গত ৩ আগস্ট ভারতে মুক্তি পেয়েছে পরিচালক অনুভব সিনহার ছবি ‘মুল্ক’। মুক্তির আগে থেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক ঝড় তুলেছিলো এ ছবির ট্রেইলার। সম্প্রতি মুক্তি পাওয়ার পর ‘মুল্ক’ নিয়ে বেড়েই চলছে তর্ক-বিতর্ক। কী আছে এই ছবিতে? কী দেখাতে চেয়েছেন পরিচালক অনুভব সিনহা? যে ছবি মুক্তির পর তাকে নিয়ে ভারতে সমালোচনার ঝড় উঠেছে একদিকে, অপরদিকে তাকে এই সময়ের সাহসী পরিচালক বলছেন অনেকে, বাহবাও দিচ্ছেন। যদিও সংবাদমাধ্যমগুলোর বরাতে দ্বিতীয় দলের সংখ্যাটাই ভারি।
মুল্ক বেনারসে বসবাসকারী একটি মুসলিম পরিবারের হারানো আত্মসম্মান পুনরুদ্ধারের কাহিনী। বেনারসের একটি মুসলিম যৌথ পরিবারের জীবনকে তুলে ধরা হয়েছে ছবিটিতে। বেনারসের সেই মু্সলিম পরিবারে দুই ভাই মুরাদ (ঋষি) ও বিলালের (মনোজ পহওয়া) পরিবার একসঙ্গে থাকে। ভারতীয় আট-দশটা মুসলিম যৌথ পরিবার যেমন হয় তাদেরটাও ব্যতিক্রম নয়।
মুরাদ পেশায় আইনজীবী। অপর ভাই বিলাল ছোট দোকানি। মুরাদের ছেলে (ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত) থাকেন ইংল্যান্ডে। তিনি বিয়ে করেন এক হিন্দু নারীকে। তার হিন্দু স্ত্রী আরতি (তাপসী) বেনারসে এসেছেন শ্বশুরবাড়িতে কয়েকদিন থাকবেন বলে। এরই মধ্যে এলাহাবাদে ঘটে এক ভয়াবহ বিস্ফোরণ। সেই বিস্ফোরণে মারা যায় ১৬ জন। বিলালের ছেলে শাহিদ (প্রতীক বব্বর) এই বিস্ফোরণের মূল হোতা। সন্ত্রাসবাদী ও জঙ্গি হিসেবে পুলিশের টার্গেটে পরিণত হয় সে। পুলিশের ‘এনকাউন্টার স্পেশালিস্ট’ দানিশ (রজত) এর হাতে নিজ বাড়িতে মারা যায় শাহিদ।
গল্পের শুরুটা এখানেই। এরপর থেকেই সেই পরিবারের উপর চলতে থাকে নানা টানাপোড়েন। পরিবারের বাকি সদস্যরা যদিও এর কিছুই জানেন না। কিন্তু প্রশাসন আর সরকার উঠে পড়ে লাগে এটা প্রমাণ করতে যে, গোটা পরিবারই এই সন্ত্রাসবাদ বা জঙ্গিবাদের সাথে জড়িত। সেই সাথে এই ছবিতে বারবার মানবমনের এক ধারণার দেখা মেলে যে, মুসলিম মানেই তাকে সন্দেহ করা। এর মাঝেই বিলালকে তুলে নিয়ে যায় পুলিশ। মুরাদও গ্রেফতার হয়। সরকারি আইনজীবী সন্তোষ (আশুতোষ) আদালতে প্রমাণ করার চেষ্টা করে, মুরাদ ও বিলালের গোটা পরিবারই দেশবিরোধী সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে যুক্ত ও তারা জঙ্গি। প্রমাণের কোনো দরকার হয় না। কারণ তারা মুসলমান!
সমাজেও তারা একঘরে হয়ে পড়ে। সকলের চোখেই অবিশ্বাস। পরিবারের সম্মান বাঁচাতে শ্বশুরের অনুরোধে মামলা লড়তে নামেন আরতি। সমানে সমানে টক্কর দেন ঝানু সরকারি আইনজীবীর সঙ্গে। এ নিয়েই এগোতে থাকে সিনেমার কাহিনী। সেই পরিবারের একটি ছেলে সন্ত্রাসবাদী পরিচয়ে নিহত হওয়ায় গোটা পরিবারের ওপর দিয়ে যেভাবে ঝড় বয়ে যায়, তা নিয়েই এই সিনেমার গল্প।
সিনেমার বহু দৃশ্যে বারবার ফুটে এসেছে ইসলামোফোবিয়ার কাহিনী। ছবির কিছু সংলাপ প্রশ্ন তোলে এই সমাজের দিকে কিংবা দৃশ্যায়িত করে সমাজব্যবস্থার ভুল ধারণাগুলোকে। ছবির এক সংলাপে অভিনেতা ঋষি কাপুরকে বলতে শোনা যায়,
যতদিন পাকিস্তানের জয়ে ভারতে একটি মুসলিম পরিবারও উল্লাস করবে, ততদিন তাদের মহল্লার দেওয়ালে পাকিস্তানি লেখা থাকবেই।
আবার আদালতে সরকারি কৌঁসুলি বলেন,
মুসলিম পরিবারে অনেক বাচ্চাকাচ্চা হয় বলে তাদের এক-আধটাকে জিহাদের কাজে লাগিয়ে দেওয়া হয়।
মুক্তি পাওয়ার আগে থেকেই আলোচনা ও তর্ক-বিতর্কের অবসান হচ্ছে না মুল্ক নিয়ে। মুসলিমদের প্রতি সহানুভূতিমূলক মনোভাব নিয়ে এই ছবি তৈরি করেছেন বলে অনেকে অভিযোগ করছেন পরিচালক অনুভব সিনহাকে। অনেকে তো অভিযোগ করেছেন, অনুভব সিনহা পাকিস্তানিদের দালালি করতেই তৈরি করেছেন এই ছবি!
এমনকি তিনি নাকি মাফিয়া ডন দাউদ ইব্রাহিমের টাকায় তৈরি করছেন এমন মুসলিমদের প্রতি সহানুভূতিমূলক ছবি! দোষটা ঠিক কোথায় তা কেউ বলতে পারছেন না, কিন্তু অভিযোগের অন্ত নেই। তবে কি সমাজের ইসলামোফোবিয়া ও সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে মুসলিমদের লড়াই করে বেঁচে থাকার দৃশ্য দেখানোটাই অপরাধ অনুভব সিনহার? আর এজন্যই অনেকে অবলীলায় তাকে বানিয়ে দিল পাকিস্তানের দালাল। অবশ্য এসব অভিযোগের শক্ত জবাব দিয়েছেন অনুভব সিনহা। তিনি বলেছেন,
আপনাদের মনিবদের জন্য আমি এই ছবি বানাইনি। অনেকে ছবিটাকে রাজনৈতিক দৃষ্টিতে দেখলেও আসলে এটা রাজনীতির ছবি নয়- বরং আবেগের ছবি, কোর্টরুম ড্রামার ছবি। হ্যাঁ, ‘মুল্ক’ সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রশ্ন তুলেছে ঠিকই, কিন্তু তার কোনো উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করেনি। উত্তর খোঁজার ভার দর্শকেরই।
অনুভব সিনহার বিরুদ্ধে ওঠা নানা সমালোচনার বিরুদ্ধে জবাব দিতে গিয়ে কলকাতার একজন লেখক সম্রাট মুখোপাধ্যায় বলেন, যে দেশে লোকে গো-হত্যার বদলা নিতে নরহত্যার পথে হাঁটে, সেই দেশে এই ছবি নিঃসন্দেহে কিছু প্রশ্নের ঝাঁপি খুলে দেয়।”
যে ছবি বানানোর জন্য অনুভব সিনহাকে ভারতে অনেকের কাছে শুনতে হয়েছে সে ‘পাকিস্তানের দালাল’, সেই পাকিস্তানেই ‘মুল্ক’ ছবি মুক্তিতে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে পাকিস্তান সেন্সর বোর্ড। নিষিদ্ধ হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে পরিচালক অনুভব সিনহা একটি টুইট করেন।
অবশ্য অনেকের মতে, মুল্ক ভারতের বর্তমান সমাজ ব্যবস্থার প্রতি একটি কঠোর জবাব। সাম্প্রতিক সময়ে ভারতে একটি বিশেষ ধর্মের মানুষকে যেভাবে লড়াই করতে হচ্ছে সমাজে টিকে থাকার জন্য ও নিজেদের দেশপ্রেম প্রমাণ করার জন্য, এই সিনেমা সেই সমাজকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে। যে সময়ে ভারতের চল্লিশ লক্ষ লোকের নাগরিকত্ব নিয়ে প্রশ্ন ওঠে, সেসময় এই ছবি অনেক প্রাসঙ্গিক ও অনেক প্রয়োজন।
‘মাদারিং অ্যা মুসলিম’ বইয়ের লেখিকা ও গবেষক নাজিয়া বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে মুল্ক ছবি নিয়ে বলেছিলেন,
এই ছবিতে সাঙ্ঘাতিক একটি সংলাপ ব্যবহৃত হয়েছে, আমার ঘরেই আমাকে স্বাগত জানানোর তুমি কে? এটা তো আমারও ঘর। অর্থাৎ হিন্দুরা বিরাট উদারতা দেখিয়ে ভারতে মুসলিমদের থাকতে দিয়েছে- এই রেটোরিকটার ঝুঁটি ধরে নাড়া দিয়েছে এই সিনেমা। ছবির দ্বিতীয় যে জিনিসটি আমাকে ভাবিয়েছে তা হলো সন্ত্রাসবাদ মানে শুধু কারো জীবন নেওয়া নয়, রাজনৈতিক বা সামাজিক ফায়দা লোটার জন্য যখন কাউকে ভয় দেখানো হয়, হুমকি দেওয়া হয়- সেটাও কিন্তু সন্ত্রাসবাদ!
ছবির অন্যতম অভিনেত্রী তাপসী পান্নু আবার ছবি মুক্তির সময়েই সরাসরি বলেছিলেন,
ভারতে একটা বিশেষ ধর্মের মানুষকে যেভাবে আক্রমণের নিশানা করা হচ্ছে, সেটাই তাকে এই ছবি করতে অনুপ্রাণিত করেছিল।“
সকল তর্ক-বিতর্ক ছাপিয়ে এ ছবি এখন দর্শকের কাঠগড়ায়। এখন দেখবার পালা, এ ছবি কি পারবে সত্যিই দর্শকদের প্রশ্নবিদ্ধ করতে? আর দর্শকরাই কি পারবেন সেসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে নিতে?
ফিচার ইমেজ – Podbean