অনলাইনে শিক্ষাদান বিষয়টা বাংলাদেশে সার্বিকভাবে কম প্রচলিত থাকলেও একেবারে যে ছিল না তা কিন্তু নয়। আমি ছোটবেলায় বাংলাদেশ টেলিভিশনে দূরশিক্ষন কার্যক্রমের বিভিন্ন প্রোগ্রাম দেখতাম। আবার মাগুশ, কোর্সেরা, খান একাডেমি কিংবা ব্রিলিয়ান্ট ইত্যাদিদের মতো প্রতিষ্ঠানও কিন্ত অনলাইনে সাফল্যের সাথে বিভিন্ন কোর্স করিয়ে আসছে প্রায় এক দশক ধরে। বিদেশের কথা বাদ দিলে বাংলাদেশের শিক্ষক ডট কমও বেশ জনপ্রিয় একটি ওয়েবসাইট। আবার ইউটিউবেও আমরা কোনো বিষয়ের উপর দক্ষতা লাভের জন্য ভিডিও টিওটোরিয়াল পেয়ে যাই, সেটাও অনলাইনের শিক্ষারই অংশ।
সে অর্থে বলা চলে কোভিড-১৯ মহামারীতে আমরা অনলাইন মাধ্যমের শক্তিটাকে আরো বেশি উপলব্ধি করতে পেরেছি এবং ব্যবহার করেছি। স্পষ্ট মনে আছে যেদিন সারা দেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হলো তার ঠিক পরের দিনই আমার কর্মস্থল নর্দান বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ-এর ম্যানেজমেন্টের পক্ষ থেকে আমাদের অনলাইনে ক্লাস নেবার প্রস্তুতি নিতে বলা হলো। এমনিতে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ই-লার্নিং নামে একটা প্ল্যাটফর্ম আগে থেকেই ছিল। তারপরও আমরা সবাই গুগল ক্লাসরুমে প্রত্যেক কোর্সের জন্য ক্লাস ওপেন করলাম। আমরা শিক্ষকরা প্রথমে বেশ চিন্তিত ছিলাম যে আমাদের ছাত্ররা ঠিক কতটুকু প্রযুক্তি ব্যবহারে অভ্যস্ত হতে পারবে সেটা নিয়ে। খানিকটা অনিশ্চয়তা নিয়েই আমাদের অনলাইন ক্লাস শুরু হয়ে গেল এপ্রিল মাসের শুরুতে। আমরা জুমে অনলাইনে ক্লাস নেয়াটা শিখে নিলাম। জুম আর গুগল ক্লাসরুম দুটো চালাতেই ই-মেইল আইডি লাগে। দেখা গেল শিক্ষার্থীদের অনেকের মেইল আইডি ছিল না বা থাকলেও সক্রিয় ছিল না। অনেক শিক্ষার্থীই তাই প্রথমদিকে কীভাবে অনলাইনে ক্লাস করবে সেটা বুঝতে পারছিল না।
অনলাইন ক্লাস শুরুর প্রথম দিনেই আমরা এটার প্রতিবন্ধকতাগুলো বা সীমাবদ্ধতাগুলো একে একে দেখা শুরু করলাম। প্রথম যে বিষয়টা দেখলাম সেটা হলো ডিভাইসের সমস্যা। এখানে একধরনের বৈষম্য দেখা গেল। আমাদের সব শিক্ষার্থীর কাছে একই মানের ডিভাইস ছিল না। অধিকাংশ শিক্ষার্থী মোবাইল ফোন থেকে ক্লাস করতো (এখনো করছে)। ছোট স্ক্রিনে লেখা স্পষ্টভাবে দেখার সমস্যা থাকেই, যাদের পারসোনাল কম্পিউটার বা ল্যাপটপ ছিল তারা হয়তো খানিকটা সুবিধাজনক অবস্থায় ছিল।
এরপর দুইটি সমস্যা হলো নেটওয়ার্কের সমস্যা ও ইন্টারনেটের খরচ। বড়ই দুঃখের বিষয় বর্তমান সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় থাকলেও আমাদের দেশের মোবাইল ইন্টারনেটের গতি পৃথিবীর অনান্য অনেক দেশের তুলনায় বেশ কম। ক্লাসে সব ছাত্রের ভিডিও অন করে ক্লাস নিতে গিয়ে একদিন দেখলাম অনেক ছাত্র ঘরের বাইরে, এক ছাত্র তো ধানক্ষেতের আইলে বসে আছে। কারণ জিজ্ঞেস করলে সবারই উত্তর একটাই, “স্যার, ঘরে নেটওয়ার্ক ভালো পাই না।”
আর ইন্টারনেটের খরচটাও বেশি। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষার্থীদের জন্য কিছুদিনের চলার মতো ইন্টারনেট প্যাক বিনামূল্যে দেয়া দেয়া হয়েছিল। কিন্তু বাকিটা সময় ছাত্রদেরই ইন্টারনেট খরচ বহন করতে হচ্ছে। বাংলাদেশের মোবাইল ফোন কোম্পানিগুলোর সুযোগ ছিল উদার হবার, যে দেশ থেকে তারা আয় করছেন সেখানে ক্ষনিকের জন্য হলেও খরচটা কমিয়ে আনার। দুঃখের বিষয় যে তারা সেটা করেনি। যারা একটু অবস্থাসম্পন্ন বা শহরে তারা ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট বা ওয়াইফাই ব্যাবহার করে ঘরে বসে ক্লাস করতে পারে, কিন্তু গ্রামে যেখানে ব্রডব্যান্ড নেই তারা আসলেই অনলাইন ক্লাস করতে ঝামেলায় পড়লো। এখানেও একটা বৈষম্যের সৃষ্টি হলো।
জুম বা গুগল মিট ব্যবহার করে ক্লাস নেয়াটা একেবারে মন্দ বলা যাবে না। জুমে চমৎকার হোয়াইট বোর্ড আছে। প্রথমদিকে ল্যাপটপের মাউসপ্যাডে কোনো জিনিস আঁকতে গেলে কদাকার হতো, সময়ও যেত। এখন খানিকটা দ্রুতই আঁকতে পারি, আঁকাও ভালোই হয়।
আর জ্যুমে কোনো একটা জিনিস স্ক্রিনশেয়ার করে কোনো লেকচার শিট স্ক্রিনে দেখালে সেখানে অ্যানোটেট করার বা বিভিন্ন সিম্বল/নোটেশন ব্যবহার করে আলোচ্য বিষয়বস্তুকে সহজ করে তোলার ব্যাবস্থা আছে। আমার কাছে এটা বেশ ভালোই লাগে।
শিক্ষার্থীরা যাতে পরে ক্লাসগুলো দেখে সেজন্য আমরা জুম ক্লাসের রেকর্ডিংটাও ছাত্রদেরকে দিতাম (এখনও দিচ্ছি)। ছাত্রদের অ্যাটেন্ডেন্সের জন্য অনেক পদ্ধতি কাজে লাগানো হয়েছে। বর্তমানে গুগল ফর্মে অ্যাটেনডেন্স নিচ্ছি। এক্সেল শিটে সব ক্লাসের অ্যাটেন্ডেন্স একসাথে রাখা যাচ্ছে।
মাঝেমাঝে কোনো কোনো বিষয় বোঝানোর জন্য ভিডিও বানাতে হয়েছে। আমি যখন মাস্টার্সের ছাত্র ছিলাম তখন FOCUSKY নামের একটা ভিন্নধর্মী প্রেজেন্টেশন সফটওয়্যারের কাজ শিখেছিলাম। জিনিসটা খুবই সহজ। ফোকাসকির মাধ্যমে নির্মিত প্রেজেন্টেশনগুলো পাওয়ারপয়েন্ট প্রেজেন্টেশনের চেয়ে বেশি এনগেইজিং হয়। ওটাতে প্রেজেন্টেশন বানিয়ে আমি স্ক্রিন রেকর্ডিংয়ের মাধ্যমে ভিডিও তৈরি করতাম। স্ক্রিন রেকর্ডিংয়ের জন্য ব্যবহার করেছিলাম OBS Studio। এই সফটওয়্যারটার মাধ্যমে স্ক্রিন রেকর্ডের পাশাপাশি ভয়েসও রেকর্ড হয়। আর ভিডিও এডিটিংয়ের জন্য Openshot নামের একটা সফটওয়্যার ব্যবহার করেছিলাম। একটা ছোট ভিডিও নিচে দিলাম।
ছোটখাটো ইমেজ ফাইল তৈরির জন্য মাইক্রোসফট পাওয়ারপয়েন্ট ব্যবহার করছি। এর পাশাপাশি কোনো একটা সোর্স থেকে ছবি সরাসরি পাওয়ার জন্য কম্পিঊটারের প্রিন্ট স্ক্রিন বাটনটাও (Windows button + Prt Sc) বেশ কাজে দিচ্ছে।
ল্যাব কোর্সগুলো হাতে কলমে করালেই সবচেয়ে ভালো হয় তবে বেশ কিছু ল্যাব এক্সপেরিমেন্ট কম্পিউটার সিমুলেশনের সাহায্যেও করানো সম্ভব। আমি পদার্থবিদ্যার শিক্ষক। আমি মূলত আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে এন্ট্রি লেভেলের ছাত্রদের মানে ফার্স্ট সেমিস্টারের ছাত্রদের পদার্থবিদ্যার একটা কোর্স পড়াই। এখানে যে এক্সপেরিমেন্টগুলো আমি করাতাম তার প্রায় সবগুলোরই কম্পিউটার সিমুলেশন অনলাইনে পাওয়া যায়। তবে অনান্য কোর্সগুলোর জন্য হয়তো এমন সিমুলেশন নেই সেটা বুঝতে পেরেছি।
এর বাইরে আমি বেসিক ইলেকট্রিক্যাল এন্ড ইলেক্ট্রনিকসের উপর একটা কোর্স পড়াই, সেখানেও ল্যাব এক্সপেরিমেন্ট আমি করিয়েছি কম্পিউটার সিমুলেশনের মাধ্যমে। একটা চমৎকার ওয়েবসাইট আছে TINCKERCAD। এটার মাধ্যমে খুব চমৎকারভাবে শিক্ষার্থীদের বোঝানো যায়।
আমার ধারণা যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে যন্ত্রপাতির সংকট আছে তারা ভবিষ্যতে সিমুলেশনের মাধ্যমে ছাত্রদের একটা প্রাথমিক ধারণা দিতে পারবে এই অনলাইন টুল থেকে। আমাদের দেশে কলেজগুলোতে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি নামের একটা বিষয় আছে। এই বিষয়টার ব্যবহারিক ক্লাসগুলোর জন্যও TINCKERCAD ব্যবহার করা যেতে পারে। উদাহরণ স্বরূপ আমি একটা লজিক গেটের এক্সপেরিমেন্ট নিচে দিলাম।
পরীক্ষা নেওয়ার ক্ষেত্রে এমসিকিউ অংশের জন্য গুগল ফর্ম ব্যবহার করছি। তত্ত্বীয় অংশের জন্য একাধিক সেটের প্রশ্ন করি। ছাত্ররা একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ওগুলো লিখে Camscanner বা Adobe Scanner ব্যবহার করে পিডিএফ ফাইল তৈরি করে নির্ধারিত স্থানে আপলোড করে। তবে এখানেও নেটওয়ার্কের সমস্যার কারণে অনেকে সময়মতো আপলোড করতে হিমশিম খায়। আমি শুনেছিলাম আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্র পরীক্ষা চলাকালীন নদী পার হয়ে অন্য একটা জায়গায় যেত, যেন ঠিকমতো পরীক্ষা দিতে পারে বা সময়মতো আপলোড করতে পারে।
গুগল ফর্মে এমসিকিউ অংশের মার্ক অটোমেটিক কাউন্ট হয়। তত্ত্বীয় অংশের জন্য আমরা কম্পিউটারে ম্যানুয়ালি খাতা দেখি kami নামের একটা অনলাইন টুলের মাধ্যমে। কোন জায়গায় ভুল হলো, বা কোথায় কত নম্বর পেল সেটা এই টুলটা দিয়ে খুব ভালোভাবে মার্ক করা যায়। এই সেমিস্টারে আমি আমার ছাত্রদের মিড টার্মের খাতা চেক করে মার্কসহ ছাত্রদের আবার দেখিয়েছি।
অনলাইনে শিক্ষকতার একটা সমস্যা হলো যেকোনো মুহুর্তে নানা রকম সমস্যা দেখা দিতে পারে এবং এজন্য সর্বদা তৈরি থাকতে হয়। ইন্টারনেট না থাকা বা দূর্বল নেটওয়ার্ক কিংবা ডিভাইসের সমস্যা। বিদ্যুৎ চলে গেলে ওয়াইফাই কাজ করে না, তখন মোবাইল ইন্টারনেটের সাহায্য নিতে হয়। অনেকসময় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বোঝানোর সময় ক্লাস থেকে আউট হয়ে যাবার মতো ঘটনা ঘটে। আবার শিক্ষার্থীদের ইন্টারনেটের গতি কম থাকায় কথা আটকে আটকে বা অসম্পূর্ণভাবে তাদের কাছে পৌঁছায়। ফলে তাদেরকে কিছু জিনিস বার বার বলতে হয়। আর ক্লাসের ভিডিও রেকর্ড করে, সেটা আবার ইউটিউবে আপলোড করে, ভিডিও লিংক শিক্ষার্থীদের দেয়া এই কাজগুলোর পেছনে ক্লাসটাইমের বাইরেও অনেক সময় ব্যয় করতে হয়। আর আমাদের সব শিক্ষার্থীর খাতা এখন অনলাইন সংরক্ষণ করতে হয়। গুগল থেকে প্রতি ই-মেইল আইডির বিপরীতে ১৫ গিগাবাইট ফ্রি স্টোরেজ পাওয়া যায়। সেটা বছরখানেকের মধ্যেই শেষ হয়। তখন আবার আরেকটা আইডি খোলা লাগে। একাধিক আইডির ব্যবহার ক্ষেত্রবিশেষে বেশ ঝামেলার। অসংখ্য লিংক তৈরি করতে হয় কোনটা বা ফর্মের, কোনটা শিটের কোনটা আবার ক্লাস ম্যাটেরিয়ালের। শিক্ষার্থীদের বিভ্রান্ত হবারও সুযোগ আছে।
আর সব শিক্ষার্থীর প্রযুক্তিজ্ঞান এক নয়, ফলে যাদের প্রযুক্তিজ্ঞান কম বা দক্ষতা কম তাদেরকে আলাদা করে সময় দিতে হয়, তাদের শেখাতে হয়। তবে আনন্দের বিষয় হলো যত সময় যাচ্ছে তত তাদের দক্ষতা বাড়ছে। এখন তো নতুন সেমিস্টারের ক্লাস শুরুর আগেই ক্লাস রিপ্রেজেন্টিটিভরা শিক্ষকদের সাথে যোগাযোগ করে। হোয়াটস অ্যাপে নিজেরা গ্রুপ খুলে নিজেদের মধ্যে ক্লাস ম্যাটেরিয়াল আদানপ্রদান করে।
আর যত দিন যাচ্ছে ততই শিক্ষার্থীদের অনলাইন ক্লাস থেকে মনযোগ হারানোর প্রবণতা দেখতে পাচ্ছি। ক্লাসে সময়মতো জয়েন করছে না বা দেখা যায় যে ক্লাসে জয়েন করে ছাত্র-ছাত্রীদের কেউ কেউ অন্য কাজে ব্যাস্ত হয়ে পড়ে। তাদের মনযোগ ধরে রাখার জন্য ক্লাসের মাঝখানে খানিকটা সময় অন্য বিষয় নিয়ে কথা বলি, আনন্দ দেবার চেষ্টা করি, তাদের খোঁজখবর নেই। ছবি দিয়ে বা উদাহরণ দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করি বেশি। ক্লাস শেষে বা ক্লাসের মাঝখানে শিক্ষার্থীদের জিজ্ঞাসা করি যে আজকে তোমাদের আমি কি কি পড়ালাম বলো বা আজকের ক্লাসে তুমি কী কী শিখলে সেটা একটু বোঝাও আমাকে। সবাই যে একেবারে গড় গড় করে সব বলে ফেলে তা না, তবে অনেকে মোটামুটি বলতে পারে।
কোভিড-১৯ মহামারীর শেষ কোথায় সেটা আমার জানা নেই। কবে আবার সরাসরি ক্লাস নেব তাও জানি না। সরাসরি ক্লাসের অভিজ্ঞতা আর অনলাইনে ক্লাসের অভিজ্ঞতা ভিন্ন। সরাসরি ক্লাসে ছাত্রের সাথে শিক্ষকের যে একটা বন্ধন তৈরির যে সুযোগ থাকে সেটা অনলাইনে একেবারেই অনুপস্থিত। তবে এই মহামারীর মধ্যেও শিক্ষকতা করতে গিয়ে নতুনভাবে অনেক কিছু শেখার সুযোগ হয়েছে। আমার প্রযুক্তিগত দক্ষতা বেড়েছে যেটা সরাসরি ক্লাসেও কাজে লাগবে হয়তো। ভবিষ্যতেও যদি এমন মহামারী পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় তাহলে হয়তো এই দক্ষতাগুলো আরো কাজে লাগবে।