স্নায়ুযুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়ে প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়ন তৃতীয় বিশ্বের, বিশেষত বৃহত্তর মধ্যপ্রাচ্য ও এশিয়ার, রাষ্ট্রগুলোতে প্রভাব বিস্তারের জন্য ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল। মস্কো প্রথমে গামাল আব্দেল নাসেরের নেতৃত্বাধীন মিসর এবং পরে বা’আস দলের নেতৃত্বাধীন সিরিয়া ও সমাজতান্ত্রিক দক্ষিণ ইয়েমেনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলে। কিন্তু অন্য দেশগুলোতে তাদের প্রচেষ্টা বিশেষ সাফল্য পায়নি। এমনকি ১৯৭৩ সালের আরব-ইসরায়েলি যুদ্ধের পর মিসরও সোভিয়েত বলয়ের বাইরে চলে যায়।
সোভিয়েতরা দক্ষিণ গোলার্ধের রাষ্ট্রগুলো এবং তাদের উপনিবেশবাদ-বিরো
স্বাভাবিকভাবে মস্কো উন্নয়নশীল বিশ্বে নিজেদের প্রাচ্যীয় ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালায়। বস্তুত সোভিয়েত ইউনিয়নের বিশাল ভূখণ্ডের প্রায় ৭৫ শতাংশই ছিল এশিয়ায় অবস্থিত, সেই হিসেবে সোভিয়েত ইউনিয়নকে প্রাচ্যের একটি রাষ্ট্র হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়। সোভিয়েত ইউনিয়ন বিভিন্ন বৈদেশিক কর্মসূচিতে দেশটির এশীয়/
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর বৃহত্তর মধ্যপ্রাচ্য ও এশিয়ার রাষ্ট্রগুলোতে প্রভাব বিস্তারের জন্য মস্কোর পরিকল্পনাগুলো পরিত্যক্ত হয়। ১৯৯০-এর দশকে রাষ্ট্র হিসেবে রাশিয়ার অস্তিত্ব থাকবে কি না সেটা নিয়েই সংশয় ছিল। কিন্তু বর্তমানে ভ্লাদিমির পুতিনের নেতৃত্বে রাশিয়া বিশ্বমঞ্চে পুনরায় আবির্ভূত হওয়ায় ক্রেমলিন আবার রাশিয়ার ‘প্রাচ্যীয়’ পরিচিতির ওপর জোর দিচ্ছে। এরই প্রত্যক্ষ প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে সিরিয়ায়।
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর মস্কো বিপুল পরিমাণ প্রাচ্যীয় ভূখণ্ড ও জনবল হারিয়েছে। দক্ষিণ ককেশাস ও মধ্য এশিয়ার প্রজাতন্ত্রগুলো
২০১৫ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর থেকে রাশিয়া সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে বাশার আল-আসাদের নেতৃত্বাধীন সরকারের পক্ষে সরাসরি যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিল। রুশ বিমানবাহিনী, স্পেৎসনাজ কমান্ডো আর ওয়াগনার গ্রুপ (Wagner Group) মার্সেনারিদের সক্রিয় সহায়তায় সিরীয় সরকারি বাহিনী সিরিয়ার অধিকাংশ ভূখণ্ড দায়েশ, হায়াত তাহরির আল-শাম এবং অন্যান্য মিলিট্যান্ট গ্রুপগুলোর কাছ থেকে পুনর্দখল করে নিতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু দখলকৃত অঞ্চলগুলোতে আইন-শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বজায় রাখা যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরীয় সরকারের জন্য একটি বড় মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। বিশেষত, সিরিয়ার বৃহত্তম শহর এবং যুদ্ধপূর্ব বাণিজ্যিক রাজধানী আলেপ্পোতে (যেটি সিরীয় সরকারি বাহিনী ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে পুনর্দখল করে) নিরাপত্তার অভাব মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছেছিল।
মস্কো এমতাবস্থায় দামাস্কাসের সহায়তায় এগিয়ে আসে। আলেপ্পোসহ অন্যান্য পুনর্দখলকৃত অঞ্চলগুলোর আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য রুশরা সামরিক পুলিশ (Military police) মোতায়েন করে। এই সামরিক পুলিশদের অধিকাংশই এসেছে রুশ ফেডারেশনের ‘প্রাচ্যীয়’ মুসলিম-অধ্যুষি
২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে সিরিয়ায় অবস্থিত রুশ সামরিক স্থাপনাগুলোর নিরাপত্তা রক্ষার জন্য ১ ব্যাটালিয়ন ইঙ্গুশ সৈন্য মোতায়েন করা হয়। সিরিয়ার রাজধানী দামাস্কাসের শান্তি রক্ষায় এবং সেখানে মিলিট্যান্টদের বিরুদ্ধে যুদ্ধেও ইঙ্গুশ সৈন্যরা সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছে। বর্তমানে ইদলিব প্রদেশের যুদ্ধবিরতি বজায় রাখতে তুর্কি সৈন্যদের সঙ্গে যেসব রুশ সামরিক পুলিশ যৌথ টহল দিচ্ছে, তাদেরও একাংশ জাতিগত চেচেন বা ইঙ্গুশ।
প্রশ্ন উঠতেই পারে, মস্কো কেন সিরিয়ায় ‘প্রাচ্যীয়’ মুসলিম সৈন্যদের মোতায়েন করছে? এর কারণ বহুবিধ।
প্রথমত, এর মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যে রাশিয়ার ‘প্রাচ্যীয়’ ভাবমূর্তি দৃঢ় হবে।
দ্বিতীয়ত, চেচেন ও ইঙ্গুশদের অধিকাংশই সুন্নি মুসলিম, আর যেহেতু সিরিয়ার অধিকাংশ মানুষই সুন্নি মুসলিম, তাই রুশ বিশেষজ্ঞদের মতে, একজন জাতিগত রুশ সৈন্যের চেয়ে একজন জাতিগত চেচেন বা ইঙ্গুশ সৈন্য সিরীয় জনসাধারণের সঙ্গে তুলনামূলক সহজভাবে একাত্ম হতে পারবে।
তৃতীয়ত, সিরীয় যুদ্ধ রুশ জনসাধারণের মধ্যে জনপ্রিয় নয়। রুশ সরকারি প্রচারমাধ্যম শুরু থেকেই সিরিয়ায় রুশ সামরিক অভিযানকে ‘মানবিক’ ও ‘সন্ত্রাসবিরোধী
অন্যদিকে, সিরিয়ায় সৈন্য পাঠানোর জন্য এই প্রজাতন্ত্রগুলো
প্রথমত, প্রজাতন্ত্র দুটি রুশ ফেডারেশনের সবচেয়ে দরিদ্র অঞ্চলগুলোর অন্তর্গত। এই অবস্থা কাটিয়ে ওঠার জন্য তাদের রুশ কেন্দ্রীয় সরকারের বিপুল আর্থিক সহায়তা প্রয়োজন (রুশ কেন্দ্রীয় সরকার চেচনিয়ার বাজেটের ৮০ শতাংশের বেশি সরবরাহ করে থাকে)।
দ্বিতীয়ত, এই প্রজাতন্ত্রগুলো থেকে কয়েক হাজার নাগরিক দায়েশ বা অন্যান্য মিলিট্যান্ট গ্রুপগুলোতে যোগদানের জন্য সিরিয়ায় গিয়েছে। চেচেন সরকার এসব পরিবারের অন্য সদস্যদের সিরিয়ায় পাঠাচ্ছে সিরীয় সরকারের পক্ষে যুদ্ধ করতে। একজন চেচেন কমান্ডারের মতে, সন্ত্রাসবাদে জড়িত থাকার কারণে চেচেনরা রুশদের মধ্যে যে সম্মান হারিয়েছে, সেটি পুনরুদ্ধারের জন্য এটি প্রয়োজন।
তৃতীয়ত, ২০১৫ সালে মস্কোয় রুশ বিরোধীদলীয় নেতা বোরিস নেমৎসভের খুনের সঙ্গে চেচেন রাষ্ট্রপ্রধান কাদিরভের জড়িত থাকার অভিযোগ থাকায় মস্কোর নিরাপত্তা প্রধানরা মস্কোর প্রতি কাদিরভের আনুগত্যকে সন্দেহের চোখে দেখছিলেন। এজন্য সিরিয়ায় নিজস্ব সৈন্য প্রেরণ করে মস্কোর কাছে নিজের আনুগত্য ও প্রয়োজনীয়তা প্রমাণ করা কাদিরভের জন্য দরকার হয়ে উঠেছিল। একইভাবে, সেসময় ইঙ্গুশেতিয়ার রাষ্ট্রপ্রধান ইউনুস-বেক ইয়েভকুরভের অভ্যন্তরীণ জনপ্রিয়তা হুমকির মুখে পড়েছিল এবং পার্শ্ববর্তী চেচনিয়ার সঙ্গেও তার দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছিল। তার জন্যও ক্রেমলিনের নেক নজরে থাকা জরুরি হয়ে পড়েছিল। এসব কারণে চেচেন ও ইঙ্গুশ সরকার সিরিয়ায় সৈন্য পাঠাচ্ছে।
রাশিয়ার ‘প্রাচ্যীয়’ ভাবমূর্তি নতুন করে প্রতিষ্ঠার জন্য মস্কো যে কেবল চেচেন আর ইঙ্গুশদের ব্যবহার করছে এমনটা নয়। আফগানিস্তানে রুশ রাষ্ট্রপ্রধানের
বস্তুত, রুশ ফেডারেশনের জাতিগত সংখ্যালঘুদের জন্য সৃষ্ট প্রজাতন্ত্রগুলো
সোভিয়েত শাসনামল থেকে মস্কো বৃহত্তর মধ্যপ্রাচ্যসহ তৃতীয় বিশ্বে প্রভাব বিস্তারের জন্য তাদের ‘প্রাচ্যীয়’, বিশেষত মুসলিম জনগোষ্ঠিকে ব্যবহার করে আসছে। মস্কোর এই উদ্যোগ শেষ পর্যন্ত কতটুকু সাফল্যমণ্ডিত হবে, সেটাই প্রশ্ন।