আজ্জি: লিটল রেড রাইডিং হুডের ডার্ক ইন্ডিয়ান অ্যাডাপ্টেশন

ছোটবেলায় রূপকথার গল্প আমরা কে না শুনেছি? দোর্দণ্ড প্রতাপশালী রাজা, সুয়োরানী-দুয়োরানী, সাহসী রাজপুত্র, সাত ভাই চম্পা, জলপরী, লালপরী, নীলপরী, মামদো ভূত, গেছো ভূত, দৈত্যদের গল্প শুনে শৈশব কেটেছে আমাদের৷ এতদিন পরও যেন গল্পগুলো আমাদের সাথে থেকে গেছে, ভাবনার একটি অংশে পরিণত হয়েছে। আমরা যেমন মা-বাবা, দাদা-দাদী বা নানা-নানীদের থেকে এসব গল্প শুনেছি; একইভাবে আমরাও আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের মাঝে এসব গল্প ছড়িয়ে দেব। পশ্চিমা বিশ্বে এমনই এক জনপ্রিয় রূপকথার গল্প ‘লিটল রেড রাইডিং হুড’। যেটি ছিল আবার প্রখ্যাত ইংরেজ ঔপন্যাসিক চার্লস ডিকেন্সের প্রিয় গল্প। আজকে যে সিনেমা নিয়ে আলোচনা করতে চলেছি, সেটি এই রূপকথার গল্পেরই আধুনিক, ডিস্টোপিয়ান সংস্করণ। 

প্রথমেই সংক্ষেপে লিটল রেড রাইডিং হুডের কাহিনী বর্ণনা করা যাক। এক গ্রামে মায়ের সাথে বাস করত এক ছোট্ট মেয়ে। তাকে লাল রংয়ের ঘোমটা জাতীয় বস্ত্র (রাইডিং-হুড) দেওয়া হয়। এই বস্ত্র সারাদিন মাথায় পরে থাকত বলে গ্রামবাসী তাকে ডাকত ‘লিটল রেড রাইডিং হুড’ নামে। 

সিনেমার পরিচালক দেবাশীষ মাখিজা; Image Source: Film Companion

একদিন, ছোট মেয়েটির মা তাকে তার নানীর সাথে দেখা করে আসতে বলল। তার নানী বাস করত পাশের গ্রামে, যেখানে যেতে হতো একটি জঙ্গলের ভেতর দিয়ে। তাকে সাথে করে নানীকে দেওয়ার জন্য কিছু খাবার দিয়ে দেন মা। সে যাত্রা শুরু করে। জঙ্গলের ভেতর দিয়ে যাওয়ার সময় পথিমধ্যে তার সাথে দেখা হয় এক কথা বলতে পারা নেকড়ের সাথে। ঐ নেকড়ে সে কোথায় যাচ্ছে, সেটি জানতে চায়। 

ছোট মেয়েটি নেকড়েকে নানুবাড়ি যাওয়ার কথা বলে। তখন নেকড়ে জিজ্ঞেস করে, তার নানুবাড়িটি কোথায়? ঠিকানা জানার পর সে বলে, সেও ঐদিকেই যাচ্ছে। এরপর সে জায়গায় যাওয়ার জন্য আলাদা পথ বেছে নেয় তারা। মেয়েটি প্রকৃতি দেখতে দেখতে হেলেদুলে চলছিল। অন্যদিকে নেকড়ে চলছিল দ্রুতগতিতে। ফলে নেকড়ে আগে নানুর বাড়িতে পৌঁছে। এবং নাতনির পরিচয় দিয়ে ঘরে ঢুকে আগে নানীকে খেয়ে ফেলে। এরপর নানীর ছদ্মবেশে নাতনির জন্য অপেক্ষা করে।

গল্পটির শেষাংশ একেক জায়গায় একেক রকম। কোথাও ছোট মেয়েটি মারা যায়। আবার কোথাও সে বেঁচে যায়। নিজের প্রথম ফিচার ফিল্ম ‘আজ্জি’র গল্পের ক্ষেত্রে দেবাশীষ মাখিজা পশ্চিমা এই রূপকথাকেই অবলম্বন হিসেবে বেছে নিয়েছেন। 

মারাঠি ভাষায় ‘আজ্জি’ শব্দের অর্থ দাদী বা নানী। গল্পের প্রেক্ষাপট মুম্বাইয়ের অসংখ্য বস্তি এলাকাগুলোর একটি। এখানে মান্দা (শর্বাণী সূর্যবংশী) নামের একটি বাচ্চা মেয়েকে ধর্ষিত অবস্থায় পাওয়া যায় একটি পয়ঃনালীর কাছে। বাবা-মায়ের অর্থনৈতিক দুর্দশা আর পক্ষপাতদুষ্ট ব্যবস্থার কারণে মান্দার উপর হওয়া অত্যাচারের বিচার পাওয়ার পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। সেটি প্রতীয়মান হয় এ ঘটনার তদন্তের দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ সদস্যদের আচরণে। তারা মান্দার পরিবারের উপর প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা করে। বলে কোর্ট-কাছারিতে না গিয়ে, ভালোয় ভালোয় এই ঝামেলা মিটিয়ে ফেলতে। তাদের চাহনিতে ফুটে ওঠে লালসা আর লাম্পট্য। এরকম আশাহীন একটা অবস্থায় আলোকবর্তিকারূপে আবির্ভূত হন মান্দার গোবেচারা, মধ্য বয়সের আজ্জি (সুষমা দেশপাণ্ডে); তাকে এই রূপে দেখা যাবে বলে ঘুণাক্ষরেও ভাবেনি কেউ। সেই তিনিই নাতনির উপর হওয়া অত্যাচারের বদলা নেবার পণ করেন। 

আজ্জি চরিত্রে সুষমা দেশপাণ্ডে; Image Source: Film Companion

কিন্তু ঘুণে খাওয়া সিস্টেম এই গল্পের ঘাতক নেকড়ে নয়, বরং ঘাতকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন একজন চরিত্রহীন ব্যক্তি। নাম তার বিলাস রাও দাভলে (অভিষেক ব্যানার্জী); তার পারিবারিক এবং রাজনৈতিক প্রভাব আছে। সাথে সাথে আছে অঢেল টাকা। যার ফলে যেকোনো সমস্যাকে চিরতরে গায়েব করে দিতে সক্ষম সে। উপরন্তু, কৃতকর্মের জন্য বিন্দুমাত্র অনুশোচনা নেই তার ভেতর। আজ্জি এই ঘাতক নেকড়েকে বধ করতে পারেন কি না, পারলেও কীভাবে; সেটিই দেখানো হয়েছে সিনেমার বাকি অংশে।

আজ্জিতে যে কাহিনী বর্ণিত হয়েছে, সেটি যে বীভৎস; এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। শুরুতে একটি শিশুর উপর যৌন নিপীড়ন থেকে শুরু করে পরে যে নৃশংসতা দেখানো হয়; কোনো ধরনের পাশবিক আচরণই বাদ দেওয়া হয়নি এখানে। গল্পের মূল লক্ষ্য একটাই- ভালো আর খারাপের বিভাজনরেখা নিরূপণ করা। এটিকে অনেকটা ভিজিল্যান্ট ড্রামা বা স্বপ্রণোদিত হয়ে ন্যায়বিচারের জন্য আইন হাতে তুলে নেওয়ার চিরপরিচিত কাহিনী মনে হতে পারে।

তবে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য ভিজিল্যান্ট ড্রামায় যে নাটুকেপনা দেখানো হয়, সেটি বর্জন করা হয়েছে এ সিনেমায়। কাহিনীর সর্বত্রই সংবেদনশীল বাস্তবতার ছোঁয়া বিদ্যমান। বিশেষ করে ছোট্ট মান্দার চরিত্রায়নের ক্ষেত্রে এটি প্রকটভাবে প্রকাশ পেয়েছে; যখন সে বুঝতে পারে, তার সাথে আসলে কী অনাচার হয়ে গেছে। পাশাপাশি এ গল্পে শেষপর্যন্ত পরিষ্কারভাবে বিজয়ী কোনো পক্ষ নেই। যা আমরা বাস্তব জীবনে ন্যায়বিচারের যে ধারণায় বিশ্বাসী, সেটির ব্যাপারে প্রশ্ন তোলে। 

সিনেমা জুড়ে গল্পের বর্ণনায় দেবাশীষ মাখিজা যে পন্থা বেছে নিয়েছেন, সেটি ডার্ক। এটি এখানকার রাতের দৃশ্যায়নের ক্ষেত্রে যেমন সত্য, তেমনি দাভলের বিকৃত যৌনলিপ্সার নিম্নতা ও ব্যাপকতা প্রদর্শনের ক্ষেত্রেও সত্যি। আবার নাতনির উপর হওয়া পাশবিকতার  ন্যায়বিচার নিশ্চিতকরণের জন্য আজ্জির যে ক্রোধ এবং প্রয়োজনীয়তা; সেক্ষেত্রেও এটি সত্যি।

এ সিনেমা সামাজিক বিচার ব্যবস্থা, দারিদ্র্য, সুবিচার প্রাপ্তির পথে যেসকল বাধা দেখা যায়, সেসব বিষয়কে প্রদর্শন করে অনেকটা ডকুমেন্টারির মতো করে। এসকল বিষয় মুম্বাইয়ের মতো বিশাল শহরগুলোতে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে নানা সমস্যায় ফেলে এবং তাদেরকে প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করে। এছাড়া এখানে নারীত্বের শক্তিকেও প্রদর্শন করে হয়েছে মাহাত্ম্যের সাথে। সকল বাধার বিপরীতে দাঁড়িয়ে গেছেন একজন মাঝবয়েসী মহিলা। 

আজ্জির কোলে ছোট্ট মান্দা; Image Source: Deccan Chronicle

২০১৭ সালে রেইপ-রিভেঞ্জ নিয়ে বেশকিছু সিনেমা নির্মিত হয়েছিলো ভারতে। বীভৎসতা প্রদর্শনের দিক থেকে এগুলো থেকে আলাদা হওয়ার কথা তো আগেই বলা হয়েছে। তবে ‘আজ্জি’র সবচেয়ে শক্তিশালী দিক হলো এর গল্পের লেখনী। ‘লিটল রেড রাইডিং হুড’ গল্পের ছাঁচে ফেলে  নিজেদের চেনা পরিবেশের কদর্য দিকগুলো তুলে ধরার ক্ষেত্রে একবিন্দুও ছাড় দেননি পরিচালক মাখিজা এবং লেখক মিরাত ত্রিবেদী। গল্পের জন্য তথ্য অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে তারা কতটা যত্নশীল এবং পরিশ্রমী ছিলেন, সেটি মুভিটি দেখলেই বোঝা যায়।

সেইসাথে যুক্ত হয়েছে শক্তিশালী, আঁটসাঁট চিত্রনাট্য। যা আপনাকে পুরোটা সময় কাহিনীতে মনোযোগী করে রাখবে; এক মুহূর্তের জন্যেও অন্যদিকে দৃষ্টি ফেরাতে দেবে না। এছাড়া, এখানে অনেক মেরুকরণের উপকরণ রয়েছে। যা আপনাকে যেকোনো একটা পক্ষকে বেছে নিতে এবং এই সংক্রান্ত বিতর্কে অংশ নিতে উদ্বুদ্ধ করবে। এই ধরনের কাহিনী বিষয়ক সিনেমার ক্ষেত্রে যেটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। 

মুভিটির মূল প্রাণশক্তি সুষমা দেশপাণ্ডে অভিনীত আজ্জি চরিত্র। তার চাহনি মুখের কথার চেয়েও বেশি অনুভূতি প্রকাশ করে। তিনি একইসাথে টলায়মান এবং দৃঢ়সংকল্প। যত ঘৃণ্য পন্থাই অবলম্বন করেন না কেন; এ চরিত্রে সুষমার অনবদ্য অভিনয় দর্শককে তার পক্ষ নিতে আগ্রহী করে তুলবে। বিশেষ করে কসাইখানার দৃশ্যগুলোতে তার নৈপুণ্য অসাধারণ। 

শর্বাণী সূর্যবংশী অভিনীত মান্দা চরিত্রটি যেন সরলতার প্রতিমা। বয়স কম হলেও শর্বাণী তার অভিনীত চরিত্র  ও দৃশ্যকল্পের গভীরতা অনুধাবন করতে সক্ষম হয়েছে। ফলে, আন্তরিকতার সাথে এসব দৃশ্যাবলীতে প্রয়োজনীয় অনুভূতির পরিস্ফুটন ঘটাতে পেরেছে পর্দায়। 

অভিষেক ব্যানার্জীর দাভলে চরিত্রটি আমাদের বীতশ্রদ্ধ করলেও, তার অভিনয়শৈলী দর্শকের মাঝে মুগ্ধতা ছড়াতে সক্ষম। সে একদম জাতবজ্জাত এবং নিজের চরিত্রের অন্ধকার দিকগুলোকে ধারণ করে কোনো রাখঢাক ছাড়া। ম্যানিকুইনের সাথে সঙ্গম করা এবং তা ভিডিও করার মতো একটি জঘন্য দৃশ্য রয়েছে সিনেমায়। সেখানে অসাধারণ অভিনয় করেছেন অভিষেক; যা দেখে সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষের গায়ে কাঁটা দিতে পারে। এছাড়া আরেকটি দৃশ্যেও তার শিল্পীসত্তার পরিচয় পাবেন দর্শক। এই দৃশ্যে পুলিশ তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে তার বাসায় যায়। যেখানে তার ভয় পাওয়ার কথা, সেখানে উল্টো সে পুলিশকে শাসায় এবং নিজের প্রভাব-প্রতিপত্তির কথা মনে করিয়ে দেয় কেবল শব্দচয়নের মাধ্যমে। 

দাভলে চরিত্রে অভিনয় করেছেন অভিষেক ব্যানার্জি; Image Source: Hindustan Times

 

সহযোগী চরিত্রে স্মিতা তাম্বে এবং সাদিয়া সিদ্দিকীর সংযোজন বিচক্ষণতার পরিচায়ক। এই চরিত্রগুলো সিনেমার গল্পে আরো গভীরতা আনয়ন করেছে, যুক্ত করেছে প্রলেপ, নিশ্চিত করেছে ভিন্ন ভিন্ন মানসিকতার সম্মিলন। সুধীর পাণ্ডের কথা ভুললে চলবে না, যিনি শান্তশিষ্ট, সংবেদনশীল কসাইয়ের চরিত্র রূপায়ন করেছেন। 

সামগ্রিকভাবে, ‘আজ্জি’ দুর্বলচিত্তের দর্শকদের জন্য নয়, এটা হজম করা তাদের পক্ষে বেশ কষ্টসাধ্য হবে। কিন্তু এটি আমাদের চারপাশে বিদ্যমান পঙ্কিল বাস্তবতাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। তাই যদি সহ্য করতে পারেন, তাহলে এই সিনেমা না দেখার কোনো কারণ নেই।

Related Articles

Exit mobile version