হারুকি মুরাকামি এ যুগের জাপানের সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক। ম্যাজিক রিয়েলিজম ব্যবহার করে তিনি বেশ প্রসিদ্ধ হয়েছেন। ম্যাজিক রিয়েলিজম হচ্ছে এমন একধরনের সাহিত্যিক শৈলী, যা প্রতিদিনকার বাস্তবজীবনে কাল্পনিক উপাদান যোগ করে গল্পের আবেদন আরো বাড়িয়ে তোলে। আমাদের নিত্যদিনের পৃথিবীতে উপকথা, পুরাণ কিংবা অন্য কোনো জাদুকরী উপাদান এমনভাবে যোগ করা হয় যেন বাস্তবতা ও ফ্যান্টাসির মধ্যকার ব্যবধান ক্রমশ অদৃশ্য হয়ে ওঠে।
হারুকি মুরাকামি এ ঘরানার সাহিত্যের একজন দক্ষ শিল্পী; তার বেশিরভাগ উপন্যাসেই ম্যাজিক রিয়েলিজম এর আঁকা নিপুণ শিল্পের নমুনা পাওয়া যায়। কিন্তু যে উপন্যাসটি তাকে সর্বপ্রথম খ্যাতি ও জনপ্রিয়তা এনে দেয়, সেটি ছিল তার সবচেয়ে বাস্তবধর্মী কাজ। নরওয়েজিয়ান উড নামের উপন্যাসটি তাকে জাপান এবং জাপানের বাইরের বিখ্যাত সাহিত্যিকদের সাথে স্থায়ী আসন তৈরি করে দিয়েছিল।
উপন্যাসের নামটি নেওয়া হয়েছে বিখ্যাত দ্য বিটলস ব্যান্ডের একই নামের একটি গান থেকে। উপন্যাসটি কিছুটা আত্মজৈবনিক। প্রধান চরিত্র তরু ওয়াতানাবের উপর ষাটের দশকের মুরাকামির নিজের কিছু ছাপ রয়েছে। কাহিনীর একেবারে প্রথমেই দেখা যায়, তরু ওয়াতানাবে মধ্যবয়সে এসে নাওকোকে স্মরণ করে স্মৃতিবিজড়িত হয়ে পড়ে। নাওকো ছিল তার প্রথম জীবনের ভালোবাসা। প্রায় অনেক বছর পরে নাওকোর প্রিয় গান নরওয়েজিয়ান উড শোনার পরেই তার এই স্মৃতি রোমন্থন শুরু হয়।
এরপর ফ্ল্যাশব্যাকে আঠারো বছর আগের তরুর ডরমিটরির জীবন দেখা যায়। তরু তখন একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করতো। সদ্য বিশ বছরে পা দেওয়া অন্যসব তরুণের চেয়ে সে অনেক বিচ্ছিন্ন ও নিঃসঙ্গ ছিল। এরকম এক সময়ে তরুর সাথে নাওকোর দেখা হয়। নাওকো ছিল তরুর ছোটবেলার বন্ধু কিজুকির প্রেমিকা। অতীতের কিছু বেদনাদায়ক ঘটনার ভার নাওকো তখনও বয়ে চলছিল। তরুর কাছে সে তার এই মানসিক আঘাত ও অতীত ট্রমার কথা খুলে বলে। ধীরে ধীরে তারা একে অপরের ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে। কিন্তু তাদের মাঝে সবসময়েই অদৃশ্য এক দেয়াল বিরাজ করছিল, যা কারো পক্ষেই অতিক্রম করা সম্ভব হচ্ছিল না।
এর মাঝেই তরুর সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ে মিদোরির পরিচিত হয়। মিদোরি ছিল বেশ প্রাণশক্তিসম্পন্ন একটি মেয়ে, যার স্বভাব-চরিত্র নাওকো থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। মিদোরিও ধীরে ধীরে তরুর জীবনের অবিচ্ছিন্ন এক অংশ হয়ে দাঁড়ায়। এই তিনজন মিলে এক জটিল ধরনের ত্রিভুজ প্রেমের আবহ তৈরি করে। বেশ সাদামাটা এই গল্পটিই মুরাকামি তার নিজস্ব ভাষা ও রচনাশৈলী দিয়ে এমন নিপুণরূপে রচনা করেছেন যে তা পাঠকের হৃদয়কে একেবারে শুরু থেকেই আঁকড়ে ধরে রাখবে।
শীতকালও শীতল মৃত্যুর একটি রূপক, পুরো উপন্যাসেই যার ব্যাপ্তি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। ঠাণ্ডা ও জমে যাওয়া পরিবেশ মৃত্যুর নির্দয় ও নৈসর্গিক রূপটি চিত্রায়িত করে। শীতকাল ও তুষারের পাশাপাশি মৃত্যুও এই উপন্যাসের একটি বড় উপাদান। তরু ও নাওকো দু’জনকেই এক বরফশীতল অতীত তাড়িয়ে বেড়ায়। এই অতীতটি হচ্ছে তাদের দু’জনেরই খুব কাছের মানুষ কিজুকির মৃত্যু। সে মৃত্যুও কোনো স্বাভাবিক মৃত্যু ছিল না। কিজুকি এক অজানা কারণে আত্মহত্যা করেছিল। নাওকো ও তরু দু’জনেই তার খুব ঘনিষ্ঠ মানুষ হওয়া সত্ত্বেও এই অকস্মাৎ মৃত্যুর ব্যাপারটি টের পায়নি। কিজুকি তার হৃদয়ে এক রহস্যময় বেদনা ধারণ করেছিল এবং কেউ কিছু বুঝে উঠার আগেই তার নিজের সাথে মৃত্যুর কারণটিও বিলীন হয়ে গেল। এই বেদনাটিই পরে ভিন্নরূপ নিয়ে তার ঘনিষ্ঠ দু’জন ব্যক্তির ওপর চেপে বসে, যারা এই ট্রমা থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করেও বারবার ব্যর্থ হচ্ছিল। মৃত্যুকে অস্বীকার করা যায় না। এই চিরসত্য মেনে তাদের অস্বীকারের প্রচেষ্টা শুধুমাত্র ব্যর্থই হচ্ছিল না, এক সামুদ্রিক ঝড়ের মতো তাদের জীবনকে বারবার বিচূর্ণ করে রেখে যাচ্ছিল। তরুর ভাষায়,
Death exists– in a paperweight, in four red and white balls on a pool table- and we go on living it into our lungs like fine dust.
এখানে মৃত্যু বিষয়ে তরুর একটা শূন্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গি পাওয়া যায়। মৃত্যু বিষয়ে মুরাকামির বর্ণনা পাঠকের মনেও হানা দেবে এবং এভাবে চরিত্রগুলোর বিষাদগ্রস্ত অতীত এবং তা থেকে বের হয়ে আসার সংগ্রাম আরো জীবন্ত হয়ে ওঠে। নাওকো এবং তরু দু’জনই অতীতের এই মৃত্যুকে মানিয়ে নেওয়ার জন্য নিজেদের মতো করে চেষ্টা করে, কিন্তু দিনশেষে মৃত্যুকে উপেক্ষিত রাখা যায় না। বাস্তব পৃথিবীর দিকে তাকালেও এরকম একটি চিত্র ফুটে ওঠে। মৃত্যুর এই ধ্বংসাত্মক চেহারাটিই পাঠককে চরিত্রগুলোর দিকে সহানুভূতি দিয়ে তাকাতে বাধ্য করবে, যারা এমন পরিস্থিতিতে বন্দী হয়ে গেছে এবং যেখান থেকে তাদের কোনো মুক্তি নেই।
মুরাকামি ষাটের দশকের টোকিওকে খুব যত্ন করে তার গল্পে চিত্রায়িত করেছেন। এই উপন্যাসের আত্মজৈবনিক প্রকৃতির কারণে সবকিছুরই বর্ণনা সত্যিকারের একটা অনুভূতি সৃষ্টি করে। উপন্যাসে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী টোকিওকে দেখা যায়, যা জাপানের চিরাচরিত সংস্কৃতিকে পেছনে ফেলে খুব দ্রুত বদলে যাচ্ছিল। টোকিওর শহুরে জীবনধারায় পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রবেশ খুব জোরেসোরেই দেখা যাচ্ছিল। নাওকো ও তরু নিজেদের মধ্যে কথা বলতে গিয়ে যেসব পার্ক ও রাস্তা দিয়ে হেঁটে যায়, তার বিশদ বর্ণনা রয়েছে। এই বর্ণনা থেকে ঐ সময়কার টোকিওর রঙ ও ব্যস্ততার চমৎকার চিত্র পাওয়া যায়।
জাপানের দ্রুত পুঁজিবাদী সমাজে পরিবর্তন হওয়ার সাংস্কৃতিক পরিবর্তনটা যে সবাই খুব ভালোভাবে নিয়েছিল, তা বলা যায় না। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবপন্থীদের কার্যক্রমের কিছু আভাস পাওয়া যায় এই উপন্যাসে। কিন্তু মিদোরির মাধ্যমে লেখক তাদের বেশ সমালোচনা করেছেন। এই বিপ্লবীদের বিরুদ্ধে তিনি অনিবার্য কিছু যুক্তিও দেখিয়েছেন। মুরাকামি ছোটবেলা থেকেই পশ্চিমা সভ্যতার প্রতি একধরনের আকর্ষণ নিয়ে বড় হয়েছেন। তিনি ঐতিহ্যবাদী নন এবং ছোটবেলা থেকেই পশ্চিমা সাহিত্য এবং সংস্কৃতির সাথে অভ্যস্ত ছিলেন। উপন্যাসে তার প্রতিফলনই ফুটে উঠেছে।
কাহিনীর মাঝখানে অনেক পশ্চিমা সাহিত্য, কবিতা ও গানের রেফারেন্স পাওয়া যায়। সবচেয়ে বড় উদাহরণটি দেওয়া যায় এই উপন্যাসের নামটি দিয়েই। গানটি উপন্যাসে এতবার ব্যবহৃত হয়েছে যে পাঠকের এই গানের সাথে একটি আবেগময় সম্পর্ক তৈরি হয়ে যাবে।
That song can make me feel so sad. I don’t know, I guess I imagine myself wandering in a deep wood. I’m all alone and it’s cold and dark, and nobody comes to save me. That’s why Reiko never plays it unless I request it.
তবে যে উপাদানটি এই উপন্যাসকে মনোমুগ্ধকর করার পেছনে প্রধান ভূমিকা পালন করেছে, তা হচ্ছে এর চরিত্রগুলো। সবগুলো চরিত্রই নিজেদের মতো করে ব্যতিক্রম। প্রধান চরিত্র তরুকে অনেকটা মুরাকামির নিজেরই ছায়া বলা যায়। মুরাকামি নিজেও ঐ বয়সে ডরমিটরিতে থাকতেন এবং তরুর চোখ দিয়েই পৃথিবীর প্রতি তার ঐ সময়কার দৃষ্টিভঙ্গি পাওয়া যায়। তবে তরু শুধুমাত্র ষাটের দশকের তরুণকেই প্রতিফলিত করে না। বিষণ্ণতা কাটানোর জন্যে তার প্রাণপণ চেষ্টা আজকের যুগের তরুণদের সাথেও মেলানো যায়। তার দ্বিধান্বিত প্রকৃতি এবং সুখের জন্যে ব্যর্থ অন্বেষণ আজকের ব্যস্ত প্রজন্মেও পাওয়া যায়, যা চরিত্রটিকে এ যুগের তরুণদের সাথে আরো বেশি সম্পর্কযুক্ত করে তোলে।
অন্যদিকে, নাওকো তার অতীত ট্রমাকে অতিক্রম করে সামনে এগিয়ে যেতে চায়। এই ট্রমার ফলে তার যে মানসিক অসুস্থতা, তাও কাটিয়ে উঠা প্রয়োজন। কিন্তু সেও বারবার ব্যর্থ হচ্ছিল। নাওকো এমন একজন মানুষ, যে গভীর সাগরে ডুবে যাচ্ছে কিন্তু সৈকতে উঠার জন্য তার যে আপ্রাণ চেষ্টা, তা থেকে সে বিরত হয়নি। প্রতিবারই যখন কিছুটা উন্নতি করে, তখনই এক বিশাল ঢেউ এসে তাকে আবার গভীর সমুদ্রে বয়ে নিয়ে যায়। কিজুকির মৃত্যু একটা চরিত্রের মতোই জীবন্ত হয়ে ওঠে আলাদা আলাদাভাবে দু’জন ব্যক্তিকে বিপর্যস্ত করে রেখেছে। কিন্তু এই মৃত্যুই আবার তাদের দুইজনকে পরস্পরের সন্নিকটে নিয়ে আসে।
নাওকো তার অতীত ট্রমার খোলস ছেড়ে বের হয়ে আসতে পারে না, কিন্তু তরুকে কাছে পাওয়ার জন্যে তার আকাঙ্ক্ষা দেখা যায়। অন্যদিকে তরু আটকা পড়ে মিদোরি ও নাওকোর মাঝখানে। সে মিদোরিকে পছন্দ করে কিন্তু একইসাথে ভগ্নগ্রস্ত নাওকোর জন্যেও দায়িত্ব অনুভব করে। এই দ্বিধান্বিত অবস্থাটি তরুর নিজের সুখ অন্বেষণের পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায় এবং তাকে আরো ভঙ্গুর করে তোলে। একদিকে আকাঙ্ক্ষা ও অন্যদিকে দায়িত্ব- প্রতিটি মানুষই জীবনের একপর্যায়ে এসে কখনো না কখনো এরকম দ্বিধার সম্মুখীন হয়। অনেকেই এই পরিস্থিতিতে এমন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে, যা পরবর্তী সময়ে অনুশোচনা তৈরি করে।
তরু ও নাওকোকেও এই উপন্যাসে নিজেদের ভুল সিদ্ধান্তের মূল্য দিতে হয়েছে। তাদের এই দুঃখভোগের দৃশ্যগুলো মুরাকামি এত গভীরভাবে চিত্রিত করেছেন যে সেগুলো বেদনাদায়কভাবে সুন্দর হয়ে উঠেছে। বইটি পড়ে শেষ করার পরেও মুরাকামির নিপুণভাবে বুনন করা এই গল্পটি অনিবার্যভাবে পাঠকের ভাবনায় একটা বড় সময়ের জন্যে রয়ে যাবে। সাহিত্যিক হিসেবে এটাই মুরাকামির বিজয়।
নরওয়েজিয়ান উড জাপানে প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৮৭ সালে। তরুণদের কাছে বইটি বিশাল রকমের জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। এটি মুরাকামিকে রাতারাতি ‘সুপারস্টার’ বানিয়ে ফেলে। মুরাকামি অন্তর্মুখী হওয়ায় এই খ্যাতি তাকে অসন্তুষ্ট করে তুলেছিল। অন্তর্মুখী স্বভাবের কারণেই মিডিয়াতে তার সচরাচর দেখা মেলে না। আজ পর্যন্ত তার এই নির্জনতা বজায় রাখার বিষয়টি দেখা যায়।
নরওয়েজিয়ান উড মুরাকামির সাহিত্যিক দুনিয়ায় প্রবেশের জন্যে একটি চমৎকার বই। উপন্যাসটি পাঠককে মুরাকামির বিষাদগ্রস্ত এক স্থানে বয়ে নিয়ে যাবে, যেখানে একবার প্রবেশ করলে বের হওয়া অনেকটাই দুঃসাধ্য; তবু সে জগতের হাতছানি উপেক্ষা করা দুঃসাধ্য।