উপমহাদেশের চলচ্চিত্রে বর্তমানে মালায়ালাম ইন্ডাস্ট্রির জয়জয়কার। ভিন্ন কিছু করার, বা ইতোমধ্যেই হয়েছে এমন কাজে নতুনত্ব নিয়ে আসার প্রয়াস দেখা যায় তাদের মাঝে। কিন্তু এখন পর্যন্ত ১৯৯৮ সালের ‘মুন্নাম মুরা’ ব্যতীত মনে রাখার মতো হস্টেজ ড্রামা খুব একটা নির্মিত হতে দেখা যায়নি মলিউডে। এই খরা কাটাতেই যেন ‘পাডা’ নিয়ে হাজির হলেন পরিচালক কমল কে.এম.। যেটির গল্প রচিত হয়েছে কেরালায় ঘটা একটি বাস্তব ঘটনা অবলম্বনে।
পাডা শব্দের অর্থ আর্মি বা ট্রুপস। ১৩০ মিনিট দৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্রটি আপনাকে ভালো সিনেম্যাটিক এক্সপেরিয়েন্স দেবে। তবে দর্শককে কেবল ভালো এক্সপেরিয়েন্স দেওয়াই পরিচালকের মূল লক্ষ্য নয়। এটি থেকে ইতিহাস জানতে এবং আশেপাশের পরিস্থিতি অনুধাবন করতে পারবেন। এবং দুঃখের ব্যাপার হলো একটা সময় বোধ হবে যে, প্রায় আড়াই দশক আগের ঘটনাবলী নিয়ে নির্মিত হলেও সিনেমাটি আজকের দিনেও সমভাবে প্রাসঙ্গিক।
১৯৯৬ সালে রাজ্য সরকার ভূমি সংস্কার আইন প্রবর্তন করে সংসদে। এই আইন ছিল আদিবাসী স্বার্থ বিরোধী। কেরালায় আদিবাসীদের অবস্থা এমনিতেই খুব একটা ভালো ছিল না। নতুন আইন কার্যকর হলে তাদের টিকে থাকাটা আরো কষ্টকর হয়ে পড়বে। কারণ এসকল ভূমি কেবল তাদের মাথা গোঁজার ঠাঁই নয়, বরং এগুলো জড়িয়ে আছে তাদের অস্তিত্বের সাথে। আয়ানকালি পাডা নামে একটি সংগঠন উক্ত আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করবে বলে ঠিক করে। তারা এমন কিছু করতে চায় যাতে করে সরকার এবং জনগণ উভয়ের পূর্ণ মনোযোগ থাকবে তাদের দিকে। তাই পালাক্কাড জেলার কালেক্টরকে বন্দী করবে বলে সিদ্ধান্ত নেয় তারা। এভাবে চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে বিতর্কিত আইনটি বাদ দিতে সরকারকে বাধ্য করাই ছিল আয়ানকালি পাডার উদ্দেশ্য। তারা কালেক্টরের অফিসে যাওয়ার পর যা ঘটে, এবং আয়ানকালি পাডার সদস্যদেরকে এই কাণ্ডের জন্য কি পরিণাম ভোগ করতে হয়েছিল তা-ই দেখানো হয়েছে ‘পাডা’য়।
বাস্তব ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত চলচ্চিত্র সমূহে কিছু না কিছু সিনেম্যাটিক উপকরণ যুক্ত করা হয়। এটি পরিচালকের ক্রিয়েটিভ ডিসিশন হয়ে থাকে, যা দর্শকের সিনেমা দেখার অভিজ্ঞতাকে বাড়িয়ে দেয় বহুগুণে। কিন্তু পাডাকে পরিচালক অতিরিক্ত সিনেম্যাটিক রূপ দিতে চাননি। দর্শক তোষণের বদলে পরিচালক কমল এমন একটি চিত্রনাট্য তৈরি করেছেন; যা আপনি একটি মনোমুগ্ধকর থ্রিলার সিনেমায় আশা করবেন। এর ফলাফল দেখা যাবে সিনেমাটি দেখতে বসলে। পুরোটা সময়জুড়ে প্রজেক্টের পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ছিল পরিচালকের হাতে।
১৯৯৬ সালের ৪ আগস্টের ঘটনাপ্রবাহের পুনঃমঞ্চায়ন দেখানো হয়েছে সিনেমায়। শুরুতে আয়ানকালি পাডা সংগঠনের সদস্যরা কোন পারিপার্শ্বিক অবস্থা থেকে উঠে এসেছে, সে সম্পর্কিত সংক্ষিপ্ত ধারণা পাই আমরা। এ সম্পর্কিত দৃশ্যাবলী দৈর্ঘ্যের দিক থেকে বড় না হলেও দর্শকের মনে ছাপ ফেলে। বালু (বিনায়াকান) তার কন্যাশিশুর কাছ থেকে হাতঘড়ি চেয়ে নেয়। কারণ তাদের মিশনে টাইমিং খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তার মেয়ে জানতে চায় সে কি ঘড়িটি বিক্রি করে দেবে কিনা, যা তাদের আর্থিক দৈন্যদশার কথা ফুটিয়ে তোলে। আরাভিন্দন (জোজু জর্জ)-এর অসহায়তা ফুটে উঠে যখন সে গরিব লটারি ফেরি করা ব্যক্তিকে ফিরিয়ে দেয়। কুঞ্চাকো বোবান অভিনীত রাজেশই একমাত্র ব্যক্তি যার অতীতে অপরাধের রেকর্ড আছে। অন্যদিকে কুট্টি (দিলীশ পোথেন) ব্যস্ত তার স্ত্রী মিনি (উন্নিমায়া প্রসাদ)-কে অভয় দিতে। কারণ মিনি তাদের প্ল্যান এবং এর ফলাফল কী হতে পারে, সে সম্পর্কে পুরোপুরি ওয়াকিবহাল।
শুরুতে একটু ঝামেলা হয়। সেট আপে খুব বেশি কালক্ষেপণ না করে স্ক্রিপ্ট আমাদেরকে নিয়ে যায় হস্টেজ সিচুয়েশনে। তারপরেই আমরা ঢুকে পড়ি পরিপূর্ণ থ্রিলিং আবহে। যেখানে অপেক্ষা করে রয়েছে উত্তেজনা ভরা মুহূর্ত আর খানিক পরপর পরিস্থিতির জট পাকিয়ে যাওয়া। শুরু হয় আলাপ-আলোচনা। এখানে মূলত আমরা দুটি কথোপকথন হতে দেখি। একটি হচ্ছে অপহরণকারীদের আর ডেপুটি কালেক্টর অজয় শ্রীপদ ডাঙ্গে (অর্জুন রাধাকৃষ্ণাণ)-এর মাঝে। এবং অপরটি তাদের সাথে সরকারের চিফ সেক্রেটারি (প্রকাশ রাজ)-এর মাঝে। কথোপকথনের মাঝে বেশ কয়েকবার পাওয়ার ডায়নামিক বদলায়।
আমরা দেখতে পাই সরকারি কর্মচারী হলেও কালেক্টর জনগণকে নিয়ে ভাবেন, অপহরণকারীদের দাবির প্রতিও তার সহমর্মিতা রয়েছে। অন্যদিকে, বিতর্কিত আইনের চেয়েও প্রশাসনের অধিক মাথাব্যথার কারণ কালেক্টরের সুস্থতা। তাকে যেভাবেই হোক, কোনো ক্ষতি হওয়ার আগে উদ্ধার করতে হবে। কারণ সামনেই নির্বাচন। আর নির্বাচনের আগে কোনো ধরনের ঝামেলায় তারা জড়াতে চায় না। চিফ সেক্রেটারির কক্ষ আর ডেপুটি কালেক্টরের কক্ষের দৃশ্যাবলীই আমরা বেশি দেখি। তবে পরিচালক ১৯৯৬ সালের ঘটনার ব্যাপারে বিশদ স্টাডি করেছেন। ফলে অন্যান্য ন্যারেটিভও উঠে এসেছে। যেমন- অপহৃত হওয়ার পর অজয়ের বাড়ির অবস্থা, অপহরণকারীদের পারিবারের মানুষের উৎকণ্ঠা, কোনো কিছু না বুঝে কালেক্টর অফিসের সামনে অবস্থান নেওয়া পুলিশ বাহিনী এবং ঝামেলা পাকাতে চেষ্টা করা রাজনৈতিক নেতাদের ভাষ্য। এসকল কিছু মিলে সৃষ্টি হয় জটিল এক আবহের, যেটি আরো অমোঘ হয় বিষ্ণু বিজয়ের সংগীতায়োজনে।
মালায়ালাম সিনেমা দেখে যারা অভ্যস্ত, তাদের কাছে বিনায়াকান, জর্জ, বোবান বা পোথেনকে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কিছু নেই। একই কথা খাটে প্রকাশ রাজের ক্ষেত্রেও। পাঁচজন পাওয়ার হাউজ বরাবরের মত অনবদ্য। সারপ্রাইজ প্যাকেজ হিসেবে এসেছেন অর্জুন রাধাকৃষ্ণাণ। বন্দী কালেক্টরের চরিত্রে রুমের বাকি চারজনের সাথে সমানে সমানে টক্কর দিয়েছেন তিনি। সাপোর্টিং অ্যাক্টর হিসেবে ইন্দ্রানস, উন্নিমায়া, টম চাকো এদের পার্ফম্যান্সও ভালো ছিল। যা সিনেমার উপভোগ্যতার মাত্রাকে বাড়িয়েছে। এক্ষেত্রে সামির তাহিরের সিনেম্যাটোগ্রাফিকেও বাহবা দিতে হবে। শুরুর দিকের লোকসংগীত থেকে শেষের দিকের টানটান উত্তেজনা; পুরোটা সময়জুড়ে তার মুন্সিয়ানা পাডাকে করেছে প্রাণবন্ত। একটা সময় গিয়ে কালেক্টরের রুমে ক্লস্ট্রোফোবিয়ার অনুভূতির উদ্রেক হয়। এটি সিনেমার শক্তিশালী দিকেই পড়ে। কেননা, ঐ মুহূর্তে এমন আবহ মুভি দেখার অনুভূতিকে বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণ।
পাডা সম্পর্কে বলতে গিয়ে অনুরাগ কাশ্যপের ভাষ্য, ‘ইন্ডিয়ান ডগ ডে আফটারনুন উইথ আ টুইস্ট’। এটি দেখলে উপমহাদেশের যে সিনেমাটির কথা আপনার সবার আগে মনে পড়বে, সেটি হলো রাকেশ ওম প্রকাশ মেহরার রাঙ দে বাসন্তী (২০০৬)। হলিউডের দিকে গেলে স্পিলবার্গের মিউনিখ (২০০৫), আর সাম্প্রতিক দ্যা ট্রায়াল অভ দ্যা শিকাগো সেভেন (২০২১) এর কথা বলা যায়। ডগ ডে আফটারনুন (১৯৭৫) এর কথা তো অনুরাগই বলে দিয়েছেন। সিডনি লুমেটের ভক্তরা তার আরো কয়েকটা চলচ্চিত্রের প্রভাব খুঁজে পাবেন।
অন্য গ্রেট পরিচালকদের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে, নিজের স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্যও বজায় রেখেছেন কমল। পুরো মুভিতে দেখা গেছে নিপীড়িত, দলিতদের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। অনেকগুলো রাজনৈতিক প্রশ্ন উঠে এসেছে এখানে, প্রশ্নবাণে জর্জরিত করা হয়েছে ঘুণে ধরা সিস্টেম এবং রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে। অপহরণকারীরাও ছিল সাধারণ মানুষ। অবিচার আর সহ্য করা সম্ভব হচ্ছিল না তাদের পক্ষে। বাকিদের মতে তাদের কর্মকাণ্ড অপহরণ হলেও, তাদের মতে এটা তাদের বিপ্লব। জ্ঞান ও সচেতনতার দিক থেকেও তারা কোনো অংশে কম নয়। নিজেদের দাবি তুলে ধরাতে, বা কালেক্টর, চিফ সেক্রেটারির সাথে বিতর্কে, নিজেদের সংঘের নাম ধরে স্লোগান দেওয়াতে যার পরিচয় ফুটে ওঠে।
কেবল অপহরণের রুদ্ধ দশার যবনিকাপাতে সিনেমার কাহিনীর পরিসমাপ্তি ঘটে না। পাডায় বলা হয় ১৯৯৬ সালের ৪ই আগস্টের পর কুশীলবদের কার সাথে কী হয়েছিল। আয়ানকালি পাডার সদস্যরা জানতো তাদের কাজের ফলাফল কী হতে পারে। তথাপি ‘আর্মচেয়ার রেভ্যুলেশনারি’দের মতো ঘরের কোণে বসে না থেকে, তারা আইন তুলে নিয়েছিল নিজেদের হাতে। বলতে চেয়েছিলে তাদের কথা, যাদের কণ্ঠ উপর মহলে পৌঁছায় না। সিনেমা হিসেবে এটির লেগ্যাসি কী হবে, সে উত্তর তোলা রইলো সময়ের হাতে। ইতিহাস বর্ণনা আর সোশাল কমেন্ট্রিতে পাডা অনুপম দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। যা গতবছরের ‘নায়াট্টু’-এর পর মলিউডে অসাধারণ এক সংযোজন।