বিখ্যাত মার্কিন রহস্য ঔপন্যাসিক জেমস রোলিন্সের অনবদ্য সৃষ্টি ‘ম্যাপ অব বোনস’ হলো ‘সিগমা ফোর্স’ সিরিজের দ্বিতীয় উপন্যাস। দুর্ভেদ্য পাজল আর রহস্যে ঠাঁসা এই অনন্যসাধারণ বইটি আবর্তিত হয়েছে রহস্যঘেরা প্রাচীন এক বিবলিক্যাল (বাইবেল সংক্রান্ত) মিথকে কেন্দ্র করে।
‘ম্যাপ অব বোনস’ এর কাহিনীর শুরু জার্মানির কোলনে অবস্থিত এক ক্যাথেড্রালে। এক রাতে সন্ন্যাসীর ছদ্মবেশে আগত একদল ভয়ঙ্কর খুনীর অমানবিক পাশবিকতার শিকার হয়ে মৃত্যুমুখে পতিত হয় ক্যাথেড্রালের প্রার্থনারত মানুষেরা। আক্রমণকারীরা ক্যাথেড্রালের মূল্যবান শিল্পকর্ম, স্বর্ণ-রত্ন ফেলে হাতিয়ে নিয়ে গেল প্রাচীন কিছু হাড়। এই হাড়গুলো হচ্ছে বাইবেলে উল্লেখিত তিন রাজার, তিনজন জ্ঞানী মানুষের, যারা নব্যজাত যীশুকে সম্মান প্রদর্শন করেছিলেন। এই হাড়গুলোর আড়ালে লুকিয়ে আছে অজানা এক গুপ্তধনের নির্দেশনা, যা খারাপ লোকের হাতে পড়লে মানবসভ্যতা মহাবিপর্যয়ের মুখে পড়বে। এই আক্রমণ যেন ক্যাথলিক চার্চের বিরুদ্ধে অজানা প্রতিপক্ষের সরাসরি যুদ্ধ ঘোষণাও।
যুদ্ধ এবং বিপর্যয় ঠেকাতে ভ্যাটিকান সাহায্য চেয়ে বসল আমেরিকার ডারপা’র ফিল্ডে তদন্তের অত্যাধুনিক দক্ষতাসম্পন্ন গোপন সংস্থা ‘সিগমা’র। কমান্ডার গ্রেসন পিয়ার্সের নেতৃত্বে সিগমা এজেন্ট মঙ্ক কক্কালিস এবং ক্যাট ব্রায়ান্টের ছোট্ট দল উড়ল কোলনের উদ্দ্যেশ্যে। কোলনে তাদের সাথে যোগ দিলেন ভ্যাটিকান বিশেষজ্ঞ ভিগর ভেরোনা এবং তার ভাগ্নি রোমের কালচারাল পুলিশ ক্যারিবিনিয়ারি লেফটেন্যান্ট র্যাচেল ভেরোনা। সম্মিলিতভাবে তদন্ত শুরু করতেই শত্রুর শক্তির প্রদর্শনী দেখতে শুরু করে তারা। প্রথমে কোলন, তারপর মিলানে একের পর এক আক্রমণের শিকার হয় তারা। সিগমা এজেন্টদের বিস্ময়কর দক্ষতা, ভিগর আর র্যাচেলের বুদ্ধির দীপ্তিতে প্রতিটি আক্রমণ থেকেই সফলভাবে আত্মরক্ষা করে তারা এবং পরবর্তী গন্তব্যের পানে এগিয়ে যায়।
একসময় তারা বুঝতে পারে, তাদের প্রতিপক্ষ হাজার বছরের পুরনো অ্যালকেমিক কাল্ট ‘ইমপেরিয়েল ড্রাগন কোর্ট’। হাড়ের পাজল তাদেরকে নিয়ে যায় খ্রিস্টীয় বিশ্বাসের গোড়ার ইতিহাসের গভীরে। তারপর অত্যাধুনিক বিজ্ঞানের দুর্ভেদ্য পাজল ভেঙে গুপ্তধন উদ্ধারে তারা ছুটল মিশরের আলেকজান্দ্রিয়ায়, দিগ্বিজয়ী সম্রাট আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের সমাধিতে।
তারা আবিষ্কার করল অতিপ্রাকৃতিক এক শক্তির উৎসকে। আরও আবিষ্কার করল এই শক্তির সাথে প্রাচীন সপ্তাশ্চর্যগুলোর অদ্ভুত এক যোগাযোগ আছে। এভাবে আবিষ্কৃত হলো পরবর্তী গন্তব্য, ফ্রান্সের মার্সেইয়ের প্রাচীন এক চার্চ। এদিকে ড্রাগন কোর্টের সাথে কমান্ডার গ্রে’র দলের ইঁদুর-বিড়াল খেলা চলছেই। গ্রের দল সবসময়ই এক ধাপ এগিয়ে থাকছে, তারপরও ড্রাগন কোর্ট ঠিক সময়ে হাজির হয়ে ঠিকই আক্রমণ করছে। তারা যেন আগে থেকেই কোনোভাবে জেনে যাচ্ছে সব। কীভাবে?
ড্রাগন কোর্টের মতো শক্তিশালী প্রতিপক্ষকে ফাঁকি দিয়ে গ্রের দল কি পারবে গুপ্তধন উদ্ধার করতে? তারা কি পারবে পৃথিবীকে ড্রাগন কোর্টের ভয়াবহ থাবা থেকে রক্ষা করতে?
বইটিতে জটিল অ্যালকেমিক পাজল আর প্রাচীন ইতিহাসের দুর্লভ সংমিশ্রণ ঘটেছে। খ্রিস্টীয় বিশ্বাস সম্পর্কিত নানা উপাখ্যান, কিংবদন্তী আর দ্বন্দ-অন্তর্দ্বন্দ্বকে উঠিয়ে আনা হয়েছে বইটিতে। প্রাচীন নস্টিক বিশ্বাস, পোপের ক্ষমতা নিয়ে টানাটানি প্রভৃতি ঐতিহাসিক নানা সত্য ঘটনার সাথে লেখক আশ্চর্য নৈপুণ্যের সাথে কল্পনাকে মিশিয়েছেন।
বইটির পটভূমি জার্মানি, ফ্রান্স, রোম, মিলান, সুইজারল্যান্ডের দুর্গ চার্চ, ক্যাথেড্রাল, মিশরের আলেকজান্দ্রিয়ার সমুদ্রতল থেকে ভ্যাটিকেনের সেইন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকার তলা পর্যন্ত বিস্তৃত।
অ্যালকেমির নানা মিথ বইটিতে সত্যি হয়ে উঠেছে। কাল্পনিক এম-স্টেট গোল্ড, লেভিটেশন প্রভৃতি নিয়ে রয়েছে নানা চমকপ্রদ ঘটনার বর্ণনা। বইটিতে উঠে এসেছে আলো আর অন্ধকারের চিরন্তন দ্বন্দ্ব। অন্ধকারকে দূরীভূত করে পৃথিবীকে ভয়ঙ্কর বিপদ থেকে বাঁচাতে বিজ্ঞান আর ধর্ম এখানে মিলেছে এক মোহনায়। ধর্মীয় মিথ, অত্যাধুনিক বিজ্ঞান আর অ্যাকশন ভালবাসেন- এমন পাঠকদের জন্য এটি একটি অবশ্যপাঠ্য বই।
‘ম্যাপ অব বোনসে’ লেখক সিগমার ডিরেক্টর ও ‘সিগমা ফোর্স’ সিরিজের প্রথম উপন্যাস ‘স্যান্ডস্টর্ম’ এর প্রধান চরিত্র পেইন্টার ক্রোকে অফিস ওয়ার্ক দিয়ে অপ্রধান চরিত্র করে ফেলেছেন। প্রধান চরিত্র হিসেবে তিনি এনেছেন সিগমার নতুন রিক্রুট কমান্ডার গ্রেসন পিয়ার্সকে। পিয়ার্স স্পেশাল ফোর্সে থাকাকালীন জনৈক সিনিয়র অফিসারের অন্যায়ের প্রতিবাদের কারণে জেলে যায়। জেলে বসে সে কেমিস্ট্রি নিয়ে পড়াশোনা করে এবং ডক্টরাল ডিগ্রি লাভ করে। ‘ম্যাপ অব বোনস’ এ তার রসায়নে দক্ষতার যথার্থ স্বাক্ষরও রেখেছে সে। ক্যাট ব্রায়ান্ট ও মঙ্কও নতুন এসেছে সিগমায়। এই বইতে লেখক নতুন আরো এনেছেন গিল্ড এজেন্ট দ্য ড্রাগন লেডি শেইচানকে। শেইচান আছে মানে গিল্ডও আছে। কিন্তু গিল্ডের ভূমিকা কী এখানে? শুধুই তৃতীয় পক্ষ? নাকি অন্য কোনো পক্ষের সাথে জোট বেধেছে? গিল্ড-সিগমা-ড্রাগন কোর্ট- এই তিন গুপ্ত সংগঠন যেখানে একত্রিত হয়েছে, সেখানে থ্রিলের পরিমাণ কতটা বেশি হবে তা বলাই বাহুল্য। বইটির প্রতিটি বাঁকে বাঁকে রয়েছে দারুণ সব টুইস্ট আর দুর্দান্ত অ্যাকশন।
রিভিউ
“নিশ্চিতভাবেই ড্যান ব্রাউনের ‘দ্য ভিঞ্চি কোড’ এর সাথে তুলনা করা যেতে পারে… তবে অনেকদিক থেকেই এটি অনেক ভাল একটি থ্রিলার”
– বুকলিস্ট“রিসার্চ ডিপার্টমেন্টে রোলিন্সের কিছু ঘনিষ্ঠ লোকজন রয়েছে যার কল্যাণে তার লেখায় ঐতিহাসিক বিষয়বস্তুগুলো চমকপ্রদ হয়ে ওঠে… ড্যান ব্রাউন ভক্তদের জন্য আরেকটি তৃপ্তিদায়ক পাঠ।”
– উইকলি পাবলিশার্স“দারুণ, হাই-অক্টেন অ্যাডভেঞ্চার থ্রিলার”
– স্টিভ বেরি, ‘অ্যাম্বার রুম’ খ্যাত লেখক“থ্রিলার সাহিত্যে জেমস রোলিন্স নতুন মাত্রা যোগ করেছেন। ‘ম্যাপ অব বোনস’ তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।”
– নিউজ উইক“রোলার কোস্টারে উঠতে যাচ্ছেন, সিট বেল্ট বেঁধে নিন।”
– বুক ওয়ার্ল্ড
‘ম্যাপ অব বোনস’ বনাম ‘দ্য ভিঞ্চি কোড’
সিক্রেট সোসাইটি, খ্রিস্টীয় ইতিহাস আর পুরাণ নিয়ে রচিত ড্যান ব্রাউনের বিখ্যাত বই ‘দ্য ভিঞ্চি কোড’ এর সমকক্ষ এবং মোটামুটি একই ঘরানার বই বলা যায় ‘ম্যাপ অব বোনস’কে।
উভয় বইয়েরই কেন্দ্রে রয়েছে খ্রিস্টীয় বিশ্বাস নিয়ে গুরুগম্ভীর আলোচনা আর ক্যাথলিক চার্চের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের উপাখ্যান। থ্রিলার হিসেবে ‘দ্য ভিঞ্চি কোড’ এর শুরুটা দুর্দান্ত হলেও এর পরিণতি কিছুটা হলেও বোঝা যায়। সেদিক থেকে ‘ম্যাপ অব বোনস’ এর কাহিনী অনেক বেশি চাতুর্যপূর্ণ, আগে থেকে একদমই কিছু বোঝা যায় না। তাছাড়া ‘ম্যাপ অব বোনস’ এর চরিত্র চিত্রায়ণও অনেক বেশি পরিণত। অ্যাকশন আর এডভেঞ্চারের দিক থেকেও ‘ম্যাপ অব বোনস’কে এগিয়ে রাখা যায়। ড্যান ব্রাউন ভক্তরা নির্দ্বিধায় বইটি পড়তে পারেন। পড়ার পর জেমস রোলিন্সের প্রতিও আপনাদের ভক্তি আসতে বাধ্য।
গল্পকথকের গল্প
শৈশবে জুল ভার্নের অভিযান, এইচ. জি. ওয়েলসের রচনাবলী, ‘পাল্প ‘ম্যাগাজিনের গল্প আর ডক সেভেজের বিজ্ঞানমিশ্রিত অভিযান নিয়ে রচিত বইগুলোতে ডুবে থাকা ছেলেটি সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বড় হয়ে লেখকই হবে। ছেলেটি তখন থেকেই তার গল্প বলার দক্ষতাকে শাণিয়ে নিতে শুরু করে। পুরোপুরি গল্প লেখা শুরু করার আগে জেমস রোলিন্স ইউনিভার্সিটি অব মিসৌরি থেকে ভেটেরেনারি সায়েন্সে গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করেন এবং পশুচিকিৎসক হিসেবে বেশ কিছুদিন কাজ করেন। এই অভিজ্ঞতা তাকে বিজ্ঞান এবং মেডিসিনের জ্ঞান, বৈজ্ঞানিক চিন্তাভাবনা ও গবেষণাকে ভিন্ন মাত্রা দিয়েছিল, যার প্রভাব আমরা দেখতে পাই তার পরবর্তীতে লেখা বইগুলোতে। রোলিন্স একজন লাইসেন্সপ্রাপ্ত স্কুবা ডাইভার। তাই তার বইতে সাগরের তলদেশের যে বর্ণনা পাওয়া যায়, তা নিছক কল্পনা নয়, বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকেই আসে!
আন্তর্জাতিক বেস্টসেলার এই লেখকের থ্রিলারগুলো সারাবিশ্বে চল্লিশটিরও বেশি ভাষায় অনুদিত হয়েছে। পৃথিবীর দূরতম প্রান্তের অচেনা-অজানা কোনো জায়গার হৃদয়গ্রাহী বর্ণনা, যুগান্তকারী বৈজ্ঞানিক চিন্তাভাবনা, ইতিহাসের গভীরতম রহস্যের কিনারা করা প্রভৃতি নিয়ে রচিত তার দারুণ গতিশীল থ্রিলারগুলো সমালোকদের কাছে যেমন প্রশংসা কুড়িয়েছে, তেমনি মন জয় করে নিয়েছে বিশ্বজুড়ে লক্ষ লক্ষ পাঠকের। বিভিন্ন সিরিজ থ্রিলার উপন্যাসের পাশাপাশি তার একক থ্রিলারগুলোও বিশ্বব্যাপী ভীষণ জনপ্রিয়। ‘এক্সকাভেশন’, ‘আমাজনিয়া’, ‘অল্টার অব দ্য ইডেন’ প্রভৃতি তার রচিত জনপ্রিয় একক থ্রিলার।
বাংলা ভাষাভাষী পাঠকদের জন্য আশার কথা হচ্ছে, ‘ম্যাপ অব বোনস’ বইটির বাংলা অনুবাদও রয়েছে।
রবিন জামান খানের দক্ষ অনুবাদে বইটি হয়ে উঠেছে সাবলীল এবং সুখপাঠ্য। ফলে ইতিহাস এবং বিজ্ঞানের জটিল বিষয়গুলো সহজ আর বোধগম্য হয়ে ধরা দেবে আপনার কাছে। বইটি মানব ইতিহাস এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের নতুন এক দিগন্ত উন্মোচন করবে আপনার সামনে। তাই, দেরি করবেন না। দুর্দান্ত অ্যাকশনের সঙ্গী হতে এবং দুর্লভ জ্ঞানে সমৃদ্ধ হতে আজই পড়ে ফেলুন বইটি।
বইয়ের নাম: ম্যাপ অব বোনস
লেখক: জেমস রোলিন্স
প্রথম প্রকাশ: ২০০৫
গুডরিডস রেটিং: ৪.১/৫