মুম্বাইয়ের মতো সদাব্যস্ত একটা শহরে কি কেউ একদম একা হয়ে যেতে পারে? তাও এবার এই ইন্টারনেট, ফোন, ফেসবুকের যুগে। ২০১৭ সালে মুক্তি পাওয়া বলিউড সিনেমা ‘ট্র্যাপড’ দেখলে আপনার মনে হবে- হ্যাঁ, পারে।
শৌর্য (রাজকুমার রাও) একটি ট্র্যাভেল কোম্পানিতে চাকরি করে। প্রেমে পড়ে যায় তারই সহকর্মী নুরির (গীতাঞ্জলী) উপর। কিন্তু নুরির আরেক জায়গায় বিয়ে ঠিক হয়ে থাকে। নিজের এই প্রেমকে কিছুতেই হাতছাড়া করতে চায় না শৌর্য। এ কারণে নুরিকে নিয়ে নতুন এক ফ্ল্যাটে উঠবে বলে কথা দেয় সে। নুরিও রাজি হয়।
কথা দেয়া যতটা সোজা, সেই কথা কাজের বেলায় আসলে যে কতটা কঠিন, সেটা শৌর্য এরপরেই বুঝতে পারে। তার মতো চাকরি করা মানুষ রাতারাতি একটি ফ্ল্যাট কোথায় পাবে? কিন্তু ভাগ্য ভালো ছিল তার বলতে গেলে। সম্পূর্ণ অপরিচিত এক লোকের (পড়ুন দালালের) সাহায্যে খুব কম দামে ৩৫ তলা এক বিল্ডিংয়ে একটি ফ্ল্যাট পেয়ে যায় সে। এই বিল্ডিং এ আর কেউ থাকে না। সেই রাতেই সেখানে চলে যায় সে। পরদিন খুবই অদ্ভুতভাবে নিজের সেই ফ্ল্যাটে আটকে পড়ে সে। মারফিস ল’ অনুসারে- “whatever can go wrong, will go wrong”। এরপর থেকে একটার পর একটা দুর্ঘটনা ঘটতেই থাকে তার সাথে। আর এই ফ্ল্যাট থেকে বের হওয়া অনেকটাই অনিশ্চিত হয়ে পড়ে তার জন্য। শৌর্য কি পারবে এই বন্দীদশা থেকে মুক্তি পেতে?
একজন মানুষ একটি ফ্ল্যাটে আটকা পড়েছে আর সেখান থেকে সে কোনো না কোনোভাবে বের হবে, ‘ট্র্যাপড’ সিনেমার পুরোটাতেই শুধু এই গল্প- এমনটা যদি আপনি ভেবে থাকেন, তাহলে সম্ভবত সেটা ভুল হবে। সিনেমাটিতে অনেক লুকনো ব্যাপারস্যাপার আছে, যেটা একটু মনোযোগী দর্শকদের চোখে পড়বে সহজেই। যেমন- শৌর্য যখন নিজের রুমমেটদের ছেড়ে নতুন ফ্ল্যাটে আসতে নেয়, তখন নিজের রুমমেটদের সে বলে যে সে বাড়ি যাচ্ছে কিছুদিনের জন্য। তার রুমমেটদের সেই ব্যাপারে কোনো আগ্রহ থাকে না। তারা টিভিতে একটি প্রোগ্রাম দেখতে থাকে, যেটি প্রতিকূল পরিবেশে মানুষ কীভাবে বেঁচে থাকবে তার উপর ভিত্তি করে তৈরি। প্রোগ্রামটি WildTV নামের একটি চ্যানেলে দেখানো হচ্ছিল। সেই প্রোগ্রামের উপস্থাপক তখন বলে উঠেন- “Never give up. Adventure is not about what happens out there. It is about what happens in here. The brave survive. The weak, they die.”
খুবই অদ্ভুত ব্যাপার হলো, এ দুটি লাইন ‘ট্র্যাপড’ সিনেমার একদম সারাংশ! জীবনে যত কঠিন অবস্থাতেই আপনি পড়েন না কেন, কোনোভাবেই হাল ছেড়ে দেয়া যাবে না। শৌর্য হাল ছাড়েনি বলেই সে বাঁচতে পারে। এমনকি সিনেমাটির পোস্টারেও লেখা আছে- ‘Freedom lies beyond fear’।
‘ট্র্যাপড’ সিনেমাটি পুরোটা বিভিন্ন Irony-তে ভর্তি। Irony যদি খুবই সহজ বাংলায় বোঝাতে চাই, তাহলে এটা আসলে এমন একটা এক্সপ্রেশন যেটা দিয়ে যা বলা হবে বা যা দেখা যাবে, ঠিক তার উল্টো অর্থ প্রকাশ পাবে। উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা পরিষ্কার হবে। রাজকুমার রাও যে অ্যাপার্টমেন্টে আটকা পড়ে, সেই ফ্ল্যাটের নাম ছিল ‘স্বর্গ এপার্টমেন্ট’। খুবই অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে সেখানে সে মোটেও স্বর্গের মতো কোনো পরিবেশ পায়নি, উল্টো তার জীবন নরকে পরিণত হয়েছিল খাদ্য আর পানি ছাড়া। ইংরেজিতে একেই বলে Irony। রাজকুমার রাও যে চরিত্রে অভিনয় করেন, তার নাম ছিল শৌর্য, যার অর্থ সাহস। অথচ আমরা দেখতে পাই এ মানুষটি সামান্য একটা ইঁদুরকে কী পরিমাণ ভয় পায়! একদম উল্টো চিত্র যাকে বলে।
শৌর্য যখন নিজের অ্যাপার্টমেন্টে ঢোকে, তখন সেখানে রঙিন কাগজে Welcome লেখা থাকে। তবে এই স্বাগতম যে মোটেও ‘সু’ ছিল না, সেটা আমরা সিনেমাতে পরেই দেখতে পাই। সিনেমার একটি দৃশ্যে দেখা যায় যে, ক্ষুধায় কাতর শৌর্য তার সাথে আনা বিস্কুটের প্যাকেটের অবশিষ্ট বিস্কুটগুলোও খেয়ে ফেলে। সেই বিস্কুট কোন কোম্পানির ছিল সেটা খেয়াল করেছেন কি? সেটা ছিল Good Day কোম্পানির বিস্কুট। অথচ শৌর্যের Day মোটেও Good যাচ্ছিল না, বরং আতঙ্কে যাচ্ছিল। পুরো সিনেমার অনেক অংশেই রয়েছে এরকম Irony।
সিনেমার একটি চমৎকার দৃশ্য হচ্ছে, শৌর্য নিজের এপার্টমেন্টে একটি তেলাপোকা আবিষ্কার করে যেটি উল্টো অবস্থায় শুয়ে ছিল। কিন্তু তেলাপোকাটি বারবার নিজেকে সোজা করার চেষ্টা করছিল। শৌর্য অনেকক্ষণ তেলাপোকাটিকে দেখার পর যখন তাকে সোজা করার জন্য নিজের হাত বাড়াতে নিল, ঠিক তখনই কীভাবে যেন তেলাপোকাটি সোজা হয়ে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে যায়। এই ঘটনাটি অনেকটা আমাদেরকে ছোটবেলা থেকে শুনে আসা সেই রবার্ট ব্রুস আর মাকড়শার কথা মনে করিয়ে দেয়। মাকড়শার বারবার ব্যর্থ হয়ে উপরে ওঠার চেষ্টা যেমন রবার্ট ব্রুসকে অনুপ্রেরণা দিয়েছিল, ঠিক তেমনি উল্টো তেলাপোকার সোজা হওয়াটা শৌর্যকে বেশ অনুপ্রেরণা দেয় যে, ‘এই তেলাপোকা যদি নিজে সোজা হতে পারে, তাহলে আমার পক্ষেও সম্ভব নিজে এখান থেকে বের হওয়া’। বেশ কিছুদিন পর দেখা যায় তেলাপোকাটি মরে গেছে। তেলাপোকার এই অবস্থা দেখে সম্ভবত শৌর্য সিদ্ধান্ত নেয়, আর যা-ই হোক, আমার এখানে মরে যাওয়া চলবে না, আমার এখান থেকে বের হতে হবে।
না খেতে খেতে শৌর্য বেশ শুকিয়ে যায়। খালি গায়ে শুধু প্যান্ট পরে ঘুরে বেড়ায় সে। চেষ্টা করতে করতে অনেকবারই ক্লান্ত হয়ে যায়। একটা সময়ে বারান্দায় শুয়ে থাকে সে। সেসময় তার শরীরের করুণ অবস্থা দেখা যায়। এতটাই শুকিয়ে গেছে সে যে, তার আন্ডারওয়্যার পর্যন্ত দেখা যায় প্যান্টের উপরের অংশে! খুব ভালো করে খেয়াল করলে দেখতে পাবেন- আন্ডারওয়্যারটি ZOIRO ব্র্যান্ডের তৈরি। এটি একটি ইটালিয়ান ব্র্যান্ড যারা পুরুষের অন্তর্বাস তৈরি করে। মজার ব্যাপার হলো zoiro শব্দটি এসেছে zero শব্দ থেকে। আর দুটি শব্দের অর্থই এক অর্থাৎ- শূন্য। যে দৃশ্যের কথা বলা হচ্ছিল, সেখানে শৌর্যের এই বন্দিদশা থেকে বের হওয়ার আশা ভরসার পরিমাণও শূন্য ছিল। বারবার বের হওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হতে হতে তার চোখে ছিল শুধু শূন্য দৃষ্টি!
শহর জিনিসটার কথা বললেই আমাদের চোখে ভেসে উঠে চাকচিক্য আর মায়া। আমরা যেমন ঢাকা শহরকে স্বপ্নের শহর বলি, মুম্বাইও ঠিক তেমনি একটি স্বপ্নের শহর। কিন্তু সেটাই এই শহরের একমাত্র রূপ নয়। এই শহরের আরেকটি কদর্য রুপ আছে যেটা ‘ট্র্যাপড’ সিনেমাতে দেখানো হয়েছে। এখানে সবাই ব্যস্ত, কেউ আপনার দিকে খেয়াল রাখবে না। আপনার চিৎকার কারো কানে যাবে না, আপনি শৌর্যের মতো “ওয়াচম্যান, ওয়াচম্যান” বলে যতই চিৎকার করুন না কেন, সবাই নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত। এমনকি নিজের রক্ত দিয়ে HELP লিখে কাগজ ছুঁড়ে ফেললেও সেটা দেখে সাহায্য করতে আসা মানুষটা ভয় পায় যে সাহায্য করতে এসে তার নিজের কোনো ক্ষতি হবে না তো? এমনই অদ্ভুত এক যান্ত্রিক জীবন বানিয়েছি আমরা, যেখানে মানবতা শৌর্যের মতোই বন্দি।
মুশকিল অবস্থায় পড়লে মানুষের স্বভাব কিভাবে পরিবর্তন হয়ে যায়, সেটাও দারুণভাবে দেখানো হয়েছে এ সিনেমাতে। যে মানুষটা ইঁদুরের ভয়ে কাঁপতে থাকে, সেই মানুষটাই একা ফ্ল্যাটে তার একমাত্র কথা বলার বন্ধু বানায় সেই ইঁদুরটাকে। যে মানুষটা কঠোরভাবে নিরামিষাশী, এমনকি নুরির আথে রেস্টুরেন্টে খাবার খেতে গেলেও, সেই মানুষটাই নিজের জীবন বাঁচাতে পাখির মাংস খায়। নিরামিষাশী শৌর্যের পাখি মারার আর খাওয়ার দৃশ্য দেখলে অদ্ভুত একটা অনুভূতি হয়, যেটা আসলে ভাষায় প্রকাশ করাটা কঠিন।
‘ট্র্যাপড’ সিনেমাটি একাকীত্বের কথা বলে, আমাদের মানসিক বন্দিত্বের কথা বলে। প্রযুক্তির উপর আমরা যে কতটা ভয়াবহভাবে বন্দি হয়ে পড়ছি, সেটাও চোখে আঙুল দিয়ে দেখায় এ সিনেমা। শৌর্য যখন মুক্ত হয়ে নিজের অফিসে ফিরে আসে, তখন দেখা যায় কারো কোনো বিকার নেই। কেও খেয়ালই করেনি যে একটা মানুষ এতদিন ধরে অফিসে নেই, সবাই তখনও কম্পিউটারে যার যার কাজে বন্দি!
সিনেমাটির শেষ দৃশ্যটা খুবই অসাধারণ আর গুরুত্বপূর্ণ। শৌর্য সেই ফ্ল্যাটে আবার আসে যেখানে সে আটকে পড়েছিল। হয়ত নিজেকে প্রবোধ দিতে যে- “হ্যাঁ, আমি এরকম একটি জায়গা থেকে মুক্ত হয়েছিলাম। আমি বন্দি না।” কিন্তু আসলেই কি তাই? একদম শেষ দৃশ্যে জানালার গ্রিলের প্রতিবিম্ব শৌর্যের মুখে পড়ে, আর ক্লোজ শটে সেটাকে যেভাবে দেখানো হয়, তাতে মনে হয় শৌর্য আসলে বন্দি! শৌর্য নাগরিক জীবনের আমাদের প্রত্যেকটি নাগরিকের প্রতিনিধিত্ব করে। আমরা প্রত্যেকেই কোনো না কোনোভাবে বন্দি, যতই নিজেকে স্বাধীন মনে করি না কেন আমরা।
পরিচালক বিক্রমাদিত্য আর রাজকুমার রাও এর অসাধারণ কাজের জন্য অনেকদিন এই সিনেমাটি যে কারো মনে গেঁথে থাকবে। এছাড়া টানা ২০ দিন শুধু কফি আর গাজর খেয়ে যে ডেডিকেশন রাজকুমার রাও এই সিনেমার জন্য দেখিয়েছেন, সেটার জন্য তার প্রতি মন থেকে একটা আলাদা শ্রদ্ধা চলে আসে।