১৯৫৩ সালে ‘ক্যাসিনো রয়েল’ প্রকাশিত হবার পরে কি ইয়ান ফ্লেমিং ভাবতে পেরেছিলেন তার সৃষ্ট চরিত্র প্রায় ৭০ বছর পরেও আবেদন ধরে রাখতে পারবে? বইগুলো অনূদিত হবে ২০ টিরও বেশি ভাষায়, অনুপ্রাণিত হয়ে বানানো হবে চলচ্চিত্র, সৃষ্টি হবে আরো নতুন চরিত্র? বলছিলাম জেমস বন্ডের কথা। রহস্য-থ্রিলার সাহিত্যের ঘরানায় জেমস বন্ড অবিসংবাদিত কিংবদন্তি; জনপ্রিয়তার দিক দিয়ে এখনো অতুলনীয়।
বড় পর্দায় বন্ডের প্রথম আবির্ভাব ঘটে ১৯৬২ সালে। সিনেমার নাম ছিল ‘ড. নো’ ও ০০৭ এর ভূমিকায় ছিলেন শন কনারি। তারপর ৬০ বছরে টেমস দিয়ে বহু জল গড়িয়েছে। ২৭টি সিনেমা- শন কনারি, রজার মুর, পিয়ার্স ব্রসনানের মতো কিংবদন্তি অভিনেতার হাত ঘুরে জেমস বন্ডের মশাল এসেছে ড্যানিয়েল ক্রেগের হাতে। সেই তিনিও করে ফেললেন তার শেষ বন্ড সিনেমা যেটি মুক্তি পেল ২০২১ সালেই।
২০০৬ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘ক্যাসিনো রয়্যাল’ নামক সিনেমার মাধ্যমে জেমস বন্ড হিসেবে বড় পর্দায় ড্যানিয়েল ক্রেগের অভিষেক হয়। তিনি এই চরিত্রকে ভালোভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারবেন কিনা মুক্তির আগে এ নিয়ে অনেক জল্পনা-কল্পনা থাকলেও ঘন নীল চোখের অধিকারী ক্রেগ সকল সমালোচনার জবাব পর্দায়ই দিয়েছেন। মূলত তার থেকেই বন্ড সিনেমায় নতুন ধারার সৃষ্টি হয়।
‘ক্যাসিনো রয়্যাল’ এর আগ পর্যন্ত জেমস বন্ডের চরিত্রগুলো ছিল অনেক প্রত্যাবর্তনশীল ও কিছু কিছু ক্ষেত্রে সেক্সিস্টও। অবশ্য তখনকার দিনে সেটাই ছিল ‘পুরুষত্বে’র প্রতীক। পুরুষের ভেঙে পড়লে চলবে না, এমন একটা ধারণা প্রচলিত ছিল। সেই বাঁধাধরা ছক মেনেই জেমস বন্ড চরিত্রগুলোকে উপস্থাপন করা হতো যা প্রতিনিধিত্ব করতো একজন ‘পরিপূর্ণ ভদ্রলোকের’। ড্যানিয়েল ক্রেগের জেমস বন্ড সেই দুষ্টচক্র ভেঙ্গেছে।
তবে তাই বলে কিন্তু সিনেমায় অ্যাকশনের পরিমাণ কমেনি। বরঞ্চ আগের তুলনায় মারদাঙ্গা, ধুন্ধুমার অ্যাকশন আরো বেড়েছে। ক্রেগের আগের বন্ড সিনেমাগুলোতে বন্ড গার্লদের ভূমিকা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শুধু গ্ল্যামার বাড়ানো হলেও ক্রেগের বন্ডে আমরা বন্ডগার্ল বা বন্ড ওম্যান দের প্লটে বেশ ভালো ভূমিকা রাখতে দেখি। সব মিলিয়ে ড্যানিয়েল ক্রেগের জেমস বন্ডের চরিত্রায়নে তার পূর্বসূরিদের মতো সুপার হিরো আবেশ নেই, ক্রেগের বন্ড কোনো সুপারহিরো নয়। সে ধূর্ত, কৌশলী ও প্রয়োজনে হাতে রক্ত লাগাতে দ্বিধাবোধ না করা এক দুর্ধর্ষ স্পাই।
‘নো টাইম টু ডাই’ দিয়ে শেষ হলো জেমস বন্ড হিসেবে ড্যানিয়েল ক্রেগের ১৫ বছর দীর্ঘ যাত্রা। ‘নো টাইম টু ডাই’ নিয়ে বলতে গেলে প্রথমেই বলতে হয় চলচ্চিত্রটির সিনেমাটোগ্রাফি নিয়ে। লুইস স্যান্ডগ্রেন অসাধারণ কাজ করেছেন। সিনেমাটি দেখার সময়ে প্রতিটি ফ্রেমে তার উপস্থিতি অনুভব করা যায়। বিশেষ করে ইতালির ব্রিজের উপরের দৃশ্য ও নরওয়ের বনের দৃশ্যের খুঁটিনাটি এত নিখুঁতভাবে পর্দায় উপস্থাপন করেছেন যা এককথায় দুর্দান্ত।
সিনেমাটির কাহিনী শুরু হয় পূর্ববর্তী সিনেমা ‘স্পেক্টারের’ শেষ থেকে। ব্লোফেল্ডকে গ্রেফতারের পরে আবির্ভাব ঘটে সাফিনের। সিনেমায় সাফিনের চরিত্রে অভিনয় করেছেন রামি মালেক। দুর্দান্ত এই অভিনেতার প্রতিভার প্রমাণ আমরা এর আগে ‘বোহেমিয়ান র্যাপসডি’, ‘মি. রোবট’ ইত্যাদি কাজে পেয়েছি। এই সিনেমায় তার উপস্থিতির পরিমাণ কম হলেও তিনি অল্পতেই জাত চিনিয়েছেন। তার অভিব্যক্তি ও ডায়লগ দিয়ে তিনি দর্শকের মনে ভয়ের সঞ্চার করতে পেরেছেন। তবে সিনেমায় তার চেয়ে বড় ভিলেন হয়ে উঠেছে ‘প্রজেক্ট হেরাক্লিস’; সেটির প্রভাব এত ব্যাপক ও অভিনব ছিল যে রামি মালেকের চরিত্রকেও ছাপিয়ে গিয়েছে। ড্যানিয়েল ক্রেগের বন্ড ফিল্মোগ্রাফিতে ম্যাড মিকেলসনই সেরা ভিলেন; তার শীতল কণ্ঠ, কঠোর চাহনি ও ইস্পাত কঠিন দৃঢ়তা চরিত্রটিকে যেমন প্রভাববিস্তারী করে তুলেছিল সেই জায়গা দখল করা সহজ হবে না মোটেও।
সিনেমার সঙ্গীতায়োজন করেছেন হ্যান্স জিমার সাথে মন্টি নর্ম্যান। আর সেই বিখ্যাত বন্ড থিম তো ছিলই। বিশেষ মুহূর্তে সেই থিম নস্টালজিয়া সৃষ্টি করে উত্তেজনা আরো বাড়িয়েছে।
পার্শ্ব চরিত্রগুলো যেমন মনিপেনি, কিউ, এম এদের সাথে বন্ডের রসায়নটা ভালো জমেছে। তবে বিশেষ করে বলতে হয় আনা ডে আর্মোসের করা পালোমা চরিত্রটির কথা। ‘ব্লেড রানার’ খ্যাত এই অভিনেত্রীর পর্দায় উপস্থিতি ছিল খুবই কম সময়ের জন্য কিন্তু সেটুকুতেই তিনি দারুণ দেখিয়েছেন। তিনি ছিলেন একইসাথে আবেদনময়ী ও দুর্ধর্ষ। বন্ডের যোগ্য সহযোগীই বটে! তার উপস্থিতি আরো বেশি সময়ের জন্য হলে মন্দ হতো না। ‘স্পেক্টার’ এর পর বন্ড কার্যত অবসর নিয়ে নিয়েছিল তাই ব্রিটিশ সিক্রেট সার্ভিস নতুন ০০৭ হিসেবে নিয়োগ করে নমি’কে। নমির সাথে বন্ডের ইগোর সংঘর্ষ অনেক মজাদার ছিল। তবে সিনেমাটির দৈর্ঘ্য নিয়ে কথা বলতেই হয়, কাগজে কলমে এটি বন্ড ফ্রাঞ্চাইজির সবচেয়ে দীর্ঘ সিনেমা। যদি এই দৈর্ঘ্য আরো কম হতো তাহলে সিনেমাটি নিঃসন্দেহে আরো বেশি উপভোগ্য হতো।
জেমস বন্ড হিসেবে এটিই ছিল ড্যানিয়েল ক্রেগের সর্বশেষ সিনেমা। অ্যাশটন মার্টিন ডিবি ৫ এর স্টিয়ারিংয়ে ক্রেগকে হয়তো আবারো পর্দায় দেখা যাবে কিন্তু সেটা অন্য কোনো পরিচয়ে; বিএসএস এর দুর্দান্ত স্পাই ০০৭ রূপে নয়। পর্দায় বন্ডকে তুলে ধরার দিক দিয়ে ক্রেগ তার পূর্বসূরিদের চাইতে অনেকখানিই আলাদা। তার বন্ড একইসাথে ব্যক্তিত্বপূর্ণ, চতুর, শক্তিশালী, ভঙ্গুর, আবেগী কখনো কখনো নিজের যোগ্যতা নিয়ে সন্দিহান।
তার চরিত্রায়নের এই দ্বার্থ্যবোধকতার কারণে ক্রেগের বন্ড সুপার হিরো থেকে মানুষের কাতারে নেমে এসেছে। যার ফলে দর্শকরা চরিত্রটির সাথে আরো ভালোভাবে সংযোগ স্থাপন করতে পেরেছে। ক্রেগের পরে জেমস বন্ডের মশাল যার হাতেই যাক না কেন, ড্যানিয়েল ক্রেগ বন্ড হিসেবে দর্শকদের মনে আলাদা জায়গা নিয়ে থাকবেন। আর তার বিদায়টাও সুন্দর হয়েছে। এমন সফল ফ্রাঞ্চাইজির ক্ষেত্রে অনেকসময় দেখা যায় শেষটা মনঃপুত না হবার কারণে একটা আফসোস থেকেই যায়, যেমনটা হয়েছে ‘গেম অফ থ্রোন্স’ এর ক্ষেত্রে। তবে ক্রেগের শেষটা স্মরণীয়ই হয়ে থাকলো বলতে হয়। পরিচালক বেশ ভালোভাবেই ড্যানিয়েল ক্রেগকে বিদায় জানাতে পেরেছেন।
জেমস বন্ড এমন এক চরিত্র যাকে বলা যায় ‘লার্জার দ্যান লাইফ’। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই সিনেমাগুলো হয় ধুন্ধুমার পদার্থবিদ্যার নিয়ম কানুন ভেঙে একাকার করে দেয়া অ্যাকশন থ্রিলার। সিনেমার কোনো সারবস্তুও থাকে না, সিনেমাগুলো চিন্তার খোরাকও যোগায় না। তবে এটাই এই সিনেমা গুলোর বৈশিষ্ট্য; দর্শকদের নিখাদ বিনোদন দেয়া। সিনেমা থিয়েটারে দর্শকদের ভালো সময় যেন কাটে বন্ড সিনেমাগুলোতে সেটার জন্যই সর্বোচ্চ চেষ্টাটা করা হয়। আর সেই চেষ্টার জন্যই জেমস বন্দের আবেদন কখনোই কমে না, দিন দিন বেড়েই চলে।