প্রমথ চৌধুরীর মতো আমিও বই পড়াটাকে শখ হিসেবে নিতে বারণ করবো। বই পড়া কখনো আমাদের শখ হওয়া উচিত নয়। বই পড়াকে আমাদের নিত্য দিনের অংশ হিসেবে গড়ে তোলা প্রয়োজন। বই আমাদের আলোকিত করে, আত্মার বিকাশ সাধন করে। বইয়ের মাঝে আমাদের আত্মার প্রতিফলন হয়। একটি ভালো বই পড়ার ফলে আমাদের আত্মার শুদ্ধি হয়। আমরা নিজেদের নতুন করে চিনতে পারি। নতুন নতুন বিষয় জানার পাশাপাশি যাপিত জীবনের নানা সমস্যা সমাধানের উপায় আমরা বিভিন্ন বই থেকে পেতে পারি।
বই যেভাবে উপকারে আসে
একজন বন্ধু যেমন বিপদে আপদে এগিয়ে আসে একটি বইও তেমনই আমাদের পাশে থাকে সবসময়। বই থেকে আহরিত জ্ঞান আমাদের সবসময় সঙ্গ দেয়। এই জ্ঞানকে সাথী করে আমরা যেকোনো কঠিন সময়কে খুব সহজেই মোকাবেলা করতে পারি।
আমাদের সমাজে বই পড়াকে মোটা দাগে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এবং সেই ভাগে আমাদের পাঠ্যসূচির বইকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে এর বাইরের বইকে আউট বুক হিসেবে আমাদের থেকে দূরে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। ফলাফল একটি নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে থেকে আমাদের জ্ঞানের দ্বার রুদ্ধ হয়ে যায়। আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠনগুলোর দিকে তাকালে বই না পড়ার চিত্র দেখা যায়।
বই পড়া আমাদের মানসিকতার উন্নয়ন ঘটায়, পরিস্থিতির সাথে খাপ খাওয়াতে শেখায় এবং ভালো আচরণ করতে শেখায়। গুণীজন স্বীকৃত এই বন্ধুটি আমাদের সর্বক্ষেত্রে সহায়তা করে। আমরা যখন মানসিকভাবে ভেঙে পড়ি তখন একটি আত্মউন্নয়নমূলক বই আমাদের মানসিকভাবে চাঙ্গা করে তোলে। আপনার যদি উচ্চ মাত্রায় মানসিক চাপ বোধ হয় তবে যদি মাত্র ৬ মিনিটের জন্য বই পড়েন তবে প্রায় ৬৮ শতাংশ পর্যন্ত মানসিক চাপ কমবে। এটা বৈজ্ঞানিকভাবে স্বীকৃত।
বই পড়ার অন্যতম একটি উপকার হলো অন্যের অভিজ্ঞতা হতে শিক্ষা লাভ করা যায়। এছাড়াও বই পড়ার ফলে আমাদের কল্পনাশক্তি বৃদ্ধি পায়। নিয়মিত বই পড়লে স্মর শক্তি বৃদ্ধির পাশাপাশি শব্দভাণ্ডার বৃদ্ধি পায়। একটি বই পড়ার জন্য এবং ঘটনাগুলো বুঝতে, আপনাকে বইটি নিরবিচ্ছিন্নভাবে পড়তে হবে। বই পড়ার অভ্যাস দীর্ঘ সময় ধরে মনোনিবেশ করার ক্ষমতা বিকাশ করে। যখন বিভিন্ন বিষয় নিয়ে হতাশায় ভুগি, যখন কিছুই ভালো লাগে না, তখন বই সে হতাশা থেকে মুক্তি দিতে সহায়তা করে। যখন বই পড়া হয় তখন বাড়তি চিন্তাভাবনা আমাদের মাথা থেকে দূরে থাকে।
কীভাবে শুরু করবেন
বই পড়া কীভাবে শুরু করবেন সেটা নিজে থেকের খুঁজে বের করতে হবে। নিজের পছন্দ ও রুচির ওপর নির্ভর করে পড়তে পারেন। এখানে কোন ধরা বাঁধা নিয়ম নেই। যখন যেটা খুশি পড়তে পারবেন। অনেকে মনে করে আউট বুক মানেই হলো গল্প, কবিতা আর উপন্যাস। আসলে কিন্তু মোটেও তা নয়। কারণ আউট বুকের কোনো নির্দিষ্ট সীমা নেই। আর গল্প উপন্যাস তো আমাদের মনের খোরাক যোগায়। মনকে তৃপ্তি দেয়। তাই বই আমাদের সেরা সহচর, কারণ তারা নিঃশর্তে আমাদের জ্ঞান এবং মনের শান্তি দেয়।
বই জীবনের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে জ্ঞানার্জনে সহায়তা করে। যদি গভীরভাবে কোনো ধারণা উপলব্ধি করতে চান তবে বই পড়ুন। বই সঠিক এবং নিরপেক্ষভাবে আপনাকে সে ধারণা দেবে। কারণ, অধিকাংশ বই বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞানী, দক্ষ ও পণ্ডিত ব্যক্তিদের দ্বারা রচিত হয়। তাই আপনি যখন কোনো বই পড়েন তখন এটি আপনাকে প্রায় নির্ভুল তথ্যের ব্যাপারে নিশ্চয়তা দেবে।
অনেকে বলতে পারেন, ইন্টারনেটেই তো সব কিছু পাওয়া যায়, তবে বই কেন পড়ব? কিন্তু আপনি ইন্টারনেটের কতগুলো ওয়েব সাইটকে বিশ্বাস করতে পারবেন? ইন্টারনেট ভুল তথ্যের ছড়াছড়ি, যার কারণে আমাদের মাঝে বিভিন্ন বিষয়ে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হতে পারে। এ কারণেই বই কোনো বিষয়ে তথ্যের সর্বদা সেরা উৎস।
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেন- “যে বই পড়াকে যথার্থ হিসাবে যে সঙ্গী করে নিতে পারে, তার জীবনের দুঃখে বোঝা অনেক কমে যায়।” আর রবীন্দ্রনাথের মতে, বই হচ্ছে অতীত আর বর্তমানের মধ্যে বেঁধে দেয়া সাঁকো। সুতরাং আমরা যদি বইকে আমাদের সেরা বন্ধু হিসেবে নিতে পারি তবে নিজেকে জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করে তুলতে পারব। আমাদের মাঝে বই না পড়া ও নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে জ্ঞান চর্চার যে সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে, তা থেকে মুক্তি পেতে হলে বইকে নিজের জীবনের অংশ হিসেবে গড় তুলতে হবে।