দ্য কিউরিয়াস কেস অব ডিফারেন্সিয়েশন
অভিনেতা আন্নু কাপুর এক সাক্ষাৎকারে আর্ট ফিল্ম আর বাণিজ্যিক সিনেমার পার্থক্য বোঝাতে বলেছিলেন, আর্ট ফিল্ম হচ্ছে বাসায় মায়ের হাতে তৈরি খাবার, আর বাণিজ্যিক সিনেমা রেস্টুরেন্টের খাবার। প্রথমটিতে পরিবেশনার চাকচিক্য নেই, কিন্তু স্বাদ অনুপম। আর দ্বিতীয়টিতে পরিবেশনার বাহার থাকলেও মায়ের হাতের রান্নার স্বাদ নেই। রেস্টুরেন্টের খাবার যেমন নির্দিষ্ট কিছু মশলার আনুপাতিক মিশ্রণে একইভাবে প্রতিদিন রান্না হয়, বাণিজ্যিক সিনেমারও তেমনি কিছু চেনা ছক আছে। বাণিজ্যিক সিনেমাকে এ কারণেই ‘মাসালা মুভি’ বলে কি না কে জানে!
আজকালকার থ্রিলারের গঠনশৈলীর ঠিক তেমনই অবস্থা। মনোযোগী পাঠকমাত্রই সেটা জানেন। ইতিহাসের কোনো ঘটনা-ব্যক্তি-উপাদানে লুকিয়ে থাকা সুপ্রাচীন রহস্য, আজকের দিনে যা সমাধান না হলে দুনিয়া ধ্বংস হয়ে যাবে, ঘটনাকে তীব্রভাবে মোচড় দেয়া ভিলেন, সর্ববিদ্যায় কুশলী অতিমানব নায়ক আর তার সাথে সুন্দরী-বিদুষী নায়িকা– মোটাদাগে এই তো ফর্মুলা। ড্যান ব্রাউন, জেমস রোলিন্স, জেমস প্যাটারসন বা লী চাইল্ড– এঁদের বই একটু খুঁটিয়ে পড়লেই এ কথা বোঝা যায়। এবং এই ধারার উত্থানও খুব সাম্প্রতিক।
ড্যান ব্রাউনের ‘রবার্ট ল্যাংডন’ সিরিজের প্রথম বই ‘দ্য ডা ভিঞ্চি কোড’ প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। একই বছরে জেমস রোলিন্স তার ‘সিগমা ফোর্স’ এর প্রথম বই ‘স্যান্ডস্টর্ম’ প্রকাশ করেন। জেমস প্যাটারসনের ‘এলেক্স ক্রস’ সিরিজের প্রথম বই ‘অ্যালং কেম এ স্পাইডার’ একটু আগে, ১৯৯৩ সালে এবং ‘প্রাইভেট’ সিরিজের প্রথম বই আসে ২০১০ সালে। লী চাইল্ডের ‘জ্যাক রিচার’ সিরিজের প্রথম বই ‘কিলিং ফ্লোর’ বাজারে আসে ১৯৯৭ সালে। দুনিয়াজুড়ে এসবই এখন বেস্টসেলার।
অথচ যে বাজারে যাদের এত কাটতি, সেই বাজারেই তাঁদের তীব্র সমালোচনাও আছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ড্যান ব্রাউনের ইংরেজি লেখার স্টাইল নিয়ে হাসাহাসি হয়, আর অনেকের কাছেই তার লেখাও হাস্যকর রকমের অগভীর। জেমস প্যাটারসনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে- তিনি তার বইগুলো নিজে লেখেন না, আর কাহিনীর উদ্ভট প্লটের কথা না হয় বাদই দেয়া গেল।
উমবার্তো একো: মনীষার কান্তি
কিন্তু অনেকেই জানে না যে সুপ্রাচীন রহস্য, শব্দমোড়া গুপ্তসংকেত, রহস্য উন্মোচনে ব্যস্ত সুতীক্ষ্ণ মেধা– এসব মিলিয়ে অসাধারণ থ্রিলার রচনার পথিকৃৎ হচ্ছেন উমবার্তো একো (১৯৩২-২০১৬)। পাঠক জানেন যে, উমবার্তো একো ইতালির মানুষ, অনেক সমৃদ্ধ তাঁর পরিচয়– মধ্যযুগ ও বাইবেল বিশেষজ্ঞ, দার্শনিক, সিম্বোলজিস্ট, রাজনৈতিক-সামাজিক ঘটনাপ্রবাহের মনোযোগী বিশ্লেষক, বহুভাষাবিদ এবং ঔপন্যাসিক। বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চারটি বিশ্ববিদ্যালয়- ইয়েল, কলাম্বিয়া, হার্ভার্ড ও অক্সফোর্ডে অধ্যাপনা করা এই বিদ্বান মানুষটির মনীষার গভীরতা সহজেই অনুমেয়।
সারা জীবনে অনেকগুলো মননশীল বই লিখেছেন উমবার্তো একো। সেই সাথে উপন্যাস লিখেছেন ছয়টি– দ্য নেম দ্য অব রোজ (১৯৮০), ফুকো’স পেন্ডুলাম (১৯৮৮), দ্য আইল্যান্ড অব দ্য ডে বিফোর (১৯৯৫), দ্য মিস্টিরিয়াস ফ্লেম অব কুইন লোয়ানা (২০০৪), দ্য প্রাগ সেমেটারি (২০১০), এবং নিউমারো জিরো (২০১৫)। নিজের সক্ষমতা বুঝিয়ে দেন প্রথম উপন্যাসেই। ধর্ম, ইতিহাস, শব্দতত্ত্ব আর রহস্যের এক দারুণ মিশেলে লেখা ‘দ্য নেম অব রোজ’ (১৯৮০) উপন্যাস দিয়েই বিশ্বসাহিত্যের দরবারে রীতিমতো আবির্ভূত হন একো।
প্রকাশের পরপরই দারুণ সাড়া ফেলে দেয় বইটি। ১৯৮৩ সালে এর ইংরেজি অনুবাদ করেন উইলিয়াম উইভার। সারা বিশ্বে ৫০ মিলিয়ন কপির ওপরে বিক্রি হয়েছে এটি। ফরাসি পত্রিকা লা ম্যঁন্ড একে শতাব্দীর সেরা একশ’ বইয়ের তালিকায় ১৪ তম স্থান দেয়।
গোলাপকে যে নামেই ডাকো…
কাহিনীর সময় ১৩২৭ খ্রিষ্টাব্দ। রোমান ক্যাথলিক চার্চের একটি শাখার নাম ফ্রান্সিসকান। এর প্রতিষ্ঠাতা মরমী খ্রিষ্টান সাধক সাইন্ট ফ্রান্সিস অব আসিসি (১১৮১/৮২-১২২৬)। এই ফ্রান্সিসকান শাখার এক বিদগ্ধ সদস্য উইলিয়াম অব বাস্কারভিল। বইয়ের শুরুতে দেখা যায়, উত্তর ইতালির এক বেনেডিক্টান মনাস্টারিতে তিনি ধর্মতাত্ত্বিক বিষয়ে বাহাস করতে আসেন।
পাঠকের মনে কি ‘বাস্কারভিল’ শব্দটি চেনা ঠেকছে? আর্থার কোনান ডয়েলের অমর সৃষ্টি শার্লক হোমস সিরিজের একটি সুবিখ্যাত উপন্যাসের নাম ‘হাউন্ড অব বাস্কারভিল’। কেন্দ্রীয় চরিত্রের এই নাম নিয়ে বিদগ্ধ লেখক কি একইসাথে ডয়েলকে শ্রদ্ধা জানালেন এবং উইলিয়ামকে যে হাউন্ডের নৃশংস ভিলেনের মোকাবেলা করতে হবে সেটা মনে করিয়ে দিয়ে পাঠককে আগাম সতর্ক করে দিলেন? কে জানে!
সে যা-ই হোক, মনাস্টারিতে আসার পথে উইলিয়াম অব বাস্কারভিলের সাথে এলো নবীন শিক্ষানবিশ অ্যাডসো। যেদিন তারা মঠে পৌঁছলেন, সেদিনই খুন হয় আরেক সন্ন্যাসী এডেলমো অব অন্ট্রাটো। মঠাধ্যক্ষ অ্যাবো অব ফসানোভা উইলিয়ামকে অনুরোধ করেন এই বিষয়ে তদন্ত করতে। কাজে নেমে উইলিয়াম জানতে পারেন, এডেলমো অব অন্ট্রাটো আটকোণাকৃতির লাইব্রেরির একটি জানালা দিয়ে বাইরে পড়ে গেছেন। এখন পড়ে গেছেন, না কেউ ফেলে দিয়েছে সেটা জানতে হলে তো সেখানে ঢুকতে হবে। কিন্তু প্রথমেই বাধা। গোলকধাঁধাময় সেই লাইব্রেরিতে কিছুতেই তাদের ঢুকতে দেবে না সেখানকার কর্তৃপক্ষ।
পরেরদিন আরেক সন্ন্যাসী ভেনাটিয়াস অব স্যালভামেসকে মৃত পাওয়া গেল শূকরের রক্ত ভর্তি বড় চৌবাচ্চায়। দৃশ্যকল্প বড় নৃশংস। ব্যস, শুরু হয়ে গেল সিম্বোলিজম (চিহ্নবিদ্যা), গুপ্তসংকেত, পারস্পরিক অবিশ্বাস-সন্দেহ আর টান টান উত্তেজনাময় ইঁদুর-বিড়াল খেলা। আবার এর মাঝেই বাহাসে অংশ নিতে চলে এসেছে পোপের প্রতিনিধিদল। কী ভাববে তারা? কেন উইলিয়ামকে বারবার বাধা দেয়া হচ্ছে লাইব্রেরিতে ঢুকতে? ভুলভুলাইয়ার মতো ঐ লাইব্রেরির নির্জন করিডোর কী রহস্য লুকিয়ে রেখেছে? সত্যিই কি আছে বুক অব রেভেলেশন? একের পর এক সাতটি খুনের সাথে তার কি কোনো সম্পর্ক আছে? সবকিছুর কিনারা খুঁজে শেষ রক্ষা করতে পারবে কি উইলিয়াম আর অ্যাডসো?
মধ্যযুগের ইতিহাস, চিন্তাধারা ও বাইবেল-ঐতিহ্যের ওপর অসামান্য দখল আছে বলেই একো এসব বিষয়ের সুষম সমাবেশ ঘটাতে পেরেছেন। তার সুদক্ষ কলমে উইলিয়াম অব বাস্কারভিল চরিত্রে এরিস্টটলের লজিক (যুক্তিবিদ্যা), সেইন্ট এক্যুইনাসের ধর্মদর্শন আর রজার বেকনের বাস্তব কান্ডজ্ঞানের সমন্বয় হয়েছে। তার সাথে যোগ হয়েছে কবিসুলভ তীর্যক রসিকতা আর যোদ্ধার অদম্য কৌতূহল। ভাষার কারুকার্য পাঠককে সমৃদ্ধ করে আর বিষয়বস্তুর জটিলতার পাঠককে আয়েশ করে অমনোযোগী হতে দেয় না। এ এক সুখপাঠ্য অভিযাত্রা।
বইয়ের পাতা থেকে রূপালী পর্দায়…
বইটি নিয়ে ১৯৮৬ সালে একই নামের চমৎকার সিনেমাও হয়েছে। উইলিয়াম অব বাস্কারভিল চরিত্রে অভিনয় করেছেন সদ্যপ্রয়াত শন কনারি। আর অ্যাডসো চরিত্রে ছিলেন কিশোর ক্রিশ্চিয়ান স্ল্যাটার। সিনেমার পরিচালক ছিলেন জ্যঁ জ্যাক আনাদ। তিনি কোয়েস্ট ফর ফায়ার (১৯৮১) এবং সেভেন ইয়ারস ইন তিব্বত (১৯৯৭) ছবির জন্য সুবিখ্যাত। জীবনের প্রথম ছবি ‘ব্ল্যাক এন্ড হোয়াইট ইন কালার’ (১৯৭৬) দিয়ে, বিদেশী ভাষার ছবি হিসেবে, অস্কার জেতেন তিনি। সিনেমাটোগ্রাফারের দায়িত্বে ছিলেন টোনিনো ডেলি কোলি। তিনি লাইফ ইজ বিউটিফুল (১৯৯৭) এর মতো ছবির সিনেমাটোগ্রাফি করেছেন। ফলে মধ্যযুগের ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ আবহ নির্মাণে তিনি অত্যন্ত সফল হয়েছেন। ‘দ্য নেম দ্য অব রোজ’ ছবির আইএমডিবি রেটিং ৭.৭/১০; রটেন টোম্যাটো রেটিং ৭৪%।
সম্প্রতি ২০১৯ সালে হয়েছে মিনি সিরিজ। ইতালির প্রধানতম টিভি চ্যানেল ‘রাই ওয়ান’ এবং বিবিসি টু-তে স্ট্রিমিং হয়েছে। এবার ‘উইলিয়াম অব বাস্কারভিল’ চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন জন টারটুরো। আর অ্যাডসো চরিত্রে ছিলেন ডেমিয়েন হার্ডাঙ। মিনি সিরিজটি সম্পর্কে মিশ্র প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে।
শেষ কথা
ইতিহাস-আশ্রয়ী উপন্যাস বা থ্রিলার সবাই লিখতে পারে না। সেটা এই লেখার শুরুতেই অনেকটা পরিষ্কার হয়ে গেছে। ভাষার ওপর দখল, বিষয়ের গভীরে যাবার ক্ষমতা আর জটিল ঘটনা সাবলীলভাবে বিন্যাসের সক্ষমতা না থাকলে বই লেখার কোনো যুক্তি নেই। একোর পান্ডিত্য বইয়ের সাহিত্য-সৌন্দর্যে ব্যাঘাত তো ঘটায়নি, বরং তা সমৃদ্ধ করেছে স্নিগ্ধ মননশীলতা দিয়ে।
‘দ্য নেম দ্য অব রোজ’ এর উল্লেখযোগ্য কয়েকটি উক্তি দিয়ে দিয়ে লেখাটি শেষ করা যেতে পারে:
Love is wiser than wisdom.
True learning must not be content with ideas, which are, in fact, signs, but must discover things in their individual truth.
Yesterday’s rose endures in its name, we hold empty names.
How peaceful life would be without Love, Adso. How Safe. How Tranquil. And how Dull.
Nothing gives a fearful man more courage than another’s fear.
How beautiful was the spectacle of nature not yet touched by the often perverse wisdom of man!
This, in fact, is the power of the imagination, which, combining the memory of gold with that of the mountain, can compose the idea of a golden mountain.
The beauty of the universe consists not only of unity in variety, but also of variety in unity.