এয়ারপোর্ট মানেই ব্যস্ততা ও মানুষের ভীড়। বিশ্বের ব্যস্ততম এয়ারপোর্টগুলো তাদের কাজে ধকল সামলানোর পাশাপাশি যাত্রীদের বিনোদনের জন্য কিছু না কিছু করার চেষ্টা করে থাকে। আর নিজেদের এয়ারপোর্টকে একটু ব্যতিক্রমধর্মী করতে চায়। আজকের লেখাটি বিশ্বের এরকমই ১০টি ব্যস্ততম এয়ারপোর্ট এবং তাদের ব্যতিক্রমী কিছু বৈশিষ্ট্য নিয়ে।
১. হার্টসফিল্ড-জ্যাকসন আটলান্টা ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট
বিশ্বের সবচাইতে ব্যস্ত এয়ারপোর্টগুলোর একটি হলো হার্টসফিল্ড-জ্যাকসন আটলান্টা ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট। ২০১২ সালের একটি তথ্য মোতাবেক ঐ বছর এই এয়ারপোর্টটি প্রতিদিন ২,৫০০ বা এরও বেশিবার উড়োজাহাজের উড্ডয়ন ও অবতরণ নিয়ন্ত্রণ করেছিল। এর ফলে দিন প্রতি আড়াই লাখ মানুষের সমাগম ঘটে হার্টসফিল্ডে। বর্তমানে প্রতি বছর গড়ে ১০৪ মিলিয়ন মানুষের সমাগমে মুখরিত হয়ে ওঠে এয়ারপোর্টটি। আরেকটি পরিসংখ্যানে দেখা যায়, এয়ারপোর্টটি মাসে ৫৪,০০০ মেট্রিক টনের কার্গো এবং ৬০,০০০ মেট্রিক টনেরও বেশি পরিমাণ এয়ারলাইনার ও কার্গোর জিনিসপত্র সামলানোর কাজ করে থাকে। ব্যস্ততা ও ভীড় অনেক থাকলেও যাত্রীদের জন্য ঘুরে দেখার মতো জায়গাও রয়েছে। প্রায় ৪০ বছরের সম্পদ, আর্ট ওয়ার্কের সংগ্রহশালা আটলান্টা এয়ারপোর্টটি আটলান্টা শহরের বিশাল একটি চিত্র-প্রদর্শনী বা এক্সিবিশনে পরিণত হয়েছে। এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো শিকাগোর চিত্রকর স্টিভ ওয়ালডেকের ৪৫০ ফুট লম্বা আর্ট ইনস্টলেশন ‘ফ্লাইট পাথস’ যা শহরটির সবচাইতে বড় পাবলিক আর্ট প্রজেক্ট।
২. বেইজিং ক্যাপিটাল ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট
বেইজিং ক্যাপিটাল ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট (বিসিআইএ) ‘চায়না গেটওয়ে‘ নামে পরিচিত। এটি চীনের সবচেয়ে ব্যস্ত এয়ারপোর্ট এবং বছরে এখানে ৯৬ মিলিয়ন মানুষের আগমন ঘটে। আধুনিক সুযোগ-সুবিধায় পরিপূর্ণ এই এয়ারপোর্ট বিশ্বের সাথে চীনের যোগাযোগের ও বিনিময়ের মূল মাধ্যম হিসেবে কাজ করে। বেইজিং এয়ারপোর্টের ভেতরেই রয়েছে ছোটখাট ইমপেরিয়াল গার্ডেন, যেখানে ঘুরে বেড়াতে পারবেন। এখানে মাছকেও খাবার খাওয়াতে পারবেন। আর সেই খাবারের ব্যবস্থা করাই আছে। আপনাকে আলাদা করে কিনতে হবে না। আর এই গার্ডেনে যাত্রীদের বিনোদনের জন্য প্রায় প্রতিদিনই নাচ, গান এবং ম্যাজিক অনুষ্ঠানের ব্যবস্থাও করা হয়।
এত ভীড় ও ব্যস্ত এয়ারপোর্ট হওয়া সত্ত্বেও আনুষ্ঠানিক কাজকর্মের পাশাপাশি আপ্যায়ন ও বিনোদনের ব্যবস্থায় কোনো কার্পণ্য করেনি কর্তৃপক্ষ। তাছাড়া বেইজিং লেওভার ট্যুরস যাত্রীদের এয়ারপোর্টের ভীড়ে পূর্ণ এলাকা থেকে এক ঘণ্টার দূরত্বে অবস্থিত কম ভীড়ের মুতিয়ানু সেকশনে নিয়ে যায়, যেখান থেকে গ্রেট ওয়াল অব চায়না দেখা যায়। সেক্ষেত্রে যারা ৭২ ঘণ্টার জন্য চীনে অবস্থান করে তাদের জন্য ভিসার প্রয়োজনীয়তা মওকুফ করা হয়।
৩. দুবাই ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট
যখন কথা হচ্ছে বিশাল ও ব্যস্ত কোনো জায়গা নিয়ে, তখন দুবাইয়ের নাম আসা খুবই স্বাভাবিক বিষয়। এর সুবাদে ব্যস্ততম এয়ারপোর্টের তালিকাতেও নাম রয়েছে দুবাইয়ের এয়ারপোর্টের, যেখানে বছরে ৮৮ মিলিয়ন দেশি-বিদেশিদের দেখা যায়। বিভিন্ন ধরনের খুচরা জিনিসপত্রের ও দোকানের সম্ভার হলো এই এয়ারপোর্টটি। খেজুর থেকে শুরু করে রোলেক্স ঘড়ি- সবই রয়েছে দুবাই ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে। বিলাসদ্রব্যও কেনা যায় কোনো প্রকার ট্যাক্স না দিয়ে। ‘সিটি অব গোল্ড’ দুবাই থেকে ১৮, ২২ বা ২৪ ক্যারেটের বার স্যুভেনির হিসেবেও অর্ডার দিয়ে বানিয়ে নেওয়া যায়।
এয়ারপোর্ট থেকে ১৫ মিনিটের দূরত্বেই রয়েছে দুবাই শহরের পুরোনো অংশ, যেখানে রয়েছে ঐতিহ্যবাহী সোনা এবং মসলার দোকান। দুবাই ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট যাত্রীদের দুবাইয়ের বিলাসবহুল শপিং মলের অভিজ্ঞতাও দেবে।
৪. টোকিও হানেদা ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট
জাপান বা এর রাজধানী টোকিওর বিষয় উঠলেই সুশি, রামেনের নাম তো এমনেই মনে পড়ে যায়। আর টোকিওর এয়ারপোর্টেও ছোঁয়া পাওয়া যায় জাপানের ঐতিহ্যবাহী খাবারদাবারের। টাটকা মাছের আইটেম কিংবা পুরোনো স্টাইলে তৈরি সুশি- সবই পাওয়া যায় এই এয়ারপোর্টে। এখানে বসেই জাপানের ঐতিহ্যবাহী খাবারের স্বাদ নেওয়া যায়। প্রতি বছর এখানে আসা প্রায় ৮৫ মিলিয়ন যাত্রীর সকলে যে কাঁচা খাবার খেতে অভ্যস্ত না তা ভেবে জাপানের রামেন ও উডন তো থাকেই। বলা বাহুল্য, অন্য ধরনের খাবার তো থাকেই। তবে টোকিও এয়ারপোর্টের ব্যস্ত পরিবেশে ঐতিহ্যবাহী খাবার এতে ভিন্ন মাত্রা যোগ করে যাত্রীদের জন্য। দুঃখের সংবাদ হলো, মূল শহর থেকে এয়ারপোর্টটি দূরে হওয়ায় ফ্লাইটের বিরতিতে শহর থেকে ঘুরে আসা সম্ভব হয় না। টোকিওতে যানজটও থাকে বেশি। তবে নারিতা থেকে ঘুরে আসা সম্ভব, যেখানে রয়েছে একটি বৌদ্ধ মন্দির। মানুষের দৈনিক জীবনযাত্রা দেখার পাশাপাশি ভিন্ন ধাঁচের খাবারের স্বাদও নেওয়া যায় এখানে।
৫. লস অ্যাঞ্জেলস ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট
লস অ্যাঞ্জেলস ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট শুধু যাত্রীদের এক স্থান থেকে অন্য স্থানে আকাশ পথে পৌঁছে দিয়েই ক্ষান্ত থাকেনি। তাদের বিনোদনের আয়োজনেও কোনো অভাব নেই। বিশেষ করে শিশু যাত্রীদের জন্য। এয়ারপোর্টের গ্রেট হলে বাচ্চাদের খেলার জায়গায় রয়েছে ‘ল্যাক্স বিচ‘, যেখানে সার্ফবোর্ড, ফোম ওয়েভ আর ডলফিন সর্বদা প্রস্তুত রয়েছে। আর হঠাৎ করে ফ্যামিলি পিকনিক করতে চাইলে ইঙ্ক স্যাকের স্যান্ডউইচ কিংবা ‘স্প্যানিশ গডফাদার’ নামক বিশেষ স্যান্ডউইচ কিনে বিশেষ আয়োজন করে নিতে পারেন। তাছাড়াও ভালো ভালো ফুড কোর্টের খাবার ও এর সাথে মনোরম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করার সুযোগ তো আছেই। বছরে ৮৪.৫ মিলিয়ন মানুষের আগমনে ভরে ওঠা এই এয়ারপোর্টের নিজস্ব গানও রয়েছে। দুবাই এয়ারপোর্টের মতো এখানেও বিলাসবহুল দোকানের অভাব নেই।
৬. শিকাগো ও’হ্যার ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট
লম্বা সফরের ক্লান্তি দূর করতে ও একটু প্রকৃতির ছোঁয়া আর যোগ ব্যায়ামের ব্যবস্থা করার বুদ্ধিটা নিতান্তই খারাপ নয়। আর এই ব্যবস্থাই করে রেখেছে শিকাগো এয়ারপোর্ট। টার্মিনাল ৩-এ রয়েছে যোগ ব্যায়ামের স্টুডিও এবং এর মেঝে বাঁশ দিয়ে ঢাকা, যা প্রকৃতির নির্মল ছোঁয়া দেয়। তাছাড়া রয়েছে ২৬ ধরনের ফুলের গাছসহ এয়ারপোর্টে প্রতিষ্ঠিত বিশ্বের প্রথম অ্যারোপোনিক গার্ডেন। এর সুবাদে এয়ারপোর্টের রেস্টুরেন্টগুলোর খাবারে ব্যাহৃত হয় সতেজ বেগুনি রঙের পুদিনা, হাবানেরো মরিচ, বিব লেটুস ইত্যাদি। বিশ্বের ব্যস্ততম এয়ারপোর্টগুলোর একটি হলেও সতেজ ও নির্মল পরিবেশ বজায় রাখার চেষ্টায় কোনো কার্পণ্য করেনি এয়ারপোর্টটি। বছরে ৮০ মিলিয়ন যাত্রীর সমাগমে ব্যস্ত থাকে শিকাগো এয়ারপোর্ট।
৭. লন্ডন হিথ্রো এয়ারপোর্ট
বছরে যে এয়ারপোর্টে ৭৮ মিলিয়ন মানুষের সমাগম ঘটে সেখানে স্বভাবতই ব্যস্ততার অভাব থাকার কথা না। এত মানুষের মাঝে দুটো মিনিট আপনমনে কাটানোর সুযোগ পাওয়া তো প্রায় অসম্ভবই। তবে লন্ডন হিথ্রো এয়ারপোর্ট এ থেকে কিছুটা ব্যতিক্রম করতেই বিশ্বাসী। আর সেজন্যই এয়ারপোর্টের টার্মিনাল ৫-এর এক্সপো ফাইন আর্ট গ্যালারিতে রয়েছে ‘কনটেম্পলেটিভ স্পেস’ বা ‘চিন্তা করার জায়গা’। গ্যালারির সাথে সোফিটেল লন্ডন হিথ্রো হোটেলও রয়েছে যেখানে প্রায় সারা বছরই ভাস্কর্য প্রদর্শনীর ব্যবস্থা থাকে। তাছাড়া ব্ল্যাকফ্রিয়ার্স স্টেশন, থেমস নদী, কনটেম্পোরারি আর্টের জন্য বিখ্যাত টেট মডার্নের মতো স্থানও ঘুরে আসা যায় এই এয়ারপোর্ট থেকে।
৮. হংকং ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট
প্রতি বছর ৭৩ মিলিয়ন মানুষের সমাগম ঘটে হংকং ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট। এই এয়ারপোর্টেও শত ব্যস্ততার মাঝে অন্যরকম কিছু দেখার সুযোগ হয়। এয়ারপোর্টের ভেতরেই সুযোগ রয়েছে আইম্যাক্স মুভি দেখার। তা-ও আবার বিশেষ ফোর-ডি ইফেক্টসহ। যেমন- আপনার মনে হতে পারে মুভির স্ক্রিন থেকে মাছ সাঁতার কেটে বের হয়ে আসছে বা সত্যি সত্যি বরফ পড়ছে। এই সুবিধা রয়েছে টার্মিনাল ২-এ। এ টার্মিনালেই আছে একটি আইল্যান্ড লেক, যার কাছেই নাইন হোল গলফ খেলা যায়। টার্মিনাল-১ এ রয়েছে অপটিক্যাল ইল্যুশন আর্টওয়ার্ক। আবার একটি অ্যাভিয়েশন ডিসকাভারি সেন্টার রয়েছে যেখানে ককপিটে কমার্শিয়াল পাইলটের জীবন এবং ফ্লাইট সিম্যুলেটর সম্পর্কে জানা যায়।
৯. সাংহাই পুডং ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট
সাংহাই পুডং ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে সময় কাটানোর জন্য বেশি বিকল্প নেই। এখানে রয়েছে সাধারণ ফুড কোর্ট, দোকান এবং দামী দামী লাউঞ্জ। তবে এয়ারপোর্টের ভেতর সময় নষ্ট না করে ম্যাগলেভের (ম্যাগনেটিক-লেভিটেশন ট্রেন) মাধ্যমে শহরে ঘুরে বেড়ানো যেতে পারে। প্রতি ঘণ্টায় ২৬৭ মাইল পর্যন্ত যেতে পারে এই ট্রেন। ট্রেনটির সর্বশেষ স্পট হলো সাংহাই ম্যাগলেভ মিউজিয়াম, যার অবস্থান লংইয়াং রোড স্টেশনের নিচ তলায়। সেখানে বিজ্ঞান এবং ইতিহাসের মতো বিষয়ভিত্তিক এক্সিবিশন চলতেই থাকে এবং এসব এক্সিবিশনে যাওয়ার জন্য কোনো টাকাও লাগে না। সাবওয়ে দিয়ে ইস্ট নানজিং রোডে গেলে দেখা মিলবে ঐতিহাসিক স্থাপত্য ও আধুনিক দালানকোঠার। হুয়াংপু নদীর ওপরেই এগুলো অবস্থিত। এই নদীতে জাহাজে করে ৩০ মিনিট থেকে ৪ ঘণ্টা পর্যন্ত ঘুরে দেখতে পারবেন। বছরে ৭০ মিলিয়ন মানুষ এই এয়ারপোর্ট থেকে সার্ভিস নেয়।
১০. অ্যারোপোর্ট দ্যো প্যারিস-চার্লস দ্যো গল
বছরে ৬৯ মিলিয়ন যাত্রীর আনাগোনা এই এয়ারপোর্টে। অল্প সময়ের মধ্যে প্যারিসের জীবনব্যবস্থা উপভোগ করতে চাইলে টার্মিনাল ২ একবার ঘুরে আসা যায়। এখানে রয়েছে একটি বহুভাষী পড়ার বৈঠকখানা, যেখানে আপনি কফি এবং আরামকেদারার মজাও নিতে পারবেন। থ্রি-ডি পথ দিয়ে হেঁটে একটি ভার্চুয়াল উইন্ডোর সামনে যাওয়া যায় যেখান থেকে সেই সময়ে আইফেল টাওয়ারের কী অবস্থা তা দেখা যায়। দ্রুতগামী ট্রেনে করে শেতেলেত-লে-হল স্টেশনেও যাওয়া যায়। কনটেম্পোরারি আর্ট মিউজিয়াম সেন্টার পমপিদো, নটর ডেম ক্যাথেড্রাল, সেইন্ট চ্যাপেলও ঘুরে আসা যায় এই অল্প সময়ে।
বিশ্বের চমৎকার, জানা-অজানা সব বিষয় নিয়ে আমাদের সাথে লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: https://roar.media/contribute/