লেখক এবং পরিচালক সেলিন সাইয়ামার কাজের মূল কেন্দ্রবিন্দু নারীরা। তিনি কিশোরী এবং উঠতি বয়সী তরুণীরা সময়ের সাথে যেভাবে লিঙ্গ এবং যৌন জটিলতার পরিচিত হয় এবং কীভাবে এসবের সাথে মানিয়ে নেয়; এ সংক্রান্ত সুন্দর সুন্দর সিনেমা নির্মাণ করে থাকেন। তার নিমিত টমবয় (২০১১), গার্লহুড (২০১৪) এবং পোর্ট্রেট অব অ্যা লেডি অন ফায়ার (২০১৯) এ সাক্ষ্যই দেয়। নারীত্বের গূঢ় অনুভূতিগুলোকে তিনি বোঝেন, অনুভব করেন এবং পর্দায় চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তোলেন।
চারদিকে ভূয়সী প্রশংসা পাওয়া তার সর্বশেষ সিনেমা পেটিট মামোঁ (২০২১)-ও এ ধারার ব্যতিক্রম নয়। এটাও নারীদের ব্যক্তিগত জীবনের ওপর আলোকপাত করে। তবে সাইয়ামার ফিল্মোগ্রাফির সাথে এ সিনেমার খানিকটা তফাৎও রয়েছে। কেননা, এটাই এখন পর্যন্ত এ পরিচালক নির্মিত একমাত্র সিনেমা, যেটি পিজি রেটিং পেয়েছে। বাকিসবই প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য। আর পারিবারিক সিনেমা বা পরিবারকে নিয়ে সিনেমা, যা-ই বলেন না কেন, এ বিষয় নিয়ে এতটা প্রাণরসে ভরা সিনেমা সম্প্রতি খুব কমই নির্মিত হয়েছে।
এটি প্রাঞ্জলতার সাথে নেলির জীবনের সাররিয়াল গল্প বলে, যার বয়স মাত্র ৮ বছর। নেলি চরিত্রে অসাধারণ অভিনয় করা শিল্পীর নাম জোসেফিন সাঞ্জ, যার আছে লম্বা, বাদামী রংয়ের চুল এবং তীক্ষ্ণ, সংবেদী দৃষ্টি। বয়স বা অভিজ্ঞতা, যেটির ঘাটতির কারণেই হোক, আশেপাশের লোকেদের সমস্যাটা সে পুরোপুরি বুঝতে পারে না। তবে কোনো একটা সমস্যা যে রয়েছে, সেটা সে খুব ভালোভাবেই বুঝতে পারে। আর তাদের প্রতি তার মনোভাবও সহমর্মী।
তো, গল্পের শুরুতে আমরা নেলিকে দেখতে পাই একটি বৃদ্ধাশ্রমে। সেখানকার এক মহিলার সাথে সে একটা বোর্ড গেম খেলছে। খেলা শেষে সে একে একে বৃদ্ধাশ্রমের অনেকের কাছ থেকে বিদায় নেয় এবং মায়ের কাছে ফিরে আসে। আমরা বুঝতে পারি এখানে অবস্থান করছিলেন তার নানী, যিনি দীর্ঘকাল অসুখে ভুগে পরলোকগমন করেছেন। নেলির মা তাকে নিয়ে মায়ের ব্যবহৃত জিনিসপত্র এখান থেকে নিয়ে যেতে এসেছেন। নেলির মায়ের কাজ এখানেই শেষ হয় না। তাকে এখন যেতে হবে মায়ের বাসায়, সেখানকার জিনিসপত্র গুটিয়ে নিতে হবে। এটি নেলির মা ম্যারিয়ন (নিনা মেউরিস)-এর জন্য অত্যন্ত মর্মভেদী কাজ। কেননা, মায়ের সাথে এ বাড়িতেই তিনি বেড়ে উঠেছেন। চারপাশে ছড়িয়ে রয়েছে হাজারো স্মৃতি।
ঘরের জিনিসপত্র গোছাতে বাবা-মা উভয়ের ব্যস্ততা নেলিকে একা করে দেয়। সময় কাটাতে সে বাসার কাছে থাকা বনে খেলতে শুরু করে। এখানে তার আরেকটি ৮ বছরের মেয়ের সাথে পরিচয় হয়। কাকতালীয়ভাবে যার নামও আবার ম্যারিয়ন। এই চরিত্রে অভিনয় করেছে গ্যাব্রিয়েলে সাঞ্জ, যে জোসেফিনের আইডেন্টিকাল জমজ। উভয়ের সাক্ষাতের বিষয়কে চরম চাতুর্যের সাথে ভৌতিক আবহ দেন পরিচালক। তখন দর্শকের মনে ভর করে নানা প্রশ্ন। কে এই ম্যারিয়ন? তার চেহারা নেলির সাথে এত মেলে কেন? এই বন কি তবে অতীতের মতো রূপকথার কোনো পটভূমি? নাকি আমরা সময় সুড়ঙ্গ দিয়ে পতিত হয়েছি সুদূর অতীতে?
তবে দর্শকের মনে জাগা প্রশ্নের উত্তর দিতে সাইয়ামার কোনো তাড়া নেই। সিনেমার নামের বাংলা তর্জমা হয় ‘ছোট্ট মা’; এটি গল্প সম্পর্কে খানিকটা ক্লু দেয়। এ সিনেমার সবচেয়ে শক্তির জায়গা হলো এটি এমনভাবে কিছু অদ্ভুতুড়ে ঘটনার চিত্রায়ণ করে যেন সেগুলো অত্যন্ত স্বাভাবিক।
কখনো কখনো পেটিট মামোঁকে মনে হয় জাপানি গ্রেট ফিল্মমেকার হায়াও মিয়াজাকির সিনেমাগুলোর লাইভ অ্যাকশন চিত্রায়ণের মতো। পুরো সিনেমা শিশুতোষ সতেজতা আর বিস্ময়ে পরিপূর্ণ। সাইয়ামার বিষয়বস্তুর প্রতি মনোভাবেও এ ভাব পরিলক্ষিত হয়। জাদুবাস্তবতায় বিহ্বল না হয়ে দুই বাচ্চা সেটি মেনে নেয়। দর্শকেরও সেটি মেনে নিতে বেগ পেতে হয় না। কেননা, দুই সাঞ্জ বোনের পর্দার কেমিস্ট্রি সহজাত এবং অনন্য। তাদের পর্দার কার্যক্রম আমাদেরকে নিজেদের শৈশবের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়।
নেলি আর ম্যারিয়ন বনের ভেতর ছোটাছুটি করে, গাছের পাতা কুড়ায় আর ডালপালা দিয়ে একটি কুঁড়েঘর নির্মাণ করে। পরিচালক তাদের এসব কার্যক্রমকে তুলে ধরেন সজীব শৈশবের সকল উপাদানসমেত। একসময় ম্যারিয়ন নেলিকে তার বাসায় নিয়ে যায়। সেখানে তারা আটা-ময়দা ইত্যাদি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে প্যানকেক বানায়। আর নিজেরা অভিনয় করে হাস্যরসে পরিপূর্ণ বৃহদ একটি হত্যারহস্য বিষয়ক নাটকে। হাসতে থাকা মেয়েদের কর্মকাণ্ড দেখে আমাদের হৃদয় আনন্দে পরিপূর্ণ হয়। সম্প্রতি খুব কম সিনেমাই শৈশবের আনন্দ আর সৃষ্টিশীলতাকে এতটা অনায়াসে ফুটিয়ে তুলতে পেরেছে।
পরিচালক দর্শকের সাথে খানিকটা হেঁয়ালি করেছেন পেটিট মামোঁতে। গল্পের নিয়মনীতি সম্পর্কে শুরুতে কিছুই বলা হয়নি এখানে। এসব সম্পর্কে আমরা জানতে পারি গল্পের অগ্রগতির সাথে। চুলের বিন্যাস আর ভিন্ন রঙের জামাকাপড়ের ওপর ভিত্তি করে আমরা প্রধান দুটি চরিত্রকে আলাদা করতে পারি। গল্পে থাকা কিছু প্রাপ্ত বয়স্ক চরিত্রের সাথেও আমাদের পরিচয় হয়। একসময় নেলি তার নতুন বেস্ট ফ্রেন্ডের সাথে তার বাবাকে পরিচয় করিয়ে দেয়। দুজনের চেহারার সাদৃশ্য দেখে তার বাবা অবাক হন কিনা বোঝা যায় না। হলেও কিছু বলেন না। এদিকে, নেলির মা – বড় ম্যারিয়ন অনেকটা সময়ের জন্য লাপাত্তা হয়ে যান। কেননা, মায়ের মৃত্যুশোকের সাথে মানিয়ে নিতে তার খানিকটা একা সময় প্রয়োজন।
অনেক সময় দেখা যায় নীতি সংক্রান্ত বক্তব্য দিতে গিয়ে সিনেমার বিষয়বস্তু খেই হারিয়ে ফেলে। পেটিট মামোঁতে এ পথ থেকে দায়িত্বশীলতার সাথে দূরে থেকেছেন সাইয়ামা। দর্শককে জ্ঞানগর্ভ বাণী শোনানোর পরিবর্তে তিনি জোর দিয়েছেন বিষয়বস্তুর সহজ, সাবলীল উপস্থাপনার উপর। সংবেদনশীল দর্শকেরা সহজেই বুঝে নিতে পারবেন সাইয়ামা সিনেমার মাধ্যমে কী বলতে চেয়েছেন।
এভাবেই সিনেমার মূল বিষয়বস্তু আমাদের সামনে ফুটে উঠেছে স্বমহিমায়। এটি একজন শিশুর বাল্যকালের স্বতঃস্ফূর্ততার গল্প বলে। যেখানে একটা সময়ে গিয়ে শিশু জানতে পারে জীবনের নানা গূঢ় সত্যের সাথে। যে সত্যের সম্মুখীন পরবর্তীতে তাকেও হতে হবে। সারাদিন হেসেখেলে বেড়ানো নেলির সামনে নিজের অস্তিত্বের জানান দেয় শোক। সে জানতে পারে জীবনে মৃত্যুই সত্য। এ সত্যের সাথে মানিয়ে নেয়া, হারানোর সুতীব্র বেদনা নিয়ে জীবনের পথে এগিয়ে যাওয়ার মাঝেই জীবনের সফলতা নিহিত।
আবার, আমাদের মা-বাবারা ছোটবেলায় কেমন ছিলেন, মানুষ হিসেবে তাদের বিবর্তন কীভাবে হয়েছে; এসব জানার জন্যও আমাদের অত্যুগ্র আগ্রহ থাকে। এখানে জাদুবাস্তবতার সাহায্যে সে সম্পর্কিত প্রশ্নের স্বরূপ অনুসন্ধান করা হয়েছে। পাশাপাশি পেটিট মামোঁর মূল থিমটা পরিবারকে নিয়েই। কীভাবে দুঃখ পরিবারের সকলকে প্রভাবিত করে, আর কীভাবেই বা তখন পরিবারের সদস্যরা একে অন্যকে সহানুভূতি জানায়; নেলির পরিবারের সদস্যদের আচরণে সিনেমার থিম ফুটে উঠেছে প্রাঞ্জলতার সাথে।
সেলিন সাইয়ামাকে জনপ্রিয়তা পেয়েছেন তার ইন্ডি মাস্টারপিস পোট্রের্ট অব অ্যা লেডি অন ফায়ারের কারণে। এ সিনেমার সাথে পেটিট মামোঁর বিষয়গত মিল না থাকলেও কাঠামোগত মিল রয়েছে। উভয় সিনেমা শুরু হয় একইভাবে, আর এরপর রহস্যময় কিছু ঘটে। মাত্র ৭২ মিনিট দৈর্ঘ্যের এ সিনেমায় যে ইমোশনাল ডেপথ সাইয়ামা উপস্থাপন করেছেন, সেটি আসলেই বাহবা পাওয়ার যোগ্য। এটি একাধারে হাস্যরস, মর্মবেদনা আর অগণিত জাদুকরী সম্ভাবনার চাদরে মোড়া। শেষও হয়ে যায় হঠাৎ করেই, যেভাবে শেষ হয়ে যায় আমাদের শৈশব।