবা প্রযুক্তি। বিশ্বজুড়ে চীনারাও নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করার জন্য ব্যাপক পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে তারা বিশ্বের সর্বোচ্চ বিনিয়োগকারী দেশে পরিণত হয়েছে। পাশাপাশি রপ্তানিতেও নিজেদের শীর্ষস্থানে নিয়ে গেছে।
সেই চীন এবার নিজেদের বেসামরিক বিমান খাতে নজর দিয়েছে। যে চীনে এক দশক আগেও অধিকাংশ মানুষের বিমানে ভ্রমণ করার অভিজ্ঞতা ছিল না, সেখানে ভ্রমণের জন্য এখন চীনাদের প্রথম পছন্দ আকাশপথ।
২০১৭ সালে চীনে প্রায় ৫৫১ মিলিয়ন যাত্রী বিমানে ভ্রমণ করেছে। ২০১৮ সালে সেই সংখ্যা ৬০০ মিলিয়ন ছাড়িয়ে গেছে। কিন্তু চীন নয়, অ্যাভিয়েশনের সবচেয়ে বড় বাজারটি হলো যুক্তরাষ্ট্র। সেখানে গত বছর প্রায় এক বিলিয়ন যাত্রী বিমানে ভ্রমণ করেছে। এর মধ্যে ৭৭৮ মিলিয়ন ছিল অভ্যন্তরীণ রুটে।
চীনের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের চলমান বাণিজ্য-দ্বৈরথের কথা তো সবারই জানা। দুই পক্ষই একে অপরকে ছাড়িয়ে যেতে মরিয়া। এ লড়াইয়ে নিজেকে জাহির করবার জন্য দেশজুড়ে শতাধিক বিমানবন্দর নির্মাণ করছে চীন সরকার। তবে শুধুমাত্র যাত্রী পরিবহনই কি এর উদ্দেশ্য? অবশ্যই না, শি চিনপিং সরকারের এ উদ্যোগের পেছনে রয়েছে অন্য আরো কিছু কারণ। চলুন, সেই কারণগুলো সম্পর্কেই জেনে নেওয়া যাক।
সর্ববৃহৎ অ্যাভিয়েশন মার্কেটের দখল নেওয়া
বর্তমানে বিশ্বের সর্ববৃহৎ অ্যাভিয়েশন বাজার যুক্তরাষ্ট্রের। কিন্তু আগামী তিন বছরের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষস্থানটি নিজেদের অধিকারে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে চীন। নিজেদের বাজারকে সম্প্রসারিত করবার জন্য তারা বিশেষভাবে তাদের অভ্যন্তরীণ রুটকে জনপ্রিয় করে তুলতে চাইছে।
চীনে বর্তমানে প্রায় ২৩৫টি বিমানবন্দর রয়েছে। তবে কিছু কিছু বিমানবন্দর আন্তর্জাতিক মানের পরিষেবা দেওয়ার উপযোগী নয়। চীনের রাষ্ট্রীয় গবেষণা বলছে, ২০৩৫ সালের মধ্যে দেশে সন্তোষজনক বিমান সেবা প্রদান করার জন্য ৪৫০টি বিমানবন্দর থাকতে হবে। কেননা সেই সময়ে বিশ্বের মোট বিমান ভ্রমণকারীর এক-চতুর্থাংশ যাত্রী সামলাতে হবে চীনকে। এই বিপুল পরিমাণ যাত্রীদের ভবিষ্যতে ভালো মানের সেবা দেওয়ার জন্য বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যয় করে রানওয়ে ও টার্মিনাল তৈরি করছে চীন।
কোথায় নির্মাণ করা হচ্ছে?
চীন বর্তমানে দেশের এমন কিছু শহরে চোখ ধাঁধানো বিমানবন্দর তৈরি করছে, যার নাম চীন অথবা এশিয়ার বাইরের অনেকে কখনো শোনেননি। চীনের উদ্দেশ্য, ব্যবসা বাণিজ্যের জন্য চীনের প্রতিটি শহরকে বিশ্বের যেকোনো প্রান্তের সাথে সংযুক্ত করা। এর মাধ্যমে আগামীর বিমান পরিষেবাকে যেমন সহজ, তেমনি অর্থনীতিকে আরো বেশি গতিশীল করা সম্ভব।
বর্তমানে আমরা একবিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকে পা দিতে চলেছি। এই সময়ে এসে বিশ্বের প্রায় অধিকাংশ শহর তাদের বিমানবন্দরকে কৃত্রিম সৌন্দর্যের চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে গেছে। কোনো বিমানবন্দরকে দেখে আশ্চর্য হওয়ার সুযোগ আর নেই। কিন্তু চীন বলেই হয়তো সম্ভব। অসম্ভব উদ্ভাবনী ক্ষমতা অধিকারী দেশটি নিজেদের বিমানবন্দর তৈরির ক্ষেত্রেও সৃজনশীলতার পরিচয় দিয়েছে।
চীনের রাজধানী বেইজিংয়ে মাল্টি-বিলিয়ন ডলারের ড্যাক্সিং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর তৈরি করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে নির্মাণ কাজ প্রায় শেষভাগে চলে এসেছে। চারটি রানওয়ে সম্বলিত এই বিমানবন্দরের টার্মিনালের আকার ৯৭টি ফুটবল মাঠের সমান। চলতি বছরের ১৪ মে পরীক্ষামূলক ফ্লাইটও পরিচালনা করা হয়েছে। অনিন্দ্য সুন্দর এই বিমানবন্দরটির নকশা করেছেন প্রয়াত স্থপতি জাহা হাদিদ এবং চীনের বেশ কয়েকজন খ্যাতনামা স্থপতি।
বিশ্বের অর্থনীতিকে পুরোপুরি নিজেদের নিয়ন্ত্রণের নেওয়ার চেষ্টা করছে চীন। আর সেই সাথে বেইজিংকে সারাবিশ্বের রাজধানী হিসেবে গড়ে তুলবার স্বপ্নও দেখে তারা। এজন্য রাজধানী বেইজিংয়ে আরো বেশি সুযোগ-সুবিধা যোগ করার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে।
বেইজিংয়ের বর্তমান প্রধান বিমানবন্দর ক্যাপিটাল ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট গত বছর ১০০ মিলিয়ন যাত্রীকে সেবা প্রদান করেছে। এটি বর্তমানে বিশ্বের দ্বিতীয় ব্যস্ততম বিমানবন্দর। চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে ড্যাক্সলিং এয়ারপোর্ট চালু করা হবে। তখন এটি হবে বেইজিংয়ের প্রধান বিমানবন্দর। তবে ক্যাপিটাল এয়ারপোর্ট বন্ধ করা হবে না। বরং সেখান থেকে এয়ার চায়নার মতো দেশীয় অ্যাভিয়েশন কোম্পানিগুলো ফ্লাইট পরিচালনা করা হবে।
চীনের দুই শতাধিক বিমানবন্দর নির্মাণ পরিকল্পনা যে কাউকে চমকে দেবে। কিন্তু এখনো তারা যুক্তরাষ্ট্রের বেশ পেছনে রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে বিভিন্ন শহর, উপশহর ও কমিউনিটি মিলিয়ে বর্তমানে ৫০০০ পাবলিক বিমানবন্দর রয়েছে। তবে চীন যেসব বিমানবন্দর নির্মাণ করছে, তার প্রত্যেকটি হবে দৈত্যাকার।
নিউইয়র্কে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর রয়েছে তিনটি। লন্ডনে রয়েছে পাঁচটি। সেদিক থেকে পিছিয়ে আছে বেইজিং। এ বছর বেইজিংয়ে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নির্মাণ করা হবে। এছাড়া সাংহাইতে ২০ মিলিয়ন যাত্রীকে সেবা প্রদানে সক্ষম, তৃতীয় আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর তৈরি করা হচ্ছে। গুয়াংজুতে তৈরি করা হচ্ছে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। এই বিমানবন্দরের সক্ষমতা হবে ১৭ মিলিয়ন।
চীনের বেসামরিক বিমান চলাচল অধিদপ্তর বলছে, ২০১৮ সালে চীনের বিমানবন্দরগুলো প্রায় ১.২৬৪ বিলিয়ন যাত্রীকে সেবা প্রদান করেছে, যা তার আগের বছরের তুলনায় ১০.২ শতাংশ বেশি। এছাড়া দেশের ৩৭টি অভ্যন্তরীণ বিমানবন্দর প্রতি বছর ১০ মিলিয়ন যাত্রীকে সেবা প্রদান করছে।
বর্তমানে প্রতি বছর চীনে গড়ে ৮টি করে নতুন বিমানবন্দর চালু করা হচ্ছে। এর মধ্যে কিছু বিমানবন্দরে শুধুমাত্র সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করা হয়েছে। আবার কিছু বিমানবন্দর পুরোপুরি নতুনভাবে তৈরি করা হয়েছে। তবে কয়েক বছর আগে চালু হওয়া অনেক বিমানবন্দরই অত্যাধুনিক বিমানবন্দরের মতো সেবা প্রদানে ব্যর্থ হচ্ছে।
চীনের বিভিন্ন অঞ্চলে জনসংখ্যার তুলনায় বিমানবন্দরের সংখ্যা অপ্রতুল। এই সমস্যাকে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যেই সমাধান করা সম্ভব হবে বলে ধারণা হচ্ছে।
২০২০ সালে চেংদু তিয়ানফু বিমানবন্দরটি চালু করা হবে। এটা হবে এই অঞ্চলের দ্বিতীয় অ্যাভিয়েশন হাব। চেংদু তিয়ানফু বিমানবন্দর চালু হলে সুয়াংলিউ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের উপর থেকে চাপ অনেকাংশেই কমে যাবে। চীনের পশ্চিমাঞ্চলেও নতুন বিমানবন্দর তৈরি করা হচ্ছে।
এই অঞ্চলে জনসংখ্যার পরিমাণ অধিক হলেও বিমান পরিষেবা অপ্রতুল। এই অঞ্চলে নতুন বিমানবন্দর তৈরির ফলে যোগাযোগ ব্যবস্থা ও অর্থনীতির দ্রুত উন্নতি ঘটবে। পাশাপাশি রাজধানী বেইজিং থেকে দূরবর্তী এই অঞ্চলকে নিয়ন্ত্রণ করাও সহজ হবে।
অর্থনীতির নিরাপত্তার জন্য বিমানবন্দর
চীনের অর্থনীতি যে গতিতে ছুটে চলছে, তাতে অনেক বিশেষজ্ঞ এই অর্থনীতিকে লাগামহীন ঘোড়ার সাথে তুলনা করে থাকেন। অনেকে মনে করেন, চীনের এই প্রবৃদ্ধি ক্ষণস্থায়ী হবে। কিন্তু চীনের নতুন বিমানবন্দরগুলো তাদের ধারণাকে ভুল প্রমাণ করতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রকে হটিয়ে চীন শীর্ষ সুপার-পাওয়ার হতে পারবে কিনা, সেটা বলা মুশকিল। তবে যদি কখনো চীনের অর্থনীতি মন্থর হয়, তখন বিমানবন্দরগুলো দেশটিকে অর্থনৈতিক নিরাপত্তা প্রদান করতে পারবে। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে চীনের চলমান বাণিজ্য যুদ্ধের কারণে উভয় দেশই ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে রপ্তানিনির্ভর অর্থনীতিকে নিরাপত্তা প্রদানের জন্য পর্যটনের দিকে নজর দিচ্ছে চীন। কেননা, পর্যটনে কম বিনিয়োগ করেও বিপুল অর্থ আয় করা সম্ভব।
২০৩৫ সালে সারাবিশ্বে পর্যটকের সংখ্যা ৩.৫ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। চীনে সেই হার দাঁড়াবে ১০.৫ এ। আরেক গবেষণায় দেখা গেছে আগামী ১০ বছরে ৫০০ মিলিয়ন মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠীর উদ্ভব হবে। চীনের অর্থনীতি মন্থর হলেও এই মধ্যবিত্তরা চীনের বিমান পরিবহন খাত, তথা অর্থনীতিকে চাঙ্গা রাখবে।
চীন সরকারের বিমানবন্দর নির্মাণের পেছনে আরো একটি বড় কারণ হলো, দেশি পর্যটকদের বিদেশ ভ্রমণে নিরুৎসাহিত করা। এর ফলে দেশের অর্থ দেশে রাখা সম্ভব হবে। তবে অ্যাভিয়েশন খাত নিয়ে যে স্বপ্ন তারা দেখছে, সেই পথে বাধা হতে পারে কর্মী-সংকট। আগামী পাঁচ থেকে দশ বছরের মধ্যে দ্রুতগতিতে অ্যাভিয়েশনের দক্ষ কর্মীরা গণহারে অবসরে যাবেন। তখন বিমান-সেবা প্রদানের জন্য চীনকে হিমশিম খেতে হবে। এর পাশাপাশি পরিবেশ দূষণের ব্যাপারেও দুশ্চিন্তা থেকে যাচ্ছে বিশেষজ্ঞদের।