দিল্লী শহরের আর পাঁচজন সুখী গৃহিণীদের একজন অমৃতা। সকালের আলো ফোটার আগে দরজার বাইরে থেকে দুধ এবং খবরের কাগজ সংগ্রহ করে তার দিন শুরু হয়। লেমন গ্রাস কেটে, কিছুটা আদা কুচি দিয়ে সে চা বানায়। প্রতিদিন নিয়ম করে শাশুড়ির ব্লাড সুগার মাপে, স্বামীকে ঘুম থেকে তুলে চা খেতে দেয়। অফিসে যাওয়ার সময় স্বামীর হাতে একে একে তুলে দেয় ওয়ালেট, টিফিন বক্স, ফাইলপত্র। বেশ সচ্ছলতায় এবং সুখে দিন কেটে যাচ্ছিল তাদের।
এরপর হঠাৎই ঘটনাটা ঘটল। তাদের বাড়িতে আয়োজিত এক সেলিব্রেশন পার্টিতে অফিসের বসের সিদ্ধান্তবদলের কথা জানতে পেরে অমৃতার স্বামী বিক্রম উত্তেজিত হয়ে পড়ে। আকস্মিকভাবে সবার সামনে সে অমৃতাকে একটা থাপ্পড় মেরে বসে। হাসিখুশি অমৃতা মুহূর্তেই চুপ মেরে যায়, সে কেবল ভাবতে থাকে।
সমাজের চোখে “এটা কেবলই একটা থাপ্পড়”, “সংসারজীবনে এমন তো অহরহ ঘটে”, “হঠাৎ রাগের মাথায় মেরে বসেছে– এটা ধরে বসে থেকো না, ভুলে যাও” ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু একটা থাপ্পড় কি আসলেই খুব সামান্য? চাইলেই কি এটাকে উপেক্ষা করা যায়?
এই একটি থাপ্পড় কিভাবে একজন নারীকে বুঝিয়ে দেয় অনেক কিছু– তারই একটি নিখুঁত চিত্র এঁকেছেন পরিচালক অনুভব সিনহা তার ‘থাপ্পড়‘ চলচ্চিত্রে। এ বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি হিন্দি ভাষায় নির্মিত এই চলচ্চিত্রটি মুক্তি পায়।
সময়ের সাথে বদলেছে অনেক কিছুই। সতীদাহের নামে এখন আর নারীকে পুড়িয়ে মারা হয় না, কঠোর পর্দাপ্রথায় তাদের জীবনকে চার দেয়ালে আটকেও ফেলা হয় না। নারীরা এখন লেখাপড়া শেখে, পুরুষদের সমান আয় করে, উড়োজাহাজ চালায়, মহাকাশে যাত্রা করে।
কিন্তু এই আধুনিক সমাজে এসেও পুরুষতন্ত্রের আধিপত্যবাদী মানসিকতার ঠিক কতটুকু পরিবর্তন হয়েছে? পুরুষের মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন দূরে রাখলেও, নারীরা নিজেরা এই আধিপত্যবাদ থেকে কতটুকু মুক্ত হয়েছে? এসব প্রশ্নের একটি টানটান উত্তেজনাপূর্ণ অনুসন্ধান রয়েছে ২ ঘণ্টা ২২ মিনিট দৈর্ঘ্যের এই চলচ্চিত্রে।
দেখা যায়, বিক্রমের কাছে থাপ্পড় খাওয়ার পর অমৃতার হৃদয়ের রক্তক্ষরণ বোঝার থেকে থাপ্পড়টা মারার সময় বিক্রমের মানসিক অস্থিরতার ব্যাপারটি তাৎক্ষণিকভাবে সবার কাছে গুরুত্ব পায়। বিক্রমের অফিসপ্রধান হয়ে লন্ডনে স্থায়ী হওয়ার পেছনে সবার আগ্রহ বা ঝোঁক মূলত পুঁজিবাদী সমাজের নিম্নগামী চিত্রটাই নির্দেশ করে, যেখানে প্রাতিষ্ঠানিক সাফল্যটাই গুরুত্বপূর্ণ, মানুষ বা মানুষের মন গুরুত্বপূর্ণ নয়। থাপ্পড়ের বেদনায় বোবা হয়ে যাওয়া অমৃতা ধীরে ধীরে এই জিনিসগুলো আবিষ্কার করতে শুরু করে। তার স্বামী বিক্রম নানাভাবে বোঝাতে চেষ্টা করে–
যে কোম্পানির জন্য সে এতটা একাগ্রতা নিয়ে কাজ করে, তারা যখন তাকে এভাবে আঘাত দিয়েছে, সে সহ্য করতে পারে নি। রাগের মাথায় সে থাপ্পড়টা দিয়ে ফেলেছে। অর্থাৎ, তার কাছে নিজের সাফল্য-ব্যর্থতার হিসাব যতটা গুরুত্বপূর্ণ, নিজের স্ত্রীর সামাজিক মর্যাদা বা মানসিক অবস্থা ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। থাপ্পড় মারার কারণটা ব্যাখ্যা করাই সে যথেষ্ট মনে করে, কিন্তু ভুলের জন্য ঠিকমতো ক্ষমা প্রার্থনা করাটা জরুরি মনে করে না।
অমৃতা ভাবতে ভাবতে একসময় সংসারে তার মতো সকল গৃহিণীর দুর্বল করুণ রূপটি আবিষ্কার করে, যেখানে পুরুষের জন্য নারীকে থাপ্পড় মারা অত্যন্ত সহজ এবং নারীর কর্তব্য সেটা ঝটপট ভুলে যাওয়া ও মানিয়ে নেওয়া। তবে অন্য সকলের মতো অমৃতা এ জিনিসটা সহজে মেনে নিতে পারল না। কাজেই সে তার বাবার বাড়িতে ফিরে আসে। কিন্তু ‘অমৃতা যে থাপ্পড়টিকে মেনে নিল না’, এ জিনিসটা অন্যরাও সহজভাবে গ্রহণ করল না। এমনকি অমৃতার মা-ও তার উপর ক্ষুব্ধভাব প্রকাশ করলেন।
‘বিয়ে’ নামক জটিল প্রাতিষ্ঠানিক সম্পর্কটি টিকিয়ে রাখতে একজন নারীকে যে কঠোর সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যেতে হয়, তার একটি নির্ভুল চিত্র আছে এই চলচ্চিত্রে। ‘বিবাহ-বিচ্ছেদ’ বা ‘ডিভোর্স’ জিনিসটিকে আমাদের সমাজ অত্যন্ত আগ্রহ নিয়ে, তবে নিন্দার চোখে দেখে। পুরুষের জন্য দ্বিতীয়বার বিয়ে করা স্বাভাবিকভাবে নিতে পারে, কিন্তু নারীর দ্বিতীয় বিয়ের ক্ষেত্রে নিন্দা বা কুরুচিপূর্ণ মন্তব্যের ঝড় বয়ে যায়। কাজেই বিয়ে টিকিয়ে রাখার সামাজিক চাপটা মূলত মেয়েদের উপরে পড়ে এবং তাদের সেই দুর্বল অবস্থাটিকে পুঁজি করে পুরুষেরা ক্ষেত্রবিশেষে ভয়াবহ আচরণ করে। পুনঃপুনভাবে সেটা মানিয়ে নিতে চায় নারীরা আর এভাবে মানিয়ে নিতে নিতে এক সময় নারী তার আপন সত্ত্বাটিকে হারিয়ে ফেলে, তাদের আত্মসম্মানবোধ হয় প্রবলভাবে ক্ষতিগ্রস্ত।
অমৃতার ক্ষেত্রেও সেই একই জিনিস ঘটে। সবার কাছে মনে হতে থাকে– ‘সংসার টিকিয়ে রাখা গুরুত্বপূর্ণ’, কাজেই রাগবশত দেওয়া এই ‘থাপ্পড়’ খুবই সামান্য এবং এটাকে ভুলে গিয়ে মানিয়ে নেওয়াই শ্রেয়। এমনকি তার মা ও ভাইয়ের কাছেও অমৃতার সংসার ভেঙে গেলে মানুষের কাছে মুখ দেখানোর লজ্জাটা যতটা ভয়ংকর, অমৃতার অন্তরের ব্যথা ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। অনেকগুলো নারী চরিত্রকে পরিচালক এখানে এনে হাজির করেছেন, যাদের কাছে আপোস করাটাই শ্রেয় মনে হয়। তবে যে অন্যায় ক্রমাগত চলতে চলতে নিয়মে পরিণত হয়েছে, অমৃতা তাকে অস্বীকার করে এবং পুরুষতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে তার এই সচেতন প্রতিবাদের গল্পই ‘থাপ্পড়’।
সমাজের স্তরভেদে নারীর অবমাননার ভিন্ন ভিন্ন রূপ দেখাতে অমৃতার এই গল্পটির সাথে সমান্তরালভাবে আরও কয়েকটি গল্প তুলে ধরেছেন পরিচালক অনুভব সিনহা। সমাজের নিম্ন স্তরগুলোতে এ সমস্যার প্রকটতর চিত্র পাওয়া যায়। অমৃতার গৃহকর্মী সুনীতার স্বামী মনে করে, স্ত্রীকে থাপ্পড় দিতে তার কোনো লাইসেন্সের প্রয়োজন নেই, কাজেই সে কারণে-অকারণে তাকে থাপ্পড় মারতে পারে।
গৃহিণীদের বাইরে স্বাধীন পেশাজীবী নারীদের অবস্থাও খুব বেশি ভিন্ন নয়। একজন নারী অ্যাডভোকেটের জীবনের চিত্রণ পাই এখানে। নিত্রা জয়সিং যখনই কোনো পেশাগত সাফল্য লাভ করে, তখনই তার স্বামী আকার-ইঙ্গিতে বারবার বলতে চায়,
“এ সাফল্য তোমার নয়। তোমার স্বামী এবং শ্বশুরের সম্মান ও প্রতিপত্তির জোরেই এই সাফল্য এসেছে।”
সমাজের একেবারে উচ্চ স্তর থেকে নিম্ন স্তরের একটা তুলনামূলক চিত্র আমাদেরকে খুব স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দেয় যে, এ সমাজের সব স্তরেই পুরুষের আধিপত্যবাদী মানসিকতা সমানভাবে বিদ্যমান। সেই মানসিকতা থেকে পুরুষরা কেন, এমনকি নারীরাও মুক্ত হতে পারেনি। ‘নারী অধিকার’, ‘নারী স্বাধীনতা’র হাজারো আন্দোলন আমাদেরকে আদৌ মৌলিক কোনো পরিবর্তন এনে দিতে পেরেছে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ জেগে ওঠে। স্পষ্ট হয় যে, সমাজের চোখে নারীরা এখনো ‘নারী’ই থেকে গেছে, পুরুষের সমান ‘মানুষ’ হয়ে উঠতে পারেনি।
পুরুষের ক্রমাগত অশ্রদ্ধা সহ্য করে মানিয়ে চলতে চলতে নারীরা একসময় আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলে। নারীর জন্য সমাজের বেঁধে দেওয়া নিয়ম– এই আপোসকামী মনোভাবের বিরুদ্ধে সচেতন প্রতিবাদ করেছে অমৃতা। সে বিশ্বাস করেছে– যে সংসারের প্রতি সে শ্রদ্ধা হারিয়েছে, যার প্রতি সে ভালোবাসা হারিয়েছে, সেখানে ফিরে গিয়ে মিথ্যে অভিনয় করার থেকে বিবাহ-বিচ্ছেদই ভাল। আবার এই মিথ্যে ভালো থাকার বা ভালোবাসার অভিনয়ের উপর টিকে থাকা হাজার হাজার সংসারে নারী কীভাবে প্রতিনিয়ত লড়াই করে যাচ্ছে, তারও একটি সামগ্রিক চিত্র এ চলচ্চিত্রে আমাদের সামনে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
চলচ্চিত্রে থাপ্পড়টা অমৃতার গালে পড়লেও তার আঘাতটা পরিচালক পৌঁছে দিতে চেয়েছেন পুরুষতান্ত্রিক সমাজের গালে। কাজেই অমৃতার এই নিশ্চুপ হয়ে যাওয়া, কিংবা নিজের বিশ্বাসকে আঁকড়ে ধরে ক্রমাগত লড়াই করে যাওয়ার দৃশ্য প্রতিটি সচেতন পুরুষ দর্শককে লজ্জিত করে।
অমৃতার এ প্রতিবাদ অন্য নারীদের মাঝে যে আত্মসম্মানবোধ এবং প্রতিরোধের মানসিকতা তৈরি করে, তা আমাদের বার্তা দেয় যে, মানিয়ে নেওয়ার থেকে প্রতিবাদটা অনেক ক্ষেত্রে জরুরি। এ বার্তা শুধু বিবাহিত নারীর জন্য নয়, সমাজের সকল দুর্বল মানুষের জন্যই। মানুষের মন একবার ভেঙে গেলে তা জোড়া দেওয়া যে কতটা কঠিন, তা আমরা অনেকটা অনুভব করতে পারি।
বলতে দ্বিধা নেই, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে অনেক দর্শকেরই এই চলচ্চিত্রটি দেখার সময় মনে হবে, সামান্য থাপ্পড়কে টেনে এত বড় করার কি প্রয়োজন ছিল? মূলত এখানেই এই চলচ্চিত্রের গভীরতা নিহিত। অপরাধ সামান্য হলেও সেটা যে অপরাধ এবং তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ গড়ে ওঠাটা জরুরি– অন্তত এই শিক্ষাটি দর্শক হৃদয়ে পৌঁছলে এ নির্মাণ সার্থকতা পাবে।
পরিচালক অনুভব সিনহার পরিমিতিবোধের প্রশংসা আলাদাভাবে করতে হয়। গর্ভধারণের পর অমৃতাকে পুনরায় বিক্রমের কাছে ফিরিয়ে নিয়ে গেলে এই চলচ্চিত্রটি তার গাম্ভীর্য পুরোপুরি হারিয়ে ফেলত। কাজেই মূল বার্তাটি অক্ষুণ্ন রাখতে তিনি দর্শক মনস্তত্ত্বের সন্তুষ্টির স্বার্থে কোনো ধরনের আপোস করেননি। অমৃতার বাবার চরিত্রটিও পুরুষের চোখে নারীকে দেখার একটি আদর্শ চরিত্র হিসেবে গড়ে উঠেছে। পাশাপাশি এই চলচ্চিত্রের এডিটিংয়ের প্রশংসাও অবশ্যই করতে হয়। সময়ের এই গুরুত্বপূর্ণ গল্পটিকে এত চমৎকারভাবে সেলাই করা হয়েছে যে, পুরোটা সময় দর্শকের পূর্ণ মনোযোগ কখনো ব্যাহত হয় না।
‘থাপ্পড়’ ইতোমধ্যেই সমালোচকদের দ্বারা প্রশংসিত হওয়ার পাশাপাশি দর্শক মহলে সাড়া জাগিয়েছে। অমৃতার চরিত্রে অনন্য অভিনয়ের মাধ্যমে তাপসী পান্নু আবারও তার স্বাতন্ত্র্যের পরিচয় দিয়েছেন। নারীর প্রতি যেকোনো ধরনের সহিংস আচরণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ গড়ে তোলায় একটি সচেতন দৃষ্টিভঙ্গি তৈরিতে এই চলচ্চিত্রটি বিশেষ ভূমিকা রাখবে বলেই বিশ্বাস করি।