অনেক সাহিত্যিক আছেন যারা বছরের পর বছর ধরে নিজের লেখনীর ঝুড়িতে শত শত বই আর পাণ্ডুলিপি যুক্ত করেও পাঠকের হৃদয়ে এবং সাহিত্যের বিশাল সাম্রাজ্যে নিজের স্থানটি ঠিক পাকাপোক্ত করে তুলতে পারেন না। আবার সাহিত্যের আকাশে কখনো কখনো এমনও অনেক নক্ষত্র দেখা যায় যাদের লেখনীর সংখ্যা হয়তো খুব বেশি নয় কিন্তু জীবনবোধের গভীরতায় সেই লেখা মানুষের হৃদয়ে অমর হয়ে থাকছে চিরকাল। এমনই এক সাহিত্যিক স্যার উইলিয়াম গোল্ডিং, পুরো নাম স্যার উইলিয়াম জেরাল্ড গোল্ডিং। তার লেখনীর সংখ্যা মোটেও খুব বেশি নয়, বইয়ের কথা বলতে গেলে তার সংখ্যা আরো কম। ‘লর্ড অফ দ্যা ফ্লাইজ’, ‘ফ্রি ফল’ ‘ পিচার মার্টিন’, ‘দ্যা স্পাইর’, ‘ডার্কনেস ভিসিবল’- এগুলো হলো তার উল্লেখযোগ্য বইসমূহ। কিন্তু তা দিয়েই তিনি ইংরেজী সাহিত্যে তথা বিশ্বসাহিত্যে চিরকালের জন্য এক প্রশংসনীয় স্থান দখল করে নেন।
১৯৮০ সালে তিনি ‘রাইটস অফ প্যাসেজ’ নামক রোমাঞ্চকর সমুদ্রযাত্রার ওপর লেখা বইয়ের জন্য জিতেছেন সাহিত্যের অন্যতম সম্মাননা ‘দ্যা বুকার প্রাইজ’। পরবর্তীতে ১৯৮৩ সালে তিনি ‘ লর্ড অফ দ্যা ফ্লাইজয়ের’ জন্য সাহিত্যে নোবেল পুরষ্কারে পুরষ্কৃত হোন। মানুষের আসল প্রকৃতি ও প্রবৃত্তি, জীবনবোধের বাস্তবতা, সভ্যতার মেকি মুখোশ আর ভঙ্গুর সমাজব্যবস্থা বুঝতে আজো ইউরোপের সকল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকাভুক্ত হয়ে আছে গোল্ডিংয়ের বইসমূহ।
‘লর্ড অফ দ্যা ফ্লাইজ’ প্রকাশের কয়েক বছরের মধ্যেই আমেরিকার প্রায় শতাধিক কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নিয়মিত পাঠ্যক্রমে যুক্ত হয়। জনবসতিহীন দ্বীপে আটকে পড়া কিশোররা কিভাবে সভ্যতার মুখোশ ছেড়ে বেরিয়ে আসে নিজেদের আদিমতম বর্বররূপে, শেখানো শৃঙ্খলা ও নীতিবোধ ছেড়ে মানব প্রবৃত্তি কতো সহজেই ঝুঁকে যায় ক্ষমতার লোভ ও প্রতিপত্তির আকাঙ্খায়- সেটাই দেখানো হয়েছে এই উপন্যাসে। ‘পিচার মার্টিনে’ লেখক বলেছেন পাপাচারে পূর্ণ এক নাবিকের জীবন, হতাশা, সমুদ্রযাত্রা আর তার যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যুর কাহিনী।
‘ফ্রি ফল’ তুলে ধরে গোল্ডিংয়ের দৃষ্টি থেকে মানবকে, যেন সে মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে থাকা কুচক্রী শয়তান, যেন সুযোগ পেলেই সে হামলে পড়বে নিষ্পাপের ওপর আর খুবলে খাবে দূর্বলকে। মূলত গোল্ডিং মানব প্রকৃতি সম্পর্কে পাঠককে এই সত্যই সর্বদা বোঝাতে চেয়েছেন যে- “যেভাবে মধু বানানোই মৌমাছির স্বভাব, সেভাবে পাপের দিকে ঝোঁকাই মানুষের সহজাত”। সমস্ত সৎ গুণাবলি, মূল্যবোধ, সততা, শৃঙ্খলা, আত্মনিয়ন্ত্রণ- সবই মানুষকে শিক্ষা দিতে হয়, কিন্তু না শেখালেও সে চুরি, রাহাজানি, হত্যা, মিথ্যা এসব জেনে নেয় নিজের প্রবৃত্তি থেকেই। এটাই তো মানবের ছলে-বলে লুকাতে চেষ্টা করা চিরায়ত সত্য।
ইংল্যান্ডর কর্ণওয়াল রাজ্যের নিউকোয়েতে ১৯১১ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর গোল্ডিং জন্মগ্রহন করেন। মালবোর্গ গ্রামার স্কুলের বিজ্ঞানের শিক্ষক ছিলেন তার পিতা অ্যালেক্স। সেই সুবাদে মালবোর্গেই তার ছেলেবেলা কাটে। বাবার স্কুলেই গোল্ডিং ও তার বড়ো ভাইয়ের শিক্ষাজীবন শুরু হয়। মা মিল্ডরেডকে তার কাছে অনেকটা কুসংস্কারে বিশ্বাসী মনে হলেও ছোটবেলায় তার কাছে শোনা রূপকথাগুলো তার সৃজনশীলতা, কল্পনা শক্তি ও সংস্কৃতি সম্পর্কে তার জ্ঞানকে উন্নত করে বলে মনে করতেন গোল্ডিং। এছাড়া মিল্ডরেড ছিলেন মহিলাদের ভোটাধিকার আদায়ের আন্দোলনের একজন সক্রিয় কর্মী।
ছোটবেলা থেকেই নিজের প্রতিভা আআর সৃজনশীলতার সাক্ষর রাখেন গোল্ডিং। মাত্র সাত বছর বয়সেই গল্প লেখা শুরু করেন, বারো ববছর বয়সে প্রথম উপন্যাস লেখায় হাত দেন তিনি। ১৯৩০ সালে প্রাকৃতিক বিজ্ঞান পড়ার জন্য অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিনস্ত ব্রাসনোজ কলেজে ভর্তি হোন। কিন্তু দুই বছর পরে তিনি বিজ্ঞান বাদ দিয়ে পাঠ্যবিষয় হিসেবে সাহিত্য গ্রহন করে এবং এই সিদ্ধান্তই তার জীবনকে বদলে দেয়। ১৯৩৪ সালে তিনি দ্বিতীয় শ্রেণীতে সাহিত্যে ব্যাচেলর ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর শীঘ্রই ‘পোয়েমস’ (Poems) নাম নিয়ে তার এক কবিতার বই বের হয়। পেশাজীবনে গোল্ডিং ছিলেন শিক্ষক। ১৯৩৮-১৯৪০ সাল পর্যন্ত মেডস্টোন গ্রামার স্কুলে দর্শন ও ইংরেজি পড়ান তিনি। পরে দর্শন বাদ দিয়ে কেবল ভাষা ও সাহিত্যকেই শিক্ষকতার বিষয় হিসাবে বেছে নেন এবং ১৯৪৫ সালে বিশপ ওয়ার্ডওয়ার্থ স্কুলে কেবল ইংরেজীর শিক্ষক হিসাবে নিযুক্ত হোন।
গোল্ডিংয়ের লেখনীগুলো মানুষের নেতিবাচক দিক দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হওয়ার অন্যতম কারণ হিসাবে ধরা হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তার অভিজ্ঞতাকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যোগদানের পর ববিভিন্ন সময় তার সসম্মুখ সমরের অভিজ্ঞতা হয়। ১৯৪০ সালে মিত্রবাহিনীর পক্ষ থেকে রাজকীয় নৌবাহিনীতে যোগদান করেন তিনি। এছাড়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের উল্লেখযোগ্য দিন ডি-ডেতে ফ্রান্সের নর্মান্ডি দখল করার অভিযানে নিযুক্ত সৈন্যদের সাথে মিত্রবাহিনীর কমান্ডার হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন গোল্ডিং।
মিত্রবাহিনীর হয়ে ফ্রান্স দখলের সময় তিনি যুদ্ধ করেন এবং সে সময় তার দায়িত্ব ছিলো নির্ধারিত লক্ষ্যে রকেট নিক্ষেপণ। ব্রিটিশ রাজকীয় নৌবাহিনীতে লেফটেনেন্ট গোল্ডিং পাঁচ বছর দায়িত্ব পালন করেন। বাবা নাস্তিক হলেও তিনি ছিলেন খ্রিস্টধর্মে বিশ্বাসী কিন্তু কোনো চার্চের অধীনতা তিনি কখনো স্বীকার করেননি। অ্যান ব্রুকফিল্ড নামের এক রসায়নবিদ নারীকে ১৯৩৯ সালে ৩০ শে সেপ্টেম্বর তিনি বিয়ে করেন এবং তাদের সংসারে দুইজন সন্তানের আগমন ঘটে। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত স্ত্রী অ্যান ছিলেন তার বিশ্বস্ত সঙ্গী।
সাহিত্যিক হিসেবে গোল্ডিংয়ের যাত্রা প্রথমদিকে খুব একটা সহজ ছিলো না। নিজের প্রথম উপন্যাস ‘লর্ড অফ দ্যা ফ্লাইজের পান্ডুলিপি নিয়ে তিনি প্রকাশকদের দ্বারে দ্বারে ঘুরেও ফিরে গেলেন বারবার। পরে চার্লস মনটিথ নামের এক নবীন সংস্কারক দ্বারা সামান্য পরিবর্তিত হয়ে ১৯৫৪ সালে প্রকাশিত হয় এই লেখাটি এবং অতি অল্প সময়ের মধ্যেই তা তাকে এনে দেয় প্রচুর সম্মাননা ও খ্যাতি।
১৯৭৯ সালে গোল্ডিং ‘জেমস টাট ব্লাক মেমোরিয়াল পুরষ্কার’ অর্জন করেন তার লেখা একটি মাত্র নাটক হলো ‘দ্যা ব্রাস বাটারফ্লাই’। ১৯৮৮ সালে তিনি সম্মানিত ‘দ্যা নাইট ব্যাচেলর’ উপাধি লাভ করেন। তিনি ছিলেন ইংল্যান্ডের রয়েল সোসাইটি অফ লিটারেচারের একজন সম্মানিত সদস্য। বিংশ শতাব্দীর শেষে আসা লেখকদের মধ্যে থেকে সবচেয়ে প্রভাবশালী, প্রশংসিত ও নিজস্ব লেখনীতে অনন্য লেখকদের একজন হিসাবে দ্রুতই সাহিত্যের ইতিহাসে তার স্থায়ী আসন প্রতিষ্ঠা পায়।
১৯৯৩ সালের সেপ্টেম্বরে ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, কবি ও কলাম লেখক উইলিয়াম গোল্ডিংয়ের সম্মানে প্রথম আন্তর্জাতিক গোল্ডিং সাহিত্য উৎসবের আয়োজন করা হয়। এই উৎসবের সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিকটি ছিলো এখানে গোল্ডিংয়ের স্বয়ং উপস্থিত থাকার পরিকল্পনা ও আয়োজন করা হয়। কিন্তু ঈশ্বরের পরিকল্পনা ছিলো অন্যকিছু। তাই সেই বছরের অর্থাৎ ১৯৯৩ সালের ১৯ জুন হঠাৎ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে উইলিয়াম গোল্ডিং মৃত্যুবরণ করেন।
মৃত্যুর সময় গোল্ডিং ‘দ্যা ডাবল টাং’ নামের প্রাচীন ডেলফির প্রেক্ষাপটে রচিত নিজের শেষ উপন্যাসের খসড়া রেখে যান। লেখকের মৃত্যুর পরে এই উপন্যাস প্রকাশিত হয়। ২০০৮ সালে দ্যা টাইমস পত্রিকা তাকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে আসা শ্রেষ্ঠতম ৫০ জন ব্রিটিশ লেখকদের একজন বলে ঘোষণা দেয়। বিশেষ করে মানব প্রকৃতির সূক্ষ্ম বিশ্লেষণে তার প্রতিভা আজো মুগ্ধ করে পাঠক ও সাহিত্যবোদ্ধাদের।