প্রুশিয়ানদের ছিল তেরটি আর্মি কর্পস আর সংযুক্ত অশ্বারোহী বাহিনী। নিজস্ব অশ্বারোহীসহ প্রুশিয়ান গার্ড কর্পস ছিল আলাদা। সামরিক চুক্তির আওতায় দক্ষিণ জার্মান দেশগুলোও সেনা সরবরাহ করছিল। স্যাক্সোনি থেকে এলো এক ডিভিশন অশ্বারোহী এবং একদল ইনফ্যান্ট্রি, হেসের চার রেজিমেন্ট সৈন্য এবং অশ্বারোহী, ভুর্তেমবার্গ আর ব্যাডেনের এক ডিভিশন, বাভারিয়ার অবদান ছিল দুটি কর্পস।
প্রুশিয়ানদের ড্রেইস বন্দুক ততদিনে পুরনো হয়ে গেছে। ইউরোপের অন্য সবাই ব্রিচ লোডিংয়ের কার্যকারিতা বুঝে নিজেদের বাহিনীতে ড্রেইসের থেকে উন্নত রাইফেল সংযুক্ত করেছে। তবে প্রুশিয়ান আর্টিলারি ছিল ফরাসীদের থেকে বহুগুনে এগিয়ে। সম্মিলিত জার্মান বাহিনী সংখ্যায়ও ফরাসি বাহিনীর থেকে অনেক বেশি।
নেপোলিয়নের কাছে ছিল ২,৮৮,০০০ সেনা। এছাড়া উপনিবেশগুলোতে কয়েকটি গ্যারিসন ছিল। জার্মান বাহিনীর থেকে এই সংখ্যা কম। ফরাসিদের বাধ্যতামূলক সামরিক দায়িত্ব পালন করতে হতো না। লটারি করে যাদের নাম উঠত তাদের সেনাদলে সাত বছরের মেয়াদ পূর্ণ করলেই চলত। অনেকেই টাকার বিনিময়ে আরেকজনকে বদলি হিসেবে পাঠিয়ে দিত। তদুপরি তাদের প্রশিক্ষণ চলত ঢিমেতালে। এছাড়া প্রুশিয়ানদের জেনারেল স্টাফের মতো কোনো সংগঠন না থাকায় জেনারেলদের সমরপরিকল্পনাতে সমন্বয়ের অভাব ছিল। গুপ্তচরদের তথ্য বিশ্লেষণের মতো কার্যকরী অঙ্গ ছিল অনুপস্থিত, যা প্রুশিয়ান জেনারেল স্টাফ করে থাকে।
নেপোলিয়ন ফরাসি সেনাদের সংখ্যা ও প্রশিক্ষণের সীমাবদ্ধতা নিয়ে সচেতন ছিলেন। তিনি আরো বেশি মানুষকে প্রশিক্ষণের জন্যে লটারিতে নিতে চাইলে সংসদ বাদ সেধেছিল। ১৮৬৮ সালে রফা হয় অধিক সংখ্যক মানুষ প্রশিক্ষণ নেবে বটে, তবে সাত বছর সামরিক সেবার মেয়াদ কমিয়ে আনা হলো পাঁচ বছরে। প্রুশিয়ান ল্যান্ডওয়েহের আদলে বিপ্লব সময়কার ন্যাশনাল গার্ডকে পুনরুজ্জীবিত করা হয়। কিন্তু তাদের গড়েপিটে নেবার সঠিক ব্যবস্থা ছিল না। নেপোলিয়নের পরিকল্পনা ছিল আট লাখ সেনা আর চার লাখ ন্যাশনাল গার্ড প্রস্তুত করবার। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বেন সেটা তার ধারণার বাইরে ছিল। ফলে ফরাসি সামরিক সংস্কার গতি পাবার আগেই পথ হারিয়ে ফেলে।
১৮৭০ সালের জুলাইতে নেপোলিয়নের হাতে ৩,৭৭,০০০ পেশাদার সেনা, আর ১,৭৩,০০০ স্বল্প প্রশিক্ষিত রিজার্ভ। ন্যাশনাল গার্ড ছিল সদ্যজাত শিশু। তবে ফরাসিদের চ্যাসেপট (Chassepot) ব্রিচ লোডিং রাইফেলের কাছে প্রুশিয়ানদের ড্রেইস রাইফেল মান্ধাতা আমলের। চ্যাসেপটের লক্ষ্যভেদের ক্ষমতা, দূরত্ব, প্রতি মিনিটে গুলি ছোঁড়ার গতি সবই প্রুশিয়ান রাইফেলের থেকে অনেক বেশি। আবার ড্রেইসের সমস্যাগুলো থেকেও চ্যাসেপট মুক্ত।
তবে নেপোলিয়ন তখন পর্যন্ত আর্টিলারি আধুনিকায়ন করতে পারেননি। ফলে তার পুরনো আমলের কামান প্রুশিয়ানদের সামনে খেলনার মতোই। যুদ্ধের সময় দেখা যেত প্রুশিয়ানরা চ্যাসেপটের আঘাত এড়াতে দূর থেকে তোপ দাগছে, আর ফরাসিরা চেষ্টা করছে কোনভাবে কাছাকাছি গিয়ে তাদের ঘায়েল করবার। ফরাসি সেনাদলের আরেক ভয়ঙ্কর অস্ত্র ছিল মিট্রাউজ (mitrailleuse), পরবর্তীকালের মেশিনগানের আদি সংস্করণ।
ফ্রান্সের মূল সমস্যা ছিল আন্তর্জাতিক অঙ্গনে একঘরে হয়ে পড়া। যুদ্ধ ঘোষণা তাদের তরফ থেকে হওয়ায় অন্যান্য পরাশক্তিগুলির অভিযোগের আঙ্গুল ছিল ফ্রান্সের দিকেই। যদিও সম্মিলিত জার্মানি অস্ট্রিয়ারও কাম্য ছিলনা, কারণ তাতে ইউরোপে তাদের প্রভাব খর্ব হবে। তবে ফ্রান্সকে সহায়তা করা থেকে তারা বিরত থাকে। এর প্রধান কারণ ছিল দক্ষিণ জার্মানি প্রুশিয়াকে সরাসরি সহযোগিতা করছে, যাদের সাথে অস্ট্রিয়ার সম্পর্ক বন্ধুত্বপূর্ণ।
মল্টকের ভাবনা
প্রুশিয়ান জেনারেল স্টাফের ধারণা ছিল ফ্রান্স রাইনের নিকটবর্তি অ্যালসাসে আর লরেইন অঞ্চল দিয়ে জার্মান সীমান্ত অতিক্রম করবে। কারণ ফরাসিরা জানে সংখ্যার দিক দিয়ে তারা পিছিয়ে, সুতরাং দ্রুত এবং কার্যকরী হামলাই তাদের জয়ের উপায়। তাদের রেল যোগাযোগও প্রুশিয়ানদের তুলনায় অনেক ভাল। ফলে তড়িৎ গতিতে জার্মানিতে ঢুকে যদি তারা প্রুশিয়ানদের ললাটে পরাজয়ের তিলক এঁকে দিতে পারে তাহলে খুবই সম্ভব যে দক্ষিণ জার্মান দেশগুলো নিরপেক্ষতার দিকে ঝুঁকে পড়বে। ফ্রান্সের জয়ের গন্ধে ইতালি আর অস্ট্রিয়াও লাভের আশায় তার সাথে এসে যোগ দেবে। তখন ব্রিটিশরাও চাপ তৈরি করবে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধান করার জন্য, যা নেপোলিয়নের অনুকূলে যাবে।
পরবর্তীকালে বিশেষজ্ঞরা যখন খাতা খুলে বসেছেন, তখন তাদের মাথা চুলকাতে হয়েছে ফ্রান্স কীভাবে কোনো প্রস্তুতি ছাড়াই যুদ্ধ ঘোষণা করে দিল। উনবিংশ শতাব্দীতে এটাই বোধহয় একমাত্র লড়াই যেখানে যুদ্ধ ঘোষণাকারি নিজেদের সৈন্য সামন্ত গুছিয়েই উঠতে পারেনি। মল্টকের এসব জানা ছিল না। তার ধারণা ছিল ২৫ জুলাইয়ের ভেতরে সীমান্তে ১,২৫,০০০ এর মত ফরাসি সেনার মোকাবেলা করতে হতে পারে। এজন্য যত দ্রুত সম্ভব তিনি সৈন্যদের সীমান্তে প্রেরণ করেন। তাড়াহুড়োয় অনেকেই মালসামান ফেলে রওনা হয়, যেগুলো পরে পৌঁছে দেয়া হবে। প্রুশিয়ান পরিকল্পনা ছিল যদি ১লা আগস্ট পর্যন্ত তারা প্রতিরক্ষামূলক অবস্থান বজায় রাখবে। ৪ তারিখের পরেও ফরাসিদের দেখা না মিললে প্রুশিয়ানরাই তাদের সাথে দেখা করতে যাবে।
প্রুশিয়ান সেনা সমাবেশ
সীমান্তে জুলাইয়ের ১৪ তারিখের ভেতরেই চার লাখ সেনা রাখা হয়েছিল। যুদ্ধের সূচনায় আদেশ জারি হবার আঠার দিনের মধ্যেই জার্মান বাহিনীর প্রায় আরো ১২ লাখ সেনা একত্রিত হয়। অন্যদিকে পুরো সংঘর্ষে ফ্রান্সে একত্র করতে পেরেছিল সাড়ে ৮ লাখ সৈন্য।
প্রুশিয়ান বাহিনী বিভক্ত ছিল তিনভাগে। জেনারেল স্টেইনমেটজের ফার্স্ট আর্মি, ফ্রেডেরিক চার্লসের সেকেন্ড আর্মি আর ক্রাউন প্রিন্সের থার্ড আর্মি। সেকেন্ড আর্মি এগোচ্ছিল সীমান্তবর্তী জার্মান শহর জাব্রুকেন (Saarbrucken) বরাবর। ফার্স্ট আর্মি ঠিক তার সমান্তরালে উত্তরদিক দিয়ে অগ্রসর হচ্ছিল। থার্ড আর্মি যাচ্ছিল ফরাসী নিয়ন্ত্রিত স্ট্র্যাসবুর্গের দিকে। মল্টকের ধারণা ছিল সেখানেই ফরাসিরা তাদের সাথে লড়াই করবে। তখন বাকি দুই বাহিনী দু’পাশ থেকে ঝাঁপিয়ে পড়বে। রাজা উইলিয়াম নিজে ৩১ জুলাই মেইঞ্জে যুদ্ধকালীন হেডকোয়ার্টারে চলে আসেন সেনা গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করতে।
ফরাসি বিশৃঙ্খলা
১৮৬৮ সালের এক প্ল্যান অনুযায়ী ফরাসিরা প্রথমে তিনটি বাহিনী জড়ো করে। মার্শাল ম্যাকমোহন আর্মি অফ অ্যালসাসে নিয়ে স্ট্র্যাসবুর্গে চলে যান, মেটজ শহরে মার্শাল বাজাইনের অধীনে একত্রিত হয় আর্মি অফ মেটজ। শ্যালন্স শহরে মার্শাল ক্যারোবেয়া দায়িত্ব নেন আর্মি অফ শ্যালন্সের। ১ জুলাই ১৮৭০ সালে নেপোলিয়ন তিনটি আর্মিকে একসাথে করে আর্মি অফ রাইন গঠনের নির্দেশ দেন। তিনি নিজে এই বাহিনীর নেতৃত্ব নিতে যাত্রা করেন মেটজের দিকে।
এদিকে রাইনের তীরবর্তী রুক্ষ এলাকাতে এই বাহিনী মিলিত হবার মতো অবস্থা ছিল না। ফলে তারা কার্যত দুই অংশে ভাগ হয়ে পড়ে। তাছাড়া ভৌগোলিক প্রতিকূলতার কারণে অনেক সেনাদলই নিজ নিজ ইউনিট থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এদিকে প্যারিসের ভার সম্রাজ্ঞী ইউজিনের উপর দিয়ে নেপোলিয়ন স্বয়ং নিজের ১৪ বছরের পুত্র এবং চীফ অফ স্টাফ মার্শাল লেবোফসহ ২৮ জুলাই মেটজে পৌঁছেন। তিনি জানতে পারলেন যে মাত্র ২,০০,০০০ সেনা আর্মি অফ রাইন হিসেবে এখন অবধি জমায়েত করা গেছে। ৩১ জুলাই থেকে তাদের নিয়েই ছন্নছাড়াভাবে ফরাসিরা জার্মান সীমান্তের দিকে এগিয়ে যায়।
সাগরের অবরোধ
তখন পর্যন্ত জার্মানির বলার মতো কোনো নৌবাহিনী ছিল না। অন্যদিকে ফ্রান্স প্রতিষ্ঠিত নৌশক্তি। ফলে জুলাইয়ের তৃতীয় সপ্তাহেই ফরাসি জাহাজ ভাসানো হয়েছিল। নেপোলিয়ন ভেবেছিলেন উত্তর জার্মানিতে সাগরপথে আক্রমণের কথা। তবে দ্বিতীয় স্লেশউইগ-হোলস্টেইন যুদ্ধের পর প্রুশিয়ানরা উপকূল জুড়ে কামান মোতায়েন করেছিল বিধায় তার প্ল্যান ব্যর্থ হয়। মাঠের লড়াইতে একের পর এক পরাজয়ের পর ফরাসি মেরিন সেনাদের স্থলবাহিনীতে ডেকে পাঠানো হয়। নৌবাহিনীকে তখনও অবরোধ জারি করার জন্য রেখে আসা হয়েছিল। ঝড়-বাদলের ফলে ১৮৭০ সালের সেপ্টেম্বরের মধ্যে ফরাসি জাহাজও অবরোধ তুলে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছিল।
জাব্রুকেন
বাজাইন আর ফ্রসার্ডের সেনারা ২রা অগাস্ট জাব্রুকেন চলে এলো। তখন পর্যন্ত সেকেন্ড আর্মির দেখা নেই। শহরে থাকা ছোট প্রুশিয়ান সেনাদলের উপর চ্যাসেপটের অব্যাহত গুলিবর্ষণ ড্রেইসের কাছে অস্ট্রিয়ানদের নাকাল হওয়ার কথা মনে করিয়ে দিল। তবে প্রুশিয়ানরা অনেকক্ষণ ফরাসিদের ঠেকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়। শেষ পর্যন্ত ফরাসিরা শহর দখল করলেও তাদের অনেকেই হতাহত হয়েছিল। তদুপরি জাব্রুকেন থেকে জার্মান মূল ভূখণ্ডে প্রবেশের জন্য ছিল একটিমাত্র রেলপথ, যা প্রুশিয়ানরা সহজেই আটকে দিতে পারত। রসদপত্রের সরবরাহ আসতেও সমস্যা হচ্ছিল।
উইজেমবোর্গ
থার্ড আর্মির যাত্রাপথে অ্যালসাসের উইজেমবোর্গ শহর। এখানে ম্যাকমোহনের ৫,০০০ সেনা ঘাঁটি করেছে। তাদের দক্ষিণে পাহাড় জঙ্গল, ৪ আগস্ট সেখান দিয়ে আসতে গিয়ে ফরাসি আঘাতে প্রুশিয়ানদের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হলো। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা শহরের সামনে অবস্থান নিয়ে ফেলে। চ্যাসেপটের কথা স্মরণ রেখে ক্রাউন প্রিন্স কামান দাগার আদেশ দেন। মুহুর্মুহু গোলাতে শহরের প্রতিরক্ষা প্রাচীরে ফাটল তৈরি হয়। একপর্যায়ে ফরাসি কমান্ডারও মারা যান। ম্যাকমোহন ছিলেন পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে, কিন্তু তার সেনাদলের মধ্যে যোগাযোগের অভাব ছিল, এবং সেনারাও ছড়ানো ছিল বিশাল অঞ্চল জুড়ে। ফলে একপর্যায়ে উইজেমবোর্গের ৫,০০০ সেনা ৫০,০০০ প্রুশিয়ান এবং বাভারিয়ান কর্তৃক বেষ্টিত হয়ে পড়ার উপক্রম হলো। শহরের রাস্তায় রাস্তায় লড়াই বেঁধে যায়। শেষ পর্যন্ত ফরাসিরা পিছিয়ে যেতে বাধ্য হলো।
স্পিখারেনের লড়াই
এদিকে জাব্রুকেনের ঘটনা শুনে স্টেইনমেটজ মল্টকের আদেশ উপেক্ষা করে সেদিকে ঘুরে গেলেন। ফলে তিনি সেকেন্ড আর্মির পথে পড়ে যান। তাকে আক্রমণের জায়গা দিতে সেকেন্ড আর্মির অগ্রবর্তী অংশ পিছিয়ে স্পিখারেন-স্টিয়ারিং এলাকার উচ্চভূমিতে অবস্থান নেয়। এদিকে সেকেন্ড আর্মির আগমনের সংবাদে ফ্রসার্ড তড়িঘড়ি করে স্পিখারেন চলে এসেছিলেন আগেই। এখানে ফরাসিদের ৩২,০০০ সেনা ছিল। তাদের সজ্জিত করা হল স্পিখারেন আর ফর্বাখ এলাকার মাঝের মালভূমিতে।
সংঘর্ষ শুরু হলো ৬ আগস্ট, যা পরিচিত স্পিখারেন যুদ্ধ নামে। ফরাসি চ্যাসেপটের কাছে প্রুশিয়ান ইনফ্যান্ট্রি ছিল অসহায়। ফলে জার্মানরা দূর থেকে কামান দাগতে থাকে। প্রুশিয়ান কামানের অব্যাহত গোলাবর্ষণ ফরাসিদের জায়গা থেকে নড়তেই দিল না। এদিকে দলে দলে প্রুশিয়ান সারা দিন ধরেই আসতে থাকে, এক পর্যায়ে তাদের সংখ্যা দাঁড়াল ৬৭,০০০। ফরাসিদের কামান দিয়ে আটকে রেখে তারা শত্রুদের দুই পাশ থেকে ঘিরে ফেলে।
ফ্রসার্ড শুরুতে বুঝতে পারেননি তিনি প্রুশিয়ান সেকেন্ড আর্মির মোকাবেলা করছেন। তার ধারণা ছিল এটা ছোট প্রুশিয়ান সেনাদল। ফলে বাজাইন কাছেপিঠে থাকলেও কোনো সহায়তা তিনি চেয়ে পাঠাননি। যখন তিনি বিপদ বুঝতে পারলেন তখন দেরি হয়ে গেছে। প্রুশিয়ানরা তাদের চারপাশ থেকে চাপ দিতে শুরু করেছে। অবস্থা খারাপ বুঝে ফরাসিরা রাতের আঁধারে পিঠটান দিল। উইজেমবোর্গের পরে স্পিরাখেনেও ফরাসিদের পরাজয়ের পর নেপোলিয়ন আর লেবোফ প্রতিরক্ষামূলক কৌশল অবলম্বনের ফয়সালা করেন।
ব্যাটল অফ ওয়াখট
আগস্টের ৫ তারিখে ম্যাকমোহনকে নিজের সেনাদল ছাড়াও আরো তিনটি আর্মি কর্পসের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। তিনি তখন উইজেমবোর্গ থেকে দশ মাইল দূরে ওয়াখট এলাকায় শিবির করেছেন। তাদের অবস্থানের পেছনে ছোট্ট এক পাহাড়ের উপর ফ্রশভিলা (Fröschwiller) শহর। সম্রাটের আদেশ আসার পর তিনটি কর্পসের সৈন্যরা তাদের নতুন কম্যান্ডারের দিকে আগাচ্ছিল, কিন্তু তাদের অগ্রগতি ছিল ধীর। ফলে ম্যাকমোহনের সঙ্গে ছিল মাত্র ৪৫,০০০ সৈন্য।
থার্ড আর্মির ১,৩০,০০০ জার্মান সেনা আর একশ কামান ম্যাকমোহনের দিকে নিশানা করা। ৬ আগস্ট শুরু হয় এই লড়াই। একইদিন স্পিরাখেনের যুদ্ধও সংঘটিত হচ্ছিল। আগের মতোই প্রুশিয়ান আর বাভারিয়ান কামানের গর্জনে ম্যাকমোহনের অবস্থা খারাপ হয়ে পড়ে। এদিকে অন্যদিক থেকে জার্মানরা ফ্রশভিলে ঢুকে পড়তে থাকলে ফরাসিদের পরাজয় সময়ের ব্যাপার হয়ে পড়লো। কোনো উপায় না দেখে ফরাসি অশ্বারোহী বাহিনী এবড়ো থেবড়ো জমির উপর দিয়েই ছুটে এলো, উদ্দেশ্য ইনফ্যান্ট্রিকে পিছিয়ে যাবার সময় করে দেয়া। মারাত্মক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখিন হলেও বাকিদের তারা নিরাপদে পশ্চিমদিকে দিয়ে পালানোর সুযোগ করে দিতে পেরেছিল। জার্মানদের প্রায় ১০,০০০ সেনা হতাহত হয়, তুলনায় ফরাসিদের সংখ্যা ছিল দ্বিগুণ। থার্ড আর্মি ম্যাকমোহনকে তাড়া না করে অ্যালসাসে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ শক্ত করতে মনোযোগ দেয়।
ম্যাকমোহন সম্রাটকে জানালেন তিনি শ্যালন্স চলে যেতে চান। নেপোলিয়ন প্রথমে পুরো সেনাদলকেই শ্যালন্সে নিয়ে এক করার কথা ভেবেছিলেন। কিন্তু ফরাসিদের মধ্যে বিশৃঙ্খলার কারণে অনেক ইউনিট চলে এসেছিল মেটজের দিকে। ফলে শুধুমাত্র ম্যাকমোহনের দলই শেষ পর্যন্ত শ্যালন্সে গিয়ে পৌঁছে। ফলে ফরাসি দুটি সৈন্যবাহিনী তৈরি হলো- আর্মি অফ মেটজ, যাদের সাথে ছিলেন নেপোলিয়ন, এবং আর্মি অফ শ্যালন্স। এর মধ্যেই ৯ তারিখে ফরাসি প্রধানমন্ত্রী অলিভার পদত্যাগ করেন। তার স্থলাভিষিক্ত হন জেনারেল মন্তাবু।
১২ আগস্ট নেপোলিয়ন আনুষ্ঠানিকভাবে আর্মি অফ মেটজের কম্যান্ড তুলে দেন মার্শাল বাজাইনের কাঁধে। তিনি নিজে শ্যালন্সের দিকে যাবেন বলে ঘোষণা দিলেন। তাকে অনুসরণ করবেন বাজাইন। ক্যারোবেয়া ইতোমধ্যে শ্যালন্স থেকে মেটজে এসে পড়েছেন, তবে তাড়াহুড়োতে ফেলে এসেছেন বেশিরভাগ কামান। কারণ তিনি আসার পরপরেই প্রুশিয়ান অশ্বারোহীরা শ্যালন্স আর মেটজের রেলপথ আটকে দিয়েছে।
ফরাসি সেনারা যারা মেটজের দিকে আসছিল তাদের পার হতে হচ্ছিল মোজেল নদী। কয়েকদিনে তুমুল বৃষ্টিতে বন্যা হয়ে গেলে নদীর সেতু ভেসে যায়। ফলে সাময়িক সেতু বানিয়ে তাদের পারাপার করতে হয়। ১৪ তারিখ পর্যন্ত অপর তীরে ভিড় করে থাকাদের মাত্র অর্ধেক সৈন্য মেটজে প্রবেশ করতে পারল। প্রুশিয়ানরা যদি জানত ফরাসিদের দুরবস্থা তাহলে এখানেই তারা ফরাসি সেনাবাহিনীকে চূড়ান্তভাবে ধ্বংস করে দিতে পারত।
সংঘর্ষ আরম্ভের এক সপ্তাহের মধ্যে ফ্রান্সের পশ্চাদপসরণ ইউরোপকে চমকে দেয়। তারা মনে করছিল জার্মানরা পাত্তাই পাবে না। ফরাসিদের বিপরীতে জার্মান সামরিক কাঠামোর শ্রেষ্ঠত্ব ইউরোপ এতদিন বুঝতে পারেনি। ফলে যুদ্ধের পর অনেক দেশই প্রুশিয়ার অনুকরণে নিজেদের বাহিনী সাজাতে শুরু করে। এদিকে আসন্ন পরাজয়ের দিকে চোখ রেখে প্যারিসের অলিগলিতে প্রজাতন্ত্রের পক্ষে নতুন করে বিপ্লবের ফিসফাস শোনা যেতে থাকল।