১৬ জানুয়ারি, ১৯৭৪। ভিয়েতনাম যুদ্ধের শেষ পর্যায় চলমান। মাত্র ১২ দিন আগে দক্ষিণ ভিয়েতনামের রাষ্ট্রপতি নগুয়েন ভ্যান থিউ ঘোষণা করেছেন যে, ১৯৭৩ সালে স্বাক্ষরিত প্যারিস শান্তি চুক্তি কার্যত অকার্যকর প্রমাণিত হয়েছে, এবং দক্ষিণ ও উত্তর ভিয়েতনামের মধ্যে পুনরায় যুদ্ধ শুরু হয়েছে। কিন্তু সকলেই বুঝে গিয়েছিল, যুদ্ধে দক্ষিণ ভিয়েতনামের পরাজয় সময়ের ব্যাপার মাত্র। পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যেখানে উত্তর ভিয়েতনামকে পরাজিত করতে পারেনি, সেখানে দক্ষিণ ভিয়েতনাম একাকী কীভাবে উত্তর ভিয়েতনামের মোকাবেলা করবে? এই পরিস্থিতিতে ১৬ জানুয়ারি দক্ষিণ ভিয়েতনামি নৌবাহিনীর একটি ফ্রিগেটে করে ৬ জন দক্ষিণ ভিয়েতনামি সেনা কর্মকর্তা ও ১ জন মার্কিন পর্যবেক্ষককে প্রেরণ করা হয়েছিল দক্ষিণ চীন সাগরে অবস্থিত প্যারাসেল দ্বীপপুঞ্জ পর্যবেক্ষণ করতে। ফ্রিগেটটি প্যারাসেল দ্বীপপুঞ্জের অন্তর্গত ড্রামন্ড দ্বীপের কাছাকাছি পৌঁছানোর পর দক্ষিণ ভিয়েতনামি কর্মকর্তারা দেখতে পেলেন, দ্বীপটির কাছাকাছি দুটি শত্রুভাবাপন্ন ‘সশস্ত্র ট্রলার’ ঘোরাঘুরি করছে। কিন্তু ট্রলারগুলো উত্তর ভিয়েতনামি নয়, চীনা!
দক্ষিণ চীন সাগরের সমুদ্রসীমা ও সমুদ্রে অবস্থিত দ্বীপগুলো নিয়ে পূর্ব এশিয়ার ‘উদীয়মান পরাশক্তি’ চীন এবং দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন রাষ্ট্রের (যেমন: তাইওয়ান, ফিলিপাইন, ভিয়েতনাম প্রভৃতি) মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে বিরোধ চলছে, এবং সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই বিরোধ নিয়ে গণমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা–সমালোচনা হয়েছে। দক্ষিণ চীন সাগরে অবস্থিত যে দ্বীপগুলো নিয়ে এই রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বিরোধ রয়েছে, সেগুলোর মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি অঞ্চল হচ্ছে প্যারাসেল দ্বীপপুঞ্জ। এই দ্বীপপুঞ্জটি নিয়ে চীন ও ভিয়েতনামের মধ্যে এক শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে বিরোধ চলছে, এবং তাইওয়ানও এই দ্বীপপুঞ্জটির মালিকানা দাবি করে থাকে। দ্বীপপুঞ্জটি বর্তমানে সম্পূর্ণভাবে চীনের নিয়ন্ত্রণাধীন, কিন্তু অর্ধ-শতাব্দী আগেও এই দ্বীপপুঞ্জটির ওপর চীনের নিয়ন্ত্রণ ছিল না। তাহলে চীন কীভাবে দ্বীপপুঞ্জটির উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিল?
প্যারাসেল দ্বীপপুঞ্জ, যেটি চীনাদের কাছে ‘জিশা দ্বীপপুঞ্জ’ এবং ভিয়েতনামিদের কাছে ‘হোয়াং সা উপদ্বীপ’ নামে পরিচিত, দক্ষিণ চীন সাগরে অবস্থিত একটি দ্বীপপুঞ্জ। ১৩০টি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রবাল দ্বীপ নিয়ে এই দ্বীপপুঞ্জটি গঠিত। দক্ষিণ চীন সাগরের প্রায় ১৫,০০০ বর্গ কি.মি. অঞ্চল জুড়ে বিস্তৃত এই দ্বীপপুঞ্জটির স্থলভাগের আয়তন মাত্র ৭.৭৫ বর্গ কি.মি.। দ্বীপপুঞ্জটির দ্বীপগুলোকে দুই ভাগে বিভক্ত করা হয়– পূর্বদিকে অবস্থিত ‘অ্যাম্ফিট্রাইট গ্রুপ’ এবং পশ্চিমদিকে অবস্থিত ‘ক্রিসেন্ট গ্রুপ’। দ্বীপপুঞ্জটি চীন ও ভিয়েতনাম উভয় রাষ্ট্রের উপকূলীয় অঞ্চল থেকে প্রায় সমদূরত্বে অবস্থিত, এবং এই কারণেই রাষ্ট্র দুটির মধ্যে এই দ্বীপপুঞ্জটি নিয়ে বিরোধের সৃষ্টি হয়েছে। দ্বীপপুঞ্জটি চীনের হাইনান প্রদেশের নিকটবর্তী এবং দক্ষিণ চীন সাগরে আধিপত্য বিস্তারের জন্য কৌশলগত ঘাঁটি হিসেবে দ্বীপগুলোর গুরুত্ব ব্যাপক। ফলে দ্বীপপুঞ্জটি নিকটবর্তী রাষ্ট্রগুলোর জন্য ভূকৌশলগত দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ঐতিহাসিকভাবে দ্বীপপুঞ্জটি নিয়ে চীনা ও ভিয়েতনামিদের মধ্যে বিরোধ ছিল। ১৮৮৪–১৮৮৫ সালের চীনা–ফরাসি যুদ্ধের ফলে চীন আন্নাম (মধ্য ভিয়েতনাম) ও টনকিনের (উত্তর ভিয়েতনাম) ওপর ফরাসি আধিপত্য স্বীকার করে নেয়, অন্যদিকে প্যারাসেল দ্বীপপুঞ্জের ওপর চীনের ‘নামেমাত্র’/’আনুষ্ঠানিক’ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৩২ সালে চীনে জাতীয়তাবাদী সরকার ও কমিউনিস্টদের মধ্যে চলমান গৃহযুদ্ধ এবং উত্তর–পূর্ব চীনে জাপানি আক্রমণের সুযোগ গ্রহণ করে ফ্রান্স প্যারাসেল দ্বীপপুঞ্জটি আনুষ্ঠানিকভাবে দখল করে নেয়ার ঘোষণা দেয়। চীন ও জাপান এই সিদ্ধান্তের তীব্র প্রতিবাদ জানায়, কিন্তু তাৎক্ষণিকভাবে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ১৯৪০ সালে ফ্রান্স জার্মানির নিকট আত্মসমর্পণ করে এবং এই সুযোগ গ্রহণ করে জাপান ১৯৪১ সালে সমগ্র ফরাসি–শাসিত ইন্দোচীনকে একটি জাপানি আশ্রিত রাষ্ট্রে পরিণত করে। এই প্রেক্ষাপটে প্যারাসেল দ্বীপপুঞ্জ জাপানের হস্তগত হয় এবং জাপানিরা দ্বীপপুঞ্জটিকে প্রশাসনিকভাবে জাপানি–অধিকৃত তাইওয়ানের সঙ্গে সংযুক্ত করে।
১৯৪৫ সালে জাপানের পরাজয়ের পর চীন প্যারাসেল দ্বীপপুঞ্জ দখল করে নেয় এবং ১৯৪৬ সালে দ্বীপপুঞ্জটির পূর্বাংশে অবস্থিত ‘অ্যাম্ফিট্রাইট গ্রুপে’র অন্তর্গত উডি দ্বীপে সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করে। উডি দ্বীপটি প্যারাসেল দ্বীপপুঞ্জের বৃহত্তম দ্বীপ এবং এটি চীনাদের কাছে ‘ইয়ংজিং দ্বীপ’ ও ভিয়েতনামিদের কাছে ‘ফু লাম দ্বীপ’ নামে পরিচিত। ফ্রান্স এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানায়, কিন্তু উডি দ্বীপ থেকে চীনা সৈন্যদের উৎখাত করতে ব্যর্থ হয় এবং প্যারাসেল দ্বীপপুঞ্জের পশ্চিমাংশে অবস্থিত ‘ক্রিসেন্ট গ্রুপে’র একটি দ্বীপে সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করে। ১৯৪৯ সালে চীনে চলমান গৃহযুদ্ধে কমিউনিস্টরা বিজয়ী হয় এবং ক্ষমতাচ্যুত জাতীয়তাবাদীরা তাইওয়ানে আশ্রয় নেয়। ১৯৫০ সালে তাইওয়ানকেন্দ্রিক চীনা জাতীয়তাবাদীরা প্যারাসেল দ্বীপপুঞ্জ থেকে নিজেদের সৈন্য প্রত্যাহার করে নেয় এবং ১৯৫৪ সালে ফ্রান্স ইন্দোচীন রাষ্ট্রগুলোকে স্বাধীনতা প্রদান করতে বাধ্য হলে তারাও প্যারাসেল দ্বীপপুঞ্জ থেকে নিজেদের সৈন্য অপসারণ করে।
১৯৫৪ সালে আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতার ফলে ভিয়েতনাম কমিউনিস্ট–শাসিত ‘উত্তর ভিয়েতনাম’ এবং অকমিউনিস্ট–শাসিত ‘দক্ষিণ ভিয়েতনাম’ এই দুইটি শত্রুভাবাপন্ন স্বাধীন রাষ্ট্রে বিভক্ত হয়ে পড়ে। দক্ষিণ ভিয়েতনাম প্যারাসেল দ্বীপপুঞ্জের পশ্চিমাংশের ‘ক্রিসেন্ট গ্রুপে’র দ্বীপগুলোর ওপর নিজস্ব কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে। অন্যদিকে, ১৯৫৬ সালে চীন উডি দ্বীপে পুনরায় সৈন্য মোতায়েন ও সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করে এবং সেখানে অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণ আরম্ভ করে। ইতোমধ্যে দীর্ঘস্থায়ী ও রক্তক্ষয়ী ভিয়েতনাম যুদ্ধ শুরু হলে দক্ষিণ ভিয়েতনাম অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ ও বৈদেশিক আক্রমণ প্রতিহত করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে, ফলে প্যারাসেল দ্বীপপুঞ্জের মতো প্রান্তিক অঞ্চলের প্রতি মনোনিবেশ করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। ১৯৬৬ সালে প্যারাসেল দ্বীপপুঞ্জের অন্তর্গত শানহু দ্বীপে অবস্থিত একটি সামরিক ‘আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র’ ছাড়া দ্বীপপুঞ্জটিতে দক্ষিণ ভিয়েতনামের কোনো সামরিক উপস্থিতি ছিল না।
১৯৭৪ সালের ১৬ জানুয়ারি দক্ষিণ ভিয়েতনামি নৌবাহিনীর একটি ফ্রিগেটে চড়ে সেনা কর্মকর্তারা প্যারাসেল দ্বীপপুঞ্জে একটি নিয়মিত পর্যবেক্ষণ পরিচালনার সময় দ্বীপপুঞ্জটির অন্তর্গত ড্রাম্নড দ্বীপের নিকটে দুটি চীনা সশস্ত্র ট্রলার দেখতে পান এবং জানতে পারেন যে, চীনা সৈন্যরা দ্বীপটি দখল করে নিয়েছে। চীনা সৈন্যরা পার্শ্ববর্তী ডানকান দ্বীপও দখল করে নিয়েছিল, এবং দ্বীপটির সৈকতে একটি ‘ল্যান্ডিং শিপ’ ও আশেপাশে ২টি ‘ক্রন্সতাদৎ শ্রেণীর সাবমেরিন চেজার’ অবস্থান করছিল। দক্ষিণ ভিয়েতনামি কর্মকর্তারা সঙ্গে সঙ্গে সায়গনে (দক্ষিণ ভিয়েতনামের রাজধানী) এই সংবাদ প্রেরণ করেন এবং সায়গন দ্রুত এতদঞ্চলে আরো কিছু নৌযান প্রেরণ করে। দক্ষিণ ভিয়েতনামি কর্মকর্তারা চীনাদেরকে দ্বীপগুলো থেকে সরে যাওয়ার আহ্বান জানালে প্রত্যুত্তরে চীনা কর্মকর্তারা উল্টো দক্ষিণ ভিয়েতনামিদেরকেই দ্বীপগুলোর কাছ থেকে সরে যাওয়ার নির্দেশ দেয়। দুই বাহিনী একে অপরের মুখোমুখি হয়, কিন্তু আক্রমণ করা থেকে বিরত থাকে।
বস্তুত চীনারা প্রথম থেকেই সম্পূর্ণ প্যারাসেল দ্বীপপুঞ্জ করায়ত্ত করতে আগ্রহী ছিল। কিন্তু দক্ষিণ ভিয়েতনামে মার্কিন সৈন্যের উপস্থিতির কারণে তারা এতদিন মার্কিন সৈন্যদের সঙ্গে সংঘাত এড়ানোর লক্ষ্যে এ ধরনের কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা থেকে বিরত ছিল। ১৯৭৪ সাল নাগাদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজেকে দক্ষিণ ভিয়েতনাম থেকে সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাহার করে নিচ্ছিল এবং এই পরিস্থিতিতে চীন প্যারাসেল দ্বীপপুঞ্জ দখল করে নিলে যুক্তরাষ্ট্র কোনো পাল্টা পদক্ষেপ নেবে না, এটা চীনারা বুঝতে পেরেছিল। তদুপরি, উত্তর ভিয়েতনাম শীঘ্রই দক্ষিণ ভিয়েতনাম দখল করে নেবে এটাও বেইজিং বুঝতে পারছিল এবং এজন্য শক্তিশালী একত্রিত ভিয়েতনাম প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগেই চীন দুর্বল দক্ষিণ ভিয়েতনামের কাছ থেকে প্যারাসেল দ্বীপপুঞ্জ দখল করে নিতে চাইছিল। এজন্য ১৯৭৪ সালের প্রারম্ভে তারা গোপনে দ্বীপপুঞ্জটির দক্ষিণ ভিয়েতনামি–নিয়ন্ত্রিত অংশে সৈন্য মোতায়েন করে।
চীন ও দক্ষিণ ভিয়েতনাম উভয়েই প্যারাসেল দ্বীপপুঞ্জ থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে নিতে অস্বীকৃতি জানায়। দক্ষিণ ভিয়েতনামের দৃষ্টিতে প্যারাসেল দ্বীপপুঞ্জ ছিল তাদের নিজস্ব ভূমি, যেটিতে চীন ‘আগ্রাসন’ চালিয়েছে। অন্যদিকে, চীনাদের দৃষ্টিতে প্যারাসেল দ্বীপপুঞ্জ ছিল তাদের ঐতিহাসিক ভূমি, যেটি ফরাসি উপনিবেশবাদীরা জবরদখল করে নিয়েছিল এবং যেটিকে তারা ‘মুক্ত’ করছে মাত্র। ফলশ্রুতিতে উভয় পক্ষের মধ্যে সংঘাত অনিবার্য হয়ে ওঠে।
এই যুদ্ধে দক্ষিণ ভিয়েতনামের ৪টি যুদ্ধজাহাজ অংশ নিয়েছিল, যাদের মধ্যে ছিল ৩টি ফ্রিগেট (‘ত্রান বিনহ ত্রং’, ‘লি থুয়ং কিয়েত’ ও ‘ত্রান খানহ দু’) এবং ১টি কোর্ভেট (‘নহাৎ তাও’)। তদুপরি, দক্ষিণ ভিয়েতনামের এক প্লাটুন নৌ কমান্ডো, ১টি ‘আন্ডারওয়াটার ডেমোলিশন টিম’ ও ১ প্লাটুন স্থলসেনা এই সংঘর্ষে অংশ নিয়েছিল। অন্যদিকে, ৪টি চীনা মাইনসুইপার (২৭১, ২৭৪, ৩৮৯ ও ৩৯৬) এবং ২টি ক্রন্সতাদৎ শ্রেণীর ‘সাবমেরিন চেজার’ (২৮১ ও ২৮২) এই যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল এবং চীনারা দখলকৃত দ্বীপগুলোতে ২ ব্যাটালিয়ন মেরিন ও অজ্ঞাতসংখ্যক অনিয়মিত মিলিশিয়া মোতায়েন করেছিল। দক্ষিণ ভিয়েতনামিদের যুদ্ধজাহাজগুলো ছিল চীনা জাহাজগুলোর তুলনায় অপেক্ষাকৃত নতুন এবং এগুলোর অস্ত্রশস্ত্রও ছিল তুলনামূলকভাবে উন্নত। উল্লেখ্য, চীনা সাবমেরিন চেজার দুটি এই যুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নেয়নি।
১৯ জানুয়ারি সকালে দক্ষিণ ভিয়েতনামি ফ্রিগেট ত্রান বিনহ ত্রং থেকে একদল সৈন্য চীনাদের দখলকৃত ডানকান দ্বীপে অবতরণ করে, কিন্তু চীনা সৈন্যরা তাদের ওপর গুলিবর্ষণ করলে ৩ জন দক্ষিণ ভিয়েতনামি সৈন্য নিহত ও আরো কয়েকজন আহত হয়, এবং তারা দ্বীপটি থেকে পশ্চাৎপসরণ করতে বাধ্য হয়। এরপর সকাল ১০টা ২৪ মিনিটে চীনা ও দক্ষিণ ভিয়েতনামি জাহাজগুলোর মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়। প্রায় ৪০ মিনিট স্থায়ী এই নৌযুদ্ধে চীনা নাবিকরা দক্ষিণ ভিয়েতনামি নাবিকদের চেয়ে অধিকতর রণনৈপুণ্যের পরিচয় দেয় এবং ৪টি দক্ষিণ ভিয়েতনামি জাহাজই গোলার আঘাতে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। চীনাদের নিক্ষিপ্ত গোলার আঘাতে দক্ষিণ ভিয়েতনামি কোর্ভেট ‘নহাৎ তাও’–এর ইঞ্জিন বিকল হয়ে যায় এবং এর ফলে জাহাজটির নাবিকদেরকে জাহাজ ত্যাগের নির্দেশ দেয়া হয়, কিন্তু জাহাজটির অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কমান্ডার নগুয় ভ্যান থা জাহাজটিতে থেকে যান এবং জাহাজটির সঙ্গে তিনিও সলিল সমাধি বরণ করেন।
ওদিকে দক্ষিণ ভিয়েতনামি ফ্রিগেট ‘লি থুয়ং কিয়েত’ নিজেদেরই অপর ফ্রিগেট ‘ত্রান বিনহ ত্রং’–এর গোলার আঘাতে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং পশ্চিম দিকে পশ্চাৎপসরণ করে। শীঘ্রই অন্য দুইটি দক্ষিণ ভিয়েতনামি ফ্রিগেটও তাদের সঙ্গে যোগ দিতে বাধ্য হয়। যুদ্ধ চলাকালে দক্ষিণ ভিয়েতনামি সরকার এতদঞ্চলে অবস্থানরত মার্কিন নৌবাহিনীর ৬ষ্ঠ নৌবহরের কাছে সহায়তা প্রার্থনা করেছিল, কিন্তু চীনারা যেমন ভেবেছিল, ঠিক তেমনভাবেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ ভিয়েতনামকে এক্ষেত্রে সহায়তা করতে অস্বীকৃতি জানায়।
২০ জানুয়ারি নিকটবর্তী হাইনান প্রদেশে অবস্থিত বিমানঘাঁটি থেকে চীনা বিমানবাহিনী দ্বীপগুলোতে অবস্থানরত দক্ষিণ ভিয়েতনামি সৈন্যদের ওপর বোমাবর্ষণ করে এবং এরপর চীনা সৈন্যরা দ্বীপগুলোতে অবতরণ করে। একটি সংক্ষিপ্ত সংঘর্ষের পর দক্ষিণ ভিয়েতনামি সৈন্যরা চীনাদের কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। এই খণ্ডযুদ্ধের ফলে দক্ষিণ ভিয়েতনামের ১টি কোর্ভেট ডুবে যায় ও ৩টি ফ্রিগেট ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এবং ৫৩ জন দক্ষিণ ভিয়েতনামি সৈন্য নিহত, ১৬ জন আহত ও ৪৮ জন চীনা সৈন্যদের হাতে বন্দি হয়। বন্দি দক্ষিণ ভিয়েতনামি সৈন্যদের, যাদের মধ্যে একজন মার্কিন নাগরিকও ছিল, চীনারা রেড ক্রসের মাধ্যমে হংকংয়ে ছেড়ে দেয়। অন্যদিকে, যুদ্ধে অংশগ্রহণকারো ৪টি চীনা মাইনসুইপারই কম-বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, কিন্তু কোনোটিই ডুবে যায়নি। ১৮ জন চীনা সৈন্য এই সংঘর্ষে নিহত হয় এবং ৬৭ জন আহত হয়।
এই খণ্ডযুদ্ধের ফলে প্যারাসেল দ্বীপপুঞ্জ সম্পূর্ণরূপে চীনের হস্তগত হয়। দক্ষিণ ভিয়েতনাম জাতিসংঘে এর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানায়, কিন্তু চীন জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য বিধায় জাতিসংঘ এই ব্যাপারে কোনো কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে নি। দক্ষিণ ভিয়েতনামের ‘মিত্ররাষ্ট্র’ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে ১৯৭১ সাল থেকে চীনের সঙ্গে মৈত্রী গড়ে তুলছিল এবং ভিয়েতনাম থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নিচ্ছিল, ফলে তারা চীনাদের এই কার্যক্রমে বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি।
কৌতূহলের ব্যাপার এই যে, উত্তর ভিয়েতনাম তখন পর্যন্ত চীনের সঙ্গে মিত্রতার বন্ধনে আবদ্ধ ছিল, কিন্তু দক্ষিণ ভিয়েতনামের বিরুদ্ধে চীনাদের বিজয়ে তারা খুশি হয় নি, বরং তারা ‘শান্তিপূর্ণভাবে’ আঞ্চলিক সীমান্ত সংঘাতগুলোর সমাধান করার জন্য সকলকে আহ্বান জানায়। বস্তুত, উত্তর ভিয়েতনাম ও চীন উভয়েই কমিউনিজমের অনুসারী হলেও উভয় রাষ্ট্রের নেতৃবৃন্দই ছিল তীব্রভাবে জাতীয়তাবাদী। ফলে উত্তর ভিয়েতনামি নেতৃবৃন্দ চীন কর্তৃক ‘ভিয়েতনামি’ ভূমি দখলকে গ্রহণ করতে পারেননি। ১৯৭৫ সালে উত্তর ভিয়েতনামি সৈন্যরা দক্ষিণ ভিয়েতনাম দখল করে নেয় এবং দুই ভিয়েতনাম একত্রিত হয়। একত্রিত ভিয়েতনাম প্যারাসেল দ্বীপপুঞ্জের মালিকানা দাবি করে এবং দ্বীপপুঞ্জটির ওপর চীনা দখলদারিত্বের তীব্র প্রতিবাদ জানায়। বর্তমানেও প্যারাসেল দ্বীপপুঞ্জটি নিয়ে বেইজিং ও হ্যানয়ের মধ্যে বিরোধ অব্যাহত রয়েছে।