গত ৯ এপ্রিল সোমবার গভীর রাতে সিরিয়ার একটি বিমান ঘাঁটিতে হামলা করেছে ইসরায়েল। রাত ৩টা ৩৫ মিনিট থেকে ৩টা ৪৫ মিনিট সময়ের মধ্যে ইসরায়েলি এফ-১৫ বিমান থেকে সিরিয়ার হোমস শহরে অবস্থিত টি-৪ বিমান ঘাঁটি লক্ষ্য করে মোট আটটি মিসাইল নিক্ষেপ করা হয়। এর মধ্যে সিরিয়ার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা পাঁচটি মিসাইল আকাশে থাকা অবস্থাতেই ধ্বংস করে দিতে সক্ষম হয়। বাকি তিনটি মিসাইল ঘাঁটির পশ্চিম অংশ আঘাত করে। হামলায় মোট ১৪ জন নিহত হয়েছে, যাদের মধ্যে ৪ জন ইরানী।
বিমান হামলার পর সিরিয়ার পক্ষ থেকে প্রথমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে দায়ী করা হয়েছিল। কারণ, হামলাটি ঘটেছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সিরিয়ার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকির মাত্র একদিন পরেই। ট্রাম্প এই হুমকি দিয়েছিলেন গত শনিবার সিরিয়ার অবরুদ্ধ পূর্ব ঘুতার দুমা শহরে বিদ্রোহীদের উপর বিষাক্ত ক্লোরিন গ্যাস আক্রমণের পরিপ্রেক্ষিতে। ঐ রাসায়নিক আক্রমণে ৮৫ জন নিহত এবং ১,০০০ জনের আহত হওয়ার সংবাদ পাওয়া গেছে, যাদের মধ্যে অনেক নারী-শিশুও আছে।
সিরিয়াতে সংঘটিত অধিকাংশ রাসায়নিক হামলার মতোই দুমার ঘটনাটিতেও সিরিয়ার সেনাবাহিনীকে দায়ী বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। ঐ হামলার পরপরই আশঙ্কা করা হচ্ছিল, সিরিয়াতে হয়তো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অভিযান চালাতে পারে। এর আগে গত বছর এপ্রিল মাসে বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রিত ইদলিবের খান শায়খুন শহরে বাশার আল-আসাদের বাহিনী বিষাক্ত সারিন গ্যাস প্রয়োগে ৭৪ জনকে হত্যা করার পর মার্কিন বাহিনী সিরিয়ার একটি ঘাঁটি লক্ষ্য করে ৫৯টি টমাহক মিসাইল নিক্ষেপ করেছিল।
Many dead, including women and children, in mindless CHEMICAL attack in Syria. Area of atrocity is in lockdown and encircled by Syrian Army, making it completely inaccessible to outside world. President Putin, Russia and Iran are responsible for backing Animal Assad. Big price…
— Donald J. Trump (@realDonaldTrump) April 8, 2018
….to pay. Open area immediately for medical help and verification. Another humanitarian disaster for no reason whatsoever. SICK!
— Donald J. Trump (@realDonaldTrump) April 8, 2018
এবারও দুমাতে রাসায়নিক হামলার পরপরই প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এক টুইট বার্তায় এই হামলার জন্য বাশার আল-আসাদকে দায়ী করে তাকে পশু বলে সম্বোধন করেন। তিনি হুঁশিয়ারি করে জানান, এর জন্য সিরিয়াকে বিশাল মূল্য দিতে হবে। অন্যদিকে জাতিসংঘে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত নিকি হ্যালি জানান, জাতিসংঘ যদি সিরিয়ার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নেয়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র একাই ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
আমেরিকার হুমকির পরিপ্রেক্ষিতে তাই প্রথমে টি-৪ বিমান ঘাঁটিতে ইসরায়েলের হামলাকে আমেরিকার কাজ বলেই সন্দেহ করা হয়েছিল। কিন্তু সিরিয়ার পক্ষ থেকে অভিযোগের পরপরই আমেরিকা তাদের ভূমিকার কথা অস্বীকার করে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই অভিযোগের তীর নিক্ষিপ্ত হয় ইসরায়েলের দিকে। ইসরায়েল আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার না করলেও তাদের ভূমিকার কথা অস্বীকারও করেনি। পরবর্তীতে লেবাননের সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে যখন জানানো হয় যে, সোমবারে গভীর রাতে ইসরায়েলের চারটি এফ-১৫ বিমান ভূমধ্যসাগর হয়ে তাদের আকাশসীমায় অনুপ্রবেশ করে সিরিয়া সীমান্তের কাছাকাছি পর্যন্ত গিয়েছিল, তখনই হামলার পেছনে ইসরায়েলের ভূমিকা প্রমাণিত হয়।
সিরিয়াতে ইসরায়েলের বিমান হামলা অবশ্য এটাই প্রথম নয়। গত কয়েক বছরে তারা বেশ কয়েকবার সিরিয়াতে বিমান হামলা চালিয়েছে। সর্বশেষ গত ফেব্রুয়ারি মাসেও একটি ইরানি ড্রোন ইসরায়েলের আকাশসীমায় প্রবেশ করার পর ইসরায়েল সিরিয়ার ভেতরে একাধিক লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালায়। ঐ সংঘর্ষে ইসরায়েলের একটি এফ-১৬ যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয় এবং ৮ জন সিরীয় এবং কয়েকজন ইরানি সেনাসদস্য নিহত হয়।
এবারের ইসরায়েলের আক্রমণটি দুমা শহরে গ্যাস হামলার দুদিন পরেই সংঘটিত হওয়ায় প্রথমে ধারণা করা হয়েছিল, ইসরায়েল হয়তো সে হামলার পরিপ্রেক্ষিতেই আমেরিকার হয়ে এ হামলা চালিয়েছে। কিন্তু পরবর্তীতে পরিষ্কার হয় যে, আমেরিকা নিজেই ব্রিটেন, ফ্রান্সসহ অন্যান্য দেশের সাথে সম্মিলিতভাবে সিরিয়ার উপর আক্রমণের পরিকল্পনা করছে। তাছাড়া ইসরায়েল আক্রমণটি করেছে হোমস শহরের বিমান ঘাঁটিতে, যার সাথে দুমা শহরের গ্যাস আক্রমণের কোনো সম্পর্ক নেই।
এর আগেও ইসরায়েল যতবার সিরিয়াতে আক্রমণ করেছে, তার কোনোটিই সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের সাথে সরাসরি সম্পর্কিত না, বরং ইসরায়েলের নিজের নিরাপত্তার সাথে সম্পর্কিত। সিরিয়ার বাশার আল-আসাদের সাথে ইসরায়েলের সম্পর্ক মোটামুটি ভালোই ছিল। তাই সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে শুরু থেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন প্রায় সরাসরি জড়িয়ে পড়লেও ইসরায়েল মোটামুটি দূরত্ব বজায় রেখেছিল। কিন্তু যখন থেকে সিরিয়াতে ইরান এবং হিজবুল্লাহ মিলিশিয়া বাশার আল-আসাদের পক্ষে অংশ নিতে শুরু করে, তখন থেকেই ইসরায়েল সিরিয়া সংকটে জড়িয়ে পড়তে শুরু করে।
ইসরায়েল মধ্যপ্রাচ্যে ইরানকে তার সবচেয়ে বড় শত্রু হিসেবে গণ্য করে। ইরান সমর্থিত লেবানীজ মিলিশিয়া বাহিনী হেজবুল্লাহও ইরানের অন্যতম প্রধান শত্রু। সিরিয়াতে ইরানের অন্তত ১০টি পূর্ণ সামরিক ঘাঁটি, আরো ৪০টি সামরিক অবস্থান এবং ২৫,০০০ যোদ্ধা আছে। সীমান্তের ওপারেই তাই ইরানের এবং হিজবুল্লাহ’র শক্তিশালী উপস্থিতিকে ইসরায়েল নিজেদের অস্তিত্বের জন্য হুমকি হিসাবে মনে করে। ইসরায়েল প্রকাশ্যেই বারবার ঘোষণা দিয়েছে, তারা হিজবুল্লাহ’র হাতে অস্ত্র পাঠানোর কোনো প্রমাণ পেলেই সেখানে আক্রমণ করবে।
সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ বর্তমানে অনেকটাই আন্তর্জাতিক ছায়াযুদ্ধ। টি-৪ বিমানঘাঁটিটি সিরিয়াতে অবস্থিত হলেও এবং এতে রাশিয়ানদের অবস্থান থাকলেও, এতে ইরানি রেভোলিউশন গার্ড, কুদস ফোর্স এবং হিজবুল্লাহর শক্তিশালী অবস্থান আছে। সেজন্যই ইসরায়েল সেখানে আক্রমণ করেছে। এর আগে ফেব্রুয়ারি মাসের আক্রমণের সময়ও ইসরায়েলের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য ছিল এই বিমানঘাঁটিটি। কারণ তাদের দাবি অনুযায়ী, এখান থেকেই ইরানের ড্রোন উড্ডয়ন করে ইসরায়েলের আকাশসীমায় প্রবেশ করেছিল।
ইরান এবং হিজবুল্লাহর উপর আক্রমণ করার জন্য ইসরায়েল সব সময়ই সুযোগ খোঁজে। দুমাতে রাসায়নিক গ্যাস আক্রমণের পর যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন পশ্চিমাশক্তি সিরিয়াতে আক্রমণের সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করেছিল, সে সময়টাকেই হয়তো ইসরায়েল তাদের নিজেদের লক্ষ্য অর্জনের জন্য উপযুক্ত সময় মনে করেছে। তাছাড়া যুক্তরাষ্ট্র যেখানে সিরিয়াতে রাশিয়ার উপস্থিতির কারণে সিরিয়া থেকে কিছুটা পিছিয়ে যেতে আগ্রহী, সেখানে আগ্রাসী এই আক্রমণের মাধ্যমে হয়তো তারা যুক্তরাষ্ট্রকে এই ইঙ্গিতই দেওয়ার চেষ্টা করেছে যে, রাশিয়ার উপস্থিতিতেও সিরিয়াতে ইরানের স্বার্থের উপর আক্রমণ করা সম্ভব।
Featured Image Source: The Daily Beast