“ইটের পরে ইট মাঝে মানুষ কীট”
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মনশ্চক্ষুতে শতকাল পূর্বেই ধরা পড়েছিল চরণখানা। যা আজ আরও অধিকতর বাস্তবরূপে পরিস্ফুটিত হচ্ছে আমাদের সমাজে। বলা হয়, মহান পণ্ডিতেরা নাকি খুব সহজেই অনুদ্ভূত কাল সম্পর্কে অবগত হতে পারেন। চরণখানা দিয়ে হয়তো সচেতনভাবেই তরুণদের বার্তা দিতে চেয়েছিলেন তিনি অথবা শঙ্কিত হয়েছিলেন আগামী প্রজন্মের হবু সংসার নিয়ে। তবে শুধু রবীন্দ্রনাথই নন, এ ব্যাপারে শঙ্কিত হয়েছেন আরও অনেক মান্য ব্যক্তিবর্গ। তাদের মধ্যে কার্ল মার্কস অন্যতম।
কার্ল মার্কসের স্বরচিত পুস্তকের বাইরে শুধুমাত্র কার্ল মার্কসের কর্মকাণ্ডের ওপর ভিত্তি করেই পৃথিবীতে প্রায় চার লাখেরও বেশি বই প্রকাশিত হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। পৃথিবীতে এমন কোনো বিশ্ববিদ্যালয় নেই, যেখানে মার্কসবাদের ওপর পড়াশোনা হয় না। কার্ল মার্কস এমনই একজন ব্যক্তিত্ব, যাকে নিয়ে প্রতি মুহূর্তে আলোচনা-সমালোচনা হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে হয়তো আলোচনার চাইতে সমালোচনাটাই বেশি হতে দেখা যায়। সেসব সমালোচনা থেকে নিজেকে মুক্ত করতে আবারো পৃথিবীতে ফিরে এসেছেন স্বয়ং মার্কস। সমাজ, শাসন ব্যবস্থা আর ইতিহাস নিয়ে তার চিন্তাধারার ভুল ব্যাখ্যাকে মোকাবেলা করতেই তিনি ফিরে এসেছেন। তবে এবার স্বশরীরে নয়, ফিরেছেন মার্কিন নাট্যকার হাওয়ার্ড জিনের ‘সোহোতে মার্কস’ এর ওপর ভর করে।
লন্ডনের একটি স্থানের নাম সোহো, যেখানে পাঁচ বছরের জন্য থিতু হয়েছিলেন মার্কস। লেখক চেয়েছিলেন মার্কস ফিরে আসুক বর্তমান মার্কিন মুলুকের কোন এক স্থানে। ফিরে এসে বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে পুঁজিবাদে মত্ত জনগণের হুঁশ ফেরাবার মতো কিছু করুক। এ প্রকল্পে জিন যথার্থই রচনা করেছেন বলে মনে হয়। লন্ডনের সোহো শহরে মার্কসকে ফিরিয়ে আনলেও ‘MARX IN SOHO: A PLAY ON HISTORY’ নাটকটি রচনার মাধ্যমে মূলত তিনি মার্কসকে ফিরিয়ে এনেছেন বর্তমান পৃথিবীতে। আর সেখান থেকে মার্কসকে বাংলাদেশে নিয়ে আসার কাজটি করেছেন জাভেদ হুসেন। বঙ্গানুবাদ করে বাংলাদেশি পাঠকদের জন্য নাটকটিকে উপযোগী করে তুলেছেন তিনি।
ইতিহাসনির্ভর নাটকটিতে একটিমাত্র চরিত্র কার্ল মার্কস নিজে। নাটকের বিষয়বস্তুর উৎসরীতি অনুসারে, একে ঐতিহাসিককল্প চরিত্রমূলক নাটক হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। নাটকের একমাত্র চরিত্র যেমন ঐতিহাসিক, তেমনি সংলাপে উঠে আসা প্রত্যেকটি চরিত্রই ইতিহাসের পাতায় নিজেদের জায়গা করে নিয়েছে অনেক আগেই। তবে নাটকের Plot এবং Premise উভয়ই কাল্পনিক। বাংলাদেশে এখনও পর্যন্ত এ নাটকের মঞ্চায়নের খবর পাওয়া যায়নি। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের একাধিক নাট্যদল নাটকটি এখনও পর্যন্ত অসংখ্যবার মঞ্চায়ন করেছে। কাহিনী বর্ণনার সাবলীলতা এবং নিরেট বাস্তবতা এখনও বিশ্বের অনেক দেশেই এর প্রাসঙ্গিকতা টিকিয়ে রেখেছে।
বিষয়বস্তু অনুসারে এটি যে একটি রাজনৈতিক নাটক এতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। নাটকের বিভিন্ন সংলাপে তা বারংবার উঠে এসেছে। কাহিনী বর্ণনা করতে গিয়ে লেখক বর্তমান সময়ের বিভিন্ন অসঙ্গতিকে ফুটিয়ে তুলেছেন খুব সাবলীলভাবে। সংলাপের মাধ্যমে তা কার্যতই আরও স্পষ্ট হয়েছে। যেমন নাটকের এক সংলাপে উপস্থিত দর্শকদের উদ্দেশে মার্কস বলেন,
“শেষ পর্যন্ত ওরা বললো, ‘ঠিক আছে, যেতে পারো, মনের কথাগুলো বলার জন্য এক ঘণ্টার মতো সময় পাবে। তবে মনে রাখবে কোনো গণ্ডগোল নয়’। ওরা বাক স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে… তবে একটা সীমা পর্যন্ত (হেসে) ওরা উদারপন্থী”।
মার্কস তার লেখনীর অধিকাংশই ব্যয় করেছেন পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার সমালোচনায়। নাটকেও সে ব্যাপারটির নিষ্কর্ষণ হয়নি। পুঁজিবাদের আগ্রাসনে মার্কসের ‘পণ্যপূজা’ কথাটি যথার্থতা পায় এ নাটকে। মুনাফার লোভে মানুষ যে দিন দিন হিংস্র হয়ে উঠছে, লেখক তার স্বচ্ছ উদাহরণ দিয়েছেন মার্কসের অপর এক সংলাপের মাধ্যমে; যা বাংলাদেশের সমসাময়িক প্রেক্ষাপটের সাথে হুবহু মিলে যায়। অনুবাদক জাভেদ হুসেনের অসামান্য বুদ্ধিমত্তার ফলে তা পাঠকের মাঝে আরও একটি চিন্তার খোরাক তৈরি করতে সমর্থ হয়। সংলাপে মার্কস বলেন,
“মাত্র কয়েকদিন আগে, আপনাদের দেশেই তাজরিন নামে একটি পোশাক কারখানা মালিক গেটে তালা মেরে রেখেছিল। কেন? মুনাফা, আরও বেশি মুনাফা। আগুন লাগলো আর ১১২ জন শ্রমিক জ্যান্ত পুড়ে কয়লা হলো”।
পুঁজিবাদের সমালোচনার পাশাপাশি তথাকথিত মার্কসবাদীদের সমালোচনা করতেও ভুল করেননি লেখক হাওয়ার্ড জিন। বর্তমান সময়ে মার্কসবাদের নামে মার্কসের বক্তব্যগুলোর অপব্যবহার সম্পর্কেও সংলাপের মাধ্যমে নিজের শঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি। একইসাথে ভুল ব্যক্তিবর্গের খপ্পরে পড়া মার্কসবাদকে উদ্ধার নিয়েও আলোচনা হয় সেখানে।
নাটকের সংলাপ দীর্ঘায়িত করতে গিয়ে নাট্যকার ঘুরে আসেন সোহোতে ফেলে আসা মার্কসের দিনগুলোতে। কখনো দরিদ্রতার কষাঘাতে নিজ সন্তানের মৃত্যু প্রত্যক্ষ করা মার্কসকে চিত্রায়িত করেন তিনি। পরক্ষণেই আসবাবপত্র বন্ধক রেখে ভ্রমণে বের হওয়া কোমল পিতার ভূমিকায় দেখা যায় মার্কসকে। কখনো সন্তানের সাথে চলতে থাকে যুক্তি উপস্থাপন ও খণ্ডন। আবার কখনো বন্ধুর সাথে বাক-বিতণ্ডা। সংলাপের পিঠে সংলাপের মাঝে চলতে থাকে নানা ঘাত-প্রতিঘাত। এরই মাধ্যমে উঠে আসে সমাজের সকল রুঢ় বাস্তবতা, যা বাংলাদেশের সমসাময়িক প্রেক্ষাপটের সাথে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক।
নাটকটি পাঠ করতে গিয়ে কখনো মনে হয় না যে এটি বিদেশী কোনো লেখকের রচনা। উল্টো মনে হয়, লেখক এদেশের মানুষের জন্যই নাটকটি রচনা করেছিলেন। অনুবাদক জাভেদ হুসেন এতটা প্রাঞ্জলভাবে ভাষান্তর করেছেন, যে কারণে লেখকের মূল বার্তাটি বুঝতে পাঠকের বিন্দুমাত্র শ্রম ব্যয় করতে হয় না। নাটকের একটি দৃশ্যে মার্কস পত্রিকা পড়ার ভঙ্গিতে দর্শকদের উদ্দেশে প্রশ্ন রাখেন-
(পত্রিকা থেকে পাঠ) “নিউইয়র্ক শহরে দুই হাজার চাকরির জন্য ভোর হওয়ার আগে থেকে এক লক্ষ লোকের লাইন। বাকি আটানব্বই হাজারের কী হবে?”
প্রশ্নটি শোনার সাথে সাথেই ঢাকাস্থ গণগ্রন্থাগারের সামনের ভোরবেলার চিত্র চোখের সামনে ভেসে ওঠে। কেননা প্রতিদিন সকালে সেখানেও যে চলে চাকরি প্রত্যাশীদের মিছিল, যেখানে ভবিষ্যতের নিশ্চয়তার খোয়াবে লাখো তরুণ ভিড় জমায় প্রত্যহ।
সমাজে অগ্রগতির নামে যে প্রতিনিয়ত গরিবের ধন লুণ্ঠিত হচ্ছে, সে সম্পর্কেও লেখক ছিলেন সচেতন। তাই শ্রেণিবৈষম্যের খুঁটিনাটি তুলে ধরেছেন পাঠক কিংবা দর্শকের সামনে। খুব অল্প ভাষায় এমন শক্তিশালী বক্তব্য এখনকার নাটকে খুব কমই পরিলক্ষিত হয়। সে বিবেচনায় রাজনৈতিক নাটকের শতভাগ সার্থকতা নিয়েই পরিণতি ঘটেছে ‘সোহোতে মার্কস’ এর।
লেখক পরিচিতি
মার্কিন লেখক হাওয়ার্ড জিন যতটা না একজন মার্কিনী হিসেবে পরিচিত, তার চেয়ে বেশি পরিচিত জনমানুষের প্রতিনিধি হিসেবে। জীবনের প্রায় পুরোটা জুড়েই কাজ করে গেছেন নিপীড়িত মানুষের পক্ষে। যেখানেই ন্যায় অধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে, সেখানেই প্রতিবাদ করতে দেখা গেছে হাওয়ার্ডকে। এবং তিনি সেই প্রতিবাদ তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের মতো টেলিভিশন কিংবা পত্রিকার পাতায় নয়, করেছেন রাজপথে উপস্থিত থেকে। এমনকি যেদিন তিনি মারা যান, সেদিনও তার একটি মিছিলে যোগ দেবার কথা ছিল, আর সে কারণে নির্ধারিত সময়ের প্রায় ৩০ মিনিট পূর্বে ক্লাস শেষ করেন তিনি।
১৯২২ সালের ২৪ আগস্ট পৃথিবীর বুকে ভূমিষ্ট হন হাওয়ার্ড জিন। নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম নেয়া জিন বেড়ে ওঠেন নিউইয়র্ক শহরের ঘিঞ্জি বস্তিগুলোর একটিতে। সেখানে তিনি সমাজের নানা অসামঞ্জস্যকে খুব কাছ থেকে দেখতে পান। সেসময় থেকেই তিনি জনগণের সাথে শাসকের আচরণের বৈষম্যগুলোকে খুব সুস্পষ্টভাবে উপলব্ধি করেন। এরই ধারাবাহিকতায় ধীরে ধীরে সমাজ ও রাজনীতি সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠেন। নিজ যোগ্যতায় পড়াশোনা করে উচ্চ শিক্ষা অর্জনের পাশাপাশি কাজ করতে থাকেন মানুষের জন্য। জীবনের নানা অধ্যায়ে কখনো তাকে দেখা গেছে রাজপথে আন্দোলন করতে, কখনো কুলি মজুরের কাজ করতে আবার কখনো বিশ্ববিদ্যালয়ের মিলনায়তন কক্ষে বক্তৃতা করতে। সঙ্গীতজ্ঞ কিংবা অভিনেতা না হয়েও যে মানুষের আইডল হওয়া যায় তা তাকে দেখলেই অনুধাবন করা যায়।
শিক্ষাদান ও গবেষণার পাশাপাশি তিনি বেশ কয়েকটি গ্রন্থও রচনা করেছেন তিনি। ‘অ্যা পিপলস হিস্টরি অব দ্য ইউনাইটেড স্টেটস’ তার লেখা গ্রন্থগুলোর মধ্যে অন্যতম। ভিয়েতনাম যুদ্ধে যে ক’জন মার্কিন নাগরিক সর্বপ্রথম প্রতিবাদ জানিয়েছিল, তাদের মধ্যেও তিনি প্রথম সারিতেই আছেন। নানান সময় বিভিন্ন অপকর্মের প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে অপদস্থও হয়েছেন বেশ কয়েকবার। তবু হাল ছাড়েননি। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত কাজ করে গেছেন মানুষের জন্য। মানুষের জন্য কাজ করতে করতেই ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি পৃথিবী ত্যাগ করেছেন তিনি। সোহোতে মার্কসের শুরুর দিকে নোম চমস্কির লেখা ‘হাওয়ার্ড জিন স্মরণে’ শীর্ষক অনুবন্ধে তার সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানা যায়।
ফিচার ইমেজ – মাইকেল হোমস