মহামারীর এই ক্রান্তিলগ্নে পৃথিবীজুড়ে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। আমাদের কাজ-কর্ম, জীবনযাপন ও যোগাযোগের ধরন ইত্যাদি বদলে গেছে হুট করেই। ন্যাশনাল পাবলিক রেডিওতে (এনপিআর) এই মহামারী পরবর্তী বিশ্ব কেমন হবে, তা নিয়ে কথা বলার জন্য ইউভাল নোয়াহ হারারিকে ডাকা হয়েছিল। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন লুলু গার্সিয়া। এখানে সেই সাক্ষাৎকারটি অনুবাদ করা হলো।
গার্সিয়া: মহামারী ২০২০ এর পরে পৃথিবীর কী অবস্থা হবে? আমাদের কাজ-কর্ম, জীবনযাপন ও যোগাযোগের ধরন ইত্যাদি বদলে গেছে। মহামারী মোকাবেলায় সরকারের কাছে জনগণের চাওয়া বদলে গেছে। এ নিয়ে আমরা এখন কথা বলব লেখক, ঐতিহাসিক ও দার্শনিক ইউভাল নোয়াহ হারারির সঙ্গে। তিনি এখন আছেন জেরুজালেমের ওদিকে, তার বাসায়। সেখান থেকেই তিনি আমাদের সঙ্গে যোগ দেবেন। তার চিন্তা-ভাবনা নিয়ে কথা বলবেন।
হারারি, আপনাকে স্বাগতম।
ইউভাল নোয়াহ হারারি: হ্যালো! আমারও ভাল লাগছে এসে।
গার্সিয়া: আপনি বলেছেন, এই মহামারীর সময়ে আমরা সবাই একটা বিশাল সামাজিক এক্সপেরিমেন্টের মধ্যে ঢুকে গেছি। আপনি আসলে কী বোঝাতে চেয়েছেন, একটু ব্যাখ্যা করে বলুন।
হারারি: আসলে সবখানেই এক্সপেরিমেন্ট হচ্ছে। যেমন— আমার বিশ্ববিদ্যালয় ওদের সব কোর্স অনলাইনে নিয়ে এসেছে। এই ভাবনাটা কিন্তু নতুন না। আগেও অনেকবার এটা করার কথা ওরা ভেবেছে। কিন্তু করা হয়নি। ফলে, এখন হঠাৎ করে আমরা একটা এক্সপেরিমেন্টের মধ্যে ঢুকে গেছি।
এক্সপেরিমেন্টের মূল প্রশ্ন হলো, একটা গোটা বিশ্ববিদ্যালয়কে অনলাইনে নিয়ে আসলে কী হতে পারে? একইভাবে দেখুন, ইউনিভার্সাল বেসিক ইনকাম নিয়ে বেশ কয়েক বছর ধরে কথা হচ্ছিল। (বেসিক ইনকাম মানে, রাষ্ট্রের নাগরিক কোনো কাজ না করেই, নিঃশর্তভাবে নাগরিক হিসেবে রাষ্ট্র থেকে একটা ভাতা পাবে।) এখন যুক্তরাষ্ট্র সরকার সেটা বাস্তবায়ন করার কথা বলছে। কোটি কোটি মানুষ অফিস বা কারখানায় না গিয়ে ঘরে বসে কাজ করতে শুরু করলে কী হবে? এটাও একটা প্রশ্ন। কিন্তু এখন এটা হচ্ছে।
এই সবগুলোই একেকটা সামাজিক এক্সপেরিমেন্ট। প্রতিটাই বিশাল পরিসরে হচ্ছে। নিশ্চিতভাবেই এরা পৃথিবীকে বদলে দেবে। কিন্তু এর ফলাফল ঠিক কী হবে আমরা জানি না। কারণ, আমাদের সামনে নানা ধরনের বিকল্প উপায় আছে। এর যে কোনোটা আমরা বেছে নিতে পারি। অর্থাৎ, এই মহামারী পৃথিবীর নিয়তি নির্ধারণ করে দেয়নি। তাই, মহামারী থেকে বেরিয়ে পৃথিবী একটা নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতেই গিয়ে পড়বে—এমন কিছু বলার কোনো উপায় নেই।
গার্সিয়া: সমাজে বিশাল সব সমস্যা যে আছে, সেগুলো আমরা আগে থেকেই জানতাম। কিন্তু এত প্রকটভাবে কখনো বিষয়গুলো আমাদের চোখে পড়েনি। এখন পড়ছে। ধনী আর দরিদ্রদের তফাৎ খুব স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে। মহামারীর ফলে তথাকথিত আধুনিক অর্থনীতি যে সমস্যায় পড়েছে, যারা দিন-আনে-দিন খায়- তারা বিশেষ করে এর শিকার হচ্ছে।
হারারি: হ্যাঁ, সেটা ঠিক। সুসংগঠিত যে শ্রমব্যবস্থা আছে, আমার মনে হয় এই দুর্যোগের ফলে এটা পুরোপুরি ভেঙে পড়বে। আবার, এর ফলে আমরা পুরো রীতিটাকে উল্টে ফেলতেও পারি। মানুষ হয়তো দরিদ্রদের সামাজিক নিরাপত্তার ব্যাপারটা বুঝবে। সরকারি অর্থায়নে ‘হেলথ কেয়ার’ ব্যবস্থার গুরুত্ব অনুভব করবে। দুটোর যেকোনোটাই হতে পারে।
আমাদের সামনে এখন বেছে নেয়ার মতো বেশ কিছু বিকল্প আছে। মানুষের এখন এই ব্যাপারটা বোঝা খুব জরুরি। আসলে, আগামী এক-দুই মাসে অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে হবে আমাদের। আমাদের সামনে একটা খুবই সংক্ষিপ্ত কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ আছে। ইতিহাস এখন অনেক দ্রুত মোড় নিচ্ছে। প্রতিমুহূর্তে এই মোড় নেয়ার গতি আরো ত্বরান্বিত হচ্ছে। আগে যেসব আইডিয়ার কথা শুনলেও লোকে পাগল ভাবত, সেরকম আইডিয়া প্রয়োগ করার ব্যাপারে বিভিন্ন দেশের সরকার এখন আগ্রহী হয়ে উঠেছে। এই ঝামেলা শেষ হয়ে গেলে এসব সরকার কিন্তু আবার আগের অবস্থাতেই ফিরে যাবে।
২০২১ সালে যে প্রেসিডেন্ট হবে, তার অবস্থা হবে পার্টি শেষ হওয়ার পরে পার্টিতে আসা আগন্তুকের মতো। এসময় শুধু ময়লা বাসন-কোসন পরিষ্কার করা ছাড়া আর কিছু করার থাকে না। এরকম হওয়ার কারণ আছে। আগামী কয়েক মাস সরকারগুলো ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলার ব্যয় করবে। কাজেই, আমাদের সামনে কী কী উপায় আছে, এটা বোঝাটা অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিদিন কয়জন নতুন আক্রান্ত হচ্ছে, নিউ ইয়র্কে কয়টা ভেন্টিলেটর নতুন আনা হলো- শুধু এসব ছোটখাট বিষয় নিয়ে পড়ে থাকলে চলবে না। বরং রাজনৈতিক দিক থেকে সচেতন হতে হবে। কারণ, দিন শেষে ‘কোন জিনিসটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ’ বা ‘কারা বেশি সাহায্য পাবে’ সিদ্ধান্তগুলো আসলে রাজনৈতিক।
গার্সিয়া: যুক্তরাজ্যের ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসে এ নিয়ে সম্পাদকীয় দেখে আমি তো অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। কারণ, পত্রিকা হিসেবে ওরা তো বেশ রক্ষণশীল। অথচ ওরাই এখব বলছে বেশ কিছু জিনিস সংশোধন করতে হবে। সরকারকে অর্থনীতিতে আরো সক্রিয় হতে হবে। পাবলিক সার্ভিসকে দায় হিসেবে না দেখে বিনিয়োগ হিসেবে মূল্যায়ন করতে হবে। সম্পদের পুনঃবন্টন, আবার আপনি যেমন বললেন- বেসিক ইনকাম, ধনীদের অতিরিক্ত ট্যাক্স ইত্যাদি নিয়েও লিখেছে ওরা। এই মহামারী না আসলে তো ওদের এই বোধোদয় হতো না। এসব দেখে আপনার কী মনে হচ্ছে?
হারারি: আবারও বলি, আমার মনে হয়, এখনকার সময় গণ-মানুষের জন্য বেশ উপযুক্ত। যেসব জিনিসের কথা মানুষ বছরের পর বছর ভেবে এসেছে, চেয়ে এসেছে কিন্তু পায়নি, এখন সেসব দ্রুত বাস্তবায়ন করা সম্ভব। তাছাড়া, বেশিরভাগ দেশের রাজনীতিবিদরা একদম হতভম্ব অবস্থায় আছে। এ ধরনের কোনো কিছুর জন্য ওরা প্রস্তুত ছিল না। এরকম অবস্থায় কী করতে হবে, সেরকম কোনো নির্দেশনা তাদের ড্রয়ারে নেই। সেজন্যই এটা একটা দুর্লভ সুযোগ। এই সুযোগে তাদের চিন্তা-ভাবনা বদলে দেওয়া সম্ভব। তাদেরকে দিয়ে এমন কিছু করানো সম্ভব, যেটা তারা সাধারণ অবস্থায় করত না। এবং অবশ্যই, এর ভাল-মন্দ- দুই দিকই আছে।
গার্সিয়া: আমি বলতে চাচ্ছিলাম, আপনি কী নিয়ে বেশি চিন্তিত? দুর্যোগ মোকাবেলায় সরকারের প্রতিক্রিয়ার কোন ব্যাপারগুলো নিয়ে আমাদের চিন্তিত হওয়া উচিৎ বলে মনে করেন?
হারারি: একটা চিন্তা হলো, স্বৈরতন্ত্র শুরু হয়ে যায় কি না। এরকম জরুরি পরিস্থিতি এসবের জন্য উপযুক্ত সময়, বলা যায়। মানুষ নিজের জীবন নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ে। অর্থনীতি ভেঙে পড়তে থাকে। মানুষ তাই চায় শক্ত হাতে কেউ নেতৃত্ব দিক। এমন কেউ, যে সবকিছু জেনে-বুঝে এই সংকটময় পরিস্থিতিতে সবাইকে দেখে-শুনে রাখতে পারবে। পৃথিবীর কোথাও কোথাও আমরা এটা হতে দেখছি। যেমন—হাঙ্গেরি। আবার, ইসরায়েলেও খানিকটা এরকমই হচ্ছে। মানুষ চাচ্ছে, কেউ সবকিছুর দিকে খেয়াল রাখুক। সবার ওপরে নজরদারী করুক। সাহায্যের এই আর্তির সুযোগ নিয়ে স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। এমনকি গণতান্ত্রিক দেশেও এরকম নজরদারী দেখা যাচ্ছে। জরুরি অবস্থা শেষ হলেও এই নজরদারী কিন্তু শেষ হবে না। থেকে যাবে।
গার্সিয়া: হ্যাঁ, ইসরায়েলে আমরা এটা দেখেছি। যেমন- কোভিড-১৯ এ আক্রান্তদেরকে ওরা যেভাবে শনাক্ত করছে, এ নিয়ে অনেকেই দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছেন।
হারারি: বিষয়টা দুশ্চিন্তার মতোই। বিশেষ করে নজরদারীর কাজটা যখন হেলথ কেয়ার সিস্টেম না করে সিক্রেট সার্ভিস করছে। আমি যে নজরদারীর বিপক্ষে, তা কিন্তু না। কিন্তু কাজটা কে করছে এবং তথ্যগুলো কার কাছে যাচ্ছে, সেটা গুরুত্বপূর্ণ। আরো বড় কথা, এটা দুই দিকেই হচ্ছে কি না। মানে, নজরদারী কিন্তু দ্বিপাক্ষিক হতে পারে। সরকারই যে শুধু জনগণের ওপরে নজরদারী করবে, তা না। জনগণও সরকারের ওপরে নজরদারী করতে পারে। কিন্তু সরকার যখন প্রচুর পরিমাণে ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ করতে থাকে, আর নিজেদের সিদ্ধান্ত নেয়ার প্রক্রিয়ার সবটুকু গোপন রয়ে যায়, তখন আমার দুশ্চিন্তা হয়। এরকম সময় সরকারের সংসদ, জনগণ ও সংবাদমাধ্যমের কড়া নজরদারীতে থাকা জরুরি। আর, তারা চাইলেই যা খুশি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলতে পারবে, ব্যাপারটা মোটেও এমন না।
আলাদা আলাদাভাবে রাষ্ট্রীয় পর্যায়েই এটা দুশ্চিন্তার বিষয়। তার ওপরে, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কী হচ্ছে, সেটা নিয়েও তো দুশ্চিন্তা। কারণ, এখন পর্যন্ত পৃথিবীকে নেতৃত্ব দেয়ার মতো কাউকে পাইনি আমরা। মনে হচ্ছে যেন, ঘরে প্রাপ্তবয়স্ক একজন মানুষও নেই। স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সমস্যা বা অর্থনৈতিক দুর্যোগ মোকাবেলার জন্য এখন পর্যন্ত কোনো বৈশ্বিক পরিকল্পনা করা হয়নি। আর, এখনো তো সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি আসেইনি। মহামারী আর অর্থনৈতিক দুর্যোগ যখন মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকা, আফ্রিকা এবং মধ্যপ্রাচ্যের উন্নয়নশীল দেশগুলোর ওপরে ভয়ংকর আঘাত হানবে, তখন গিয়ে সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতির সূচনা হবে। যুক্তরাষ্ট্রের নাহয় ২ ট্রিলিয়ন ডলারের প্রণোদনা ও ত্রাণ প্যাকেজ আছে। কিন্তু ইকুয়েডর, মিশর বা বাংলাদেশের তো নেই। তাই প্রশ্ন হলো, স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সমস্যা বা অর্থনৈতিক দুর্যোগ মোকাবেলার জন্য কোনো বৈশ্বিক পরিকল্পনা আমরা আদৌ পাব কি না। পেলেও সেটা কখন পাব?
গার্সিয়া: হ্যাঁ, এরকম অনেক প্রশ্নের জবাব এখনও আমরা পাইনি। প্রিয় শ্রোতা, এতক্ষণ আমাদের সাথে ছিলে ইউভাল নোয়াহ হারারি। তিনি ‘স্যাপিয়েন্স: আ ব্রিফ হিস্ট্রি অফ হিউম্যানকাইন্ড’ এবং ‘২১ লেসন ফর দ্য টুয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরি’ বইয়ের লেখক। হারারি, আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
হারারি: আপনাকে ধন্যবাদ।