ভালোবাসা সবসময় বয়ে যাওয়া নদীর স্থির স্রোত নয়, ভালোবাসা কখনো কখনো শৃঙ্খল ভাঙার আচমকা শব্দও; ভালোবাসা মানেও বিপ্লব। কালবেলার রূপে সমরেশ মজুমদার উপস্থাপন করেছেন বিপ্লব ও প্রেমের সমন্বিত এক উপন্যাস। এটি তার ত্রিরত্নের দ্বিতীয় বই। অন্যগুলো হচ্ছে উত্তরাধিকার ও কালপুরুষ। প্রথমবার এই বইটি ১৯৮১-৮২ খ্রিস্টাব্দে দেশ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে বের হয়েছিল। ১৯৮৪ সালে এ বই লেখককে এনে দেয় সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার। বইটি থেকে ২০০৯ সালে ভারতের সমান্তরাল ধারার জনপ্রিয় পরিচালক গৌতম ঘোষ ‘কালবেলা’ সিনেমা নির্মাণ করেন। চিত্রনাট্য রচনায় সমরেশ মজুমদারও ছিলেন। এর শ্রেষ্ঠাংশে অভিনয় করেছেন পরমব্রত চ্যাটার্জী ও পাওলি দাম।
বইটিকে একটি রাজনৈতিক প্রেমের উপন্যাস বলা যায়। বইটির ভূমিকায় লেখক বলেছেন, তিনি এতে একটি নির্দিষ্ট সময়কে শব্দে বন্দী করতে চেয়েছেন, একত্র করে প্রকাশ করতে চেয়েছেন তখনকার নির্যাস। সময়টা কলকাতার নকশাল আন্দোলনের, যদিও শেষপর্যন্ত তা শুধু রাজনৈতিক উপন্যাস হয়েই থেমে থাকেনি, রূপ নিয়েছে এক অদ্ভুত প্রেমের কাহিনীতেও। এ গল্প নিজের, এ গল্প আপামর জনসাধারণের, আজ এবং কালকের সকল প্রেমিকের চোখের তারায় সত্যি হতে চাওয়া এক প্রচণ্ড আকাঙ্ক্ষিত প্রেমের, এ গল্প অনিমেষ ও মাধবীলতার। এটি কিছু ভুলেরও গল্প, যে ভুল কখনো শুধরাতে হয় না, এখনও নয়, তখনও নয়। কারণ, কিছু ভুল সংশোধিত সত্যের চেয়েও বেশি সত্য বয়ে আনে।
‘কালবেলা’ ভালোবাসার অনুভূতি দেয়, অনুভব করায় বহু আত্মত্যাগের, একইসাথে কালবেলা এক নাছোড়বান্দা জীবনের গল্প। বইটি পড়ার সময় পাঠক এক বহুমাত্রিক অনুভূতিতে ভাসবেন, সন্দেহ নেই।
শুরুটা হয় এক বিষণ্ণ বিকেলে অনিমেষের স্মৃতিচারণ থেকে। আকাশে ভেসে যাওয়া ভারি মেঘের দল আর অনিমেষ কলকাতার হোস্টেলের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ডুবছে নস্টালজিয়ায়। সে তার স্মৃতিতে ঘুমন্ত কিছু মুখের কথা ভাবছে, কিছু হারিয়ে গেছে, কিছু বা তাকে আজও ভাবিয়ে তোলে! এ থেকেই তার বিগত দিনগুলোর একটা ঝলক দেখতে পাওয়া যায়। যখন সে প্রথম এসেছিলো এ শহরে, সেই যে প্রথমদিন সে মুখোমুখি হলো এক দুর্ঘটনার! প্রথমদিনের দুর্ঘটনাটি তার আসন্ন সমগ্র জীবনে, জীবনযাপনে এবং তার উরুতে একটা গভীর দাগ ফেলে গিয়েছিলো। তার পড়াশোনার একটা বছরও তো সেজন্যই বাদ দিতে হলো।
অনিমেষ কখনোই ভাবেনি সে রাজনীতি বা কোনো আন্দোলনে অংশ নেবে, কিন্তু সময়ের দাবি কখনো কোনো ভাবনার তোয়াক্কা করে না। সময় তার চাহিদা নিজ থেকেই যেন পূরণ করে নেয়, ঠিক এমনটাই ঘটে অনিমেষের বেলায়ও।
এই রাজনীতি ও আন্দোলনের সাথে সমান্তরালভাবেই চলে আসে আরেকটি গল্প, কিছুটা কৌতূহলের, কিছুটা বা সংযোগের; যাকে আমরা বলি, ‘প্রেম’?
ঠিক এসময়ই অনিমেষ মুখোমুখি হলো মাধবীলতার, সে তারই ক্লাসে পড়তো এবং আড়চোখা চাহনিতে একটা কেমন যেন যোগাযোগ হয়ে যায় তাদের মধ্যে। মাধবীলতার চোখগুলো অনিমেষকে বড় বেশি টানতো, এমনকি যখন সে তার মুখটিও দেখতে পায়নি, তখন থেকেই। চুম্বকের মতো সে চাহনি অনিমেষকে তাড়া করে বেড়াতো ক্লাসরুমে, করিডোরে। উথালপাথাল জীবনের অন্য সবকিছু ভুলে অনিমেষও ডুবে যেতে শিখেছিলো ঐ দুই চোখে। অজানা অচেনা এক দুর্বার আকর্ষণ!
যখন তাদের কথা হলো, তখন অনিমেষ আবিষ্কার করলো, এ মেয়েটি সহজে নিজেকে সঁপে দেয় না। তার নিজস্ব বেশ দৃঢ় আদর্শ ও মতামত রয়েছে এবং সেগুলো প্রকাশে সে প্রচণ্ড স্পষ্ট। এতদিন চোখের চাহনিতেও যা অসম্পূর্ণ থেকে গিয়েছিল, কথোপকথনে তা পূর্ণতা পেল। মাধবীলতা সবসময়ই অনিমেষের দল ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিয়ে প্রশ্ন করতো, বিভিন্ন সন্দেহ প্রকাশ করতো। অনিমেষের মনেও যে সেসব প্রশ্ন আসতো না, তা নয়। তবু সে-ও দলীয় ভাবনায় বয়ে যেতো।
মাধবীলতা ছিল এক বহুমাত্রিকতার নাম, অনিমেষের প্রয়োজনে সে ছিল নিবিড় ছায়ার মতন, তার এগিয়ে চলার পথে মাধবীলতা হয়ে উঠেছিলো অনুপ্রেরণা। তাদের জীবন পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছিলো একে অপরের মধ্য দিয়ে। প্রতিটি সাক্ষাতে তারা গড়ে উঠছিলো জীবনের আরো নতুন কিছু প্রাপ্তিতে। ঠিক এই সময়টাতেই, তারা যেন উড়ছিলো! লাইব্রেরি, বসন্ত কেবিন, কফি হাউস- সর্বত্র তাদের দেখা যেত একসাথে। মাধবীলতা চিনছিলো অনিমেষের শেকড়টাকে, মেলতে দিচ্ছিলো তার ডালাপালাগুলোকেও।
কিছু শক্তিশালী পার্শ্বচরিত্রেরও দেখা মেলে উপন্যাসটিতে।
সুভাষ, ট্রাম জ্বালানোর সময়টাতেও সক্রিয় নকশালপন্থী কম্যুনিস্ট। অনিমেষের জন্য প্রথম দিকটায় সে ভূমিকা নেয় পথপ্রদর্শকের। কম্যুনিজম নিয়ে সুভাষের মতাদর্শ অনিমেষের মনে ছাপ ফেলে, তারা দেশ-জনতা-দল সবকিছু নিয়েই আড্ডায় মাতে বহুবার। সুভাষই অনিমেষকে দলের অন্যদের সাথে দেখা করিয়ে দেয়।
বিমান, ইউনিভার্সিটির কম্যুনিস্ট পার্টির নেতা। সুভাষই তার সাথে অনিমেষের পরিচয় করিয়ে দেয়। বিমান সবসময় অনিমেষের ক্ষতটাকে প্রতিদ্বন্দ্বী দলের সামনে তুরুপের তাসের মতো ব্যবহার করতে চাইতো। এবং ঠিক এ কারণেই সে অনিমেষকে অন্য ছাত্রদের সামনে দলীয় প্রচারণা চালাতে উদ্বুদ্ধ করে। অনিমেষ যদিও তখন নিজেকে একজন কম্যুনিস্টই মনে করছিল এবং সে আর দশটা ছাত্রের মতো দল থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল না, তারপরও প্রায়ই বিমান এবং দলের অন্যদের সাথে তার মতভেদ দেখা দিতো। বিমান মাও সে তুং এর ‘পিস মিল সল্যুশন’ এ বিশ্বাস করতো, মাও সে তুং এর আদর্শ তাকে অনুপ্রাণিত করলেও প্রেক্ষাপট বদল করে ভারতের পটভূমিতে সে কখনো এর প্রায়োগিক ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে পারেনি। আর এখানেই তার রাজনৈতিক জীবনের গলদটা রয়ে গিয়েছিল।
পরমহংস, অনিমেষের সত্যিকারের একজন বন্ধু ও শুভাকাঙ্ক্ষী। তার রাজনৈতিক জীবনের সাথে কোনো যোগ নেই পরমহংসের, কিন্তু যখনই অনিমেষের একজন বন্ধুর প্রয়োজন হয়েছে, বিমান এগিয়ে এসেছে। অনিমেষ-মাধবীলতার প্রেমের একজন স্বাক্ষীও বলা যায় তাকে। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে সে তাদের সাহায্য করে গেছে।
দেখা মেলে এক হিপোক্রিসির পতাকা ওড়ানো এক চরিত্র সুবিমল গুপ্তেরও। তিনি একদিকে গণমানুষের অধিকারের কথা বলেন, অপরদিকে তার মধ্যে ধরা পড়ে সুবিধাবাদী রাজনীতিবিদের চেহারা। কোনটা সত্য? কোনটা ঠিক? অনিমেষ ভাবনায় পড়ে এই সুবিমল গুপ্তকে দেখে। চরিত্রটি বেশ প্রয়োজনীয়, কারণ যাত্রার বিবেকের নেতিবাচক রূপের মতো দেখায় সুবিমল গুপ্তকে। তিনি অনিমেষকে ভাবতে সাহায্য করেন, ভাবনায় পড়তে সাহায্য করেন, সে ভাবনা থেকেই বোধোদয়ের উন্মেষ ঘটা সম্ভব।
তথাকথিত কম্যুনিস্ট পার্টি থেকে সরে গিয়ে অনিমেষের সাক্ষাৎ হয় কম্যুনিস্ট বিপ্লবীদের দ্বারা সংগঠিত অল ইন্ডিয়া কো অর্ডিনেশন কমিটির। তারা সবাইই প্রাক্তন কম্যুনিস্ট। সবারই কখনো না কখনো মতভেদ হয়েছে দলের সাথে এবং সে থেকেই এই নতুন দলের উদ্ভব। অনিমেষ দ্বিধায় ভোগে, আবার নিজেকে এদের একজন বলেও মনে হয় তার। তারা চা শ্রমিক, গ্রামের লোকজন, কৃষক- এদের সাথে তখনকার শহুরে লোকেদের একটা সংযোগ ঘটাতে চাইছিলেন। তা কতটা সফল হয়, তা দৃষ্টিভঙ্গির মুখাপেক্ষী। তারা কি তাদের দলের নিয়ম থেকে পুরোটা বেরিয়ে আসতে পেরেছিলেন কিনা, সেটিও শুধু জানবার নয়, বোধ করবার বিষয়।
বইটির পরতে পরতে জড়িয়ে আছে বিপ্লবের ঘ্রাণ। বিপ্লবকে এক নতুন অর্থ দেয় কালবেলা। কল্পনাকে ছুঁতে পারা এক বিপ্লবগাথা তাই বলাই যায় কালবেলাকে। প্রতিটি ঘটনার বর্ণনায় সমরেশ ছুঁয়ে গেছেন সময়কে, তার সাথে ঘিরে থাকা মানুষকে। অনিমেষ, সুবাস, দলের অন্যরা বহু ভুল করেছে। কিন্তু সে ভুলগুলো খুব দরকার ছিল, সময়ের সাথে সাথে লেখক এও বুঝিয়ে দিয়েছেন। সমাজতন্ত্র পরিবর্তন আনতে পারে, কিন্তু এক ধাক্কায় নয়। তাতে প্রয়োজন অনেক বদলের। প্রেক্ষাপটের অনুযায়ী সমাজতন্ত্রের চেহারাকে রূপ দিতে হবে, এ কথাও ফুটে উঠেছে কালবেলায়। অনিমেষদের ভুলগুলো পরবর্তী প্রজন্মের জন্য প্রয়োজন ছিল। চে গ্যেভারাও বলেছিলেন, “বিপ্লব তো আর গাছে ধরা আপেল নয় যে পাকবে আর পড়বে, বিপ্লব অর্জন করতে হয়”।
আমাদের সভ্যতার ইতিহাস বিপ্লবের, সকল প্রকার ঘোষিত স্বাধীনতা বিপ্লবের। তাই বিপ্লবের আঁচড়ে নিজেকে শুদ্ধ না করে নিলে শেষমেষ কোনো শৃঙ্খলমুক্তির আশা নেই। বিপ্লব ও প্রেম যে একে অপরের পরিপূরক, তা-ই কালবেলা আমাদের জানিয়ে দেয়। জীবনে কোনো একটি বেছে নিতে হয় না, দুটোই পথচলার ইন্ধন হয়ে ওঠে। অনিমেষের পুরো জীবনেই বিপ্লব এসেছে বহুরূপে। কালবেলার সমগ্র নির্যাস শুধু একটি উক্তি দিয়েই প্রকাশ করা সম্ভব,
“বিপ্লবের আরেক নাম মাধবীলতা”
ফিচার ইমেজ- amarboi.com