আহমদ ছফা স্বয়ং দাবি করেছেন, অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী তার আত্মজৈবনিক উপন্যাস। উপন্যাসটির বেশিরভাগ চরিত্রের অস্তিত্ব তার নিজের জীবনে বিদ্যমান ছিল বলে স্বীকার করেছেন তিনি। বইটি পড়লে তা সত্য বলেই প্রতীয়মান হয়। চরিত্রগুলোর সাথে বাস্তব জীবনের মানুষগুলোর মিল খুঁজে পাওয়া যায়। এটি উত্তম পুরুষে বর্ণিত। কথক জাহিদ তার নবপ্রত্যাশিত প্রেমিকা শাবানকে তার প্রাক্তন অসফল প্রেমের গল্প বলেছেন। নতুন প্রেম ও প্রিয়তমার কাছে নিজ হৃদয়ের পরিশুদ্ধি ও নির্ভারতা প্রকাশ করার জন্য অকুণ্ঠচিত্তে তার জীবনে অতীতে আসা নারীদের কথা বয়ান করেছেন। জাহিদ একটি চিঠিতে তার প্রেমিকাকে তার পূর্বস্মৃতি বর্ণনা করেছেন। পুরো উপন্যাসটিই আগাগোড়া একটি চিঠি।
জাহিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন রিসার্চ স্কলার। বারোশ’ টাকা বৃত্তির বদৌলতে তার দিনাতিপাত হয়। তার এই চাকচিক্যবিহীন বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে একসময় তার সাথে জনৈক দুরদানা আফরাসিয়াবের সাথে পরিচয় হয়। গতানুগতিক নারীত্বকে অস্বীকার করে আসা এই নারীর অনন্যসাধারণ গুণাবলী জাহিদকে আকৃষ্ট করে। দুরদানার এই ‘অ-নারীসুলভ’ আচরণ সমাজের চোখে দৃষ্টিকটু দেখালেও জাহিদ কিন্তু তাতেই মজে যান। দুরদানার ভাই একজন বামপন্থী রাজনীতিক হওয়ায় জাহিদের তথাকথিত অনেক সুহৃদ তাকে সাবধান করে দেয়। আমাদের সমাজের বামপন্থী রাজনীতির প্রতি এই বীতরাগ তখনো ছিল, এখনো আছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বামপন্থী রাজনীতি আজও বিষদাঁতহীন সাপ। কিন্তু এই দুরদানার যে ভিন্নধর্মী, পুরুষতান্ত্রিকতাকে পরিহাস করা ব্যক্তিত্ব জাহিদকে আকর্ষণ করেছিল, ধীরে ধীরে তা যেন মলিন হয়ে যায়। জাহিদ এবং দুরদানা দুজনেই টের পান, কোনো নারীর পক্ষেই নারীত্বের বৈশিষ্ট্যকে শত চেষ্টা করেও দূরে রাখা সম্ভব নয়। দুরদানাও তার নারীসত্ত্বাকে পুরোপুরি অস্বীকার করতে পারেন না। বাইরে বাইরে তিনি যতটাই স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য প্রকাশ করুন না কেন, ভেতরে ভেতরে তিনি কিন্তু শেষ পর্যন্ত একজন নারীই বটে। নারী দুরদানার নারীত্বকে মেনে নিতে পারেন না জাহিদ, ধীরে ধীরে তাদের মধ্যকার সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়।
দুরদানার পর জাহিদের জীবনে আসেন শামারোখ- জাহিদ যাকে কন্যা শামারোখ বলে বিবেচিত করেছেন। শামারোখ সমাজের চোখে নিন্দনীয়, কিন্তু সেসবের ধার ধারেন না প্রেমিক জাহিদ। সময়ের সাথে সাথে শামারোখই জাহিদের ধ্যানজ্ঞান হয়ে ওঠেন, তার জন্য তিনি মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার কথাও নির্দ্বিধায় স্বীকার করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে সকলের চোখে শত্রু পরিণত হয়ে শামারোখকে চাকরি পাইয়ে দেন জাহিদ। কিন্তু তারপর ধীরে ধীরে শামারোখেরও পরিবর্তন ঘটে। আবারও পরিবর্তনের ধাক্কায় বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় জাহিদ-শামারোখের সম্পর্ক, কথকের দ্বিতীয় প্রেম।
শামারোখ পরে এক কবির সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। নিজের বিপদের সময় যে জাহিদের গলগ্রহ হতে চেয়েছিলেন শামারোখ, বিপদমুক্ত হয়েই তাকে একরকম ত্যাগই করেন তিনি। নিজেকে একপ্রকার ‘লুজার’ বলে বিবেচনা করেন আরেকবার ব্যর্থ জাহিদ। অতীতের এই ব্যর্থতার গল্প বলে কথক শাবানের কাছে নিজেকে প্রমাণের চেষ্টা করেন।
ভালোবাসা এক বিচিত্র জিনিস। লেখক আহমদ ছফার মতে, প্রতিটি পুরুষই একজন সর্বাঙ্গীণ নারীসত্ত্বাকে কল্পনা করে তাকে ভালোবাসতে চায়। কিন্তু বাস্তবে যে তা সোনায় সোহাগা- কারণ কোনো নারীর পক্ষেই পুরুষের চির আকাঙ্ক্ষিত সকল বৈশিষ্ট্য ধারণ করা সম্ভব নয়। তাই পুরুষেরা সেই প্রমাণ নারীত্বের আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্যধারী নারীদের সাথে বহুবার প্রেমের জালে আবদ্ধ হয়। অর্থাৎ প্রেম যে একটি মনের প্রতি আজীবন অনুরক্ততা, তা কিন্তু মোটেই নয়, বরং প্রেম বারবার হওয়াটাই স্বাভাবিক। চিরপতিব্রতা আবহমান বাঙালি নারীর প্রেমময়তার বিপরীত সংজ্ঞা এই উপন্যাস।
উপন্যাসটি পড়ে মনে হয়, নারীর শরীর সম্পর্কে আহমদ ছফা যথেষ্ট শৌখিন ছিলেন। নাকি সমঝদার বলব? তিনি মেকিভাষ্যের আশ্রয় নেননি। সরাসরি স্বীকার করেছেন, সুন্দরী মাত্রই বেশি আকর্ষণীয়া, ভালোবাসায় শরীর একটি অবিচ্ছেদ্য, অপরিহার্য উপাদান, এবং তন্বীর চাইতে হৃষ্টপুষ্ট নারী-শরীরই বেশি কামোৎপাদক। শামারোখ বা দুরদানার শরীরের প্রতি তার আকর্ষণ তিনি বারবার উপন্যাসে স্বীকার করেছেন এবং কোথাও তা লুকোনোর জন্য তাকে মিনমিনে কৈফিয়ত দিতে দেখা যায়নি। হোস্টেলে নিজের কক্ষে শামারোখের কান্নাভঙ্গুর কম্পমান দেহকে জড়িয়ে ধরে বা চুম্বন করে তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার যে স্বগত অভিলাষ তিনি প্রকাশ করেছেন, তা শুধু জাহিদের নিজস্ব কামনা নয়, বরং নারী, নারীত্ব ও নারীদেহের প্রতি সকল পুরুষের অবদমিত আকাঙ্ক্ষা।
ছফার ইচ্ছে ছিল, উপন্যাসটির দ্বিতীয় খণ্ড লিখে যাবেন। কিন্তু কপালের ফের (কার? ছফার না পাঠকের?), পরপারের ডাক চলে আসায় দ্বিতীয় খণ্ড লিখে যেতে পারেননি। নইলে হয়তো আরও কিছু নশ্বর মানুষের সৌভাগ্য হতো, ছফার লেখনীর অন্তরালে নিজেদের স্মৃতিগুলোকে চিরস্থায়ী করে যাওয়ার।
পুরোপুরি প্রমাণিত সত্য না হওয়ায় উপন্যাসের চরিত্রগুলোর সাথে বাস্তবের মানুষগুলোর মিল এখানে দেখানে হলো না। আগ্রহী পাঠক একটু খোঁজ করলে নিজেই জানতে পারবেন।
অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী প্রথমে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকায় প্রাণপূর্ণিমার চান নামে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল। পরে উপন্যাস হিসেবে বর্তমান নামে ১৯৯৬ সালে প্রকাশিত হয়।
বইয়ের নাম: অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী || লেখক: আহমদ ছফা
প্রকাশক: মওলা ব্রাদার্স || অনলাইন প্রাপ্তিস্থান: রকমারি.কম