আচ্ছা, টুইস্ট থ্রিলার বলে কি থ্রিলারের কোনো সাব-জনরা আছে? অ্যাকশন, ক্রাইম, স্পাই থেকে শুরু করে কন্সপিরেসি, কমেডি, ইরটিক—বিভিন্ন ধরনের সাব-জনরা থাকলেও, সরাসরি টুইস্ট থ্রিলার বলে কি কিছুর অস্তিত্ব আদৌ আছে, যেখানে থ্রিল বা শিহরণের মূল উপাদানটি কেবল ওই টুইস্টের মাঝেই নিহিত?
স্মৃতি হাতড়ে যদি কোনো নাম এই মুহূর্তে আপনার মনে না-ও পড়ে, সমস্যা নেই তাতে। কারণ এখন যে ছবিটি নিয়ে কথা বলতে চলেছি, সেটিকে নির্দ্বিধায় একটি টুইস্ট থ্রিলার বলা যেতে পারে।
ছবিটি ‘দ্বিতীয় পুরুষ’। গত দশকের গোড়ার দিকে ভারতীয় বাংলা চলচ্চিত্রের মোড় ঘুরিয়ে দেয়া ছবি ‘বাইশে শ্রাবণ’-এর সিক্যুয়েল। পরিচালকের আসনে যথারীতি সৃজিত মুখার্জি, বক্স অফিস সাফল্য থেকে শুরু করে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, সবকিছুই যার পায়ে এসে লুটায়।
‘বাইশে শ্রাবণ’-এর ধারাবাহিকতা বজায় রেখেই আবির্ভূত হয়েছে ‘দ্বিতীয় পুরুষ’-এর কাহিনী। নয় বছর আগে পুলিশের ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টে ইন্সপেক্টর ছিল যে অভিজিৎ পাকড়াশি (পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়), সে আজ কলকাতার ‘সবচেয়ে প্রমিজিং’ অফিসার। তার প্রেমিকা ও লিভ-ইন পার্টনার অমৃতাও (রাইমা সেন) আছে, তবে এখন সে বিয়ে করা বউ। প্রবীর রায়চৌধুরী (প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়) যদিও সশরীরে নেই, কিন্তু আচমকা ফ্ল্যাশব্যাকে কিংবা অভিজিতের স্মৃতিতে বারবারই ধরা দিয়ে যায় সে।
প্রবীরবাবু থুক্কু… প্রবীর স্যারকে পাকড়াও করার পর থেকেই সিরিয়াল কিলিং এক্সপার্ট হিসেবে নামডাক ছড়িয়ে পড়েছে অভিজিতের। তাই তো ২৫ বছর আগে, ১৯৯৩ সালে তিনটে খুন করে জেলে যাওয়া চায়নাটাউনের কিশোর গুণ্ডা খোকা (ঋতব্রত মুখোপাধ্যায়) যখন যুবক বয়সে বেরিয়ে এসে (অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়) আবারো একই কায়দায় খুন করতে শুরু করে, তখন স্বভাবতই এই কেসের দায়ভারও এসে চাপে অভিজিতেরই কাঁধে। অভিজিতের সঙ্গী হিসেবে যোগ হয় জুনিয়র অফিসার রজত (গৌরব চক্রবর্তী)।
তো, ব্যক্তিজীবনে ইতোমধ্যে টানাপোড়েন চলতে থাকা অভিজিৎ কি পারবে একের পর এক খুন করে যাওয়া খোকাকে তার কোটা পূরণের আগেই আটকাতে? নাকি নিজের অতীত ও বর্তমানের জটিলতা নিয়েই ক্রমশ দগ্ধ হতে থাকবে অভিজিৎ, এবং একপর্যায়ে তলিয়ে যাবে নিঃসীম আঁধারে?
মোটের উপর এটাই হলো ছবির কাহিনী। যদিও খুব একটা দরকার ছিল না, তবু সম্ভবত সিক্যুয়েলের চাহিদা পূরণেই অতিথি চরিত্র হিসেবে মুখ দেখিয়ে যায় অমৃতা ও অভিজিতের বন্ধু সূর্য (আবীর চট্টোপাধ্যায়)। রজতের প্রেমিকা হিসেবে অঙ্কিতাও (ঋদ্ধিমা ঘোষ) আরেকটি নতুন চরিত্র। এছাড়া ২৫ বছর আগে খোকাকে গ্রেপ্তার করেছিল প্রবীর রায়চৌধুরীর বড় ভাই প্রণব রায়চৌধুরী, যে চরিত্রে রূপদান করেছেন বাবুল সুপ্রিয়।
অভিনেতা হিসেবে পরমের জন্য বড় চ্যালেঞ্জিং ছিল এই চরিত্রটি। কেন? কারণ অন্য আর সকল ছবি তো বটেই, এমনকি ফেলুদা কিংবা ব্যোমকেশের চরিত্রেও তাকে দেখা গেছে নিজস্ব ব্যক্তিত্বের ছাপ ফেলে যেতে। কিন্তু এই ছবির অভিজিৎ পাকড়াশি কেবল তার নিজের থেকেই আলাদা নয়, বরং ‘বাইশে শ্রাবণ’-এর অভিজিৎ পাকড়াশির থেকেও তার তফাতের জায়গা অনেক।
‘বাইশে শ্রাবণ’ এর থেকে এই ছবিতে পরমকে ঢের বেশি রাফ অ্যান্ড টাফ অভিনয় করতে হয়েছে, অনেকটা যেন প্রসেনজিতের ছেড়ে যাওয়া জুতোতেই পা গলাতে হয়েছে। বদমেজাজ, যখন তখন গালিগালাজ কিংবা নিজের জুনিয়রকে প্রতি পদে পদে হেনস্থা করা, এই সবকিছুই পরমের ব্যক্তিত্বের একদম বিপরীত। তারপরও সু-অভিনেতা তিনি, তাই চ্যালেঞ্জটা বেশিরভাগ সময়েই জয় করতে পেরেছেন তিনি। কিন্তু যে এক-আধবার পারেননি, সেই দৃশ্যগুলো বড্ড দৃষ্টিকটু লেগেছে।
বড় খোকা হিসেবে অনির্বাণ নিঃসন্দেহে দারুণ। শাহরুখের ‘ডর’ ছবির গানে-সংলাপে, পা টেনে টেনে হাঁটায়, বিকৃত হাসিতে বা খাবার চিবোনোয় পুরো পর্দাজুড়েই যেন ছিলেন তিনি। তার জন্য এই চরিত্রটি করা খুব কঠিন হয়তো ছিল না, কেননা পরিচালক-চিত্রগ্রাহক-কস্টিউম ডিজাইনারের বড় ভূমিকা ছিল তাকে এভাবে উপস্থাপনে। কিন্তু তারপরও দীর্ঘদিন একই রকম চরিত্রে কাজ করে যাওয়ার পর এ ছবির মাধ্যমে দর্শকের সামনে নিজেকে খানিকটা ভিন্নভাবে চেনানোর সুযোগ পেয়েছেন তিনি। পেয়েছেন নিজের ইমেজটাকে নতুন আদলে গড়ার সুযোগও। এই সুযোগ হাতছাড়া করেননি তিনি।
তবে সবচেয়ে বেশি প্রশংসার দাবিদার ঋতব্রত। সেই ‘ওপেন টি বায়োস্কোপ’ থেকে শুরু করে ‘জেনারেশন আমি’ কিংবা ‘গোয়েন্দা জুনিয়র’, সব ছবিতেই পাশের বাসার মিষ্টি ছেলের ভূমিকায় কাজ করে চলা ঋতব্রতকে রক্তের নেশায় উন্মত্ত খোকা হিসেবে দেখতে পাওয়াটা এক পরম পাওয়া। নিজের জাত তো চিনিয়েছেনই, সেই সাথে প্রমাণ করে দিয়েছেন তিনি লম্বা রেসের ঘোড়া। তার সমান্তরালে অসাধারণ কাজ করেছেন ছোট পল্টনরূপী সোহম মৈত্রও।
সিনেমাটোগ্রাফিতে সৌমিক হালদারের সবচেয়ে বড় সফলতা খোকার চরিত্রটির ম্যানারিজম সঠিকভাবে তুলে ধরার ক্ষেত্রে। তবে ভায়োলেন্সের দৃশ্যগুলোতে ক্যামেরা খানিকটা কাঁপলেও হয়তো মন্দ হতো না, বরং থ্রিলারের অনুভূতিটা পাওয়া যেত। এদিকে সম্পাদনায় প্রণয় দাশগুপ্তের বিশেষ কিছু করার ছিল বলে মনে হয়নি।
সৃজিতের ছবিতে অনুপমের গান বরাবরই বিশেষ আকর্ষণের বস্তু হয়ে থাকে, এবং তা ছিল এই ছবিতেও। বিশেষ করে ‘যে কটা দিন’ গানটি নিয়ে তো বহু আগে থেকেই দর্শকশ্রোতাদের উন্মাদনা ছিল তুঙ্গে। সামান্য ক্রিয়াপদের বর্তমান থেকে অতীতে পরিবর্তনই একটি চরিত্রের কিংবা একটি পরিস্থিতির কেমন আকাশ-পাতাল তফাৎ ঘটিয়ে দিতে পারে, তার একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত এ গানটি। এবং এ গানটির দৃশ্যায়নও চমৎকার হয়েছে। অভিজিৎ-অমৃতার সম্পর্কের ভাঙনের বিষয়টি মূলত এ গানের মধ্য দিয়েই সূক্ষ্মভাবে দেখানোর চেষ্টা করেছেন পরিচালক, এবং সেটি বেশ ভালোভাবেই করেছেন তিনি।
তবে এই একটি গান ছাড়া এ ছবির আর কোনো গানই তেমন উল্লেখযোগ্য নয়। ‘বাইশে শ্রাবণ’-এ ‘গভীরে যাও’, ‘এই শ্রাবণ’ কিংবা ‘একবার বল’-এর মতো আরো অসাধারণ সব গান ছিল, এ ছবিতে সেগুলোর অনুপস্থিতি উপলব্ধ হয়েছে।
অনুভূত হয়েছে ‘বাইশে শ্রাবণ’-এর সেই দুর্দান্ত ওয়ান লাইনার সংলাপগুলোর অনুপস্থিতিও। অভিজিৎ পাকড়াশি হয়তো প্রবীরবাবুর গালিগুলো আয়ত্ত করতে পেরেছে, কিন্তু সেই গালিতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা তিনি করতে পারেনি। এবং তার কথায় কথায় বাংলা শব্দচয়ন ও উচ্চারণের ভুল ধরাটাও বিশেষ কোনো রসবোধের জন্ম দেয়নি, কেবল চরিত্রটির অবসেসিভ ডিজঅর্ডারের দিকটিকেই আরো পাকাপোক্ত করেছে। উপভোগ্য ছিল মৃত্যুদণ্ডের পক্ষ-বিপক্ষের বিতর্ক কিংবা খোকার মুখে শাহরুখের ফিরে আসার ভবিষ্যদ্বাণী।
এবার চলে আসা যাক ছবির মূল প্রাণ তথা কাহিনীর বিষয়ে। সৃজিতের পাশাপাশি কাহিনীকার হিসেবে রয়েছেন শুভঙ্কর ব্যানার্জি। দুঃখজনক হলেও সত্যি, এই ছবির দুর্বলতম দিক এর কাহিনী। এবং এ কথা তো বলাই বাহুল্য যে, একটি থ্রিলার ছবির কাহিনীই যদি শক্তপোক্ত না হয়, তাহলে সেই ছবির আর কতটা পটেনশিয়াল থাকে!
ওই যে শুরুতে বলছিলাম টুইস্ট থ্রিলারের কথা, আদতেই এটি পুরোদস্তুর একটি টুইস্ট থ্রিলার। ‘বাইশে শ্রাবণ’ যে একটি কাল্ট ছবিতে পরিণত হয়েছে, তার কারণ অবশ্যই ছবিটির ক্লাইম্যাক্সের সেই টুইস্ট। তাই এ ছবিতেও কাহিনীকারদ্বয় তাদের পুরোটা শক্তি ব্যয় করেছেন ক্লাইম্যাক্সের টুইস্টের পেছনে। কিন্তু তারা ভুলে গেছেন, ‘বাইশে শ্রাবণ’-এর ইউএসপি শুধু ক্লাইম্যাক্সের টুইস্টই ছিল না, সে ছবির পুরোটা জুড়েই হাড় হিম করা আবহ ছিল। সেরকম কোনো উপাদান এ ছবিতে একটিবারের জন্যও ছিল না।
দেখতে বসে মনে হচ্ছিল, শেষ ওভারে ছয় ছক্কা হাঁকানোর জন্যই পরিচালক ক্রিজ আঁকড়ে পড়ে আছেন। শেষ ওভার আসার আগে তিনি হাত খুলে খেলবেন না। এবং আদতে হলোও তা-ই। শেষ ওভারেই ছক্কার পর ছক্কা হাঁকাতে লাগলেন তিনি। কিন্তু ততক্ষণে যে বড্ড দেরি হয়ে গেছে। জয়ের জন্য শেষ ওভারে রান যদি দরকার হয় ৫০, তাহলে ছয় ছক্কা হাঁকিয়ে বিনোদনের ফোয়ারা ছোটানোর পরও, মাঠ যে ছাড়তে হবে সেই বিজিতের বেশেই। তাছাড়া ছক্কাটিও আসলে কতটুকু উপভোগ্য ও অননুমেয় ছিল, সে প্রশ্নেরও অবকাশ রয়ে যায়।
দিন শেষে তাই ‘দ্বিতীয় পুরুষ’-কে শুধু টুইস্ট থ্রিলারই বলাটা হবে ভীষণ রকমের অনুচিত। কেননা তাতে আব্বাস-মাস্তানের ছবিকে অপমান করা হয়, যেখানে ছবির শুরু থেকেই নিয়মিত বিরতিতে টুইস্ট থাকে, এবং তার পাশাপাশি অন্যান্য রোমাঞ্চকর উপাদানও থাকে। সৃজিতের ‘দ্বিতীয় পুরুষ’ আরো এক কাঠি সরেস। এটি একটি ‘ওয়ান টুইস্ট থ্রিলার’।
তবে শেষ করার আগে কিছু ইতিবাচক দিকের কথা জানিয়েই শেষ করব।
প্রথমত, অভিজিৎ চরিত্রের মানসিক সমস্যার দিকটি ‘বাইশে শ্রাবণ’-এ তেমন দৃশ্যমান না হলেও, এ ছবিতে যেহেতু কাহিনীর সাথে সঙ্গতি রাখতে প্রয়োজন ছিলই, সেই প্রয়োজনটুকু যথাসাধ্য পূরণের চেষ্টা সৃজিৎ করেছেন। এটি তার চিত্রনাট্যের একটি প্লাস পয়েন্ট। আরেকটি প্লাস পয়েন্ট হলো কিছু কিছু দৃশ্য খুব যত্ন করে লেখা, যেমন: গঙ্গার বুকে সূর্য-অমৃতার কথোপকথন, রজত-অঙ্কিতার খুনসুটি, খোকার তৃতীয় খুনের পর অভিজিতের প্রতিক্রিয়া ইত্যাদি।
তবে খেয়াল করে দেখুন, শেষটি বাদে বাকি দুটি কিন্তু মূল কাহিনীর সাথে সরাসরি সম্পর্কিত নয়। সমস্যাটা আসলে এখানেই। মূল কাহিনীর চিত্রনাট্য এতটা সুলিখিত নয়, যতটা পারিপার্শ্বিক অংশগুলোর চিত্রনাট্য।
এ ছবির দ্বিতীয় ও প্রধান ইতিবাচক দিকটি হলো, একইসাথে বর্তমান সময়ের চার ব্যোমকেশ তথা পরম, আবীর, অনির্বাণ ও গৌরবকে পর্দায় দেখতে পাওয়া। সেই সাথে আরো ছিলেন একজন গোয়েন্দা জুনিয়র (ঋতব্রত) এবং একজন সত্যবতীও (ঋদ্ধিমা)।
বাংলা গোয়েন্দা কাহিনীর জগতের এই বাঘা বাঘা চরিত্রদের নিয়ে নির্মিত থ্রিলার ছবিটি কি আরেকটু ভালো হতে পারত না? আর যদি না-ই পারল, তাহলে খুব কি দরকার ছিল এমন একটি ছবির ‘বাইশে শ্রাবণ’-এর বিরিয়ানির মাঝে একখানা অখাদ্য এলাচ হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার?