সিআইএর সাম্প্রতিক ইতিহাসে, বিশেষ করে বন্দীদের উপর সিআইএর অমানবিক নির্যাতনের ইতিহাস আলোচনার সময় আবু জুবায়দা নামটা বেশ গুরুত্বের সাথে উঠে আসে। আবু জুবায়দা ছিল আল-কায়েদার মাঝারি পর্যায়ের একজন নেতা। ৯/১১ এর সন্ত্রাসী হামলার কয়েক মাস পর, ২০০২ সালের ২৮ মার্চ পাকিস্তানের ফয়সালাবাদের আল-কায়েদার এক সেফ হাউজে যৌথ অভিযান চালিয়ে তাকে গ্রেপ্তার করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী, সিআইএ এবং এফবিআই।
গ্রেপ্তারের সময় আবু জুবায়দা গুলিবিদ্ধ হয়েছিল। কিন্তু তাকে চিনতে পেরে সিআইএ এবং এফবিআই তার সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করে। মোটামুটি সুস্থ হওয়ার পর সিআইএ তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়ে যায়। কিন্তু তার আগেই, হাসপাতালের বিছানায় তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন পরবর্তীতে এফবিআই থেকে পদত্যাগ করা স্পেশাল এজেন্ট আলি সুফান।
আলি সুফান ছিলেন ১৯৯৯ সালে ইয়েমেনের এডেনে মার্কিন নৌবাহিনীর জাহাজে আল-কায়েদার আত্মঘাতী হামলার কেসের প্রধান তদন্ত কর্মকর্তা। নিজে লেবানিজ বংশোদ্ভূত এবং মুসলমান হওয়ায় তিনি আল-কায়েদা সদস্যদের মনোভাব সহজেই বুঝতে পারতেন, তাদের সাথে সহজে কথোপকথন চালাতে পারতেন এবং কখনো কখনো তাদের আস্থাও অর্জন করতে পারতেন।
ইয়েমেনে তদন্ত চালানোর সময়ই তিনি দেখিয়েছিলেন, কোনো ধরনের টর্চার না করেই কৌশল খাটিয়ে, কথার মারপ্যাঁচে ফেলেই সন্ত্রাসীদের কাছ থেকে যথেষ্ট তথ্য আদায় করা যায়। আবু জুবায়দার উপরেও তিনি এই পদ্ধতি প্রয়োগ করেছিলেন। কোনো ধরনের নির্যাতন ছাড়াই তার মুখ থেকে তিনি তার পরিচিতি অন্যান্য আল-কায়েদা নেতাদের সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য আদায় করেছিলেন।
কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই এফবিআইর কাছ থেকে আবু জুবায়দাকে নিজেদের হেফাজতে নিয়ে নেয় সিআইএ। শুরু হয় আবু জুবায়দার উপর অবর্ণনীয় নির্যাতন। মুখের উপর তোয়ালে চেপে ধরে পানি ঢালা (ওয়াটারবোর্ডিং), উচ্চস্বরে মিউজিক বাজিয়ে ঘুমোতে না দেওয়া (স্লিপ ডিপ্রাইভেশন), কফিনের মতো বক্সের ভেতর ভরে রাখা, শরীরের উপর পোকামাকড় ছেড়ে দেওয়া, হাত-পা শেকলে বেঁধে শূন্যে ঝুলিয়ে রাখাসহ মধ্যযুগীয় নির্যাতন পদ্ধতির কোনোটিই বাকি ছিল না। প্রথম দুই মাসের মধ্যেই সিআইএ আবু জুবায়দার উপর ওয়াটারবোর্ডিং প্রয়োগ করে অন্তত ৮৩ বার! কিন্তু এত নির্যাতনের পরেও তারা তার মুখ থেকে কাজে লাগানোর মতো আর একটা কথাও বের করতে পারেনি। যে কয়টা তথ্য দিয়েছিল, তাও ছিল মিথ্যা তথ্য, নির্যাতন থেকে বাঁচার জন্য দেওয়া।
বন্দীদের উপর নির্যাতন আমেরিকার আইনবিরুদ্ধ। কিন্তু ২০০১ সালের ৯/১১ এর সন্ত্রাসী হামলার পর সিআইএ এবং বুশ প্রশাসনের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা সেসব আইনকে কাঁচকলা দেখিয়ে সন্ত্রাসদমনের অজুহাতে নিজেরাই শুরু করে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস। দীর্ঘদিন পর্যন্ত তাদের এসব কার্যকলাপ গোপন থাকলেও ২০০৭ সালে নিউ ইয়র্ক টাইমস যখন প্রকাশ করে যে, সিআইএ বন্দীদের নির্যাতনের বেশ কিছু ভিডিও রেকর্ড নষ্ট করে ফেলেছে, তখন অনেকেই নড়েচড়ে বসে।
বিশেষ করে ব্যাপারটাকে গুরুত্বের সাথে নেয় সিনেট ইন্টেলিজেন্স কমিটি। কমিটির পক্ষ থেকে সাবেক এফবিআই অ্যানালিস্ট ড্যানিয়েল জে. জোন্সকে দায়িত্ব দেওয়া হয় বিষয়টার উপর তদন্ত করার, নষ্ট করে ফেলা ভিডিওগুলোতে কী ছিল, সিআইএর নথিপত্র ঘেঁটে সেটা বের করার। শুরু হয় ড্যানিয়েল জোন্সের একাকী যুদ্ধ। সিআইএসহ প্রতিটা প্রতিষ্ঠানের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে, প্রায় এক বছর পর্যন্ত দিনরাত খেটে তিনি এবং এবং তার ছোটো তদন্তকারী দল শেষপর্যন্ত রিপোর্ট পেশ করেন।
তার সেই রিপোর্টের পর কমিটি তাকে দায়িত্ব দেয় বৃহত্তর তদন্তের – শুধু ভিডিও নষ্টের না, পুরো টর্চার প্রোগ্রামের উপর তদন্তের। কবে থেকে শুরু হয়েছিল, কারা কারা এর পেছনে দায়ী ছিল, মোট কতজনকে টর্চার করা হয়েছে, টর্চারের ফলে আসলেই কোনো লাভ হয়েছে কিনা। যে তদন্তটার জন্য প্রথমে সময় নির্ধারণ করা হয়েছিল এক বছর, শেষপর্যন্ত সেটা গড়ায় প্রায় সাত বছরে। শেষপর্যন্ত যখন অ্যাডাম জোন্স তার কাজ শেষ করেন, ততদিনে তিনি এবং তার টিম গবেষণা করেছেন ৬.৩ মিলিয়ন পৃষ্ঠার গোপন সিআইএ ডকুমেন্ট। আর সেগুলোর উপর ভিত্তি করে যে রিপোর্টটি তিনি তৈরি করেছেন, তার পৃষ্ঠাসংখ্যা ছিল প্রায় ৭,০০০!
অ্যাডাম জোন্সের এই টর্চার রিপোর্ট তৈরির কাহিনী নিয়েই এ বছর মুক্তি পেয়েছে দ্য রিপোর্ট চলচ্চিত্রটি। সিনেমাটার চিত্রনাট্য বেশ সরল। এখানে খুব বেশি চরিত্র নেই। পুরো ঘটনা আবর্তিত হয়েছে মূল চরিত্র ড্যানিয়েল জোন্সকে ঘিরে। সেই সাথে মাঝে মাঝে দেখানো হয়েছে সিনেটর ডায়ানে ফাইস্টাইনের সাথে তার কথোপকথন। এই দুজনের বাইরে অধিকাংশ চরিত্রকেই দেখানো হয়েছে নাম-পরিচয় ছাড়াই। এর দুটো কারণ আছে। একটা হচ্ছে, ঐ চরিত্রগুলোর নাম প্রকাশের উপর থেকে এখনও নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়নি। আর দ্বিতীয় কারণটি হচ্ছে, বাস্তবেই এটা ছিল ‘ওয়ান ম্যান জব’। ড্যানিয়েল জোন্স বলতে গেলে একাই এই যুদ্ধ চালিয়ে গেছেন এবং শেষপর্যন্ত জয় ছিনিয়ে এনেছেন।
ছয় জনের যে ছোটো দলটি নিয়ে তার অনুসন্ধানের যাত্রা শুরু করেছিলেন, তাদের মধ্যে রিপাবলিকান দলের তিন জন কয়েকমাস পরেই নিজেদেরকে প্রত্যাহার করে নিয়েছিল। অন্য একজন পারিবারিক কারণে এই চাকরি ছেড়ে দিয়ে অন্য চাকরিতে যোগদান করেছিল। শেষপর্যন্ত রয়ে গিয়েছিলেন শুধু জোন্স আর তার এক সহকারী। বছরের পর বছর ধরে আমেরিকার প্রায় প্রতিটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের বিরাগভাজন হয়ে তারা তাদের তদন্ত কার্যক্রম চালিয়ে গেছেন। সিনেটর ফাইনস্টাইনের অনুপ্রেরণা ছাড়া তাদের সম্বল আর তেমন কিছুই ছিল না।
দ্য রিপোর্ট সিনেমাটা ড্যানিয়েল জোন্সের উপর নির্মিত হয়নি। এটা নির্মিত হয়েছে তার কাজের উপর, তার তৈরি রিপোর্টের উপর। তা সত্ত্বেও ড্যানিয়েল জোন্সের চরিত্রে অ্যাডাম ড্রাইভার চমৎকার অভিনয় করেছেন। গত বছর ব্ল্যাকক্ল্যানসম্যান চলচ্চিত্রের জন্য অস্কার নমিনেশন পাওয়া এই সিনেমার মধ্য দিয়েও তার অভিনয় প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। চার বার অস্কার নমিনেশন পাওয়া অভিনেত্রী অ্যানেট বেনিংও সিনেটর ফাইনস্টাইনের চরিত্রে নিজেকে চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন।
তবে এই সিনেমার মূল কৃতিত্বের দাবিদার অবশ্যই এর চিত্রনাট্যকার এবং পরিচালক, স্কট জি. বার্নস। ফিচার ফিল্ম হিসেবে এটাই বার্নসের প্রথম কাজ। কিন্তু চলচ্চিত্র জগতে তিনি পরিচিত নাম। বিশেষ করে দ্য বর্ন আল্টিমেটামের এবং নাম করা পরিচালক স্টিভেন সোডারবার্গ পরিচালিত চলচ্চিত্র সাইড ইফেক্টস, কন্টেজিয়ন এবং দ্য ইনফরম্যান্টের চিত্রনাট্যকার হিসেবে তিনি আগে থেকেই বিখ্যাত। স্টিভেন সোডারবার্গের সাথে দীর্ঘদিন কাজ করার সুবাদে তার প্রভাবও বার্নসের উপর পড়েছে বললে ভুল হবে না। অন্তত দ্য রিপোর্ট সিনেমার ফ্ল্যাশব্যাকের দৃশ্যগুলো দেখানোর স্টাইল দর্শকদেরকে সোডারবার্গের সাইড ইফেক্টস সিনেমার কথা মনে করিয়ে দিতে পারে।
সাইড ইফেক্টসের সাথে দ্য রিপোর্টের আরেকটা জায়গায়ও মিল আছে। সাইড ইফেক্টসের মতোই দ্য রিপোর্টেও সাইকিয়াট্রিস্টদের কথা গুরুত্বের সাথে উঠে এসেছে। সিআইএর টর্চার প্রোগ্রামের মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন দুজন মনোবিজ্ঞানী। তারাই প্রথমে দাবি করেছিলেন টর্চার সহ্য করার জন্য মার্কিন সেনাদেরকে যে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, সেটাকে রিভার্স ইঞ্জিনিয়ারিং করে তারা বন্দীদের উপর নির্যাতন করে তাদের মুখ থেকে গোপন তথ্য বের করে আনতে পারবেন। এবং এই টর্চার প্রোগ্রামের পুরোটাই পরিচালিত হয়েছিল তাদের পরিকল্পনা এবং তত্ত্বাবধানে।
স্কট জি. বার্নস যে তার প্রথম চলচ্চিত্র হিসেবে এই কাহিনীকে বেছে নিয়েছেন, তার পেছনেও এই সাইকিয়াট্রিস্টদের ভূমিকা আছে। এক সাক্ষাৎকারে বার্নস দাবি করেছেন, তার বাবা-মা দুজনেই ছিলেন সাইকিয়াট্রিস্ট। আর সে কারণেই এই দুই সাইকিয়াট্রিস্টের কাহিনীটা তাকে বেশি পীড়া দিয়েছিল এবং তাকে এ ব্যাপারে আগ্রহী হতে উদ্বুদ্ধ করেছিল।
দ্য রিপোর্ট সিনেমাটিকে এর বৈচিত্র্যহীন বর্ণনাভঙ্গির কারণে অনেকের কাছে একঘেয়ে এবং বৈচিত্র্যহীন বলে মনে হতে পারে। এ ধরনের অন্যান্য সিনেমার মতো এখানে মূল চরিত্রের পরিবারকে দেখানো হয়নি, তার কাজের চাপ তার পরিবারের উপর, পরিবারের সদস্যদের সাথে তার সম্পর্কের উপর কী ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে, সেটা তুলে ধরা হয়নি। পুরো সিনেমাটাই তার তদন্ত কার্যক্রমকে ঘিরেই আবর্তিত হয়েছে।
কাহিনীকারের এই সিদ্ধান্তকে প্রথমে অদ্ভুত বলে মনে হতে পারে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, তদন্ত চলাকালীন সময়ে আক্ষরিক অর্থেই ড্যানিয়েল জোন্সের সিনেমায় তুলে ধরার মতো কোনো পারিবারিক জীবন ছিল না। এই তদন্তই ছিল তার জীবন। দিন এবং রাতের কোনো পার্থক্য তার কাছে ছিল না। বছরের পর বছর ধরে তিনি কাজ করে গেছেন একা, উইকেন্ডের ছুটি এড়িয়ে, গভীর রাত পর্যন্ত। নাটকীয়তার জন্য তার পারিবারিক জীবনকে সিনেমায় তুলে ধরে হয়তো সেটাকে দর্শকদের কাছে আরো আকর্ষণীয় করে তোলা যেত, কিন্তু তাতে বাস্তবতা থেকে অনেকটা দূরে সরে যেতে হতো।
দ্য রিপোর্টের এই সাদামাটা উপস্থাপনের কারণে হয়তো সিনেমাটা খুব বেশি সংখ্যক দর্শককে আকর্ষণ করতে পারবে না, কিন্তু যারা দেখবে তাদের কাছে এর ম্যাসেজটা পরিষ্কারভাবেই ধরা পড়বে। নির্মাতারা যে জনপ্রিয়তার চেয়ে এর প্রামাণিকতাকেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন, সেটা বোঝা যায় সিনেমাতে যখন টুয়েন্টি ফোর অথবা জিরো ডার্রক থার্টির মতো মূলধারার টিভি সিরিজ ও চলচ্চিত্রকে সত্যকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করার জন্য মৃদু তিরস্কার করা হয়।
সিনেমাটি মুক্তির পর থেকে এ পর্যন্ত যতটুকু দেখা গেছে, এটা খুব একটা ব্যবসা সফল হবে না। সিনেমাতে টর্চার রিপোর্ট নিয়ে তদন্তের সময় ফাইনস্টাইন জোন্সকে বলেছিলেন, এটা বিশ্বকে পাল্টে দিতে পারবে কিনা, সেটা পরে দেখা যাবে। আপাতত তদন্তটা ঠিকভাবে শেষ করা দরকার। সিনেমাটা নির্মাণের সময় এর নির্মাতারাও কি এরকমই কিছু ভেবেছিলেন? এটা ব্যবসা সফল হবে কিনা, সেটা পরে দেখা যাবে, আপাতত এটা নির্মাণ করাটাই গুরুত্বপূর্ণ?
বই ও সিনেমা সম্পর্কিত চমৎকার সব রিভিউ আমাদের সাথে লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: https://roar.media/contribute/