২০১৩ সালের কথা, রবার্ট ডি নিরো এসেছেন আমেরিকান হাসল সিনেমার শুটিং সেটে। এর আগে বেইল আর নিরোর কখনও সামনাসামনি দেখা সাক্ষাৎ হয়নি; তাই সবার সাথে পরিচিত হওয়ার পর ডি নিরো যখন সন্ধানী চোখে খুঁজে ফিরছিলেন ক্রিশ্চিয়ান বেইলকে, হুট করে একজন মোটা করে ভদ্রলোক এসে তার সঙ্গে করমর্দন করলেন। কিছুটা হতবিহবল নিরো কৌতূহল এড়াতে না পেরে শেষমেশ পরিচালক ডেভিড ও’রাসেলকে একপাশে নিয়ে জিজ্ঞেস করে বসলেন, “আচ্ছা, এই মোটা লোকটা আবার কে?” তাকে অবাক করে দিয়ে ডেভিড উত্তর দিলেন “ক্রিশ্চিয়ান বেইল”। নিরো অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে বেইলের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়তে নাড়তে সেদিন অস্ফুটে বলে উঠেছিলেন “সেকি! তাকে তো চেনাই যাচ্ছেনা!”
ক্রিশ্চিয়ান বেইল! যার রয়েছে অসাধারণ নৈপুণ্যের সাথে যেকোন চরিত্রে মিশে যাওয়ার ক্ষমতা। অন্যান্য অভিনেতারা চরিত্রের খাতিরে পাল্টান নিজেদের বেশভূষা বা চুল আঁচড়ানোর ধরণ; আর বেইল বদলে ফেলেন তার শারীরিক গড়ন। সেই দ্য মেশিনিস্ট থেকে আমেরিকান হাসল পর্যন্ত, তিনি এতবার ওজন কমিয়েছেন/বাড়িয়েছেন যে, তার দেহ রূপান্তরের ব্যাপারটি এখন আর হলিউডে নতুন কিছু নয়। কিন্তু তবুও যতবারই তিনি পর্দায় হাজির হয়েছেন, অবাক করেছেন দর্শকদের।
প্যাট্রিক বেইটম্যান (আমেরিকান সাইকো)
আমেরিকান সাইকোতে বেইলকে অবশ্য শারীরিক কোনো পরিবর্তন আনতে হয়নি। তবে তার বহুরূপী অভিনয় জীবনের শুরুটা এই সিনেমা দিয়েই হয়েছিল। তাকে পরিবর্তন আনতে হয়েছিল আচরণের ধরণ এবং দৈনিক কর্মসূচীতে। সিনেমার শুরুতে প্যাট্রিক বেইটম্যান নিজের সকালবেলার যে রুটিন বর্ণনা করে, বেইল সিনেমা নির্মাণের সময় বাস্তবেও সেই নিয়ম অনুসরণ করতেন। এমনকি বদলে ফেলেছিলেন নিজের উচ্চারণভঙ্গী।
তার সাথে সিনেমার মূল চরিত্রের চরিত্রগত কোনো মিলই ছিল না। তাই অনেকেই ভেবেছিলেন সিনেমাটি তার ক্যারিয়ারে নেগেটিভ প্রভাব ফেলবে। অনেকে আবার তাকে সাবধানও করেছিলেন চরিত্রটি না নেয়ার জন্যে। কিন্তু এতে আরও হিতে বিপরীত হয়, তার আগ্রহ বরং আরও বেড়ে যায়। তিনি ব্যাপারটাকে অনেকটা চ্যালেঞ্জ হিসেবেই নেন এবং সবাইকে অবাক করে দিয়ে বেইটম্যান চরিত্রটি ফুটিয়ে তুলেন অত্যন্ত নিপুণতার সাথে। এই সিনেমা তার ক্যারিয়ারে প্রভাব ফেলেছিল ঠিকই, তবে সেটা ছিল পজিটিভ, তার সম্পূর্ণ ক্যারিয়ারেরই মোড় ঘুরে যায় এর মাধ্যমে।
ট্রেভর রেজনিক (দ্য মেশিনিস্ট)
দ্য মেশিনিস্ট সিনেমার প্রযোজকরা যখন চরিত্রটি নিয়ে বেইলের শরণাপন্ন হয়েছিলেন তখন তার ওজন ছিল ৮৩ কেজির মতো। তিনি মাত্র কয়েক মাসে সেই ওজন নামিয়ে নিয়ে আসেন ৫৫ কেজিতে! তার পরিকল্পনা ছিল প্রায় ৪৫ কেজি ওজন কমানোর। কিন্তু তার স্বাস্থ্যের জন্যে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যায় বলে প্রযোজক তাকে ৫৪ কেজির নিচে নামতে দিতে রাজী হননি।
পরে তিনি নিজেই উপলব্ধি করেন আর ওজন কমালে তার পক্ষে দৌড়ানো তো দূরের কথা, হাঁটাচলা করা কষ্টকর হয়ে যেত, কেননা তার পায়ে কোনো পেশীই অবশিষ্ট ছিল না। ওজন কমানোর সময় তার প্রতিদিনকার খাদ্য তালিকায় ছিল একটি আপেল আর একটি টুনা মাছ। ক্ষুধা কমানোর জন্যে তিনি শেষমেশ ধূমপানও শুরু করেন।
পরিচালক ব্রাড অ্যান্ডারসন কখনই বেইলকে এত ওজন কমানোর জন্যে বলেননি। বরং বেইলকে প্রথমদিন সেটে দেখার পর তিনি প্রচণ্ড অবাক হন। অবশ্য তিনি পরে স্বীকার করেন যে, চরিত্রের জন্যে বেইলের এই আত্মনিবেদন তাকে রোমাঞ্চিত করেছিল। সিনেমার ইতিহাসে কোনো অভিনেতা বা অভিনেত্রী এতটা ওজন কমাতে সক্ষম হননি, যতটা না বেইল কমিয়েছিলেন দ্য মেশিনিস্ট সিনেমার জন্য।
ব্যাটম্যান (ব্যাটম্যান বিগিনস)
নতুন ব্যাটম্যান সিনেমার জন্যে কাস্টিং চলছে, পরিচালনায় আছেন সবেমাত্র পরিচালনা শুরু করা নবীন পরিচালক ক্রিস্টোফার নোলান। তখন বেইলের দ্য মেশিনিস্ট সিনেমা মাত্র মুক্তি পেয়েছে। ট্রেভর রেজনিক চরিত্রের জন্যে বেইলের ত্যাগ আর আন্তরিকতা দেখে তার প্রতি আকৃষ্ট হন পরিচালক নোলান। চরিত্রের জন্যে তাকে অডিশন দিতে বলেন এবং চরিত্রটিও পেয়ে যান বেইল।
কিন্তু সমস্যা হল তার ওজন। ৬ ফুট উচ্চতার কোনো মানুষের তুলনায় তার ওজন ছিল খুবই কম, মাত্র ৫৫ কেজি। নোলান তার হাতে ছ’মাস সময় দিয়ে বললেন, যতটুকু সম্ভব স্বাস্থ্য বাড়াতে। বেইলও লাগলেন উঠেপড়ে। ছ’মাস নিয়মিত খাওয়াদাওয়া আর ব্যায়ামের পর যখন নোলানের সামনে হাজির হলেন, তখন তার ওজন ৯৫ কেজির মতো। পরিচালক তো দাড়ি-গোঁফে মুখ ঢাকা বিশালদেহী বেইলকে দেখে প্রথমে চিনতেই পারেননি। ক্রুর এক সদস্য তাকে দেখে রীতিমত মশকরা করে বলেন, “আচ্ছা আমরা কি ফ্যাটম্যান এর ছবি বানাচ্ছি? নাকি ব্যাটম্যানের?”।
এই অবস্থায় তার জন্য বানানো ব্যাটস্যুট ফিট হবে না বিধায় তাকে আবার ওজন কমাতে হয়। মাত্র কয়েকদিনেই তিনি তার ওজন কমিয়ে নিয়ে আসেন ৮৬ কেজিতে। ব্যাটম্যান চরিত্রের জন্যে ওজন বাড়ানোর সময় তিনি দৈনিক প্রতি দুই ঘণ্টা পর পর খাবার খেতেন। তার খাবারের প্রোটিন, কার্বোহাইড্রেট ও চর্বির অনুপাত ছিল, ১:২:৩।
ডিটার ডেংলার (রেসকিউ ডন)
ব্যাটম্যান বিগিনসের মুক্তির পরপরই বেইলকে আবার ওজন কমাতে হয় তার পরবর্তী সিনেমা রেসকিউ ডন এর জন্য। ৮৬ কেজি থেকে তিনি ওজন কমিয়ে নিয়ে আসেন ৬১ কেজিতে। অবশ্য তার সুবিধার জন্যে বিপরীত ধারাবাহিকতায় অর্থাৎ সিনেমার শেষের দিকের দৃশ্যগুলো আগে ধারণ করা হয়, যাতে চিত্রগ্রহণ চলাকালীন সময় তিনি আগের স্বাভাবিক শারীরিক অবস্থায় ফিরে যেতে পারেন। কেননা পরের বছরই তার আবার ব্যাটম্যান দ্বিতীয় সিনেমা দ্য ডার্ক নাইটের জন্যে প্রস্তুত হতে হয়েছিল।
মজার ব্যাপার হলো, এই সিনেমার জন্যে বেইল সহ আরও বেশ কজন সহকারী অভিনেতাকেও তাদের ওজন কমাতে হয়েছিল। আর তাদের দেখাদেখি পরিচালক নিজেও ১৩ কেজি ওজন কমিয়ে ফেলেন।
ডিকি একলান্ড (দ্য ফাইটার)
এরপর তার ডাক পড়ে অস্কার মনোনীত পরিচালক ডেভিড ও’রাসেল পরিচালিত দ্য ফাইটার সিনেমায় ডিকি একলান্ড চরিত্রের অভিনয় করতে, যার জন্যে তাকে কমাতে হয়েছিল প্রায় ১৩ কেজি ওজন অর্থাৎ সেই চরিত্রে অভিনয় করার সময় তার ওজন ছিল মাত্র ৬৬ কেজি।
মজা ব্যাপার হচ্ছে, এই সিনেমাটির জন্যে বেইল শুধু ওজনই কমাননি, তিনি রোজ ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় কাটাতেন আসল ডিকি একলান্ডের সাথে। মূলত ডিকি হিরোইন আসক্ত ছিলেন বিধায় তার ওজন কম ছিল আর সেই কারণেই বেইলকেও ওজন কমাতে হয়। পরিচালক ডেভিল ও’রাসেল এই নিয়ে বলেছিলেন, ব্যাপারটা অনুকরণ থেকেও বেশি কিছু ছিল। ডিকির চলাফেরার মাঝে একটা তাল ছিল, বলতে পারেন অনেকটা সঙ্গীতের মতোই। বেইলকে বুঝতে সেটা বুঝে নিতে হয়েছিল।
সে বছর তিনি এই চরিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে সহকারী অভিনেতার অস্কার জিতে নেন। এর পরপরই তাকে আবার ব্যাটম্যানের তৃতীয় এবং শেষ সিনেমা দ্য ডার্ক নাইট রাইজেসের জন্য ওজন বাড়িয়ে ৬৬ কেজি থেকে নিয়ে যান ৯০ কেজিতে। ব্যাটম্যান চরিত্রটি যদি তার অভিনয় জীবনের সবচেয়ে সার্থক চরিত্র হয়ে থাকে, তবে ‘দ্য ডার্ক নাইট রাইজেস’ হতে পারে তার এখন অবধি শারীরিক পরিবর্তনের সবচেয়ে বড় উদাহরণ।
আরভিন রোজেনফিল্ড (আমেরিকান হাসল)
লেখার শুরুতেই বলা হয়েছিল, আমেরিকান হাসল সিনেমার জন্য বেইল এতই ওজন বাড়িয়েছিলেন যে তাকে অনেকেই চিনতেই পারছিল না। ৮৬ কেজি থেকে ১০৩ কেজিতে যাওয়াটা কম কথা নয়। বয়স চল্লিশের কোঠায় ওঠার পর এভাবে ঘনঘন ওজন বাড়ানো/কমানো স্বাস্থ্যের জন্যে বিপজ্জনক।
কিন্তু বেইল যেন বিপদ নিয়ে খেলতে বেশি পছন্দ করেন। যে চরিত্র নিতে মানুষ তাকে সাবধান করে, তিনি সেই চরিত্রের প্রতি আরও বেশি আকৃষ্ট হন। আমেরিকান হাসলের পর তার ফিজিও তাকে একপ্রকার মানা করে দিয়েছিলেন আর ওজন না বাড়াতে। কিন্তু কে শোনে কার কথা? তিনি আবারও ওজন বাড়িয়েছিলেন নতুন সিনেমা ভাইস সিনেমার জন্যে। এবারে তাকে দেখা গেছে প্রাক্তন ভাইস প্রেসিডেন্ট ডিক চেনিরচরিত্রে।
বেইল প্রত্যেক চরিত্রেই যেন নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার পণ করে নামেন। এভাবেই তিনি নিজেকে নিয়ে গেছেন ভিন্ন এক উচ্চতায়। পরিণত হয়েছেন হলিউডের সবচেয়ে সুপরিচিতদের একজনে। তিনি একজন অস্কারজয়ী। তার রয়েছে সুবিশাল তারকাখ্যাতি। আর জনপ্রিয়তার তুঙ্গে থাকা মানুষটি শুধুমাত্র ক্রিশ্চিয়ান বেইল নন, তিনি গোথামের দুর্ধর্ষ ‘ব্যাটম্যান’।