১৯৯১ সালে ভারতে তখন চন্দ্রশেখর সরকার ক্ষমতায়। আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক পরিবেশ তখন উত্তাল। একদিকে ইরানে ঘটে গেছে ইসলামি বিপ্লব, আবার সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন হয়েছে মাত্র। আন্তর্জাতিক তেলের বাজারে তখন অস্থিতিশীলতা তৈরি করছিল প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধ। এমন পরিস্থিতিতে ভারতে মুদ্রাস্ফীতি চরমে, চন্দ্রশেখর সরকার ব্যর্থ হন বাজেট উপস্থাপন করতে। ভারতের অর্থনীতি বড়সড় এক সংকটের কাছাকাছি। ফরেক্স রিজার্ভ বা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ পৌঁছায় ১.২ বিলিয়ন ডলারে, যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দিয়ে ভারত মাত্র তিন সপ্তাহের মতো আমদানি করতে পারবে; যেমনটি বর্তমানে আমরা দেখতে পাচ্ছি পাকিস্তানের অর্থনৈতিক অবস্থার ক্ষেত্রে। ভারত তখন মুখোমুখি হয় ব্যালেন্স অফ পেমেন্ট (BoP) সংকট বা মুদ্রা সংকটের। অক্ষম হয় আমদানির জন্য অর্থ প্রদান করতে বা তার বাহ্যিক ঋণ পরিশোধ করতে। বেড়ে যায় সরকারি আয়ের থেকে ব্যয়ের পরিমাণ, কমতে থাকে বিনিয়োগ।
সংকটের সূচনা
১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা লাভের পর থেকে ভারত সমাজতন্ত্র ঘেঁষা অর্থনৈতিক উন্নয়ন পরিকল্পনা নিতে থাকে। গুরুত্ব দিতে থাকে স্ব-নির্ভরতা, রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত বিনিয়োগের উপর। ‘লাইসেন্স রাজ’ সিস্টেমের জন্য বেশিরভাগ আমদানি, বিনিয়োগের ক্ষেত্রে নিতে হতো সরকারের অনুমতি, বাধাগ্রস্ত ছিল বিদেশি বিনিয়োগও। তাছাড়া ছিল অতি উচ্চ মাত্রায় শুল্ক। ১৯৯১ সালের পূর্বে ভারত চালু ছিল বদ্ধ অর্থনীতি।
সোভিয়েত-ঘেঁষা থাকার কারণে ভারতের বাণিজ্য ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে সরাসরি রুপি-রুবল বিনিময়ের মাধ্যমে। কিন্তু গর্বাচেভের সময় ১৯৯১ সালে এসে পুরোপুরি পতন ঘটে সোভিয়েত ইউনিয়নের, যা ভারতের রুপির ওভার-ভ্যালুয়েশন বা অতি-মূল্যায়ন ঘটায়। এই পালে হাওয়া দেয় ১৯৯০-৯১ সালের প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধ। ১৯৭৯ সালে ইরানের ইসলামি বিপ্লবের পর মধ্যপ্রাচ্যে কার্যত অস্থিতিশীলতা বৃদ্ধি পায়। উপসাগরীয় যুদ্ধের ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বেশ বৃদ্ধি পায়, যার প্রভাব পড়ে ভারতে। তাছাড়া, অভ্যন্তরীণ ঝামেলায় আসাম বা অত্র এলাকা থেকেও তেল উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হয়।
এরূপ পরিস্থিতিতে ভারতে মুদ্রার সংকট দেখা দেয়। মুদ্রাস্ফীতি পৌঁছায় ১৬.৭%-এ। সরকারের আয়ের থেকে ব্যয় বেড়ে যায়। বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ উঠিয়ে নিতে শুরু করে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে ৬ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে আসে, যার দ্বারা ভারত মাত্র তিন সপ্তাহের আমদানি করতে পারতো। ১৯৯১ সালে চন্দ্রশেখর সরকারের পতন ঘটায় এই অর্থনৈতিক সংকট। নতুন করে সরকার গঠন করেন নরশীমা রাও। তিনি অর্থমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত করেন মনমোহন সিংকে, যিনি ভারতের এই অর্থনৈতিক সংকট কাটিয়ে উঠতে যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করেন। বিশ্লেষকদের মতে, ভারতে ১৯৯১ সালের সঙ্কট প্রধানত উচ্চ রাজস্ব ঘাটতি, সরকারের প্রতি আস্থা হারানো, এবং চলতি হিসাবের ঘাটতি বৃদ্ধির কারণে ঘটেছিল।
সংকট কাটাতে ভারতের পদক্ষেপ
তীব্র অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলায় চন্দ্রশেখর সরকার তখন আইএমএফ এর দ্বারস্থ হয়। আইএমএফ থেকে ২.২ বিলিয়ন ঋণ নিতে আবেদন করলে জামানত হিসেবে রাখতে হয় সোনা। রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া ৬৭ টন সোনা ব্যাংক অব ইংল্যান্ড (৪৭ টন) ও ইউনিয়ন ব্যাংক অব সুইজারল্যান্ডে (২০ টন) পাঠিয়ে দেয়, যাতে ৬০০ (৪০০+২০০) মিলিয়ন ডলারের ফান্ড গঠন করে ঋণ খেলাপি দশা থেকে রক্ষা পায়। নরশীমা রাও সরকার ৪৭ টন সোনা পাঠায় জুলাই মাসে। কিন্তু ১৯৯১ সালে ছিল ভারতের নির্বাচন। চন্দ্রশেখর সরকারের বিরুদ্ধে জনরোষ বাড়তে থাকে, গুজব ছড়ায়- সরকার দেশের সকল সোনা ঋণের পিছে দিয়ে দিচ্ছে। ফলাফল যা হবার তা-ই হলো, তিন মাসের মাথায় পতন হলো চন্দ্রশেখর সরকারের। নতুন করে সরকার গঠন করেন নরশীমা রাও।
নরশীমা রাওয়ের অর্থমন্ত্রী হন মনমোহন সিং। তিনি ভারতের অর্থনীতিতে ব্যাপক সংস্কার সাধন করেন, যার ফলে ভারত অর্থনৈতিক সংকট থেকে দ্রুত বেরিয়ে আসতে সক্ষম হয়। ২০০৯ সালে ভারতের রিজার্ভ ব্যাংক আইএমএফ থেকে ২০০ টন সোনা কিনতে সক্ষম হয়।
অর্থমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সংস্কারসমূহ
রুপির অবমূল্যায়ন
নরশীমা রাওয়ের সরকার পর পর দু’দিনের ব্যবধানে ভারতীয় রুপির ২০% অবমূল্যায়ন ঘটায়। ভারতের আমদানি ও রপ্তানি বাণিজ্যের পরিমাণে ধস নামার পেছনে অন্যতম কারণ ছিল দেশটির মুদ্রার ওভার-ভ্যালুয়েশন। সরকার দুই ধাপে মুদ্রার অবমূল্যায়ন ঘটায় মূলত রপ্তানিতে প্রতিযোগিতা বৃদ্ধির জন্য। ফলে রপ্তানি বৃদ্ধি পায়, এবং লেনদেনের ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে।
অর্থনীতির উদারীকরণ
১৯৯১ সালের অর্থনৈতিক সংকট ভারতের অর্থনীতিতে উদারীকরণের সূচনা করে। দেশের অর্থনীতিকে বিশ্বের কাছে উন্মুক্ত করার লক্ষ্যে ভারত তার অর্থনীতিকে আরও বাজার এবং সেবাভিত্তিক করে। ফলে ব্যক্তিগত এবং বিদেশি বিনিয়োগের ভূমিকা প্রসারিত হয়। অর্থনীতির উদারীকরণের উদ্দেশ্যে ভারতকে শুল্ক প্রত্যাহার, ট্যাক্স কমানোসহ বাজারের নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দিতে হয়। যেমনটা উদার অর্থনীতিতে বাজার নিয়ন্ত্রিত হয় চাহিদা ও যোগানের ভিত্তিতে। অর্থনীতির উদারীকরণের ফলে ভারতে বাড়তে থাকে বৈদেশিক বিনিয়োগ, বাড়ে জিডিপিও। যেখানে ১৯৯১ সালে ভারতের সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ ছিল ৭৫ মিলিয়ন, তা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৪২,২৮৫.৬৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে। ব্লক-কেন্দ্রিকতা থেকে অর্থনৈতিক উদারীকরণ ভারতের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখে।
শিল্প ও বাণিজ্য নীতিতে সংস্কার
অর্থনৈতিক উদারীকরণ, মুদ্রা অবমূল্যায়নের পর ভারতের নরশীমা রাও সরকার ও অর্থমন্ত্রী মনমোহন সিং বাণিজ্য নীতিতে সংস্কার আনেন। ভারতেও নতুন বাণিজ্য নীতি রপ্তানি বৃদ্ধিকে করে উৎসাহিত, আবার যেসব পণ্য জরুরি বা নিত্যপ্রয়োজনীয় নয়- সেগুলো আমদানিতে করে নিরুৎসাহিত। তাছাড়া রপ্তানিতে দেয়া হয় বিশেষ ভর্তুকি। প্রাইভেট সেক্টরকে স্বতন্ত্রভাবে আমদানি-রপ্তানির অধিকার দেয়া হয়।
অর্থনৈতিক সংকট কাটিয়ে উঠতে ভারত তার শিল্পখাতকে সংস্কারের আওতায় নিয়ে আসে। লাইসেন্স রাজ ব্যবস্থা উঠিয়ে দেয়। অর্থনৈতিক উদারীকরণ দেশটির শিল্পে মনোপলি ব্যবস্থা উঠিয়ে শিল্পখাতে বিনিয়োগ নিয়ে আসে। জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে কয়েকটি সেক্টর বাদে বাকি প্রায় সব সেক্টরে সরকারি কর্তৃত্ব উঠিয়ে নেয়া হয়। বাণিজ্য-বাধা প্রয়োজন নেই এমন সেক্টর থেকে এই বাধা উঠিয়ে নেয়া হলে প্রায় ১৮টি সেক্টর প্রচুর বৈদেশিক বিনিয়োগ পায়।
কর সংস্কার ও ফরেক্স রিজার্ভ বৃদ্ধি
সংকট কাটিয়ে উঠতে পূর্ববর্তী চন্দ্রশেখর সরকার বছরের শুরুতেই ২০ টন স্বর্ণ ইউনিয়ন ব্যাংক অব সুইজারল্যান্ড ব্যাংকে হস্তান্তর করে। পরবর্তীতে নতুন সরকার এসে আবার ৪৭ টন সোনা ব্যাংক অব ইংল্যান্ডে জামানত হিসেবে পাঠায়। ফলে ৬০০ মিলিয়ন এসে জমা হয় ভারতের ফরেক্স রিজার্ভে। নিশ্চিত হয় আইএমএফ-এর লোন। পরবর্তীতে সংস্কার কার্যক্রম ভারতের অর্থনীতিতে ফরেক্স রিজার্ভ বৃদ্ধিতে সাহায্য করে।
একটি দেশ যখন ঋণখেলাপি হয়, তখন তাকে যেভাবেই হোক কোষাগারে অর্থ বাড়াতে হয়। এক্ষেত্রে ট্যাক্স বাড়িয়ে সেই অর্থ সংগ্রহ করতে চায় সরকার। সম্প্রতি শ্রীলঙ্কায় সরকার ট্যাক্স বৃদ্ধি করেছে এই পরিস্থিতিতে পড়ে। ভারতের সরকার ১৯৯১ সালে বিভিন্ন অর্থনৈতিক সংস্কার করার ফলে কোনো কোনো সেক্টরে ট্যাক্স বৃদ্ধি করে, আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা কমিয়ে প্রচুর বৈদেশিক বাণিজ্য আকর্ষণ করা হয়। যেমন- দেশি-বিদেশি কর্পোরেট কোম্পানির উপর ট্যাক্স কমিয়েছিল দেশটি।
বিশ্বায়ন পৃথিবীতে বাণিজ্যের পরিবর্তন নিয়ে আসে। অর্থনৈতিক উদারবাদের যুগে রাষ্ট্রীয় অর্থনীতি সংকীর্ণ করে বা কোনো আন্তর্জাতিক ব্লকঘেষা রাখলে তা যেকোনো মুহূর্তে বিপদে ফেলতে পারে। নির্দিষ্ট দেশের সাথে বাণিজ্য ও আবদ্ধ অর্থনীতিতে রাষ্ট্রের ঋণখেলাপি হওয়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়। বরং চলমান আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে মুক্তবাজার অর্থনীতির মাধ্যমে সব দেশের সাথে বাণিজ্য করে উপকৃত হতে পারে রাষ্ট্র। ১৯৯১ সালের ভারতের এই অর্থনৈতিক সংকট শিক্ষণীয় হতে পারে সংকটের মধ্যে দিয়ে যাওয়া বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলোর জন্য।