আফ্রিকা মহাদেশের পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত মালাবি নামের দেশে কাসুনগু অঞ্চলের ছোট একটি গ্রামকে ঘিরে গড়ে উঠেছে গল্পটি। দুনিয়া জুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বেশিরভাগ গ্রামের মতোই এ গ্রামের বাসিন্দাদের জীবিকার প্রধান মাধ্যম চাষাবাদ। অশিক্ষিত ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন গ্রামবাসীর জীবনে দরিদ্রতা ও অনাহার ছিল একদম জীবনের আনুষঙ্গিক উপাদান। তবে গ্রামে স্কুল থাকার কল্যাণে নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞানলাভের মধ্য দিয়ে সুশিক্ষা ও আধুনিকতার ছোঁয়ার বেড়ে উঠার সুযোগ হয়েছিল।
মালাবির সে অঞ্চলের লোকজন সবে পুরনো ঐতিহ্য ও জীবনধারা থেকে বেরিয়ে প্রগতিশীল নতুন যুগের দেখানো আলোর পথে হাঁটতে শুরু করেছিল। কিন্তু বাইরের উন্নত দুনিয়ার সাথে প্রত্যক্ষভাবে যোগাযোগের অভাব ও আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সাথে পরিচিত না হবার কারণে তাদের জীবনযাত্রার মানের কোনো অগ্রগতি হওয়া সম্ভবপর ছিল না। আর এমন এক সময়ে তাদের অঞ্চলে নেমে আসে দুর্ভিক্ষ নামক অভিশাপ। যেহেতু তাদের রুটি রোজগার সব জমির ফসল থেকে আসে, তাই বৃষ্টির মতো প্রাকৃতিক উপাদানের কাছে তারা মাথা নোয়াতে বাধ্য। আর যে বছর বৃষ্টির দেখা মিলবে না, সে বছর যে ফসলের মুখও কৃষকেরা দেখবে না, জানা কথা। আর ফসল নেই মানেই পাতিলে অন্ন নেই, পকেটে অর্থকড়ি নেই। সেই সাথে ক্ষুধায় অন্ধ হয়ে থাকা লোকজনের মনে নেই সুখ, দেহে নেই শক্তি। আর এমন এক মহাপ্রলয়ের সন্ধিক্ষণে এ গ্রামেরই এক অতি সাধারণের বেশে লুকিয়ে থাকা অনন্য সাধারণ এক বালকের দেবদূতের রূপ ধারণ করার গল্পই তুলে ধরা হয়েছে আমাদের আজকের প্রবন্ধে।
উপরের অনুচ্ছেদে এ বছরে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘দ্য বয় হু হার্নেসড দ্য ওয়াইন্ড’ সিনেমার কাহিনী তুলে ধরা হয়েছে। সাম্প্রতিককালে নেটফ্লিক্সে আসা অন্যান্য নতুন সিনেমার ভিড়ে ভিন্নধারার এই সিনেমাটি দর্শক ও সমালোচক উভয় শ্রেণীর কাছে ভালোই গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। ব্রিটিশ অভিনেতা চুইটেল এজিওফর এই সিনেমা দিয়ে পরিচালক হিসেবে নিজের অভিষেক ঘটান। সিনেমার চিত্রনাট্য একই নামের বই থেকে সংকলিত হয়েছে। সত্য ঘটনা অবলম্বনে লেখা এ বইটির রচয়িতা হলেন স্বয়ং গল্পের মূল নায়ক উইলিয়াম কামকোয়াম্বা। ব্রায়ান মিলার নামে একজনের সাথে যৌথভাবে লিখে নিজের জীবনের গল্পকে বইয়ের পাতায় লিপিবদ্ধ করেছেন উইলিয়াম।
বাস্তব ঘটনাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা বায়োগ্রাফিক্যাল-ড্রামা ঘরানার এ সিনেমার প্লটটি নিয়ে এবার আলোচনা করা যাক। যেমন উপরে বলা হয়েছে, সিনেমাটি একজন বিস্ময়-বালককে নিয়ে চিত্রিত হয়েছে। উইলিয়াম কামকোয়াম্বা নামের সেই বালকটি নিজের এক অভূতপূর্ব আবিষ্কারের কারণে শুধু নিজের গ্রামের লোকদেরই চোখেই যে মহানায়কে পরিণত হয়েছে, তা কিন্তু নয়। একইসাথে বিশ্ব দরবারে নিজের জাতিকে যেভাবে নতুনভাবে মেলে ধরেছে, তা এককথায় অনবদ্য।
সিনেমাতে উইলিয়াম ও তার পরিবারের জীবনযাপনের সামগ্রিক চিত্র ফুটে উঠেছে। বাবা-মা, বড় বোন অ্যানি ও কোলের এক ভাইকে নিয়ে উইলিয়ামের পরিবার। উইলিয়ামের বাবা টাইরেল কামকোয়াম্বা একজন সাধারণ কৃষক হয়েও নিজের বড় দুই সন্তানকে পড়াশোনা শিখিয়ে মানুষের মতো মানুষ করতে প্রত্যয়ী ছিলেন। সিনেমাতে দেখানো হয়, অ্যানি স্কুল-কলেজ পাস করে ইউনিভার্সিটিতে যাবার জন্য প্রস্তুত। কিন্তু ইউনিভার্সিটির খরচ যোগাড় না হওয়া পর্যন্ত তার ঘরে বসে থাকা ছাড়া উপায় নেই। টাইরেল ও তার স্ত্রী একে অপরকে তো অনেক ভালোবাসতেনই, তাছাড়া নিজেদের সন্তানদের ভালোমন্দ নিয়েও যথেষ্ট যত্নশীল ছিলেন। তাই তো নিজে মাঠে-ময়দানে খেটে ছেলে উইলিয়ামকে স্কুলে পাঠানো অব্যাহত রাখেন টাইরেল। সন্তানগুলোও অনেক বাধ্য ও অল্পতে তুষ্ট ছিল। মেয়ে অ্যানি যেমন গৃহস্থালির কাজে মায়ের সাথে হাত লাগাত, ছেলে উইলিয়ামও বাবাকে নানা ধরনের ছোটখাট সাহায্য করত। এমনকি যন্ত্রপাতি ও কলাকৌশলে পারদর্শী উইলিয়াম বাড়তি আয়ের জন্য গ্রামবাসীদের রেডিও ও টুকিটাকি ইলেকট্রনিক জিনিস মেরামত করে দিত। তাদের জীবন এভাবে বেশ ভালোভাবেই কেটে যাচ্ছিল। কিন্তু সময় কি আর সবার সবসময় একরকম কাটে? তাই তো তাদের গ্রামে হানা দিলো মহামারী আকারের এক দুর্ভিক্ষ।
সময়টা ছিল ২০০৬ সাল। সে বছর চাহিদামতো বৃষ্টি না হওয়াতে গ্রামের সব আবাদি জমিতে খরা দেখা দিয়েছিল। গোলাঘরে আগে থেকে মজুদ করে রাখা খাদ্যশস্যই ছিল গ্রামবাসীর একমাত্র অবলম্বন। কিন্তু ক’জনেরই বা গোলাঘর ভর্তি পুরো বছর চলার মতো খাদ্যদ্রব্য ছিল! তাই তো পুরো গ্রাম জুড়ে খাদ্যসঙ্কট দেখা যায়। গ্রামের মোড়ল রাজনৈতিক বেড়াজালে পড়ে শারীরিকভাবে নির্যাতনের শিকার হলে গ্রামের বাসিন্দাদের দেখভালের জন্য মাথার উপর কোনো আশ্রয়স্থল ছিল না।
দিন যত এগোচ্ছিল, গ্রামের অবস্থা তত শোচনীয় হচ্ছিল। ক্ষুধার জ্বালায় অন্ধ হয়ে মানুষজন চুরি থেকে শুরু করে কাড়াকাড়ি, মারামারি ও আক্রমণের পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল। আর গ্রামটিকে এমন এক মহা বিপর্যয়ের হাত থেকে বাঁচাতে কোনো এক বীরপুরুষের আগমন আবশ্যক হয়ে উঠেছিল। কে জানত, এ গ্রামেরই এক কিশোর সেই বীরপুরুষের ভূমিকা পালন করবে! উইলিয়াম নামের সেই তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন ছেলেটি নিজের গ্রাম ও পরিবারকে এ মহাপ্রলয় থেকে রক্ষা করতে নিজের এক প্রকল্পকে বাস্তবে রূপ দিতে বদ্ধপরিকর হয়ে ওঠে।
সিনেমায় গল্পটিকে এত নিখুঁতভাবে পরিবেশন করা হয়েছে যে, দর্শকদের মনে হবে তিনি নিজেও সিনেমারই অংশ। উইলিয়াম, তার পরিবার ও গ্রামের সাথে পুরোটা সময় জুড়ে মিশে যেতে বাধ্য হবেন দর্শক। সিনেমাতে যে শুধু মালাবির সেই ছোট্ট গ্রামটির করুণ অবস্থা ফুটে উঠেছে তা কিন্তু নয়। যেহেতু বাস্তবের উইলিয়াম নিজেই এ কাহিনী লিখেছে, তাই সে নিজের অঞ্চলের সংস্কৃতি ও রীতিনীতি সম্পর্কেও বেশ গোছালো ধারণা দিতে চেষ্টা করেছে। সিনেমার একদম প্রথম দৃশ্যটাই এর প্রমাণ। সেই অঞ্চলে কেউ মারা গেলে তার শেষকৃত্যের আয়োজন ও অনুষ্ঠানের একটি চিত্র দেখানো হয়েছে সেই দৃশ্যে। এছাড়া সেই অঞ্চলের মানুষদের পারস্পরিক সম্পর্ক, সমাজ ব্যবস্থা, শাসন ব্যবস্থা নিয়েও অনেক কিছু জানতে পারবেন দর্শক।
সিনেমাটির সিনেমাটোগ্রাফি যেমন দৃষ্টিনন্দন, ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর ঠিক তেমনি শ্রুতিমধুর। ইংলিশ ও চিচেবা ভাষার সংমিশ্রণে লিখিত সিনেমার সংলাপগুলো ছিল বেশ সরল। তবে ঘটনা সাপেক্ষে চিত্রনাট্যের সাথে মিল রেখে সংলাপে আবেগ ও গাম্ভীর্য উভয়েরই প্রকাশ পেয়েছে।
সিনেমার অভিনয়শিল্পীদের প্রত্যেকেই নিজ নিজ চরিত্রে ছিলেন প্রশংসার দাবিদার। উইলিয়াম চরিত্রে ম্যাক্সওয়েল সিম্বার অভিনয় দর্শকদের বিমোহিত করে ছাড়বে। টাইরেল উইলিয়াম চরিত্রে সিনেমার নির্মাতা চুয়ালেট এজেইফর খোদ অভিনয় করেছেন। টাইরেল চরিত্রটি দর্শকমনকে বিশেষভাবে নাড়া দেবে নিশ্চিত। বাকি অভিনয়শিল্পীরাও সিনেমার গল্পের চরিত্রগুলোর সাথে একেবারে খাপে খাপে বসে গিয়েছিলেন।
বাস্তবের উইন্ডমিল কামকোয়াম্বা ময়লার স্তূপ থেকে যন্ত্রপাতি, বাবার সাইকেলের যন্ত্রাংশ ও ব্লু গাম ট্রি ব্যবহার করে নিজের গ্রামের লোকদের ক্ষুধার হাত থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্য যে উইন্ডমিল তৈরি করেছিল, তা দুনিয়া জুড়ে বেশ সাড়া ফেলেছিল। ২০০৭ সালে তানজানিয়াতে অনুষ্ঠিত টেড গ্লোবালে টেড কনফারেন্সের ডিরেক্টর এমেকা ওকাফরের নিমন্ত্রণে ভাষণ দিতে যান উইলিয়াম। নিউ ইয়র্ককেন্দ্রিক আন্তর্জাতিক সংবাদপত্র ‘দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল’ এ সারাহ চাইল্ড্রেস নামের এক সাংবাদিক উইলিয়ামকে নিয়ে এক বিশেষ প্রতিবেদন লিখেছিলেন। মালাবির রাজধানী লিলংবেতে অবস্থিত আফ্রিকান বাইবেল কলেজে পড়াশোনার পর সে আফ্রিকান লিডারশীপ অ্যাকাডেমি থেকে স্কলারশিপ লাভ করে। ২০১৪ সালে ডার্টমাউথ কলেজ থেকে সে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে। ২০১৩ সালে টাইম ম্যাগাজিনে ‘থার্টি পিপল আন্ডার থার্টি চেঞ্জিং দ্য ওয়ার্ল্ড’ এর তালিকায় উইলিয়ামের নাম এসেছিল। যুক্তরাষ্ট্রের নানা নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমে ‘দ্য বয় হু হার্নেসড দ্য ওয়াইন্ড’ বইটি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে৷
অনুপ্রেরণামূলক সিনেমা হিসেবে ‘দ্য বয় হু হার্নেসড দ্য ওয়াইন্ড’ অত্যন্ত কার্যকরী একটি সিনেমা। এছাড়া বিনোদনের কথা চিন্তা করলেও একে উপযুক্ত সিনেমা বলেই ধরা যাবে। রটেন টম্যাটোসে ৩১টি ক্রিটিক রিভিউয়ের ভিত্তিতে ৮৬% ও মেটাক্রিটিকে ১৮টি রিভিউয়ের ভিত্তিতে ৬৮% স্কোর করেছে সিনেমাটি।