বর্তমানে রাশিয়ার অন্যতম জনপ্রিয় চলচ্চিত্রকার আন্দ্রেই জাগিন্তসেভের সিনেমা জার্নির প্রথম পদক্ষেপ বলা হয় ‘দ্য রিটার্ন ‘কে। নির্মাতা হিসেবে আত্মপ্রকাশের শুরুর এ চলচ্চিত্রের গুরুত্ব একে অন্য সব ফিল্ম থেকে কিছুটা হলেও আলাদা করেছে। প্রথমত, স্পর্শকাতর প্লট, তার উপর নির্জন আইল্যান্ডের নীলাভ জলের মনোরম লোকেশন। এছাড়া, এতে ভিন্নধর্মী তিন বয়সের তিনজন মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কের চিত্তাকর্ষক চিত্রায়ণ আর সম্পর্কের সূক্ষ্ম বাঁধনের গল্প রয়েছে। যে গল্প লিখেছেন ভ্লাদিমির মইসেয়েঙ্কো এবং অ্যালেক্সান্দার নভোতস্কি। তাদের এ গল্প প্রত্যাবর্তনের, আবার এই গল্প প্রত্যাগমনের!
ভেনিস ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের গোল্ডেন লায়ন জয়ী ড্রামা ফিকশন ঘরানার ফিল্মটিতে কোনো টান টান উত্তেজনা পাওয়া যাবে না। দেখা যাবে না পুরোপুরি দুই সমকোণে ঘুরে যাওয়া লোভনীয় টুইস্ট। বরং এর কাহিনি তার নিজস্ব গতিপথে উদ্ভূত পরিস্থিতির সাথে তাল মিলিয়ে অগ্রসর হতে থাকে। সেখানে নেই জোরপূর্বক অহেতুক আরোপণের কোনো অপপ্রচেষ্টা। নেই অবিশ্বাস্য অতিরঞ্জন। বোধহয় এতেই যেকোনো গল্পের প্রকৃত সৌন্দর্য নিহিত থাকে। শুরুতে অবশ্য সামান্য চমক আছে। যে চমকের নামেই চলচ্চিত্রটির নামকরণ করা হয়েছে ‘প্রত্যাবর্তন’।
১২ বছর পর বাবা ফিরেছেন স্ত্রী ও দুই সন্তানের কাছে। এতদিন কোথায় ছিলেন, এত বছর পর কেন ফিরেছেন আর কোথা থেকে ফিরেছেন তার সবটাই অজানা আমাদের। এভাবে অজানার প্রতি কৌতূহল সৃষ্টি করে দেয়া গল্পের একটি শক্তিশালী দিক বলা যেতে পারে। যা সিনেমাকে একদম শেষ অবধি টেনে নিয়ে গেছে। বিপরীত স্বভাব ও আচরণের দুই ভাই এই ছবির গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রদ্বয়। মনোমালিন্য আন্দ্রেই আর ইভানের প্রাত্যহিক রুটিন। ইভান বয়সে ছোট, শারীরিক আকৃতিতে সামান্য বেঁটে আর প্রচণ্ড জেদি। অন্যদিকে আন্দ্রেই বয়ঃসন্ধি কাটিয়ে একটু একটু করে পরিপক্ব হতে শুরু করেছে কেবল। তবে ছোট ভাইকে খ্যাপানো ওর স্বভাবসুলভ আচরণ। নমুনাস্বরূপ পুরো ছবিতে প্রায়ই ওর থেকে ‘shorty’ আর ভীতু মুরগি সম্বোধন শোনা যায়। এসব কিছু নিয়ে ইভান কারণে অকারণে খিটখিটে থাকে।
শুরুতেই বলেছি এই বাবা চরিত্রটি বড় কৌতূহল উদ্দীপক। তার আচরণ আন্দ্রেই আর ইভানের মতো দর্শককেও দ্বিধায় ফেলে। কার্যত রহস্যগল্পেরও একটু আধটু ভিত তৈরি হয়। তবে সে রহস্য উন্মোচিত হবে কিনা তা কখনো মুখ্যতা পায় না। বরং মুখ্যতা পায় ত্রিমাত্রিক সম্পর্কের। বাবা লোকটি ছেলেদের চোখে প্রত্যাবর্তনের বিস্ময়। আন্দ্রেই এহেন প্রত্যাবর্তনে ইতিবাচক, ইভান নেতিবাচক। তাদের এই প্রারম্ভিক বদ্ধমূল ধারণা গল্পের প্রগাঢ়তাকে গল্পের পরিস্থিতিকে আরও দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর করে। তবে কমন একটি বিষয়- দুজনই তাদের বাবাকে ভীষণ ভয় পায়। সিনেমার একপর্যায়ে বাবা চায় এবার কিছুদিন ছেলেদের নিয়ে কোথাও ঘুরতে যেতে। একসাথে আনন্দঘন কিছু সময় কাটাতে। মা অনুমতি দিলে ওরাও রাজি হয় ভ্রমণসঙ্গী হতে। নির্মাতা বাবা এবং মায়ের মধ্যে তেমন বিশেষ কোনো কথোপকথন রাখেননি। ফলে এই প্রত্যাবর্তনে মায়ের অনুভূতি লেন্সে সবিশেষ ধরা পড়ে না।
মূলত চলচ্চিত্রের বাকি সময়টা জুড়েই তিনজনের ভ্রমণদৃশ্য আর বাবা-ছেলে সম্পর্কের বিমিশ্রিত স্বরূপ উন্মোচন। পাশাপাশি আন্দ্রেই জাগিন্তসেভের এই মুভি কিছু মুহূর্তকালের গল্পও। তিনজনের ভাগাভাগি করা মুহূর্ত, যেখানে সর্বেসর্বার ভূমিকায় বাবা। বাবার কঠোরতার মাঝেও বাবা ডাক শোনার এক আকুতি নির্মাতা দেখিয়েছেন। আন্দ্রেইয়ের চোখেমুখে দেখিয়েছেন বাবাকে ফিরে পাবার আনন্দ আর ইভানের চোখে দায়িত্বজ্ঞানহীন বাবার প্রতি পুষে রাখা দীর্ঘদিনের ক্ষোভ আর বিরক্তি। সময়ে সময়ে বাবার কঠোরতা ঈষৎ মাত্রা ছাড়িয়েছে সত্যি, তবে তা অর্থশূন্য মনে হয়নি।
বুদ্ধিদীপ্ততা চলচ্চিত্রটির ক্ষণে ক্ষণে ধরা দিয়েছে। কখনো সংলাপে, কখনো আবার আলো নিভিয়ে অন্ধকারে না ঘুমানো দুই ভাইয়ের মৃদুস্বরের আলাপনে। তেমনি সমুদ্র থেকে ধরা মাছ ছেড়ে দেয়ার আক্ষেপ দৃশ্য কিংবা রক্তাক্ত মুখে সাফল্যের হাসি তার জলজ্যান্ত উদাহরণ। খাবার প্লেট পরিষ্কারে বাধ্য করা, পর্যবেক্ষণ টাওয়ার থেকে পতন কিংবা মাঝ দরিয়ায় হঠাৎ পাথরের ধাক্কা এ সিনেমার দারুণ সব ভিজুয়্যালের প্রতিনিধিত্ব করে। মিউজিক আর সাউন্ড ইফেক্টেও পরিমিত আর পরিশীলনের পরিচয় আছে। সিনেমাটোগ্রাফি বেশ সুস্থির আর সময় নিয়ে চলচ্চিত্রের গতিকে একটি তৃপ্তিদায়ক শ্লথতা দিয়েছে, নিঃসন্দেহে প্রতিটি দৃশ্যায়নকে উপভোগের উদাত্ত আহবান জানিয়েছে। অভিনয়ের ক্ষেত্রে প্রধান এই তিন চরিত্র ছাড়া বাকি চরিত্রগুলোকে কোনো স্পেস দেয়া না হলেও, তা গল্পে অসহায়ক হয়ে দাঁড়ায় না। বরং স্ক্রিনটাইমে এই তিনটি চরিত্রের সাথে সহজে একাত্ম হওয়া গেছে। তাছাড়া সংলাপের সাবলীলতা আর সম্পর্কের গভীরতা কাহিনীর পুরোটা সময়ে প্রধান চালিকাশক্তি হিসেবে জ্বালানি সরবরাহ করে গেছে।
নির্মাতা তার ছবিতে পারিবারিক সম্পর্কের অনুভূতিকে একটি ভিন্ন আঙ্গিক থেকে একটি ভ্রমণ অভিজ্ঞতাকে আশ্রয় করে দেখিয়েছেন। নির্মাতার দেখানোর সামগ্রিক যে ট্রিটমেন্ট তা দর্শকদের জন্য অভিনব। চরিত্রত্রয়ের অভিনয় পারদর্শিতায় নিঃসন্দেহে ২০০৩ সালে রিলিজ হওয়া দ্য রিটার্ন রাশিয়ার চলচ্চিত্রের ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ ফিল্ম হয়ে উঠেছে। একইসাথে নির্মাতার সিনেমার জার্নি হয়েছে আরও সুগম, মসৃণ, এবং প্রসারিত।
চলচ্চিত্রটির শুরু রবিবার থেকে। আর শেষটা এসে হয় শনিবারে আন্দ্রেই এবং ইভানের প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়ে। শেষের সিকুয়েন্সে পুরো জার্নির স্থিরচিত্র প্রক্ষেপণের আইডিয়াটি চমকপ্রদ। প্রত্যাবর্তনের দ্বিত্বতার সাথে সাথে তাদের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ এই সাতদিন দর্শক হিসেবে সত্যিই ভীষণ মুগ্ধ করেছে।