মাত্র চুয়ান্ন বছর বেঁচেছিলেন; এই স্বল্প জীবনে লিখে গেছেন দুটি উপন্যাস, একটি প্রবন্ধগ্রন্থ আর হাতেগোনা কয়েকটি ছোটগল্প। তুলনামূলকভাবে এটুকু লিখেই বাংলা সাহিত্যে নিজেকে এক অনন্য আসনে অধিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছেন আখতারুজ্জামান ইলিয়াস। লেখার সংখ্যার উপরে নয়, বরং লেখার গুণগত মানের উপর তিনি সব সময় গুরুত্ব দিয়েছেন। তাঁর গল্পের চরিত্রগুলোকে সুচারুভাবে উপস্থাপন করতে পুরনো ঢাকার অলিগলি থেকে শুরু করে যমুনার দুর্গম চর এলাকায় হেঁটে বেড়িয়েছেন অনবরত।
যে পা দুটোয় ভর করে জীবনের কঠিন বাস্তবতা এবং সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর প্রকৃত স্বরূপ উন্মোচনের জন্য আজীবন কাজ করে গেছেন, জীবনের শেষ বয়সে দুরারোগ্য ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে সেই পা দুটোর একটি হারিয়েছেন। ক্রমশ ফুসফুসেও ছড়িয়ে গেছে ক্যান্সার, তবুও তিনি বারবার বাঁচতে চেয়েছেন। আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে একটি বড় ক্যানভাসের উপন্যাস লেখার প্রবল ইচ্ছা ছিল তাঁর। আবেগমাখা গদগদ গলায় নয়, বরং বাস্তবতার নিষ্ঠুর কঠিন সত্যকে তার যথাযথরূপে নিখুঁত আঁচড়ে পরিস্ফুটিত করেছেন তাঁর সমস্ত সৃষ্টিকর্মে।
‘চিলেকোঠার সেপাই‘ ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস রচিত একটি মহাকাব্যিক উপন্যাস। কোনো বাড়ির চিলেকোঠায় বাস করেও স্বাধীনতার লক্ষ্যে গড়ে ওঠা বৃহত্তর আন্দোলনের জোয়ারে একজন সাধারণ মানুষের মিলতে সক্ষম হওয়ার গল্প এটি। একটি বিশেষ সময়ে জনজীবনের সমগ্রতাকে, বিশেষ করে গ্রাম ও শহরের প্রতিটি কোণের মানুষকে লেখক এ উপন্যাসে অত্যন্ত সুচারুভাবে উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছেন। ‘চিলেকোঠার সেপাই’ ১৯৮০-এর দশকের শুরুতে ‘রোববার’ নামের সাপ্তাহিক পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয় এবং ১৯৮৬ সালে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়।
এ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র ওসমান গণি ওরফে রঞ্জু দেশবিভাগের কারণে উদ্বাস্তু হয়ে ঢাকায় আসে। ওসমানের বাবা থেকে যান ভারতে, বাবা বেঁচে আছে কি না তা-ও জানে না সে। সবকিছু থেকে সে এতটাই বিচ্ছিন্ন আর ছিন্নমূল যে ঢাকার ঘিঞ্জি গলির মধ্যে এক বাড়ির চিলেকোঠায় বাস করাই তার জন্য যথাযথ হয়। পাকিস্তানি শাসকদের শোষণের বিরুদ্ধে ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানে তখন শহর, নগর, বন্দর, গঞ্জ, নিভৃত গ্রাম, এমনকি যমুনার দুর্গম চর এলাকা কেঁপে কেঁপে উঠছে। নিত্যদিন মিটিং, মিছিল, গণআদালত, কারফিউ ভাঙা- ক্ষোভ ও বিদ্রোহে সব স্থানের মানুষ তখন মুক্তির লক্ষ্যে উন্মত্ত। ওসমান গণি সবকিছু দেখে, শোনে, মিছিল-মিটিংয়েও যায়। কিন্তু কোনো কিছুতেই সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতে পারে না। তার বিচ্ছিন্নতা ও আত্মপ্রেমের চিলেকোঠার চার দেয়ালে আবদ্ধ থেকে তার দিন কাটে।
তবু বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের সাথে তার বিভিন্নভাবে যোগাযোগ হতে থাকে। তারই সহনামী প্রতিবেশী কিশোর রঞ্জুর প্রতি তার ভালবাসা কাজ করে। কিন্তু রঞ্জুর তরুণী বোন রানুকে আবার ওসমান অবচেতন মনে কামনা করে। এছাড়া এক নেতায় বিশ্বাসী আলাউদ্দিন, ভোটের রাইট প্রার্থী আলতাফ, রাজনীতি বিশ্লেষক বামপন্থী আনোয়ার, রিকশাওয়ালা হাড্ডি খিজিরসহ বিভিন্ন ধরনের মানুষ তার চারপাশ ঘিরে রাখে। মূলত একটি বিশেষ সময়ের সব ধরনের মানুষকে লেখক এই উপন্যাসে এক ফ্রেমে আবদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছেন। শহরের আধুনিক উচ্চবিত্ত বুদ্ধিজীবীর পাশাপাশি বস্তির খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের চোখে একটি গণআন্দোলনের প্রকৃত রুপটি লেখকের অসামান্য পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা ও বর্ণনা-নৈপুণ্যে পাঠকের সামনে উন্মোচিত হয়েছে।
ওসমানের বন্ধু আনোয়ার বামপন্থি রাজনীতির সক্রিয় সদস্য। যমুনার দুর্গম চর এলাকায় গ্রামে গিয়ে মহাজন জোতদারসহ শোষকশ্রেণীর ভয়াবহ রূপ দেখে নিজ শ্রেণীর উপরে তার ঘৃণা জন্মায়। নিজ আত্মীয় ও জ্ঞাতিদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েও সমাজের নিচু স্তরের মানুষগুলোর কাছে সে বিশ্বস্ত হতে পারে না। আরেক চরিত্র হাড্ডি খিজির একটু আলাদা ধরনের রুক্ষ মানুষ। এক নেতায় বিশ্বাসী আলাউদ্দিন মিয়ার রিক্সার গ্যারেজে থেকে রাজপথের মানুষের সাথে মিছিল করে স্লোগান দিতে তার ভালো লাগে। সময় আর সুযোগ পেলেই তাই চলে যায় মিটিং-মিছিলে। এক ভরা জনসভায় ক্ষমতার অপব্যবহারের প্রসঙ্গ উঠলে হাড্ডি খিজির নির্ভয়ে মহাজনের বিরুদ্ধে কথা বলে। শহরের কোণায় কোণায় আন্দোলনের উত্তাপ যেভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল, তা বিভিন্ন চরিত্রের বর্ণনা ও ঘটনাপ্রবাহে অপূর্ব নিপুণতায় এ উপন্যাসে ফুটে উঠেছে।
গণঅভ্যুত্থানে ভীতসন্ত্রস্ত শাসকদের নতুন করে আরোপ করা সামরিক শাসন এবং নির্যাতনের পরিপ্রেক্ষিতে চারপাশের মানুষের মধ্যে এক বিহ্বলভাব লক্ষ্য করা যায়। বন্ধুদের বিহ্বলভাব ওসমানকেও দারুণভাবে আলোড়িত করে। ঊনসত্তর যে স্বাধীনতা আন্দোলনকে চূড়ান্ত রূপ দেয় এবং এই ঊনসত্তরই যে হাজার বছরের বাংলার শোষণ মুক্তির হাতিয়ার তা লেখক ওসমানের চিন্তায় এবং চোখে দেখিয়েছেন। লেখকের লেখনীতে-
…সব রাস্তায় আগুন জ্বলছিল, নবাবপুরে আগুন, নীমতলীতেও আগুন। ফায়ার ব্রিগেডের বড় বড় গাড়ি থেকে বড় পাইপ দিয়ে জলধারা পড়ে রাস্তাঘাট ভেসে যাচ্ছে, আগুনের শিখা নিচে নামে না। দেখতে দেখতে সেই জলধারা পরিণত হয় নদীতে।
সদরঘাট থেকে জনসন রোড, নবাবপুর থেকে নীমতলী পেরিয়ে মেডিকেল কলেজের সামনে দিয়ে স্যাভেজ রোড দিয়ে বুড়িগঙ্গা ছুটে চলেছে শাহবাগ এ্যাভিন্যুতে। সেখান থেকে নদী ছোটে এয়ারপোর্টের দিকে। তার শাখা-প্রশাখা ছড়িয়ে যায় নীলখেতে, নিউ মার্কেটের সামনে দিয়ে মিরপুর রোডে। নদীর ঢেউ এসে লাগে ধানমণ্ডির এ রাস্তায় সে রাস্তায়। তবে আগুনকে এতটুকু দমাতে পারে না। …ওসমান ঠিকই টের পায় নদী এসেছে আগুনকে উস্কে দেবার জন্য। আগুনকে কদমবুচি করতে করতে নদী এগিয়ে যায়।
তার এ কথাতেই যেন পূর্ণতা পায় ঊনসত্তরের ঢাকা।
অথবা,
ওসমান ভাবতে থাকে……
বাংলা বাজার, তাঁতি বাজারের মানুষ লুপ্ত-খালের হিম হৃদপিণ্ড থেকে উঠে এসেছে? ঐ তো ইব্রাহীম খাঁর আমলে শাহজাদা খসরুর সঙ্গে সংঘর্ষে নিহত পাগড়ি পরা সেপাইরা। শায়েস্তা খাঁর টাকায় আট মণ চালের আমলে না খেয়ে মরা মানুষ দেখে ওসমান আঁতকে ওঠে। ৩০০ বছর ধরে তাদের খাওয়া নাই, – কেউ চুলের তরঙ্গ উড়িয়ে তারা এগিয়ে চলে পায়ে পায়ে।
মোগলের হাতে মার খাওয়া, মগের হাতে মার খাওয়া, কোম্পানির বেনেদের হাতে মার খাওয়া- সব মানুষ না এলে মিছিল কি এত বড় হয়?”
চিলেকোঠার চার দেয়াল থেকে মুক্তির প্রচেষ্টা অবশেষে ওসমানকে উন্মত্ত করে তোলে। পরিচিতরা বদ্ধ পাগল হিসেবে চিহ্নিত করে তাকে আটকে রাখে তার নিজের ঘরে। মুক্তি আকাঙ্ক্ষী ওসমানের কাছে মনে হয়,
… মহল্লার গলি, উপগলি, শাখাগলি থেকে আরো সব লোক এসে জুটেছে খিজিরের সঙ্গে। এত লোক কোত্থেকে আসে? পাড়ায় কি এত মানুষ আছে? — হ্যাঁ এবার ওসমান ঠিক ধরতে পেরেছে। মহল্লার জ্যান্ত মানুষের সঙ্গে যোগ দিচ্ছে ১০০ বছর আগে সায়েবদের হাতে নিহত, সায়েবদের পোষা কুকুর নবাবদের হাতে নিহত মিরাটের সেপাই, বেরিলির সেপাই, লক্ষ্মৌ-এর মানুষ, ঘোড়া ঘাটের মানুষ, লালবাগের মানুষ। গা একটু ছম ছম করলেও ওসমান সামলে নেয়। না, তার ভয় কী?
অবশেষে সেই বিচ্ছিন্ন ঘর থেকে তাকে বেড়িয়ে পড়তে প্ররোচনা দেয় গণঅভ্যুত্থানের সদস্য হওয়ার অপরাধে মধ্যরাতে কারফিউ চাপা রাস্তায় মিলিটারির হাতে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত হাড্ডি খিজির। সমাজের তথাকথিত নিম্নস্তরের সামান্য একজন শ্রমিকই ওসমানের মুক্তি আকাঙ্ক্ষী সত্তাকে জাগিয়ে তোলে।
ওসমানকে আটকে রাখার জন্য বন্ধুদের সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায়। নিহত খিজিরের আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে সে ঘরের তালা ভেঙে সবার অগোচরে রাস্তায় বেড়িয়ে আসে। চিলেকোঠার বন্ধন থেকে মুক্তি পেয়ে ওসমানের সামনে অজস্র পথ খুলে যায়। নিজের সামনে-পেছনে-ডানে-বায়ে সব পথকেই তখন তার আপন মনে হয়। মূলত, চিলেকোঠার চার দেয়ালের বন্ধন থেকে মুক্ত হওয়ার সাথে সাথে তার বিচ্ছিন্নতা ও আত্মপ্রেমের বন্ধন থেকেও তার মুক্তি ঘটে। বৃহত্তর গণআন্দোলনের জোয়ারে অবশেষে ওসমান একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে মিশে যেতে সক্ষম হয়।
আখতারুজ্জামান ইলিয়াস মহাকবির মতো ছোট ছোট কাহিনীপর্বকে সুন্দর সম্মিলনের মাধ্যমে এ উপন্যাসে একটি মহাকাব্যিক রূপ দিয়েছেন। শহরের বস্তি থেকে শুরু করে যমুনার দুর্গম চর এলাকা পর্যন্ত উপন্যাসটি বিস্তৃত হয়েছে। লেখকের অতি সূক্ষ্ম এবং নিবিড় পর্যবেক্ষণ শক্তিতে উপন্যাসের শব্দে শব্দে একটি আলাদা দ্যোতনা সৃষ্টি হয়েছে। লেখকের অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন লেখায় একেকটি চরিত্রের বাস্তবতা, পরাবাস্তবতা, ঘটনার সাথে চরিত্রের বাস্তবতা, কল্পনা, চেতনা অন্তঃচেতনার মিশ্রণে প্রতিটি পৃষ্ঠায় পাঠক নতুন দৃষ্টিতে জীবনকে আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছে। উপন্যাসের কাহিনীবিন্যাসই পাঠককে শেষ পর্যন্ত টেনে নিয়ে যায়। ইতিবাচক রাজনীতির উপস্থাপনায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের অব্যবহিত পূর্বরূপটি উপস্থাপনে ‘চিলেকোঠার সেপাই’ একটি অনন্য উপন্যাস।