একজন মানুষের জীবনে সে অনেক স্বপ্ন দেখে। এর মধ্যে সবচেয়ে প্রিয় স্বপ্নের তকমা পায় একটি বা দুটি। কারো কারো পুরো জীবন কেটে যায় সে স্বপ্নের পিছু ধাওয়া করতে করতে, আবার কেউ পেয়েও যায় সোনার হরিণ। কিন্তু সেই স্বপ্নটি পূরণ হবার পরও যদি মনে হয়, কিছু বাকি রয়ে গেছে? আর খুব অপ্রত্যাশিত কিছু, অপ্রত্যাশিত কেউ এসে সেই স্বপ্ন পূরণের পথে শেষ পেরেকটি ঠুকে দেয়?
হাজারি ঠাকুর আর আদর্শ হিন্দু হোটেলের গল্পটাও ঠিক এমনই এক স্বপ্নের। বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের অপেক্ষাকৃত কম আলোচ্য এই উপন্যাসটির শুরুটা হয় বেচু চক্কোত্তির আদি ও অকৃত্রিম হিন্দু হোটেল থেকে। রাণাঘাটে আদর্শ হিন্দু হোটেল বাস্তবেও রয়েছে, এবং সে থেকেই বিভূতিভূষণ এই উপন্যাস রচনার ইন্ধন নেন। খুব সম্ভবত ১৯৬২ গোপীনাথ কুণ্ডু এই হোটেল শুরু করেছিলেন। বর্তমান হোটেলের পেছনে তখন ছিল বৈদ্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের বাড়ি। হোটেলের মালিকও সেখানেই থাকতেন ও বাড়ির সামনেই হোটেলটি চালু করা হয়। এদিকে বৈদ্যনাথ মুখোপাধ্যায় ছিলেন বিভূতিভূষণের আত্মীয়। সে সূত্রে প্রায়ই আসা-যাওয়া ছিল তার। মজার ব্যাপার হলো, উপন্যাসটি হোটেল চালু হবার ২০ বছরেরও বেশি আগে লেখা হয়েছে। এমনটা হতেই পারে যে হোটেলের নামটা আগে ঠিক করা ছিল, এবং এ থেকে লেখকমন আরো বহু কিছু কল্পনা করে নিয়েছেন।
শুরুতে উপন্যাসের মূল চরিত্রকে তেমন শক্তিশালী অবস্থানে পাওয়া যায় না। এখানে লেখক পাচক হাজারি ঠাকুরকে অবহেলিত নায়ক হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। পদে পদে তার জীবনের দারিদ্র্য, গঞ্জনা, অবহেলা নিয়েই কাহিনীর পথচলা। আর সেই পথচলায় তার সঙ্গ দেয় একটাই স্বপ্ন-
তার নিজের হোটেল হবে, যেখানে বাইরে লেখা থাকবে,
হাজারি চক্রবর্তীর হিন্দু হোটেল
রাণাঘাট
ভদ্রলোকদের সস্তায় আহার ও বিশ্রামের স্থান।
আসুন! দেখুন!! পরীক্ষা করুন!!!
কে এই হাজারি ঠাকুর? মামুলি একজন হোটেলের রাঁধুনী বামুন। তার হাতের রান্নায় প্রচুর স্বাদ। তবু যেন নীরবে-নিভৃতেই তার যাপন। প্রাপ্য প্রশংসার আশায় চাতকের মত চেয়ে থাকে, কেউ ফিরেও চায় না। তাই দিনশেষে একটু দয়া পেয়েই নিজেকে ধন্য মনে করতে হয় তাকে। হাজারির কাছে তার পেশা অনেকটা নেশার মতোই। রান্না তার কাছে তেমনই, যেমন একজন শিল্পীর শিল্প। বয়সের রেখা তাকে ক্রমশ গ্রাস করছিলো, সাথে অস্বীকৃতির দায়। তার গুণেই যে হোটেলের খদ্দের বারবার ফিরে আসে, সে কথা কেউ মানেনি। না মানার দলে সর্বাগ্রে থাকে পদ্মঝি, তাকে হাজারি ডাকে ‘পদ্মদিদি’ বলে। হোটেলের মালিকের সাথে পদ্মের বড় ভাব, আর তাই অন্যদের উপর ছড়ি ঘোরাতে সে সিদ্ধহস্ত।
সাত টাকা মাইনের চাকরি থেকে নিজের হোটেল, স্বপ্নটা একজন রাঁধুনী বামুনের জন্য অনেক বেশিই। সততার পথ থেকে একটুও না সরে, তিল তিল করে টাকা জমিয়ে এবং কিছু অনাত্মীয় আপনজনদের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করে সে তার হোটেলের স্বপ্নের পথে একটু একটু করে পা বাড়ায়।
বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের অন্যান্য উপন্যাসের মতো এ বইয়েও প্রকৃতির বৈচিত্র্যময় সৌন্দর্য রয়েছে অনেকটা জায়গা জুড়ে। ১৯৪০ সালে বইটি প্রকাশ পেয়েছিল। তখন ভারতে চলছে ইংরেজ শাসনামল। উপন্যাসের ধরন অনুযায়ী এটিকে একটি সামাজিক উপন্যাস বলা যায়, যেহেতু এখানে একটি নির্দিষ্ট সময়ের নির্দিষ্ট সমাজের এবং মূলত নির্দিষ্ট পেশার কথা বলা হয়েছে। তবে এই উপন্যাসের একটি গূঢ় মনস্তাত্ত্বিক দিক রয়েছে, যে কারণে একে মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস বলাটাও এড়িয়ে যাওয়া যায় না। এখানে হাজারি ঠাকুর ও পদ্মঝির মধ্যিকার সম্পর্কটা একপ্রকার আনুগত্যের বয়ান করে। যে আনুগত্য শ্রেণিবোধ থেকে নয় বরং ব্যক্তিত্বের প্রভাব থেকে সৃষ্ট। পদ্মঝি নিজেও বেচ্চু চক্কোত্তি হোটেলে ঝিয়ের কাজই করে, যদিও মালিকের সাথে তার ঘনিষ্ট সম্পর্ক রয়েছে, তারপরও সে কিন্তু হাজারি ঠাকুরেরই শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত। বেতনভুক্ত শ্রমিকদের ক্ষেত্রে এখানে পদ্মঝি উচ্চশ্রেণির ও হাজারি ঠাকুর অপেক্ষাকৃত নিম্নশ্রেণির শ্রমিক ধরা যায়।
হাজারি ঠাকুর ছাড়াও এই উপন্যাসে দেখা পাই পদ্ম ঝি, বেচু চক্কোত্তি, মতি চাকর প্রভৃতির। এদের জীবনটা ঘিরে থাকে হোটেল, রান্না-বান্না, খদ্দের, হোটেলের মানরক্ষা এবং উত্তরোত্তর উন্নতি; সাথে অবশ্যই ফাঁকফোঁকর দিয়ে নিজের আয়বৃদ্ধি ও উপরি পাওনা । হাজারি অন্যদের মতো নয়, সে তার কাজের সাথে অত্যন্ত সৎ। কিন্তু তার সরলতার সুযোগ নিয়ে পদ্ম ঝি তাকে প্রায়ই উপহাস করে এবং ঠকাতেও ছাড়ে না। একদিন হোটেলের বাসনকোসন চুরি যায়। হাজারির উপরই দোষ চাপানো হয় এবং সে এই চাকরিটি হারায়।
হাজারি ঠাকুরের জীবনের চড়াই-উতরাই এবং তার উপর আশেপাশের অন্যান্য চরিত্রের প্রভাবকে লেখক আকর্ষণীয় বেশ কিছু ঘটনার মধ্য দিয়ে প্রকাশ করেছেন। মনস্তত্ত্বের ভিন্ন ভিন্ন মাত্রার ব্যাখ্যাও পাওয়া যায় এই উপন্যাসে। কাহিনীর গতিময়তার কারণে কখনো একঘেয়ে লাগবে না, বরং টানটান এক গল্পময় গাঁথুনির মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাওয়া যাবে সমাপ্তির দিকে। এর সবচেয়ে বড় ধাক্কা সমাপ্তিতেই। শেষটায় এসে যেন একধরনের অতৃপ্তির স্বাদ থেকে যায়, যা একে ছোটগল্পের বৈশিষ্ট্যের ছোঁয়া দেয়। শেষটায় এসে থমকে যেতে হয়, তখন ভাববার আরো অনেক কিছুই থেকে যায়। লেখক এখানে যবনিকা শুধু টেনে দিয়েই থেমে থাকেননি, বরং শেষটা এমন করেছেন, যাতে করে পাঠক বইটি শেষ করবার পর কিছুক্ষণ নিজের মধ্যেই থমকে যেতে পারে। একটি ভালো বইয়ের অন্যতম গুণ বোধকরি এটাই যে তা শেষ হবার পরও অনেকটা সময় ধরে পাঠকমনে তার রেশ ধরে রাখে। ‘আদর্শ হিন্দু হোটেল’ নিঃসন্দেহে তা করবে এবং হাজারি ঠাকুরের জীবনের উত্থান-পতন এবং মনস্তত্ত্বের বহুমাত্রিকতা উপন্যাসটিকে একটি ভিন্ন ধাঁচ দিতে সমর্থ হয়েছে।
অনুপ্রেরণার দিক দিয়ে এই উপন্যাস অত্যন্ত ভালো একটি উদাহরণ। সব গণনাই শূন্য থেকে শুরু হয় এবং হাজারি ঠাকুর এই কথাটিকে কড়ায়-গণ্ডায় সত্যি প্রমাণ করে। নিজের লক্ষ্যে অটল থাকলে বহু বাধাবিপত্তির পরও সফল হওয়া যায়। নিজের উপর বিশ্বাস থাকলে আর স্বপ্নপূরণের জন্য অদম্য বাসনা থাকলে কিছুই আটকাতে পারে না সে স্বপ্নের কাছে যাওয়া থেকে। শূন্য থেকে শুরু করা হাজারি ঠাকুরের সফলতা পাঠককে অনেক অনুপ্রেরণা দেবে এবং কিছুটা সময়ের জন্য হলেও ব্যর্থতার গ্লানি থেকে দূরে রাখতে পারবে। আঁধারের মাঝে কিছুটা আলোর রেখা দেবার মতোই একটি চরিত্র হাজারি ঠাকুর।
কিন্তু এই উপন্যাসের মধ্য দিয়ে লেখক এ সমাজের সবচেয়ে কুৎসিত সত্যটিও উপস্থাপন করেছেন। অর্থই সকল অনর্থের মূল- এই উক্তিটি বহুল পরিচিত হলেও সকলেই জানি যে অর্থ ছাড়া এক তিলও চলা যায় না। আর ভোগবাদী সমাজে তো সকল মান-সম্মান-অবস্থানের নির্ধারক হচ্ছে অর্থ। ‘আদর্শ হিন্দু হোটেল’ও বাস্তব এই সত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখেনি, বরং পাঠকদেরকে এর মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। পদ্মঝি ও হাজারি ঠাকুরের মধ্যকার সম্পর্কও এই গূঢ় অথচ সাধারণ সত্যের একটি বড় উদাহরণ।
তবে সব চরিত্র ও সম্পর্কই এমন নয়। অনাত্মীয় বেশ কিছু লোক হাজারিকে তার স্বপ্নপূরণের পথে এগিয়ে যেতে সাহায্য করে এবং তাদের সহযোগিতা ছাড়া হাজারি বাস্তবিক অর্থেই একা ও অসহায় হয়ে পড়তো তার সততা ও নিষ্ঠা থাকা সত্ত্বেও। লেখক এখানে ব্যক্তি-মানুষের খারাপ-ভালো দুটো দিকই দেখাতে সমর্থ হয়েছেন। মানুষ আদতে ভালো না খারাপ? এ প্রশ্নের উত্তর বহুকাল ধরে বহু সমাজবিজ্ঞানী, মনোবিজ্ঞানীরা অন্বেষণ করে এসেছেন। কারো মতে, মানুষ খারাপ, তো কারো মতে ভালো। কেউ বা একটু এগিয়ে গিয়ে ভেবেছেন যে মানুষ পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে ভালো বা খারাপ প্রতিক্রিয়া দেখায়। সবদিকেই রয়েছে অনেক যুক্তি ও তর্কের অবস্থান। বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের ‘আদর্শ হিন্দু হোটেল’ উপন্যাসটির মাধ্যমে পাঠকেরা মানুষের সহজাত ভালো-খারাপ এবং পরিস্থিতি অনুযায়ী প্রতিক্রিয়া দেখানো- এ সব বৈশিষ্ট্যের উপস্থিতিই পাবেন। এবং উপন্যাসের শেষে আসলে প্রশ্নটির উত্তর কী, তা ভাববার অবকাশও রয়েই যায়।
ফিচার ইমেজ: ittadishop.com