বিশ শতকের প্রথমদিকের কথা, অটোমোবাইল ইন্ডাস্ট্রি তখন হাঁটি হাঁটি পা পা করে এগোচ্ছে মাত্র। ব্যক্তিগত গাড়ি তখনো কেবল যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চবিত্ত সমাজের বিলাসিতার উপকরণ। উচ্চমূল্যের কারণে গাড়ি মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে। এ সময় ফোর্ড মোটর কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা হেনরি ফোর্ড সিদ্ধান্ত নিলেন, তিনি গণমানুষের জন্য গাড়ি তৈরি করবেন। নিরাপদ ও দক্ষ গাড়ির ক্রয়মূল্য মধ্যবিত্তের নাগালের মধ্যে নিয়ে আসার স্বপ্ন দেখেছিলেন তিনি।
এটা সহজেই বোঝা যায়, এজন্য ফোর্ডের উৎপাদন খরচ অনেক কমিয়ে আনতে হবে। সে উদ্দেশ্যেই ১৯০৮ সালের দিকে ফোর্ডের একটি নতুন মডেলের গাড়ি ডিজাইন করা হয়। Model T নামক এ ডিজাইনটি ছিল অনেকটা সরল ও বেশ দক্ষভাবে বানানো, সবচেয়ে বড় কথা, এটি ছিল অনেক সাশ্রয়ী। তবে এটিও যথেষ্ট ছিল না, মধ্যবিত্তের নাগালে আনতে হলে এর উৎপাদন খরচকে আরো কমানোর দরকার ছিল। ফোর্ড বুঝতে পারলেন, যেহেতু পণ্যকে সাশ্রয়ী করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হয়ে গেছে, তাই এবার উৎপাদনের প্রক্রিয়াকে সাশ্রয়ী করার দিকে মনোযোগ দিতে হবে।
উৎপাদন প্রক্রিয়াকে আরো কার্যকরী করে তুলতে হবে, যাতে কম সময়ে আরো বেশি গাড়ি উৎপাদন সম্ভব হয়। এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য তিনি বিভিন্ন ক্ষেত্র থেকে বিশেষজ্ঞ সকল ব্যক্তিকে এনে হাজির করলেন। বিস্তর পর্যবেক্ষণ, গবেষণা ও আলোচনার পর তারা নতুন এক প্রক্রিয়ার উদ্ভাবন করলেন। পার্টস তৈরির পর এগুলো একসাথে জুড়ে দিয়ে একটি সম্পূর্ণ গাড়ি তৈরির যে প্রক্রিয়াটি সেটিকে নতুন করে সাজান তারা।
ফোর্ডের এর আগের গাড়িগুলো জোড়ার ক্ষেত্রে কর্মীরা প্রথমে এর যন্ত্রাংশগুলোকে সারিবদ্ধভাবে মেঝেতে রাখতেন। এরপর একটি একটি করে জুড়তেন। ‘অ্যাসেম্বলি লাইন’ নামক নতুন প্রক্রিয়ায় তারা চলমান বেল্ট ব্যবহার শুরু করলেন। একজন কর্মীকে কেবল একটি কাজ করারই প্রশিক্ষণ দেয়া হলো। বেল্টে করে অসম্পূর্ণ গাড়ি আসতো তার সামনে, আর ওদিকে মেশিনের মাধ্যমে চলে আসতো অংশটি। তখন তিনি সেটি জুড়ে দিতেন। এরপর সেটি চলে যেত সামনে অন্য একজনের কাছে, আর আগেরজনের কাছে আসতো নতুন আরেকটি গাড়ি। সেখানেও তিনি একই কাজ করতেন।
এই সরল প্রক্রিয়াটি উৎপাদন সময়ের ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নতি নিয়ে আসে। আগে একটি গাড়ি তৈরি করতে যেখানে সময় লাগতো গড়ে প্রায় বারো ঘন্টা, এক্ষেত্রে সে সময় নেমে আসে তিন ঘন্টারও কমে। ফলে ‘মডেল টি’র উৎপাদন খরচও ব্যাপকভাবে কমে আসে। ফোর্ড সফল হন তার স্বপ্ন পূরণের ক্ষেত্রে। ‘মডেল টি’ হয়ে ওঠে সর্বপ্রথম জনগণের গাড়ি। ফোর্ডের এ সফলতার ফলে বিভিন্ন ইন্ডাস্ট্রিতে অ্যাসেম্বলি লাইন প্রক্রিয়া ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। কিন্তু কেউই হয়তো ভাবতে পারেনি, কোনো একদিন হাসপাতালেও এর প্রয়োগ হতে পারে, সার্জারির ক্ষেত্রে। অসম্ভব এ কল্পনাটিই সম্ভব করেছেন ডা. দেবী শেঠী। তার সেই অনন্য উদ্ভাবনের কথাই বলা হবে আজকের লেখায়।
ডা. শেঠী ভারতের বিখ্যাত কার্ডিয়াক সার্জন, নব্বইয়ের দশকে তিনি মাদার তেরেসার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ছিলেন। পরবর্তীতে কলকাতার বিরলা হার্ট ফাউন্ডেশনে যোগ দেন। এখানে কাজ করার সময় নিয়মিত তিনি প্রচুর হৃদরোগী দেখতে পেতেন, যাদের অধিকাংশেরই অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হতো। কিন্তু তিনি অবাক হয়ে লক্ষ্য করলেন, এ রোগীদের অধিকাংশই পরে অস্ত্রোপচারের জন্য আর ফিরে আসতেন না।
বিষয়টি ডা. শেঠীকে চিন্তিত করে তুললো। তিনি বুঝতে পারলেন, এর কারণ হার্ট সার্জারির ব্যয়বহুলতা, সেসময়ের মূল্যে যা ছিল প্রায় দেড় লাখ রুপি। ভারত এমন একটি দেশ ,যেখানে মাত্র পাঁচ শতাংশ জনগনের হেলথ ইন্স্যুরেন্স রয়েছে। সকল স্বাস্থ্যসেবার প্রায় দুই-তৃতীয়াংশই আসে সরাসরি রোগীর পকেট থেকে। এর চেয়েও খারাপ খবর হলো চিকিৎসা ব্যয় বহনের জন্য জনগণের এক বড় অংশকে হয় টাকা ধার নিতে হয়, অথবা বিক্রি করতে হয় তাদের সম্পত্তি।
এমন অবস্থায় অধিকাংশ মানুষই যে ব্যয়বহুল চিকিৎসাকে এড়িয়ে যেতে চাইবে সেটাই স্বাভাবিক। এ কারণেই ভারতে প্রতি বছর যেখানে গড়ে ২০ লক্ষ সার্জারির প্রয়োজন হতো, সেখানে সার্জারি হতো মাত্র ১ লক্ষ ২০ হাজার। ডা. শেঠী বুঝলেন, অবস্থার উন্নতি করতে হলে সার্জারির খরচ কমানোর কোনো বিকল্প নেই। তাকেও এমন কোনো প্রক্রিয়ার উদ্ভাবন করতে হবে, যাতে হেনরি ফোর্ডের গণমানুষের জন্য গাড়ির মতো গণমানুষের জন্য অস্ত্রোপচারও সম্ভব হয়। আর অবশ্যই এক্ষেত্রে মানের বিষয়ে কোনো আপস করা চলবে না।
শেঠী আরেকটি বিষয়ের প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করলেন, তা হলো একটি আদর্শ ব্যাবসার মডেল। কারণ তিনি জানতেন, দানশীলতার মাধ্যমে যত মানুষের সাহায্য করা সম্ভব, তার চেয়ে অনেক বেশি মানুষের সাহায্য করা সম্ভব একটি আদর্শ প্রক্রিয়ার ব্যবসার মাধ্যমে। এছাড়া ব্যবসার পরিধি ধীরে ধীরে বাড়বে, দানশীলতার নয়। এ উদ্দেশ্যেই তিনি ২০০১ সালে ব্যাঙ্গালুরুতে ‘নারায়না হেলথ’ (NH) প্রতিষ্ঠা করেন। একটি ২২৫ শয্যার হাসপাতাল হিসেবে যাত্রা শুরু করা নারায়না হেলথ এখন ২৩টি হাসপাতাল, ৭টি হার্ট সেন্টার ও ১৯টি প্রাথমিক সেবা কেন্দ্রের এক বিশাল নেটওয়ার্ক, রয়েছে ছয় হাজারেরও অধিক শয্যা।
এ পর্যন্ত নারায়না হাসপাতালে লক্ষাধিক অস্ত্রোপচার হয়েছে, যার মধ্যে প্রায় অর্ধেক রোগীই ছিল দরিদ্র শ্রেণীর, যাদের কেউ স্বল্পমূল্যে, কেউ বিনামূল্যে চিকিৎসা পেয়েছেন। প্রতিনিয়ত সেখানে বাড়ছে রোগীর সংখ্যা। নারায়না হাসপাতাল এটি সম্ভবপর করেছে সার্জারির ব্যয় কমানোর মাধ্যমে। দেড় লাখ থেকে এ খরচ তারা কমিয়ে এনেছেন নব্বই হাজার রুপিতে। ডলারের হিসেবে যা মাত্র ১৫০০ ডলার, যেখানে এ ব্যয় যুক্তরাষ্ট্রে ১,৪৪,০০০, মেক্সিকোতে ২৭,০০০ ও কলাম্বিয়ায় ১৪,৮০০ ডলার।
সার্জারির ব্যয়ের ক্ষেত্রে যে লক্ষণীয় পার্থক্য এসেছে এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু তারা এতটা ব্যয় কীভাবে সাশ্রয় করলেন? এই প্রশ্নের উত্তর হলো অ্যাসেম্বলি লাইন প্রক্রিয়া। ফোর্ডের মডেল টি’র উৎপাদন প্রক্রিয়াই ডা. শেঠী প্রয়োগ করেছেন সার্জারির ক্ষেত্রে। আপনি যদি এখন তাদের কোনো একটি অপারেশনাল থিয়েটারে যান, তাহলে হয়তো দেখবেন প্রথম কক্ষে একজন রোগীকে অস্ত্রোপচারের পর সেলাই করা হচ্ছে, পাশের কক্ষে গিয়ে হয়তো দেখবেন অন্য একজনকে প্রস্তুত করা হচ্ছে অস্ত্রোপচারের জন্য। এভাবে প্রতি মুহূর্তে প্রায় পাঁচজন রোগীর অপারেশন করা হয় একইসাথে। একজন ডাক্তার বা নার্স একই কাজ করে থাকেন সকল রোগীর ক্ষেত্রে।
ডা. শেঠীর এ প্রক্রিয়ার লক্ষ্য হচ্ছে সময় সংক্ষেপ করা। বিশেষজ্ঞ সার্জনের সংখ্যা যেহেতু সীমিত, তাই তার সময়ের যথাযথ ব্যবহার প্রয়োজন। সাধারণত যা হয়, একজন বিশেষজ্ঞ সার্জন ও অন্য সকল ডাক্তার নার্সরা উপস্থিত থেকে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত কাজ সম্পন্ন করেন। কিন্তু এসব কাজের অনেকগুলো অংশ অন্যান্য ডাক্তার বা নার্সরাই করতে পারেন, সার্জনের পুরোটা সময় এক্ষেত্রে ব্যয় করার কোনো প্রয়োজন নেই। ডা. শেঠী তাই এ প্রক্রিয়া শুরু করলেন, অন্যান্য ডাক্তার নার্সরা একজন রোগীকে সার্জারির জন্য সম্পূর্ণ তৈরি করে রাখেন, এরপর তিনি এসে কেবল মূল কাজটি করেন। তার কাজ শেষ হতে হতে আবার অন্য একজন রোগী প্রস্তুত হয়ে পড়ে, আর এ রোগীকে নিয়ে যাওয়া হয় অস্ত্রোপচার পরবর্তী কাজের জন্য।
এ প্রক্রিয়ায় সময় কতটা সাশ্রয় হয় তা একটি তথ্য দিলেই বোঝা যাবে। যেখানে অন্যান্য হাসপাতালগুলোতে প্রতিদিন গড়ে মাত্র চার-পাঁচটি অস্ত্রোপচার করা হয়, সেখানে দেবী শেঠীর হাসপাতালে এ সংখ্যা ত্রিশেরও অধিক। এ সময়ের সাশ্রয়ই অস্ত্রোপচারের ব্যয় কমিয়ে আনে। এছাড়া এতে অন্য একটি সুবিধাও আছে। যেহেতু একজন নার্স ও ডাক্তার কেবল একটি কাজই করেন, তাই তারা ঐ বিষয়ে যথেষ্ট দক্ষ ও অভিজ্ঞ হয়ে ওঠেন। কোনো সমস্যা হলে তারা বেশ দ্রুতই তা টের পান।
এছাড়া নারায়না হাসপাতাল থেকে কখনো কাউকে আর্থিক অস্বচ্ছলতার কারণে ফিরে যেতে হয় না। তারা অনেক দরিদ্র মানুষকেই স্বল্পমূল্যে সেবা প্রদান করে থাকেন। তবে এটি কোনো দান হিসেবে করেন না তারা। এ ব্যয় বহন করতে তারা ‘ভর্তুকি মডেল’ অনুসরণ করেন। ধনী ব্যক্তিরা দরিদ্রদের জন্য ভর্তুকি দেন, ধনীরা এজন্যে হয়তো বিলাসবহুল কক্ষ কিংবা এ ধরনের অতিরিক্ত কিছু সুবিধা পান। কিন্তু মূল চিকিৎসার মান সকলের জন্যই বিশ্বমানের।
বহনযোগ্য খরচে এ চিকিৎসা অসংখ্য মানুষের জন্য আশীর্বাদ হয়ে এসেছে। এই যে জটিল সব রোগের চিকিৎসা আবিষ্কৃত হচ্ছে, এতে কী লাভ যদি মানুষ টাকার অভাবে সে চিকিৎসা নিতে না পারে? এ প্রশ্নটিই তাড়িত করেছিল ডা. শেঠী ও তার দলকে। তারা তাই কাজ করেছেন স্বাস্থ্যসেবাকে মানুষের নাগালে নিয়ে যেতে। শুধু ব্যবসায়ী মনই ছিলো না তাদের, ছিলো মানুষের সেবা করার আন্তরিক ইচ্ছাও। তারা হৃদয়ে ধারণ করেছিলেন মাদার তেরেসার সেই বাণী,
মানুষের সেবা করা হাত, প্রার্থনা করা ঠোঁটের চেয়েও পবিত্র।