বর্তমান সময়ে চিঠি লিখতে পছন্দ করেন এমন মানুষ পাওয়া একটু কঠিন, তবে খুব বেশি কঠিন নয়। কিন্তু যদি বলা হয়, চিঠি লেখেন কয়জন? তবে তালিকাটা হবে প্রায় শূন্য, কেননা এখন মানুষ মুঠোফোনে বা সামাজিক মাধ্যমে বার্তা আদান-প্রদানটা বেশি স্বাচ্ছন্দ্যদায়ক ও কম সময়সাপেক্ষ ভাবেন। কিন্তু যে সময়টাতে বিনোদনের কোনো মাধ্যম ছিল না, ছিল না যোগাযোগের সুষ্ঠু ব্যবস্থা, তখন মানুষ মনের খোরাক মিটিয়ে দূরের মানুষের সাথে আয়েশ করতে গল্প করার এই একটাই মাধ্যম ব্যবহার করত- চিঠি।
বিনিময় হতো যাপিত জীবনের সুখ-দুঃখ, আবেগ, ভালোবাসা, অনুভূতি, বোধ, উপলব্ধি, পছন্দ-অপছন্দ, প্রতিদিন ঘটে যাওয়া ছোট-বড় ঘটনা, ইচ্ছে স্বপ্ন, টানাপোড়েন, এমনকি উপহারও; সেই সাথে চিঠির পরতে পরতে তৈরি হতো কত-শত গল্প! এই ধারণাটি থেকে একটি উপন্যাস লিখে ফেললেন বুদ্ধদেব গুহ। নাম দিলেন ‘সবিনয় নিবেদন’।
‘সবিনয় নিবেদন’ একটি চিঠি-সাহিত্য বা পত্রোপন্যাস। চিঠির জাদুকরী প্রভাব, কত মায়া তা প্রকাশ পেয়েছে এই বইয়ে। চিঠি মানুষের জীবনে কতটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে, কীভাবে এটি অপরিচিত দুইটি মানুষকে আত্মিক সম্পর্কে বেঁধে দিতে পারে, তা এই উপন্যাস পড়লে বেশ বোঝা যায়।
চরিত্র পরিচিতি
ঋতি রায়
মুক্তচিন্তার এক প্রাণবন্ত নারী এই গল্পের নায়িকা, ঋতি রায়। যে ভালো থাকতে জানে, ভালো রাখতে জানে। সম্পর্কের গুরুত্ব ঋতির কাছে অনেক বেশি; সে শুধু বোঝে মানবধর্ম। কেউ এই ধর্মের পূজারী না হলে তাকে মোটেও গ্রহণ করতে পারে না সে। এই ‘চপলমতি’ চরিত্রটি জানে, শেকড় আঁকড়ে বেঁচে থাকার সুখ। তবে ঋতি বেশ অভিমানী; তার গুরুত্বের জায়গাটা একটু নড়বড়ে হলেই অভিমানে ফেটে পড়ে এই মেয়েটি। কিন্তু সে রাগী নয়, যতক্ষণ না তার আত্মসম্মানে আঘাত করা হচ্ছে।
রাজর্ষি বসু
এই চিঠি সাহিত্যের নায়ক, রাজর্ষি বসু একটি আত্মনির্ভর ও সুবিবেচক চরিত্র। বনই তার জীবন, বনের সকল পশুপাখি তার পরিবার এবং সন্তান সমতুল্য। রাজর্ষি একজন নীতিবান, সৎ ও পরোপকারী মানুষ। বন্ধু হিসেবেও মানুষটির তুলনা হয় না। বলাবাহুল্য, বিবাহ বিচ্ছেদের পরও সে তার স্ত্রীর সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে বন্ধুত্বের জোরে এবং উপন্যাসটি পড়লে বোঝায় যায়, কীভাবে তার বন্ধুসুলভ আচরণের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত সে জয় করে নিচ্ছে মানুষের মন। রাজর্ষি তথাকথিত সুশিক্ষিত মানুষ ভয় পায়, তবে স্বশিক্ষিত মানুষগুলো তার খুব পছন্দের। রাজর্ষি একজন নারীবাদী চরিত্র, তবে কোনোপ্রকার উগ্রতার পরিপন্থী।
এককথায় বলে চলে, রাজর্ষি এমন এক চরিত্র, যার প্রেমে না পড়ে উপায় নেই।
শ্রুতি
বিদূষী, সরল, আন্তরিক এবং যথার্থ সুন্দরী এই নারী ঋতির খুব কাছের বন্ধু এবং সম্পর্কে তার মামাত কাকিমা। শ্রুতির স্বামীর নাম তেজেশ। বাস্তবাদী এই মানুষটির চিঠি লেখার প্রতি অনাগ্রহের শেষ নেই। একটু ভুল বলা হলো। চিঠি লিখতে নয়; বিধিবৎ চিঠি লেখাতে ভারি বিরক্তি শ্রুতির। শ্রুতি ব্যক্তি স্বাধীনতা এবং নিজস্বতায় বিশ্বাসী একজন মানুষ। সে সৎ এবং নারীবাদী একটি চরিত্র।
নীতি
রাজর্ষি বসুর স্ত্রী। ভালোবেসে রাজর্ষি তাকে ‘বনী’ ডাকে। নীতি সমাজের নীতিমালা এবং অযাচিত কথার তোপে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়া একটি চরিত্র, যে কি না একমাত্র রাজর্ষির কাছেই পেয়েছে পরিপূর্ণ সম্মান এবং ঠাঁই।
লেখক পরিচিতি
২৯ জুন, ১৯৩৬ সালে কলকাতার জন্মগ্রহণ করেন প্রকৃতিপ্রেমী এই লেখক। তার শিক্ষাজীবন শুরু হয় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে সুপরিচিত সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজিয়েট স্কুলে এবং শেষ হয় এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্থ স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে লেখাপড়া শেষ করে। বুদ্ধদেবের স্ত্রী ঋতু গুহ ছিলেন একজন রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়িকা। পেশায় যদিও তিনি ছিলেন একজন চার্টার্ড একাউন্ট্যান্ট, কিন্তু সাহিত্যের প্রতি তার ঝোঁকের কোনো কমতি ছিলো না। স্ত্রীর সাথে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতেন তিনিও, তবে পুরাতনী টপ্পা গানে ছিল তার বিশেষ পারদর্শিতা। ভ্রমণরসিক মানুষটি ইংল্যান্ড, ইউরোপের প্রায় সমস্ত দেশ, কানাডা, আমেরিকা, হাওয়াই, জাপান, থাইল্যান্ড ও পূর্ব আফ্রিকাসহ বহু জায়গায় ঘুরেছেন এবং সেসব অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন তার লেখনীতে।
‘হলুদ বসন্ত’, ‘খেলা যখন’, ‘বিন্যাস’, ‘ওয়াইকিকি’, ‘অন্বেষ’, ‘ভোরের আগে’, ‘সন্ধের পরে’, ‘পুজোর সময়ে’, ‘নগ্ননির্জন’, ‘বাতিঘর’, ‘কোজাগর’, ‘বাসনাকুসুম’, ‘একটু উষ্ণতার জন্য’ কিংবা ‘মাধুকরী’র মতো নামকরা উপন্যাসগুলো আমরা উপহার পেয়েছি এই ‘আরণ্যক’ লেখকের কাছ থেকে।
১৯৭৬ সালে মাধুকরী উপন্যাস বুদ্ধদেবের ঝুলিতে এনে দেয় আনন্দ পুরস্কারসহ শিরোমণি ও শরৎ পুরস্কার। জীবনের ৬০টি বসন্ত বাংলা সাহিত্যকে বিলিয়ে দেওয়ার জন্য ২০১৯ সালে টেকনো ইন্ডিয়া বিশ্ববিদ্যালয় এই লেখকে ডি.লিট উপাধিতে ভূষিত করে তার প্রাপ্তির ঝুলি আরেকটু সমৃদ্ধ করে দেয়।
পাঠ প্রতিক্রিয়া
বিশ শতকের ভারতের প্রখ্যাত বাংলা লেখক বুদ্ধদেব গুহ তার ‘সবিনয় নিবেদন’ উপন্যাসে চিঠির মাধ্যমে বেশ সাবলীলভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন আঠারো শতকের বাংলা চিত্র। এই উপন্যাসে ঋতি ও রাজর্ষির চিঠির মাধ্যমে লেখক নিখুঁতভাবে তুলে ধরেছেন সেই সময়ের বাংলার চিত্র পরিবর্তনের ধারা। উপন্যাসের মূল পাত্র-পাত্রী চিঠি পড়ে আমরা জানতে পারি, শিল্পায়নের প্রভাব বাংলাকে কীভাবে তিলে তিলে গ্রাস করছিল। মানুষের ভেতর থেকে আবেগ, বিবেক হারিয়ে যাচ্ছিল একেবারেই। সবাই শুধু জানত, অন্যদের পেছনে পিষে ফেলে কীভাবে দৌড়ে যেতে হবে। এত রূঢ়তার আর স্বার্থপরতার মাঝে ঋতির মনটা যে কীভাবে ভালোবাসায় ভরা, সেটা যেন এক সুবিশাল রহস্য। ঋতির ভালোবাসার বিশালতা দেখে শ্রুতি বলেই বসে,
“তোর প্রেমে পড়ার ক্ষমতা এমনই অসীম যে তুই টেবিল-চেয়ার গাধা-গরু … প্রেমেও পড়তে পারিস অবহেলায়।”
আমরা জানি, বুদ্ধদেব গুহ মূলত অরণ্য ও প্রকৃতির লেখক। এই পত্রোপন্যাসেও তিনি ধরে রেখেছিলেন সেই বৈশিষ্ট্য। তুলে ধরেছেন, বেতলা থেকে শুরু করে আরুশা, তানজানিয়া, সেসেলস দীপপুঞ্জ, আফ্রিকার বন ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। যা নিজের অজান্তেই পাঠককে মিশিয়ে দেবে সেই প্রকৃতির সাথে। ঋতি-রাজর্ষির চিঠিতে প্রকৃতির মনোরম বর্ণনার সাথে আছে মান-অভিমান, খুনসুটি এবং সর্বোপরি সাহিত্যের একটি নতুন আঙ্গিক। পাঠক নিশ্চিত থাকতে পারেন, বইটি পড়তে শুরু করা মাত্রই হারিয়ে যাবেন বুদ্ধদেবের পত্র জগতে। সকল পড়ুয়ার কাছে তাই ‘সবিনয় নিবেদন’ পড়ার সবিনয় নিবেদন রইল।