২০১৫ সালে বাংলাদেশের বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল দীপ্ত টিভিতে প্রচার শুরু হয় বিশ্বখ্যাত তুর্কি সিরিজ ‘মুহতেশেম ইউযিয়েল’ এর বাংলা ডাবকৃত সংস্করণ ‘সুলতান সুলেমান’। ঐতিহাসিক কাহিনীর উপর ভিত্তি করে নির্মিত সিরিজটি প্রচার শুরুর পর থেকেই দারুণ সাড়া জাগায়। লোকের মুখে মুখে ফিরতে থাকে ‘সুলতান সুলেমান’-এর নাম। এতটাই জনপ্রিয়তা পায় সিরিজটি যে একই নামের বইও প্রকাশ করতে থাকে দেশসেরা প্রকাশনীগুলো।
এভাবেই সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশি পপ-কালচারের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে ‘সুলতান সুলেমান’। তবে শুধু এই একটি সিরিজই নয়, এর পথ ধরে বাংলাদেশি টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে প্রচার শুরু হয় বিশ্ব কাঁপানো আরও একাধিক তুর্কি সিরিজ। সব মিলিয়ে বাংলাদেশি রুচিশীল দর্শকের কাছে এখন প্রিয় টেলিভিশন অনুষ্ঠানসমূহের অন্যতম তুর্কি সিরিজগুলো।
‘সুলতান সুলেমান’ তো ছিল পিরিয়ডিকাল ফিকশন। কিন্তু এরপর বাংলাদেশে এসেছে তুর্কি চমৎকার কিছু সমসাময়িক প্রেক্ষাপটের সিরিজও। সেসব সিরিজের তালিকায় একদম প্রথম সারিতেই থাকবে যে নামটি, তা হলো ‘মারিয়া’। ২০১৯ সালের মার্চ থেকে সিরিজটির প্রচার শুরু হয় দীপ্ত টিভিতে, এবং বর্তমানে সেটি এক্সক্লুসিভলি পাওয়া যাচ্ছে দেশের শীর্ষ অনলাইন ভিডিও স্ট্রিমিং সার্ভিস বায়োস্কোপেও।
‘মারিয়া’ সিরিজের কেন্দ্রীয় চরিত্রে রয়েছে মারিয়া, এক অনিন্দ্য সুন্দরী তরুণী, যে কাজ করে একজন ওয়েটার হিসেবে। মা এবং সৎ বাবা ও বোনের সাথে থাকে সে। সেই স্কুলজীবন থেকেই তার প্রেম বাবা-মা হারা আরমানের সাথে। প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর তারা দুজনেই এখন বিয়ের স্বপ্নে বিভোর। তাদের বিয়েতে প্রাথমিকভাবে বাধা হয়ে দাঁড়ায় মারিয়ার সৎ বাবা। যদিও মারিয়ার মায়ের দৃঢ়তায় বিয়ে একপ্রকার পাকাই হয়ে যায়।
কিন্তু ঠিক এমন সময়ই তাদের দুজনের ভালোবাসায় কুদৃষ্টি পড়ে ধনী ব্যবসায়ী হাসান চৌধুরীর। মানসিক ভারসাম্যহীন হাসান ইতঃপূর্বে নিজ হাতে খুন করেছে তার স্ত্রী নাজকে। এরপর হঠাৎ একদিন রাস্তায় মারিয়ার দর্শন পেয়েই তার মনে হয়, অবিকল নাজের মতো দেখতে এই মেয়েটি বুঝি আসলেই নাজ, যে ফিরে এসেছে তার কাছে! ফলে মানসিকভাবে আরো অস্থির হয়ে ওঠে সে, শুরু করে উন্মাদের মতো আচরণ। এবং এক পর্যায়ে সে আবিষ্কার পারে, মারিয়া আসলে তাদের কোম্পানিতেই কাজ করে। তখন থেকে মারিয়ার ঘনিষ্ঠ হওয়ার পাঁয়তারা শুরু করে সে, এবং কৌশলে মারিয়াকে বিয়ে করে আরমানের কাছ থেকে ছিনিয়েও নেয়।
নিজের জীবনের সবচেয়ে প্রিয় মানুষটি, যার জন্য সে সমুদ্রের তলদেশ থেকে ব্ল্যাক পার্ল পর্যন্ত উদ্ধার করেছিল, সেই মারিয়াকে হারিয়ে চরম অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ে আরমান। সে যখন একেবারে দিশেহারা, জীবনে কী করবে ভেবে পাচ্ছে না, ঠিক তখনই দেবদূতের মতো তার জীবনে প্রবেশ ঘটে মাফিয়া ডন আজিজ খানের, যে কিনা হাসানের প্রাক্তন স্ত্রী নাজের বড় ভাই। তার সহায়তায় ঘুরে দাঁড়ায় আরমান। শুরু হয় তার হারানো ভালোবাসা পুনরুদ্ধারের লড়াই। এদিকে হাসানও তো সহজে হার মানার পাত্র নয়। তাহলে ভালোবাসার মানুষ মারিয়াকে জয়ের এই যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত জিতবে কে? জয় হবে সত্যিকারের ভালোবাসার, নাকি ছলনা ও প্রতারণার?
প্রেম-ভালোবাসা, দ্বন্দ্ব-সংঘাতের এমন টানটান উত্তেজনাময় কাহিনীর সূত্র ধরেই এগিয়ে গেছে ‘মারিয়া’ সিরিজটি। এখানে একটি বিষয় জানিয়ে রাখা প্রয়োজন, তুর্কি ভাষায় মূল সিরিজটির নাম কিন্তু ছিল ‘সিয়াহ ইনচি’, যেটি তুরস্কের স্টার টিভিতে প্রচারিত হয় ২০১৭-১৮ সালে। এছাড়া সিরিজের চরিত্রগুলোর নামও বাংলাদেশে প্রচারের সময় পরিবর্তন করা হয়েছে।
অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগতে পারে, কেন এই পরিবর্তন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এটি নিয়ে নিয়মিত আলোচনা-সমালোচনাও হয়। অবশ্যই এ কথা সত্য যে অনেক দর্শকই চায় বাংলা ভাষাতেও চরিত্রদের মূল নামটিই শুনতে। তবে এমন দর্শকের সংখ্যাই আসলে বেশি, যারা তুলনামূলক অপরিচিত ও বিদেশি নামের চেয়ে চরিত্রদের পরিচিত ও সহজ নামের সাথে বেশি একাত্মতা অনুভব করতে পারে। মূলত তাদের কথা মাথায় রেখেই বাংলা ডাবিং নির্মাতাদের এই সিদ্ধান্ত, যা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার।
সিরিজটি রচনা করেছেন বাসাক আনগিগুন, আলফান দিকমেন ও দুইগু তানকাস। আর পরিচালনায় সেম কারসি, এরল ওজলেভি ও বেনাল তাহিরি। তাদের অনবদ্য নির্মাণকে সঠিক ভাব ও আবহের সমন্বয়ে বাংলা ভাষায় প্রাণবন্তভাবে তুলে ধরার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় অবদান বাংলাদেশের টেলিভিশন, চলচ্চিত্র এবং থিয়েটারের প্রায় ২০ জন অভিনয়শিল্পীর, যারা বিভিন্ন চরিত্রের ভূমিকায় কণ্ঠ দিয়েছেন। শোএসআরকে’র প্রযোজনায় গোটা সিরিজটির ডাবিংয়ের কাজই সম্পন্ন হয়েছে বাংলাদেশে।
এই সিরিজের মুখ্য তিন চরিত্রে অভিনয় করেছেন হান্ডে আর্সেল (মারিয়া), তোলগাহান সাইসম্যান (আরমান) এবং বার্ক হাকম্যান (হাসান)। তবে বাংলাদেশের দর্শকদের কাছে সবচেয়ে বড় আকর্ষণ অবশ্যই হান্ডে আর্সেল। কেননা একে তো তিনি বর্তমানে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ সুন্দরীদের একজন, যার হাসি ছেলেবুড়ো সকলের হৃদয়ে ঝড় তুলতে যথেষ্ট, পাশাপাশি বাংলাদেশি দর্শকদের কাছে তিনি অতি পরিচিত মুখও বটে।
কেন? কারণ এর আগেও জনপ্রিয় ধারাবাহিক ‘আস্ক লাফতান আনলামাজ’ এর কল্যাণে ‘হায়াত’ নামে বাংলাদেশসহ এই উপমহাদেশে বেশ পরিচিতি পান তিনি। ওই সিরিজের নানা টুকরো দৃশ্য এখনো ঘুরে বেড়ায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে। মিস সিভিলিস্টেশন অব দ্য ওর্য়াল্ড ২০১২ বিজয়ী আর্সেল এখন চুটিয়ে কাজ করছেন অভিনেত্রী ও মডেল হিসেবে। ইতোমধ্যেই তার অভিজ্ঞতার ঝুলিতে জমা হয়েছে উল্লিখিত দুইটি ছাড়াও ‘কালিকুসু’, ‘হায়াত আগাছি’, ‘গুনেসিন কিজলারি’-র মতো দর্শকপ্রিয় সব সিরিজ।
‘মারিয়া’ সিরিজে ২৬ বছর বয়সী এই অভিনেত্রীর বিপরীতে আরমান চরিত্রে অভিনয় করা তোলগাহান সাইসম্যানও দারুণ সুদর্শন, সুপুরুষ। তাই আর্সেলের সাথে তাকে মানিয়েছে বেশ, এবং তাদের রসায়নটাও দর্শকের কাছে খুবই উপভোগ্য মনে হয়েছে। এই সিরিজের শুরুতে মারিয়া-আরমানের স্বপ্নের মতো প্রেমটা যখন ষড়যন্ত্র ও বিশ্বাসঘাতকতার জালে জড়িয়ে গতি হারায়, তখন যেকোনো দর্শকের মনেই তাদের জন্য গভীর সহানুভূতির জন্ম হয়। শেষপর্যন্ত এই প্রেমিক-প্রেমিকা যুগল একে অপরের কাছে ফিরতে পারে কি না, তা জানার জন্যও মনে জাগে অদম্য কৌতূহল।
সে কারণেই, একবার যারা দেখা শুরু করবেন সিরিজটি, শেষ পর্যন্ত না দেখা অবধি মন ভরবে না। অর্থাৎ যাকে বলে সত্যিকারের বিঞ্জ ওয়ার্দি, ঠিক তা-ই যেন ১২০ পর্বের এই সিরিজটি, যার প্রতিটি পর্ব প্রায় ২০ মিনিট করে। ইতোমধ্যেই ১০০টি পর্ব দেখা যাচ্ছে বায়োস্কোপে। বাকি ২০টি পর্বও চলে আসবে খুব শীঘ্রই। সুতরাং এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে বাংলা ভাষায় বিঞ্জ করার মতো ভালো সিরিজের সন্ধানে রয়েছেন যারা, তাদের জন্য সম্ভাব্য সেরা পছন্দ হতে পারে ‘মারিয়া’। তাই আর দেরি না করে, এখনই বায়োস্কোপে প্রাইম প্যাক নিয়ে দেখা শুরু করে দিতে পারেন দারুণ এই সিরিজিটি!