পল থমাস অ্যান্ডারসনের ‘দ্য মাস্টার’ (২০১২)-তে আমরা দেখতে পাই ফ্রেডি কোয়েলকে (হোয়াকিন ফিনিক্স)। সে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণ শেষে দেশে ফিরেছে এবং বর্তমানে পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেসে ভুগছে। ভিয়েতনাম যুদ্ধের ভেটেরান ট্র্যাভিস বিকলের (রবার্ট ডি নিরো) মতোই সে তার জন্মভূমিকে বুঝতে চেষ্টা করছে। তার আচার-আচরণেও বিকলের সাথে মিল রয়েছে। উভয়েই এমন একটি বিশ্বের সম্মুখে দাঁড়িয়ে আছে, যেটিকে তারা চিনতে পারে, কিন্তু বুঝতে সমর্থ হয় না।
কঠোর আইন-কানুন, পুঁজিবাদ, ভোগবাদ- এগুলো অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধশালী এই জমানার বৈশিষ্ট্য। তবে বাতির নিচে অন্ধকারও রয়েছে। সমাজতন্ত্রের অনুপ্রবেশের জুজু স্পষ্টভাবে সৃষ্টি করেছে রক্ষণশীল রাজনৈতিক এবং সামাজিক পরিবেশ।
সুস্পষ্ট সামাজিক সংসক্তির এই যুগে নিজেকে খুঁজে পেতে ফ্রেডির প্রয়োজন একজন মাস্টার বা মনিব। আর এই মাস্টার হলেন ক্যারিশম্যাটিক ল্যাঙ্কাস্টার ডড (ফিলিপ সিমুর হফম্যান), যিনি ‘দ্য কজ’ নামক আপাতদৃষ্টিতে ধর্মীয় দর্শন বিষয়ক একটি আন্দোলনের নেতা।
অ্যান্ডারসনের ২০০২ সালের সিনেমা ‘পাঞ্চ-ড্রাংক লাভ’-এ আমরা দেখেছিলাম ভীতসন্ত্রস্ত এবং লঘুচিত্তের ব্যারি ইগানকে (অ্যাডাম স্যান্ডলার)। তার মতো ফ্রেডিও যেন নিজেকে হারিয়ে খুঁজছে, সে নিজের সত্তার চেয়ে বৃহত্তর কোনোকিছুর সাথে সংযুক্ত হতে চায়। দেখতে কদাকার ফ্রেডি কথা বলে মুখের একপাশ দিয়ে, সবসময় বাঁকা হয়ে ঝুঁকে থাকে, নিজের চেহারার সাথে মানিয়ে যাবে, এমন কাপড়-চোপড়ও সে খুঁজে পায় না। বিশ্বযুদ্ধোত্তর আমেরিকার সাথে সে কিছুতেই খাপ খায় না।
অন্যদিকে রয়েছেন সর্বজন শ্রদ্ধেয় এবং মান্য ল্যাঙ্কাস্টার ডড। পরিচালকের অন্য আরেকটি সিনেমা ‘দেয়ার উইল বি ব্লাড’ (২০০৭)-এর ড্যানিয়েল প্লেইনভিউর (ড্যানিয়েল ডে-লুইস) মতোই যিনি লার্জার-দ্যান-লাইফ উদ্যোক্তা। সকল জাঁকজমকের সাথে আমেরিকান চেতনাকে তিনি ধারণ করেন ভাবগাম্ভীর্যের সাথে।
‘দ্য মাস্টার’ হয়তো অ্যান্ডারসনের অন্যান্য সিনেমার মতো সরাসরি ভাবপ্রবণতার উদ্রেক করে না দর্শকের মাঝে। তার কারণ এটি রোমান্টিকতা কিংবা কীভাবে একটি বৈশ্বিক তেল সাম্রাজ্য গড়ে তোলা হয়, তা নিয়ে নাড়াচাড়া করছে না। এখানকার বিষয়বস্তু অনেকটা জটিল প্রকৃতির। কেননা, এখানে পরিচালক তুলে ধরেছেন মানব চরিত্রের প্রশমিত, অন্তরস্থ ব্যাপারসমূহকে।
এই সিনেমার ‘দ্য কজ’ আন্দোলন বা প্রতিষ্ঠানের জন্য অনুপ্রেরণা হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে সায়েন্টোলজি। আর ল্যাঙ্কাস্টার চরিত্রটিকে সাজানো হয়েছে সায়েন্টোলজির প্রতিষ্ঠাতা এল রন হাবার্ডের আলোকে। এছাড়া চরিত্রটিতে আইন র্যান্ড এবং ডেল কার্নেগিরও ছাপ রয়েছে। তবে এই প্রজেক্টের মূল লক্ষ্য সায়েন্টোলজির ব্যবচ্ছেদ করা নয়। বরং এখানে আলোকপাত করা হয়েছে নিয়ন্ত্রণের সাধারণ প্রণালি, এবং মনুষ্য চরিত্রের আজ্ঞা পালনের মনস্তাত্ত্বিক অভিলাষের উপর।
ল্যাঙ্কাস্টারের সান্নিধ্যে এসে ফ্রেডি দ্রুততার সাথে তার উপদেশ অনুসরণ করতে উৎসাহী হয়ে ওঠে। ‘দ্য কজ’ সম্পর্কিত বিতর্কে কেউ ন্যায়সঙ্গত এবং যুক্তিসম্মত প্রশ্ন তুললেও সে নিজের মাস্টার আর তার প্রতিষ্ঠানকে রক্ষা করার চেষ্টা করে, প্রশ্নকর্তাকে হিংস্রভাবে আক্রমণ করে। মাস্টারের প্রতি তার বিশ্বাস এতটাই গভীর যে সে তাকে সকল আইন-কানুনের উর্ধ্বে মনে করে। এবং তার অথবা তার প্রতিষ্ঠানের বিপরীতে কেউ কিছু বললে সে সেটাকে নিজ বিশ্বাসের উপর আঘাত হানা হচ্ছে বলে ভেবে বসে। কিন্তু এই পরিস্থিতি বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না।
‘দ্য মাস্টার’ কখনো এটি পরিষ্কারভাবে প্রদর্শন করে না যে কেন ফ্রেডি এই প্রতিষ্ঠানের প্রতি এতটা আকর্ষণ বোধ করে। কারণ, ল্যাঙ্কাস্টারকে সিনেমার কোথাও নিজের বা প্রতিষ্ঠানের নীতি-নৈতিকতাকে বিশ্বাসযোগ্যভাবে উপস্থাপন করতে দেখা যায়নি। বরং শুরুর একটি দৃশ্যে যখন সে দার্শনিকের মতো জীবন সংক্রান্ত বক্তব্য রাখে; তখন সেটাকে ফাঁকা বুলির মতো শোনায়।
সে বলে, তার পদ্ধতিতে মেনে চললে মানুষের যাবতীয় দুর্দশা দূর হয়ে যাবে। আর তার পদ্ধতির ব্যাপারে কেউ যদি প্রশ্ন তোলে, তাহলে তাকে সে গালিগালাজ করে। এমনকি তার নিজের ছেলেও বলে যে, তার বাবা যা বলে, সবই বানানো কেচ্ছা। তথাপি, ফ্রেডি কর্তব্যনিষ্ঠতার সাথে মাস্টারের পাশে থাকে। তাকে কথা বলতে দেখলে বাঁকা হাসিতে তার মুখ উদ্ভাসিত হয়।
মুভির প্রারম্ভে আমরা যে ফ্রেডিকে দেখি, সে শিশুসুলভ এবং প্রায় বন্য। সহজাত রিপুর দ্বারা সে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রিত। মদ্যপান তার খুব প্রিয়। তাই হাতের কাছে যা পায়, তা দিয়েই সে ঘরোয়া পদ্ধতিতে মদ তৈরি করে। এমনকি কলকারখানায় ব্যবহৃত বিভিন্ন ধরনের তরল এবং রাসায়নিক পদার্থ দিয়েও মদ বানিয়ে গলা ভেজাতে দেখা যায় তাকে।
কামুকতা তার ভেতর সর্বদা বিরাজমান। এ সংক্রান্ত বেশকিছু দৃশ্য দেখানো হয়েছে সিনেমায়, যা দেখে দর্শক ফ্রেডির চরিত্রের কামুকতা, বন্যতা উভয় বৈশিষ্ট্যের সাথে পরিচিত হবেন। অনেক পরে আমরা একটি দৃশ্য দেখি, যেখানে ফ্রেডি কক্ষে উপস্থিত সকল নারীকে নগ্নরূপে কল্পনা করে। তবে এসব নারী না কি ল্যাঙ্কাস্টার; কার দ্বারা সে বেশি উত্তেজিত হয়, তা বলা মুশকিল।
যৌন সম্পর্ক স্থাপনে অক্ষমতা তাকে ভেতরে ভেতরে ক্রোধান্বিত করে। এই দমিত ক্রোধের প্রকাশ আমরা দেখতে পাই একটা সময়। ফ্রেডি সবসময় একজন যুবতীর কথা বলে। নাম তার ডরিস, তাকে নাকি সে ভালোবাসত। তথাপি, ডরিসের ব্যাপারে তার অবহেলাপূর্ণ আচরণে আমরা শেষপর্যন্ত এটাই বুঝি যে; সে আসলে ঐ যুবতীর ধারণা বা কল্পনাকেই ভালোবাসত। এর মাঝেই নিজের সুখ খুঁজে নিয়েছিল।
যৌনতা বিষয়ক একটি দৃশ্যকল্পে বারবার ফ্রেডিকে ফেরত যেতে দেখি আমরা। এখানে রয়েছে একটি বালি নির্মিত নারীমূর্তি, যেটিকে অশ্লীল ম্যাগাজিনের মডেলদের মতো অঙ্গভঙ্গিতে বসানো হয়েছে। পরিচালক স্টিভ ম্যাককুইনের ‘শেইম’ (২০১১)-এর মূল চরিত্র ব্র্যান্ডনের (মাইকেল ফ্যাসবেন্ডার) মতো, ফ্রেডি যৌনতার বাস্তব অভিজ্ঞতার বদলে; এটির কল্পিত প্রতিরূপের ব্যাপারে সে বেশি আগ্রহী।
সে যে ধরনের মদ পান করে, তা কৃত্রিম পদার্থ থেকে তৈরি। সে যে ধরনের যৌনতা পছন্দ করে, সেটাও কৃত্রিম। আসলে সে নিজের জীবনকে যাপন করার পরিবর্তে জীবনের একটি নকল সংস্করণকে খুঁজে ফেরে। আর ল্যাঙ্কাস্টার তাকে এমনই কিছু অলীক বিশ্বাস আর সামাজিক শ্রেণিবিভাগের সমন্বয়ে গঠিত জীবনের স্বপ্ন দেখায়।
অতএব, শেষপর্যন্ত ‘দ্য মাস্টার’ পরিণত হয় অনুগত্য বা বশ্যতা বিষয়ক একটি চলচ্চিত্রে, যেখানে পরাধীনতার উপর ভিত্তি করে একজন মানুষের পরিচয় বিরচিত হয়। গল্পের শুরুতে ফ্রেডির মাস্টার ছিল যৌনতা এবং সুরা। কিন্তু ল্যাঙ্কাস্টার এবং ‘দ্য কজ’ দ্রুতই সে জায়গা দখল করে।
মনিবের পরিবর্তনের সাথে দর্শক মাদকাসক্তি থেকে মুক্তিলাভের পথে আছেন, এমন মানুষের সাথে মিল খুঁজে পাবেন। এ ধরনের মানুষেরা সাধারণত মাদকের বদলে অন্য কোনো বিষয়ের প্রতি অত্যধিকভাবে ঝুঁকে পড়েন। ল্যাঙ্কাস্টার ফ্রেডির উপর যেসব পদ্ধতির প্রয়োগ ঘটান, তাতে আমরা তার ভেতর জ্ঞানালোকের সম্পাত ঘটতে দেখি না। বরং এসব অনুশীলন তার নিজের সম্পর্কিত যেসব বোধ আছে; সেগুলোর বিলুপ্তি ঘটায়। এদিক থেকে ল্যাঙ্কাস্টারের সাথে কোনো মতবাদে মগজধোলাই করে লোকজন যুক্ত করার দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তির সাথেও মিল পাওয়া যায়।
গল্পে ফ্রেডি একলাই পরাধীন নয়। তার মনিব এবং দ্য কজের প্রধান ল্যাঙ্কাস্টার ডডও আমাদের চোখে ঢাল-তলোয়ারহীন নিধিরাম সর্দার হিসেবে উপনীত হন। যৌনতা এবং বিশ্বস্ততা নিয়ে একটি চরিত্র তার সাথে ঠিক সেরকম আচরণ করে; যেমনটা তিনি নিজে ফ্রেডির সাথে করেন। অনেকাংশে ডড আরো ভয়াবহ আচরণের শিকার হয়। এই চরিত্রই আসল মনিব, দ্য কজ নামক প্রতিষ্ঠানের একচ্ছত্র অধিপতি। তার সাথে ল্যাঙ্কাস্টারের সম্পর্ক অত্যন্ত বিকৃত। সে তাকে প্রারম্ভিক ফ্রেডির মতো সহজাত আবেগ এবং অভিলাষের উপর ভিত্তি করে আচরণ করা প্রাথমিক যুগের মানুষের কাতারে নামিয়ে আনে।
কেনেথ লোনারগানের ‘মার্গারেট’ (২০১১) চলচ্চিত্রটি নাইন ইলেভেন পরবর্তী মার্কিন মনস্তত্ত্বের নানা দিক তুলে ধরেছিল। একইভাবে এখানে অ্যান্ডারসন উপস্থাপন করেছেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী আমেরিকান মনস্তত্ত্বকে। সিনেমায় বর্ণিত তৎকালীন সমাজে, সামাজিক সংসক্তিকে একজন মানুষের সাফল্য এবং শান্তি অর্জনের একমাত্র পন্থা বলে বিবেচনা করা হতো। এই ধারণার বিপরীত কোনো মত পোষণ করলে তাকে তীব্র ভর্ৎসনার মুখোমুখি হতে হতো।
সে যুগে যৌনতাকে অবদমিত করে রাখার মতো একটি বিষয় বলে ভাবা হতো। অথবা এই কার্যে এমনভাবে লিপ্ত হতে উৎসাহিত করা হতো, যেভাবে লিপ্ত হলে সমাজের কোনো অভিযোগ থাকবে না। তার ফলাফল হিসেবে উদ্ভব হয় যৌনতা সম্পর্কিত বিকৃত সব ধ্যান-ধারণার। মানুষজন মূল যৌনতার বদলে যৌনতার অভিপ্রায় নিয়ে ভেবেই বাতুল হয়ে পড়ে৷
সংক্ষেপে বলতে গেলে, ‘দ্য মাস্টার’ একজন ব্যক্তির অকপট আখ্যান। এই ব্যক্তি বর্তমানে যে পৃথিবীতে বাস করছে, তার সাথে প্রত্যয়হীন। তার পূর্ণ ইচ্ছা আছে, নিজের শিশুসুলভ আচার-আচরণ এবং আদিম সহজাত বোধ হতে নিষ্কৃতি লাভের। এছাড়া নিজের জীবনকে মহিমান্বিত করতে সে মহৎ কোনো কর্মকান্ডের সাথেও যুক্ত হতে চায়, গুণী লোকের সহচার্য পেতে চায়।
মোটকথা, সে সামাজিক স্বীকৃতির কাঙাল।
ফ্রেডি তার আদিম বন্যতা থেকে কতটুকু উত্তরণ করতে পেরেছে; সে সংক্রান্ত সহজ কোনো উত্তর দেন না অ্যান্ডারসন। যদিও শেষের দিকের অর্থপূর্ণ একটি দৃশ্য খানিকটা আলোকপাত করে এ ব্যাপারে। আমরা অনুধাবন করি যে সামাজিক মর্যাদার দিক থেকে কয়েক ধাপ উন্নীত হলেও; মানসিক দিক থেকে সে আসলে গল্পের শুরুতে যেমন ছিল, তেমনই আছে।
পল থমাস অ্যান্ডারসনের অন্যান্য সিনেমার মতো আলোচিত না হলেও, ‘দ্য মাস্টার’ বিষয়বস্তু আর নির্মাণশৈলীর কারণেই চলচ্চিত্রপ্রেমীদের দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম। এসবের সাথে যুক্ত হয়েছে অসাধারণ একটি কাস্ট। হোয়াকিন আর হফম্যান ছাড়াও এমি অ্যাডামস, জনপ্রিয় হওয়ার আগের র্যামি মালেক, জেসে প্লেমন্স এবং সম্প্রতি অস্কারজয়ী লরা ডার্নকে দেখা গেছে এই সিনেমায়। তাই সময় করে বসে যেতে পারেন এই সিনেমাটি দেখতে। আর ফ্রেডির সাথে ঘুরে আসতে পারেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী আমেরিকান সমাজে, উপলব্ধি করতে পারেন মনুষ্যমনের অবদমিত বিভিন্ন অভিলাষের স্বরূপ।