[১ম পর্ব পড়ুন]
দ্রোণাচার্যকে হত্যার উদ্দেশ্যে রচিত পাণ্ডব পরিকল্পনা
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের পঞ্চদশ দিনে কৃষ্ণ কৌরব বাহিনীর সর্বাধিনায়ক দ্রোণাচার্যকে হত্যা করার জন্য একটি সুচতুর পরিকল্পনা প্রণয়ন করেন। দ্রোণাচার্য তার একমাত্র ছেলে অশ্বত্থামাকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। এজন্য কৃষ্ণ পরিকল্পনা করেন যে, দ্রোণাচার্যকে অশ্বত্থামার মৃত্যুসংবাদ দেয়া হবে। এর ফলে দ্রোণাচার্য শোকগ্রস্ত হয়ে অস্ত্রত্যাগ করবেন এবং সেই সুযোগে তাকে হত্যা করা হবে। কিন্তু অশ্বত্থামা ছিলেন অত্যন্ত শক্তিশালী যোদ্ধা এবং তাকে হত্যা করা ছিল খুবই কঠিন কাজ। এজন্য কৃষ্ণ একটি বিকল্প বের করেন। পাণ্ডব পক্ষের অন্তর্ভুক্ত মালবের রাজা ইন্দ্রবর্মার অশ্বত্থামা নামক একটি অতিকায় হাতি ছিল। কৃষ্ণের পরামর্শে ভীম তার গদার আঘাতে উক্ত হাতিটিকে হত্যা করেন এবং এরপর দ্রোণাচার্যের অভিমুখে অগ্রসর হয়ে জোরে জোরে বলতে থাকেন যে, “অশ্বত্থামা নিহত হয়েছে!”
ভীমের কথা শুনে দ্রোণাচার্য বিচলিত হয়ে পড়েন, কিন্তু পরক্ষণেই তার অশ্বত্থামার রণকুশলতার কথা স্মরণ হয় এবং তিনি ভীমের বক্তব্যকে মিথ্যা হিসেবে বিবেচনা করে আবার যুদ্ধে লিপ্ত হন। দ্রোণাচার্য পাণ্ডব বাহিনীর সর্বাধিনায়ক ধৃষ্টদ্যুম্নের বিরুদ্ধে অগ্রসর হন এবং তার দিকে তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করেন। এমতাবস্থায় পাঞ্চালের ২০,০০০ সৈন্য একযোগে দ্রোণাচার্যের ওপর আক্রমণ চালায় এবং তার দিকে অজস্র তীর নিক্ষেপ করে। দ্রোণাচার্য মন্ত্র উচ্চারণ করে পাঞ্চালের সৈন্যদলটির বিরুদ্ধে ব্রহ্মাস্ত্র প্রয়োগ করেন এবং এর ফলে সৈন্যদলটি সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যায়। এরপর দ্রোণাচার্যের তীরের আঘাতে পাণ্ডব রথী বসুদান নিহত হন। তারপর দ্রোণাচার্যের তীরের আঘাতে মৎস্য রাজ্যের ৫০০ সৈন্য এবং পাণ্ডব বাহিনীর ৬,০০০ হাতি ও ১০,০০০ অশ্বারোহী সৈন্য নিহত হয়।
এসময় বহুসংখ্যক ঋষি দ্রোণাচার্যের সামনে আবির্ভূত হন। তারা দ্রোণাচার্যকে বলেন যে, তিনি অন্যায়ভাবে যুদ্ধ করছেন এবং তার মতো চতুর্বেদের জ্ঞানসম্পন্ন একজন ব্রাহ্মণের এরকম নিষ্ঠুরতা প্রদর্শন করা অনুচিত। তারা দ্রোণাচার্যকে জানান যে, ব্রহ্মাস্ত্রের জ্ঞানবিহীন সাধারণ সৈন্যদের বিরুদ্ধে ব্রহ্মাস্ত্র প্রয়োগ করে দ্রোণাচার্য অধর্ম করেছেন। তারা আরো বলেন যে, দ্রোণাচার্যের মৃত্যুর সময় উপস্থিত হয়েছে এবং এজন্য তার উচিত অবিলম্বে অস্ত্রত্যাগ করা। উক্ত ঋষিদের কথা শুনে দ্রোণাচার্য অত্যন্ত বিচলিত হয়ে পড়েন এবং এসময় তিনি যুধিষ্ঠিরকে তার সামনে দেখতে পান। তিনি যুধিষ্ঠিরের কাছে জানতে চান যে, অশ্বত্থামা আসলেই নিহত হয়েছেন কিনা। দ্রোণাচার্যের বিশ্বাস ছিল যে, ‘ধর্মরাজ’ হিসেবে পরিচিত যুধিষ্ঠির কখনোই মিথ্যা বলবেন না।
এমতাবস্থায় কৃষ্ণ ও ভীম দ্রোণাচার্যের কাছে মিথ্যা বলার জন্য যুধিষ্ঠিরের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে থাকেন। শেষ পর্যন্ত যুধিষ্ঠির মনস্থির করেন এবং দ্রোণাচার্যকে বলেন, “অশ্বত্থামা হত ইতি গজ!” এর অর্থ হচ্ছে, অশ্বত্থামা নামক একটি হাতি নিহত হয়েছে। কিন্তু যুধিষ্ঠির ‘ইতি গজ’ শব্দটি আস্তে বলেছিলেন, ফলে দ্রোণাচার্য সেই অংশটুকু শুনতে পাননি এবং মনে করেন যে, প্রকৃতপক্ষেই তার ছেলে অশ্বত্থামা নিহত হয়েছেন। উল্লেখ্য, যুধিষ্ঠিরের সত্যবাদিতার জন্য তার রথ সবসময় মাটি থেকে চার আঙুল ওপরে অবস্থান করত। কিন্তু দ্রোণাচার্যকে এই মিথ্যা বলার পর যুধিষ্ঠিরের রথটি মাটিতে নেমে আসে।
দ্রোণাচার্য–ধৃষ্টদ্যুম্ন যুদ্ধ: দ্রোণাচার্যের নিকট ধৃষ্টদ্যুম্ন বিপর্যস্ত
যুধিষ্ঠিরের কাছ থেকে অশ্বত্থামার মৃত্যুসংবাদ শুনে দ্রোণাচার্য শোকে প্রায় সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েন। এমতাবস্থায় ধৃষ্টদ্যুম্ন দ্রোণাচার্যের বিরুদ্ধে অগ্রসর হন এবং তার দিকে একটি বিশেষ ধরনের তীর নিক্ষেপ করেন। দ্রোণাচার্য ধনুক উঠিয়ে ধৃষ্টদ্যুম্নের বিরুদ্ধে দিব্যাস্ত্র প্রয়োগ করার চেষ্টা করেন, কিন্তু দেখতে পান যে, কোনো দিব্যাস্ত্র আর তার আহ্বানে সাড়া দিচ্ছে না। এমতাবস্থায় দ্রোণাচার্য আরেকটি ধনুক উঠিয়ে নেন এবং কিছু বিশেষ ধরনের তীর উঠিয়ে সেগুলোকে ধৃষ্টদ্যুম্নের দিকে নিক্ষেপ করেন। দ্রোণাচার্য কর্তৃক নিক্ষিপ্ত তীরের আঘাতে ধৃষ্টদ্যুম্ন কর্তৃক নিক্ষিপ্ত তীরগুলো কাটা পড়ে, ধৃষ্টদ্যুম্নের রথের ঝাণ্ডা ও ধনুক কাটা পড়ে এবং রথটির সারথি আহত হয়। প্রত্যুত্তরে ধৃষ্টদ্যুম্ন দ্রোণাচার্যকে তীরবিদ্ধ করেন এবং এরপর ক্ষিপ্ত দ্রোণাচার্যের তীরের আঘাতে আবার ধৃষ্টদ্যুম্নের ধনুক কাটা পড়ে। দ্রোণাচার্য কর্তৃক নিক্ষিপ্ত তীরের আঘাতে একে একে ধৃষ্টদ্যুম্নের সকল ধনুক এবং গদা ও তলোয়ার বাদে সকল হাতিয়ার কাটা পড়ে। এরপর দ্রোণাচার্য ধৃষ্টদ্যুম্নকে তীরবিদ্ধ করেন।
এমতাবস্থায় ধৃষ্টদ্যুম্ন তার রথকে দ্রোণাচার্যের রথের কাছাকাছি নিয়ে যান এবং রথ দুইটি পরস্পরের এত কাছাকাছি চলে আসে যে, রথ দুইটির সঙ্গে যুক্ত ঘোড়াগুলো মিশ্রিত হয়ে যায়। ধৃষ্টদ্যুম্নের কাছে আর তীর–ধনুক অবশিষ্ট না থাকায় তিনি দ্রোণাচার্যকে গদা বা তলোয়ার দিয়ে আঘাত করার উদ্দেশ্যে তার রথকে দ্রোণাচার্যের রথের এত কাছাকাছি নিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু দ্রোণাচার্যের তীরের আঘাতে ধৃষ্টদ্যুম্নের রথের সারথি নিহত হয় এবং রথটি খণ্ডবিখণ্ড হয়ে যায়। এই পরিস্থিতিতে ধৃষ্টদ্যুম্ন একটি গদা উঠিয়ে নেন এবং সেটিকে দ্রোণাচার্যের দিকে নিক্ষেপ করতে উদ্যত হন, কিন্তু দ্রোণাচার্য ক্ষিপ্রগতিতে তীরের সাহায্যে সেটিকে টুকরো টুকরো করে ফেলেন। এরপর ধৃষ্টদ্যুম্ন একটি ঢাল ও একটি তলোয়ার উঠিয়ে নেন এবং ক্ষিপ্রগতিতে তার রথের ধ্বংসাবশেষের এক অংশ থেকে অন্য অংশে যাতায়াত করে তার দিকে দ্রোণাচার্য কর্তৃক নিক্ষিপ্ত তীরবৃষ্টিকে এড়াতে থাকেন।
এসময় দ্রোণাচার্য তীরের সাহায্যে ধৃষ্টদ্যুম্নের রথের সঙ্গে যুক্ত ঘোড়াগুলোকে হত্যা করেন এবং এর ফলে দ্রোণাচার্যের রথ ধৃষ্টদ্যুম্নের রথের ধ্বংসাবশেষ থেকে পৃথক হয়ে যায়। এরপর ধৃষ্টদ্যুম্ন ঢাল–তলোয়ার হাতে দ্রোণাচার্যের দিকে ছুটে যান এবং তাকে হত্যা করার চেষ্টা করেন। কিন্তু দ্রোণাচার্যের তীরের আঘাতে ধৃষ্টদ্যুম্নের ঢাল ও তলোয়ার উভয়ই কাটা পড়ে। এরপর দ্রোণাচার্য ধৃষ্টদ্যুম্নকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে তার দিকে একটি বিশেষ ধরনের তীর নিক্ষেপ করেন, কিন্তু সাত্যকি কর্তৃক নিক্ষিপ্ত একটি তীরের আঘাতে সেটি কাটা পড়ে।
এসময় দুর্যোধন, কর্ণ, কৃপাচার্য ও দুর্যোধনের ভাইয়েরা মিলে সাত্যকিকে ঘিরে ফেলেন এবং তার ওপর আক্রমণ চালান। এটি দেখে যুধিষ্ঠির, ভীম, নকুল ও সহদেব অগ্রসর হয়ে সাত্যকির চারপাশে অবস্থান নেন এবং তাকে রক্ষা করতে থাকেন। উভয় পক্ষের মধ্যে তীব্র যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। এমতাবস্থায় দ্রোণাচার্য ও ধৃষ্টদ্যুম্নের মধ্যে চলমান দ্বৈরথ যুদ্ধে ধৃষ্টদ্যুম্নকে বিপর্যস্ত অবস্থায় দেখে যুধিষ্ঠির দ্রোণাচার্যকে আক্রমণ করার জন্য শ্রীঞ্জয় রাজ্যের সৈন্যদের নির্দেশ দেন। শ্রীঞ্জয়ের সৈন্যরা দ্রোণাচার্যের দিকে অগ্রসর হয় এবং তাদের মধ্যে প্রচণ্ড যুদ্ধ আরম্ভ হয়ে যায়। দ্রোণাচার্যের তীরের আঘাতে শ্রীঞ্জয়ের ২৪,০০০ সৈন্য নিহত হয় এবং এরপর তার তীরের আঘাতে আরো হাজার হাজার পাণ্ডব সৈন্য হতাহত হয়।
দ্রোণাচার্য–ধৃষ্টদ্যুম্ন যুদ্ধ: দ্রোণাচার্যের প্রতি ভীমের তিরস্কার এবং দ্রোণাচার্যের হত্যাকাণ্ড
দ্রোণাচার্যের হাতে বিপুল সংখ্যক পাণ্ডব সৈন্যকে নিহত হতে দেখে ভীম দ্রোণাচার্যের দিকে অগ্রসর হন এবং রথবিহীন ধৃষ্টদ্যুম্নকে নিজের রথে তুলে নেন। ভীম দ্রোণাচার্যকে হত্যা করার জন্য ধৃষ্টদ্যুম্নকে আহ্বান জানান। এরপর ধৃষ্টদ্যুম্ন একটি নতুন রথে চড়ে আবার দ্রোণাচার্যের বিরুদ্ধে অগ্রসর হন এবং তাদের মধ্যে আবার তীব্র দ্বৈরথ যুদ্ধ শুরু হয়। ধৃষ্টদ্যুম্ন মন্ত্র উচ্চারণ করে দ্রোণাচার্যের বিরুদ্ধে ব্রহ্মাস্ত্র ও অন্যান্য দিব্যাস্ত্র প্রয়োগ করেন এবং এর মাধ্যমে দ্রোণাচার্য কর্তৃক নিক্ষিপ্ত সমস্ত তীরবৃষ্টিকে প্রতিহত করেন। ধৃষ্টদ্যুম্নের তীরের আঘাতে বিপুল সংখ্যক কৌরব সৈন্য নিহত হয়। এমতাবস্থায় দ্রোণাচার্যের তীরের আঘাতে ধৃষ্টদ্যুম্নের ধনুক কাটা পড়ে এবং ধৃষ্টদ্যুম্ন আহত হন।
এটি দেখে ভীম দ্রোণাচার্যের দিকে অগ্রসর হন এবং তাকে কঠোরভাবে তিরস্কার করেন। ভীম দ্রোণাচার্যকে উদ্দেশ্য করে বলেন যে, যদি দ্রোণাচার্যের মতো ব্রাহ্মণরা নিজেদের বর্ণের নিয়ম অনুসরণ করে এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করতেন, সেক্ষেত্রে এভাবে ক্ষত্রিয়রা নিশ্চিহ্ন হতো না। ভীম বলেন যে, দ্রোণাচার্য তার ছেলের জন্য এই যুদ্ধে অংশ নিয়ে ক্ষত্রিয়দের হত্যা করেছেন, কিন্তু তার সেই ছেলে এখন নিহত অবস্থায় যুদ্ধক্ষেত্রে পড়ে রয়েছে। ভীম যোগ করেন যে, যুধিষ্ঠির একটু আগেই দ্রোণাচার্যকে এই বিষয়ে বলেছেন এবং দ্রোণাচার্যের তার বক্তব্যের প্রতি সন্দেহ পোষণ করা উচিত নয়। বস্তুত ঋষিদের কাছ থেকে নিজের আসন্ন মৃত্যুর কথা শুনে এবং অশ্বত্থামার (মিথ্যা) মৃত্যুসংবাদ শুনে দ্রোণাচার্য ইতোমধ্যেই মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ছিলেন। এমতাবস্থায় ভীমের বাক্যবাণ দ্রোণাচার্যকে ব্যাপকভাবে আঘাত করে।
ভীমের তিরস্কার শুনে দ্রোণাচার্য তার ধনুক ফেলে দেন। সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র ত্যাগ করে তিনি অশ্বত্থামাকে স্মরণ করতে থাকেন এবং তার রথের ওপর বসে ধ্যানমগ্ন হন। এই দৃশ্য দেখে ধৃষ্টদ্যুম্ন ক্ষিপ্রগতিতে তার ধনুক নামিয়ে রেখে একটি তলোয়ার উঠিয়ে নেন এবং ধ্যানমগ্ন দ্রোণাচার্যের দিকে ছুটে যান। অর্জুন দ্রোণাচার্যকে হত্যা না করে তাকে বন্দি করে আনার জন্য ধৃষ্টদ্যুম্নের উদ্দেশ্যে আহ্বান জানান। কিন্তু ধৃষ্টদ্যুম্ন অর্জুনের কথায় কর্ণপাত না করে দ্রোণাচার্যের দিকে ছুটে গিয়ে তলোয়ারের আঘাতে ধ্যানমগ্ন দ্রোণাচার্যের মাথা কেটে ফেলেন। এরপর তিনি দ্রোণাচার্যের বিচ্ছিন্ন মাথাটি কৌরব সৈন্যদের সামনে ছুঁড়ে ফেলে দেন। এটি দেখে কৌরব সৈন্যদের মধ্যে তীব্র আতঙ্কের সৃষ্টি হয় এবং তারা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পশ্চাৎপসরণ করতে শুরু করে। এই দৃশ্য দেখে ভীম ধৃষ্টদ্যুম্নকে আলিঙ্গন করেন এবং বলেন যে, যখন কর্ণ এবং দুর্যোধন নিহত হবেন তখন আবার তিনি এইভাবে ধৃষ্টদ্যুম্নকে আলিঙ্গন করবেন।
কৌরবদের পশ্চাৎপসরণ, অশ্বত্থামার আগমন এবং কৌরবদের যুদ্ধক্ষেত্রে প্রত্যাবর্তন
দ্রোণাচার্য নিহত হওয়ার পর পুরো কৌরব বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পশ্চাৎপসরণ করতে শুরু করে। এসময় অশ্বত্থামা যুদ্ধক্ষেত্রের আরেক প্রান্তে ছিলেন এবং দ্রোণাচার্যের হত্যাকাণ্ডের খবর তার জানা ছিল না। কৌরব সৈন্যদের চরম বিশৃঙ্খল অবস্থায় পশ্চাৎপসরণ করতে দেখে তিনি দুর্যোধনের দিকে অগ্রসর হন এবং কৌরবরা কেন এভাবে পশ্চাৎপসরণ করছে সেটি জানতে চান। দ্রোণাচার্যের মৃত্যুতে দুর্যোধন নিজেও বড় রকমের ধাক্কা খেয়েছিলেন এবং অশ্বত্থামাকে নিজের মুখে দ্রোণাচার্যের মৃত্যুসংবাদ জানানোর মতো মনোবল সেসময় তার ছিল না। তিনি কী ঘটেছে সেটা অশ্বত্থামাকে জানানোর জন্য কৃপাচার্যকে বলেন। কৃপাচার্য অশ্বত্থামাকে দ্রোণাচার্যের হত্যাকাণ্ডের পুরো বিবরণ প্রদান করেন।
পাণ্ডবরা ধোঁকার সাহায্যে দ্রোণাচার্যকে হত্যা করেছেন, এটি জানতে পেরে অশ্বত্থামা পাণ্ডবদের ওপর অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠেন। তিনি প্রতিজ্ঞা করেন যে, তিনি অবশ্যই ধৃষ্টদ্যুম্নকে হত্যা করবেন। তিনি দুর্যোধনকে জানান যে, তার কাছে এমন একটি দিব্যাস্ত্র রয়েছে, যেটি কুরুক্ষেত্রে অবস্থানরত আর কারোর কাছেই নেই। তিনি বলেন যে, উক্ত অস্ত্র প্রয়োগ করে তিনি পাণ্ডবদেরকে যুদ্ধে পরাজিত করবেন। এরপর অশ্বত্থামা পশ্চাৎপসরণরত ও বিশৃঙ্খল কৌরব বাহিনীকে পুনরায় সংগঠিত করেন এবং তার নেতৃত্বে কৌরব সৈন্যরা আবার পাণ্ডবদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য অগ্রসর হয়।
পাণ্ডব শিবিরে মতভেদ এবং সাত্যকি–ধৃষ্টদ্যুম্ন দ্বন্দ্ব
দ্রোণাচার্যের মৃত্যুর পর কৌরব বাহিনীকে পুরোপুরি ছত্রভঙ্গ অবস্থায় পশ্চাৎপসরণ করতে দেখে পাণ্ডবরা ধরেই নিয়েছিল যে, সেদিনের যুদ্ধে তারা বিজয়ী হয়েছে। কিন্তু অকস্মাৎ কৌরব বাহিনীকে পুনরায় সংগঠিত হয়ে তাদের দিকে অগ্রসর হতে দেখে পাণ্ডবরা বিস্মিত হয়। যুধিষ্ঠির অর্জুনের কাছে জানতে চান যে, কৌরব বাহিনীকে এই পরিস্থিতিতে কে নতুন করে সংগঠিত করলো? প্রত্যুত্তরে অর্জুন জানান যে, অশ্বত্থামা কৌরব বাহিনীকে পুনরায় সংগঠিত করেছেন। এসময় অর্জুন দ্রোণাচার্যের হত্যাকাণ্ড প্রসঙ্গে তার অসন্তুষ্টি ব্যক্ত করেন। অর্জুন দ্রোণাচার্যের প্রিয় শিষ্য ছিলেন এবং তিনি দ্রোণাচার্যকে অত্যন্ত ভক্তি করতেন। তিনি ধ্যানমগ্ন দ্রোণাচার্যকে হত্যা করার জন্য ধৃষ্টদ্যুম্নকে দোষারোপ করেন এবং বলেন যে, দ্রোণাচার্যের অন্যায় হত্যাকাণ্ড না আটকানোর কারণে তাকেও নরকভোগ করতে হবে।
ভীম অর্জুনের সঙ্গে মতানৈক্য ব্যক্ত করেন এবং অর্জুনকে তার ‘দুর্বল মনোভাবে’র জন্য তিরস্কার করেন। ধৃষ্টদ্যুম্নও অর্জুনের সম্পর্কে অনুযোগ করেন যে, অর্জুনের উচিত ছিল দ্রোণাচার্যকে হত্যার জন্য ধৃষ্টদ্যুম্নের প্রশংসা করা, কিন্তু তিনি সেটা না করে ধৃষ্টদ্যুম্নকে অন্যায়ভাবে দোষারোপ করছেন। তিনি অর্জুনকে মনে করিয়ে দেন যে, তার জন্মের মূল উদ্দেশ্য ছিল দ্রোণাচার্যকে হত্যা করা। অর্জুন ধৃষ্টদ্যুম্নের কথার জবাব দেয়া থেকে বিরত থাকেন। কিন্তু সাত্যকি ধৃষ্টদ্যুম্নের ওপর অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হন এবং বলে ওঠেন যে, ধৃষ্টদ্যুম্ন যে লজ্জাজনক কাজ করেছেন, সেজন্য তার জনসম্মুখে কথা বলতে লজ্জিত হওয়া উচিত। সাত্যকি আরো বলেন যে, পাঞ্চালের অধিবাসীদের মতো হীন জাতি আর নেই। প্রত্যুত্তরে ধৃষ্টদ্যুম্ন সাত্যকিকে স্মরণ করিয়ে দেন যে, সাত্যকি নিজেও বাহুহীন ভুরিশ্রবা ধ্যানমগ্ন থাকা অবস্থায় তাকে হত্যা করেছেন, সুতরাং ধৃষ্টদ্যুম্নের কাজের নিন্দা করা তার পক্ষে শোভা পায় না।
ধৃষ্টদ্যুম্নের কথায় ক্ষিপ্ত হয়ে সাত্যকি তাকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে তলোয়ার হাতে তার দিকে ছুটে যান, কিন্তু ভীম সাত্যকিকে বাধা প্রদান করেন এবং বহু কষ্টে তাকে থামাতে সক্ষম হন। সহদেব সাত্যকিকে বুঝিয়ে–সুঝিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করেন। ধৃষ্টদ্যুম্ন ক্ষিপ্ত হয়ে বলেন যে, সাত্যকিকে ছেড়ে দেয়া হোক। তিনি বলেন যে, সাত্যকি তাকে বাহুহীন ভুরিশ্রবা মনে করছেন, কিন্তু তিনি সাত্যকিকে হত্যা করে তার যুদ্ধের আকাঙ্ক্ষা নিবারণ করবেন। এমতাবস্থায় কৃষ্ণ ও যুধিষ্ঠির হস্তক্ষেপ করেন এবং বহু কষ্টে সাত্যকি ও ধৃষ্টদ্যুম্নকে শান্ত করতে সক্ষম হন।
যুদ্ধের পঞ্চদশ দিনে পাণ্ডব বাহিনীর শীর্ষ রথীদের মধ্যেকার এই দ্বন্দ্ব থেকে যোদ্ধাদের মানসিক অবস্থার ওপর যুদ্ধের নেতিবাচক প্রভাব স্পষ্ট হয়ে উঠছিল। বস্তুত কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে যত দিন অতিক্রান্ত হচ্ছিল, ততোই কৌরব ও পাণ্ডবদের মধ্যেকার অন্তর্দ্বন্দ্ব বৃদ্ধি পাচ্ছিল। যুদ্ধের চতুর্দশ রাতে কর্ণ ও অশ্বত্থামার মধ্যে প্রায় যুদ্ধ আরম্ভ হয়ে গিয়েছিল এবং এর মধ্য দিয়ে শীর্ষ কৌরব রথীদের ওপর যুদ্ধের চাপ স্পষ্ট ফুটে উঠেছিল। অনুরূপভাবে, যুদ্ধের পঞ্চদশ দিনে সাত্যকি ও ধৃষ্টদ্যুম্নের মধ্যে প্রায় যুদ্ধ আরম্ভ হওয়ার উপক্রম হয় এবং এর মধ্য দিয়ে শীর্ষ পাণ্ডব রথীদের ওপর যুদ্ধের চাপ স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
অশ্বত্থামার প্রকোপ
পাণ্ডব বাহিনীর শীর্ষ রথীরা যখন নিজেদের মধ্যে তর্কবিতর্কে মগ্ন ছিলেন, তখন অশ্বত্থামার নেতৃত্বে কৌরব বাহিনী সুসংগঠিত অবস্থায় যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত হয়। অশ্বত্থামা যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত হয়েই পাণ্ডব বাহিনীর ওপর প্রচণ্ড আক্রমণ শুরু করেন। অশ্বত্থামার তীরবৃষ্টিতে পাণ্ডব বাহিনীর বিপুল পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি সাধিত হয়। অশ্বত্থামার তীরের আঘাতে বিপুল সংখ্যক পাণ্ডব সৈন্য নিহত হয়, পাণ্ডব বাহিনীর বিপুল সংখ্যক রথ ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় এবং অজস্র হাতি ও ঘোড়া প্রাণ হারায়। বস্তুত এসময় অশ্বত্থামা এমন ধ্বংসযজ্ঞ শুরু করেছিলেন যে, শীঘ্রই কুরুক্ষেত্র জুড়ে নিহত পাণ্ডব সৈন্য, হাতি ও ঘোড়া এবং ধ্বংসপ্রাপ্ত রথগুলোর পর্বতপ্রমাণ স্তূপ গড়ে ওঠে।
পাণ্ডব বাহিনীর এরকম ক্ষয়ক্ষতি সাধনের পর অশ্বত্থামা দুর্যোধনকে বলেন যে, যেহেতু যুধিষ্ঠির ধর্মের ভেক ধরে দ্রোণাচার্যকে অস্ত্রত্যাগ করিয়েছেন, তিনি যুধিষ্ঠিরের সৈন্যবাহিনীকে ধ্বংস করে দেবেন এবং এরপর তিনি পাঞ্চালের রাজপুত্রদের হত্যা করবেন। অশ্বত্থামার বক্তব্য শুনে দুর্যোধন কৌরব সৈন্যদের সুসংগঠিত করে তাদেরকে পাণ্ডবদের বিরুদ্ধে পরিচালিত করতে শুরু করেন।
ইতোমধ্যে অশ্বত্থামা মন্ত্র উচ্চারণ করে পাণ্ডব বাহিনীর বিরুদ্ধে নারায়ণাস্ত্র প্রয়োগ করেন। অশ্বত্থামা কর্তৃক নারায়ণাস্ত্র প্রয়োগের সঙ্গে সঙ্গে এর প্রতিক্রিয়ায় কুরুক্ষেত্র জুড়ে প্রচণ্ড বৃষ্টি শুরু হয় এবং প্রচণ্ড রকম বাতাস বইতে থাকে। একই সময়ে প্রচণ্ড ভূমিকম্পে কুরুক্ষেত্র কেঁপে ওঠে এবং বিভিন্ন ধরনের অজস্র হিংস্র প্রাণি কুরুক্ষেত্রে চতুর্দিকে ডাকাডাকি শুরু করে। উক্ত দিব্যাস্ত্র প্রয়োগের ফলে আকাশে অসংখ্য ভয়ালদর্শন তীর, লৌহগোলক, দুই চাকাযুক্ত ও চার চাকাযুক্ত শতঘ্নী, গদা এবং চক্র দৃশ্যমান হয়। শীঘ্রই উক্ত অস্ত্রবৃষ্টির ফলে অজস্র পাণ্ডব সৈন্য নিহত হয় এবং পাণ্ডব সৈন্যরা পুরোপুরিভাবে ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পশ্চাৎপসরণ করতে শুরু করে। এমতাবস্থায় যুধিষ্ঠির অত্যন্ত আতঙ্কিত হয়ে পড়েন এবং ধারণা করতে থাকেন যে, সেদিনের যুদ্ধে তাদের মৃত্যু নিশ্চিত।