মাইকেল জোসেফ মোরেল ছিলেন সিআইএর একজন অ্যানালিস্ট। দীর্ঘ ৩০ বছরের সিআইএর জীবনে তিনি ৩ বছর সংগঠনটির ডেপুটি ডাইরেক্টর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। এর মধ্যে দুই বারে প্রায় ছয় মাস সিআইএর ভারপ্রাপ্ত ডাইরেক্টর হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছিলেন। জর্জ বুশ এবং বারাক ওবামা- এই দুই বিপরীত দলের, বিপরীত আদর্শের প্রেসিডেন্টের সময়ই তিনি ছিলেন সিআইএর একেবারের উপরের সারির কর্মকর্তাদের মধ্যে একজন। আর এই সময়ের স্মৃতি, অভিজ্ঞতা এবং মূল্যায়ন নিয়েই তিনি লিখেছেন কিছুটা আত্মজীবনীমূলক এবং কিছুটা ইতিহাস ভিত্তিক বই “The Great War of Our Time: The CIA’s Fight Against Terrorism — From al Qa’ida to ISIS”।
বইটি শুরু হয়েছে ওসামা বিন লাদেন ও আল-কায়েদার উত্থান এবং ২০০১ সালের ৯/১১ এর সন্ত্রাসী হামলার প্রেক্ষাপট বর্ণনার মধ্য দিয়ে। ঐ হামলার সময় প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশের সাথে যে অল্প কয়েকজন কর্মকর্তা ছিলেন, তাদের মধ্যে একজন ছিলেন মাইকেল মোরেল। তিনি ছিলেন তখন প্রেসিডেন্ট বুশের ইন্টেলিজেন্স ব্রিফার। অর্থাৎ তার দায়িত্ব ছিল বিশ্বের যেকোনো প্রান্তে ঘটে চলা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলো এবং সে বিষয়ে সিআইএর বিশ্লেষণগুলোর মধ্যে যেগুলো গুরুত্বপূর্ণ, তার একটি সারমর্ম প্রতিদিন সকালে প্রেসিডেন্টের সামনে পেশ করা। এরপর সেসব বিষয়ে প্রেসিডেন্টের আরো কোনো প্রশ্ন থাকলে সেগুলোর উত্তর দেওয়া।
মোরেলের বইটি কোনো চাঞ্চল্য সৃষ্টিকারী গোপন তথ্য আমাদের সামনে প্রকাশ করে না। ৯/১১, আফগানিস্তান যুদ্ধ, ইরাক যুদ্ধ, আরব বসন্ত, বিন লাদেন হত্যা, এডওয়ার্ড স্নোডেন বিতর্কসহ অনেক কিছুই এই বইয়ে উঠে এসেছে, কিন্তু এতে বলতে গেলে এমন খুব কম বিষয়ই আছে, যা রাজনীতি সচেতন মানুষরা আগে থেকে জানেন না। কিন্তু তারপরেও এই বইটি থেকে সাম্প্রতিক বিশ্বের ইতিহাস পাল্টে দেয়া কিছু ঘটনার সাথে সরাসরি জড়িত ছিলেন, এরকম ক্ষমতাবান মানুষদের চিন্তা-ভাবনা, তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া, অভ্যন্তরীণ বিতর্ক, প্রভৃতি সম্পর্কে মোটামুটি ভালো একটি ধারণা পাওয়া যায়।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, মোরেল ৯/১১ হামলা ঠেকাতে ব্যর্থ হওয়ার পেছনে সরাসরি কাউকে দায়ী না করলেও পরোক্ষভাবে মার্কিন ইন্টেলিজেন্স কমিউনিটির বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে আপাত সমন্বয়হীনতাকে দায়ী করেছেন। তার বর্ণনা অনুযায়ী, বিন লাদেনের উপর নজরদারি করার জন্য “অ্যালেক স্টেশন” নামে সিআইএর যে বিশেষ বিভাগ ছিল, তারা আগে থেকেই আঁচ করতে পেরেছিল, দু’দিন আগে হোক, পরে হোক, এরকম একটি হামলা ঘটতে পারে। কিন্তু সে সময় সিআইএর অপারেশন বিভাগ এবং অ্যানালাইসিস বিভাগের মধ্যে একধরনের দূরত্ব ছিল। ফলে অ্যালেক স্টেশনের প্রধান নিজে অপারেশন বিভাগের না হয়ে একজন অ্যানালিস্ট হওয়ার কারণে ইন্টেলিজেন্স কমিউনিটি তার প্রস্তাবনাগুলো যথেষ্ট গুরুত্ব পায়নি।
মোরেল তার বইয়ে একাধিক স্থানে সিআইএ সংক্রান্ত বিভিন্ন প্রচলিত ধারনা সংশোধন করার চেষ্টা করেছেন। তার মতে, হলিউডের জ্যাক রায়্যান কিংবা জেসন বর্নের চলচ্চিত্রগুলোতে সিআইএকে যেরকম বিশ্বের সকল বিষয়ের উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ রাখা একটি সর্বশক্তিমান সংগঠন হিসেবে উপস্থাপন করা হয়, তা সত্য নয়। বাস্তবে সিআইএরও অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। তাদেরকেও অনেক আইনী বিধিনিষেধ, নীতি নির্ধারকদের সিদ্ধান্ত মেনে চলতে হয়। উদাহরণস্বরূপ, মোরেলের বক্তব্য অনুযায়ী, চলচ্চিত্রে যেরকম দেখানো হয় যে, সিআইএ নিজেই সবার অজান্তে বিভিন্ন গোপন অপারেশন পরিচালনা করে, সেটাও সত্য না। সিআইএ বিভিন্ন গোপন অপারেশনের পরিকল্পনা প্রস্তুত করতে পারে, কিন্তু প্রেসিডেন্টের অনুমতি ছাড়া তা কার্যকর করার এখতিয়ার তাদের থাকে না।
মোরেলের বর্ণনায় বুশ এবং ওবামা, উভয়ের প্রতিই যথেষ্ট শ্রদ্ধা লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু ওবামার তুলনায় বুশের সাথে তার সম্পর্ক যে অনেক বেশি ঘনিষ্ঠ ছিল, সেটাও সহজেই বোঝা যায়। মোরেল বুশের প্রতিটি সিদ্ধান্তের পক্ষেই নিজের যুক্তি হাজির করেছেন। ৯/১১ এর পর তাৎক্ষণিকভাবেই যখন বুশ কূটনীতি বাদ দিয়ে সরাসরি যুদ্ধে যাওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করেন, কিংবা সাদ্দাম হোসেনের বিরুদ্ধে কোনো নিশ্চিত অভিযোগ না থাকা সত্ত্বেও বুশ যখন ইরাক আক্রমণের সম্ভাবনার কথা ব্যক্ত করেন, তখনকার ঘটনাগুলো বর্ণনা করার সময়ও মোরেল বুশের যুদ্ধের প্রতি অতি আগ্রহের কোনো রকম সমালোচনা না করে বরং তাকে বিচক্ষণ প্রেসিডেন্ট হিসেবেই দেখানোর চেষ্টা করেন।
তবে মোরেলের বইয়ে বুশ প্রশাসনের ভাইস প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে কিছুটা অভিযোগ পাওয়া যায়। তার দাবি অনুযায়ী, সিআইএ শুরু থেকেই নিশ্চিত ছিল যে, সাদ্দাম হোসেনের সাথে আল-কায়েদার কোনো সম্পর্ক ছিল না। কিন্তু তা সত্ত্বেও ভাইস প্রেসিডেন্টের অফিস থেকে বারবার সাদ্দামের সাথে আল-কায়েদার সম্পর্ক প্রমাণের উদ্দেশ্যে নিয়ম বহির্ভূতভাবে সিআইএর উপর হস্তক্ষেপ করা হয়েছিল। সাদ্দামের কাছে গণবিধ্বংসী অস্ত্র থাকার মিথ্যা রিপোর্ট সম্পর্কে অবশ্য তিনি কাউকে দোষারপ করতে রাজি হননি। তিনি এটাকে অনেকগুলো “ভুল রিপোর্ট” এর ফলাফল হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করেছেন।
মাইকেল মোরেলের বইয়ের একটি বড় অংশ জুড়ে আছে আরব বসন্তের কথা। মোরেলের ভাষায়, সে সময় সিআইএ বিভিন্ন দেশের গোপন তথ্য চুরি করাতেই এত অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিল যে, তাদের সামনে দিয়ে প্রকাশ্যেই ফেসবুক এবং টুইটার কেন্দ্রিক যে গণআন্দোলন গড়ে উঠছিল, তার দিকে তারা যথেষ্ট মনোযোগ দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেনি। কিন্তু একবার আন্দোলন শুরু হয়ে যাওয়ার পর সিআইএর পক্ষ থেকে নীতি নির্ধারকদের জানানো হয়েছিল, এই আন্দোলনকে সমর্থন করাই হবে আমেরিকার জন্য মঙ্গলজনক। কিন্তু তাদের ঐ সিদ্ধান্ত যে ভুল ছিল, সেটাও স্বীকার করেছেন মোরেল। তার বইয়ের একটি অধ্যায়ের নামই হচ্ছে “আল-কায়েদা’জ স্প্রিং”, যেখানে তিনি ব্যাখ্যা করেন, আরব স্প্রিংয়ের ফলে বাস্তবে সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছিল আল-কায়েদা।
বইয়ের একটি বড় অংশ জুড়ে মোরেল বর্ণনা করেছেন ওসামা বিন লাদেনকে হত্যার পূর্ব প্রস্তুতির কথা এবং লিবিয়ার বেনগাজিতে আল-কায়েদার অনুগত বাহিনীর হাতে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ক্রিস স্টিভেন্স নিহত হওয়ার ঘটনা। অবশ্য এই দুই ক্ষেত্রেও তিনি সরকারি ভাষ্যের বিপরীতে চমক সৃষ্টিকারী নতুন কোনো তথ্য দেননি। কিন্তু এই বইয়ে প্রেসিডেন্ট ওবামাসহ হোয়াইট হাউজের বিভিন্ন কর্মকর্তার সে সময়ের অবস্থান কী ছিল, কে কী বক্তব্য দিয়েছিল, ঠিক কীভাবে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছিল, সেগুলো একজন প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণে উঠে এসেছে। বইটিতে মোরেলের দৃষ্টিভঙ্গির সাথে অনেকেই একমত হবেন না, হবার প্রয়োজনও নেই, কিন্তু আন্তর্জাতিক রাজনীতি নিয়ে যারা আগ্রহী, তারা এই বইটি থেকে নিঃসন্দেহে জানার মতো অনেক কিছুই পাবেন।
বইটি সুখপাঠ্য। কিন্তু তা সত্ত্বেও কখনও কখনও বিরক্তিকর মনে হতে পারে এ কারণে যে, এতে লেখক প্রেসিডেন্টদের সাথে বা বিভিন্ন কর্মকর্তার সাথে তার ব্যক্তিগত সম্পর্কের কথা, এমনকি নিজের পরিবারের কথাও অনেক বিস্তৃতভাবে বর্ণনা করেছেন, যার অনেকগুলোরই বিশ্ব রাজনীতির সাথে সম্পর্ক নেই। বিশেষ করে শেষের অধ্যায়গুলো শুধুমাত্র তাদের কাছেই ভালো লাগবে, যারা মার্কিন রাজনীতি গভীরভাবে অনুসরণ করেন। কারণ এই অধ্যায়গুলোতে লেখক বেনগাজী হত্যাকান্ডে তার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ অভিযোগ উঠেছিল, শুধুমাত্র সেসব অভিযোগ খন্ডানোর জন্যই ব্যয় করেছেন। সম্ভবত বইটি লেখার পেছনে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণের চেষ্টা একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল।
দ্য গ্রেট ওয়ার অফ আওয়ার টাইম বইটি পাঠকদের মধ্যে বেশ ভালো সাড়া ফেলতে সক্ষম হয়েছে। ২০১৫ সালে প্রকাশিত এই বইটি নিউ ইয়র্ক টাইমসের বেস্ট সেলার হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিল। অ্যামাজনে ৩৪৫ জন পাঠক গড়ে এটিকে ৫ এর মধ্যে ৪.৪ রেটিং দিয়েছে। অন্যদিকে গুডরিডসে ৯৭৪ জন পাঠক দিয়ে ৪.০৪ রেটিং। বইটির পৃষ্ঠা সংখ্যা ৩৮৪। মাইকেল মোরেলের সাথে বইটির সহ-লেখক বিল হারলো, যিনি দীর্ঘদিন সিআইএর মুখপাত্র হিসেবে কর্মরত ছিলেন।