প্রায় এক যুগ আগে, ২০০৬ সালের ৩০ ডিসেম্বর মধ্যরাতে জাগানো হয় ঘুমন্ত সাদ্দাম হোসেনকে। তাকে জানানো হয়, আর কিছুক্ষণের মধ্যেই তার ফাঁসি কার্যকর করা হবে। নিজের কানকে হয়তো বিশ্বাস করতে পারছিলেন না সাদ্দাম। কারণ তিনি ভাবতেন শেষ পর্যন্ত তার ফাঁসি হবে না। তবুও দণ্ডাদেশ যেহেতু এসেই গেছে, তাই তিনি আর কালক্ষেপণ করলেন না, নিজেকে প্রস্তুত করতে লাগলেন ফাঁসির মঞ্চে যাবার জন্যে। তবে সে সময় তার মাথায় ঘুরেফিরে একটি প্রশ্নই আসছিল বারংবার। সুপার টুয়েলভের সদস্যরা কি ঘুমুচ্ছে?
ইরাকের স্বৈরাচারী শাসক সাদ্দাম হোসেনের বিরুদ্ধে ধ্বংসাত্মক অস্ত্র তৈরি করার অভিযোগ যুক্তরাজ্য, কুয়েতসহ বেশ কয়েকটি রাষ্ট্রের সমর্থন নিয়ে ২০০৩ সালে ইরাক আক্রমণ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। সে বছরের শেষ দিকে মার্কিন সামরিক বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন সাদ্দাম হোসেন। পরবর্তীতে তাকে ইরাক সরকারের হাতে তুলে দেয় যুক্তরাষ্ট্র। তার বিচার ইরাকি আদালতে কার্যকর হলেও, নেপথ্যে সর্বদাই ছিল মার্কিনীদের প্রভাব। এরই বদৌলতে সাদ্দামের বিচার চলাকালীন মার্কিন ৫৫১ নাম্বার পুলিশের ১২ জন সদস্যকে তার ব্যক্তিগত রক্ষী হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। এদেরকে বলা হতো ‘সুপার টুয়েলভ’।
জীবনের শেষ ছয় মাস সুপার টুয়েলভের সদস্যদের সান্নিধ্য পেয়েছিলেন সাবেক এই ইরাকি রাষ্ট্রপতি। প্রত্যেকের সাথেই তার হয়ে উঠেছিল অনেকটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। জীবনের না বলা অনেক কথা বলার সুযোগ হয়েছিল সাদ্দাম হোসেনের। উইল বার্ডেনওয়ার্পার ছিলেন তাদেরই একজন, যিনি সাদ্দামের শেষ জীবনের কিছু সময়ের অংশীদার ছিলেন। আর তার সেই ছয় মাসের অভিজ্ঞতা নিয়ে বার্ডেনওয়ার্পার লিখেন ‘The Prisoner in His Palace: Saddam Hussein, His American Guards, and What History Left Unsaid’। বাংলা করলে বলা যায়, ‘নিজের প্রাসাদের কয়েদী: সাদ্দাম হোসেন, তার আমেরিকান রক্ষী, এবং অব্যক্ত কিছু ইতিহাস’। চলুন দেখা যাক বার্ডেনওয়ার্পার কী অজানা ইতিহাস আমাদেরকে বলতে চেয়েছেন।
সাদ্দাম দাদু
বৃদ্ধ বয়সে মানুষ যেমন অন্যের সান্নিধ্য খুঁজে বেড়ায়, ঠিক তেমনি বুড়ো সাদ্দামও পছন্দ করতো গল্প করে বেড়াতে। এমনকি সবার সাথে বেশ সৌহার্দ্যপূর্ণ ব্যবহার করতেন এক সময়ের নিষ্করুণ এ শাসক। তাকে দেখে বোঝার কোনো উপায় ছিল না যে তিনি ছিলেন অত্যন্ত নিষ্ঠুর প্রকৃতির।
উইলের বই অনুসারে, সুপার টুয়েলভের সদস্যরা সর্বদা সাদ্দামকে খুশি রাখার চেষ্টা করতেন এবং বিনিময়ে সাদ্দামও তাদের সাথে বন্ধুত্বসুলভ আচরণ করতেন। প্রায়শই সুপার টুয়েলভ সদস্যদের পরিবারের খোঁজ খবর নিতেন তিনি। এভাবে বেশ কিছুদিন চলতে থাকার পর তারা সকলেই সাদ্দামের বন্ধুসম হয়ে গেলেন। যদিও সকলের চাইতে সাদ্দাম ছিলেন বয়োবৃদ্ধ তবুও তার সখ্য আচরণ হার মানিয়েছিল বয়সের ব্যবধানকে।
সাদ্দাম হোসেন অনেক সময় তার পরিবার নিয়েও গল্প করতেন সুপার টুয়েলভের কারো কারো সাথে। যেমন একবার তিনি তার ছেলে উদয়ের অপকর্ম সম্পর্কে বর্ণনা করছিলেন। তার বক্তব্য অনুসারে জানা যায়, একদা উদয় একটি পার্টিতে এলোপাথাড়ি গুলি ছুঁড়ে। তার ছোঁড়া গুলিতে বেশ কয়েকজন নিরীহ মানুষের প্রাণহানি ঘটে, আহত হয় আরো অনেকে। তার ছেলের এহেন বর্বরতায় সাদ্দাম বেশ ক্ষুব্ধ হন। তিনি রেগে গিয়ে উদয়ের রোলস রয়েস, ফেরারি, পোর্শা ইত্যাদি দামী গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেন। এ ঘটনা বর্ণনা করবার সময়ও বারংবার রেগে যাচ্ছিলেন সাদ্দাম।
যদিও তিনি জানতেন মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে তার ফাঁসি অনিবার্য তবুও তিনি শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বেঁচে যাবার স্বপ্ন দেখতেন। গল্পের ছলে এমনটাই বলেছিলেন তিনি। এমনকি জেল থেকে বের হয়ে আবার প্রেম করে বিয়ে করবার ইচ্ছাও ছিল গদিচ্যুত এই প্রেসিডেন্টের।
সাদ্দামের রক্ষী এবং সহকর্মী রজারসনকে উদ্ধৃত করে বৃদ্ধ সাদ্দাম সম্পর্কে উইল বলেন, “আমরা কখনও সাদ্দামকে মানসিক বিকারগ্রস্ত হত্যাকারী হিসাবে দেখিনি। তাঁর দিকে তাকালে নিজের দাদুর মতো লাগত অনেক সময়ে”।
শৌখিন সাদ্দাম হোসেন
জীবনের শেষ দিনগুলোতে অনেকটা শৌখিন জীবন-যাপন করতে পছন্দ করতেন সাবেক এই ইরাকি নেতা। যেমন জেলে থাকাকালীন তিনি রেডিওতে মার্কিন গায়িকা মেরি জে ব্লাইজার গান শুনতেন নিয়ম করে। টিভিতে শিশুদের অনুষ্ঠান দেখতেও পছন্দ করতেন তিনি। এসবের পাশাপাশি সাইক্লিং মেশিনে শরীরচর্চা করতেন এবং সে মেশিনের নাম দিয়েছিলেন ‘পনি’। তিনি বাগান করতেও খুব পছন্দ করতেন।
খাবার-দাবারের ব্যাপারেও বেশ সুগ্রাহী ছিলেন সাদ্দাম। সকালের খাবার হিসেবে খেতেন অমলেট এবং তাজা ফল। তবে কোনোভাবে অমলেটটা ভেঙ্গে গেলে সেটা আর ছুঁয়েও দেখতেন না তিনি। এছাড়া মিষ্টি খুবই পছন্দ ছিল সাদ্দামের। মাঝেমাঝে মাফিন (এক ধরনের চকলেট জাতীয় কেক) খেতে চাইতেন তিনি।
শেষ দিনগুলিতে ‘কোহিবা’ সিগারের প্রতি বেশ আকর্ষণ ছিল সাদ্দামের। সিগারের জন্য বিখ্যাত কিউবার কোহিবা সিগার ভেজা ওয়াইপে জড়িয়ে বাক্সে বন্দী করে রাখা হতো। আর সাদ্দামকে এই সিগার খাওয়ানো শিখিয়েছিলেন স্বয়ং ফিদেল কাস্ত্রো।
সুপার টুয়েলভের সাথে সাদ্দাম
যদিও সাদ্দাম ছিলেন মার্কিনীদের চরম শত্রু তবুও দিনকে দিন মার্কিন রক্ষীদের সাথে তার সখ্যতা বেড়েই চলছিল। যেমন ভাইয়ের মৃত্যু সংবাদ শুনে খুব আবেগপ্রবণ হয়ে উঠেছিলেন সাদ্দাম, তখন সংবাদদাতা সেনা সদস্যকে বুকে জড়িয়ে বলেছিলেন, “আজ থেকে তুমিই আমার ভাই”।
সে সময় উপহার দিতেও পছন্দ করতেন সাদ্দাম। সুপার টুয়েলভের বিশ বছর বয়সী সদস্য ডসনকে একটা স্যুট উপহার দিয়েছিলেন তিনি। যদিও স্যুটটি ডসনের মাপের ছিল না। তবুও ডসন আনন্দের সাথেই স্যুটটি পড়ে ঘুরে বেড়াতো। আবার আরেক রক্ষীকে তিনি বলেছিলেন, “আমি যদি আমার সম্পত্তি ব্যবহার করার সুযোগ পাই, তাহলে তোমার ছেলের কলেজে পড়ার সকল খরচ আমি বহন করতে রাজী”।
বাগদাদের একটা দ্বীপে সাদ্দামের প্রাসাদ ছিল। সেখানেও তাকে মাঝে মাঝে কয়েদ করে রাখা হতো। একবার সুপার টুয়েলভের কয়েকজন সদস্য মিলে সাদ্দামকে চমকে দেবার ব্যবস্থা করলেন। সে প্রাসাদে পুরনো ফেলে দেয়া জিনিস-পত্র থেকে একটি ছোট টেবিল এবং একটি চেয়ার নিয়ে আসেন। টেবিলের ওপর ইরাকের একটি পতাকাও রাখা হয়। আর টেবিলের সামনের কিছু চেয়ারে নিরাপত্তা রক্ষীরা বসতেন। মনে হতো সাদ্দাম যেন নিজের প্রাসাদে বসে শাসন কার্য পরিচালনা করছেন। খুব চমকে গিয়েছিলেন সাদ্দাম। এবং এরপর থেকে সে চেয়ারেই সবসময় বসতেন তিনি।
উইল তার বইতে উল্লেখ করেন যে সম্পর্ক এতটাই ঘনিষ্ঠ হয়েছিল, কয়েকজন রক্ষী নিজের জীবনবাজি রেখে হলেও সাদ্দামের জীবন বাঁচাতে উদ্যত ছিলেন। এবং যেকোনো পরিণতির জন্যই তারা প্রস্তুত ছিলেন।
স্বল্প সময়ের বন্ধন ছিন্ন করে সাদ্দামের ফাঁসি
২০০৬ সালের ৩০ ডিসেম্বর ঈদুল আযহা’র দিনে সাদ্দামকে ফাঁসি দেবার জন্য প্রস্তুত করা হয়। ফাঁসির কিছুক্ষণ আগে সুপার টুয়েলভের সদস্য স্টিভ হাচিনসনকে সাদ্দাম তার রেমন্ড ওয়েইল ঘড়িটা অনেকটা জোর করেই উপহার দেন।
সাদ্দামকে ফাঁসির জন্য জল্লাদের হাতে তুলে দেবার সময় সুপার টুয়েলভের সকলের চোখের কোণে পানি চলে আসে বলে বইটিতে স্বীকার করেন উইল বার্ডেনওয়ার্পার। ফাঁসি কার্যকর করার পর রক্ষী রজারসন নিজেদেরকেই সাদ্দামের হত্যাকারী ভাবতে থাকেন। এবং সাদ্দামকে নিজেদের অনেক আপনজন হিসেবেও অভিহিত করেন।
সাদ্দামের মৃত্যুর পর তার রক্ষীরা অনেকটা শোক পালনের মতো অবস্থায় চলে যান। তারা সবচেয়ে বেশি অবাক হয়েছিলেন সাদ্দামের মৃত্যুর পর মানুষ তার লাশের ওপর থুথু ছিটিয়ে দিচ্ছিল। রক্ষীদের মধ্যে একজন হাত জোড় করে তাদের থামানোর চেষ্টাও করেছিলেন।
সাদ্দামের প্রতি এভাবে অপমান প্রদর্শন করায় সে ঘটনার পরপরই মার্কিন সেনাবাহিনী থেকে ইস্তফা দেন হাচিনসন। এবং সে দিনের ক্ষোভ এখনও পর্যন্ত তার মনে জলন্ত অগ্নিকুণ্ডের মতোই জ্বলমান।
ঘটনার প্রায় ১১ বছর পেরিয়েছে। অনেকে হয়তো ভুলেই গেছেন সে সময়ের স্মৃতি। তবে ভুলেননি সেই ১২ তরুণ রক্ষী, যারা ফাঁসির আগ মুহূর্ত পর্যন্ত সার্বক্ষণিক নিরাপত্তা দিয়েছিলেন অখ্যাতিপূর্ণ ইরাকি নেতা সাদ্দাম হোসেনকে। ভুলেননি উইল বার্ডেনওয়ার্পার, হয়তো ভুলতে চাননি কখনোই। তাই সমগ্র বিশ্ববাসীকে জানালেন সে ছয় মাসের কাহিনী। যে ইতিহাস অব্যক্ত ছিল পৃথিবীর মানুষের কাছে।
ফিচার ইমেজ সোর্স – হিন্দি ইন্সিস্টপোস্ট