![](https://assets.roar.media/assets/eTq9y9fTc6hHBDHS_Aborigines-of-Tas-1870.jpg?w=1200)
আঠারো শতকের শেষ দিকের কথা।
ভারত মহাসাগরের সুদূরে দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলে ইউরোপীয় শ্বেতাঙ্গদের উপস্থিতি ধীরে ধীরে বেড়ে চলছিল। তবে প্রথমেই তারা রাজ্য বিস্তারের কাজে আসেনি, এসেছিল শিকারী ও ব্যবসায়ী হিসেবে। সেই শিকারের পরিধি পশু আর পাখিদের ক্ষেত্র থেকে ক্রমে স্থানীয় আদিবাসী মানুষের দোরগোড়ায় এসে পড়ল।
আজ যে অঞ্চল তাসমানিয়া দ্বীপ নামে পরিচিত, অষ্টাদশ শতকে তা ভ্যান ডেমিয়েন’স আইল্যান্ড নামে খ্যাত ছিল। ১৭৯৮ সাল নাগাদ শ্বেতাঙ্গদের, বিশেষ করে ব্রিটিশদের আগমন শুরু হলেও এই এলাকায় প্রথম সামরিক উপস্থিতি শুরু হয় ১৮০৩ সাল থেকে। তখন থেকেই ভারী অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে আসা হচ্ছিল। তারই ফলশ্রুতিতে জবরদখলের প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে আদিবাসীদের বিরুদ্ধে বেশ কিছু সশস্ত্র অভিযান পরিচালিত হয়। এর মধ্যে ছিল নিরীহ আদিবাসী পুরুষদের হত্যা করা আর নারী-শিশুদের বন্দী করে নির্যাতন চালানো।
![](https://assets.roar.media/assets/TR30MWeRSmwXU6Hh_Mounted_police_and_blacks.jpg)
এই অঞ্চলের ব্রিটিশ উপনিবেশের প্রথম লেফটেনেন্ট গভর্নর ডেভিড কলিন্স ১৮০৪ সালে দায়িত্ব নেওয়ার পর যুক্তরাজ্যের উপনিবেশ নীতি অনুযায়ী আদিবাসী হত্যা বন্ধে কিছু উদ্যোগ নেওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু সময় তার অনুকূল ছিল না। বরং পরিস্থিতি আরো বেশি রক্তক্ষয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল।
১৮০৪ সালের ৩ মে ব্রিটিশ সেনাবাহিনী ও শ্বেতাঙ্গ দখলদাররা আদিবাসীদের উপর এক মিলিত হামলা চালায়। এতে পঞ্চাশেরও অধিক নিরীহ আদিবাসী পুরুষ, নারী ও শিশু প্রাণ হারায়। ৩০ জনের মৃতদেহ অবলীলায় পুড়িয়ে ফেলা হয়। এই ঘটনা বারুদে আগুন লাগানোর পরিস্থিতি তৈরি করল। আদিবাসীরা শ্বেতাঙ্গদের বেড়ে চলা নিষ্ঠুতার জবাব দিতে প্রস্তুত হচ্ছিল। এদিকে দখলদার ব্রিটিশরাও বসে ছিল না।
১৮০৬ সাল থেকে সংঘাতের তীব্রতা বাড়তে শুরু করল। ব্রিটিশ দখলদাররা চাইছিল বিনা বাধায় তাদের পশুচারণের এলাকা বাড়িয়ে তুলতে। আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে আদিবাসীদের সাথে দ্বন্দ্ব বাড়তে লাগল, সেই সাথে হতাহতের তীব্রতাও। ১৮০৭ সাল থেকে অস্ট্রেলিয়ার আশেপাশের দ্বীপাঞ্চলগুলোতে ইউরোপ থেকে আসা দখলদারদের সংখ্যা আর তাদের জমি দখল বেড়েই চলছিল। এভাবে চলতে চলতে ১৮১৪ আসার পর দেখা গেল, ভ্যান ডেমিয়েন দ্বীপের প্রায় ১০ শতাংশ জমি শ্বেতাঙ্গ দখলদারদের অধীনে চলে গেছে। অস্ট্রেলিয়ার মূল ভূখণ্ডের বাইরে নরফোক দ্বীপে দখলদার ইংরেজরা তাদের পশুচারণের এলাকা বেপরোয়াভাবে বাড়িয়ে তুলছিল। আর বাড়িয়ে তুলেছিল নিরীহ আদিবাসীদের উপর অনাকাঙ্ক্ষিত হামলা।
![](https://assets.roar.media/assets/MTkLzGx3CFR3xr8E_Aborigines-of-Tas-1870.jpg)
হামলার অংশ হিসেবে আদিবাসী পুরুষদের হত্যা আর নারী ও শিশুদের জোর করে দাস বানানো খুব সাধারণ হয়ে উঠেছিল। এর ফলে বাড়ল এই উপনিবেশে এসে ভাগ্য পরিবর্তনের তোড়জোড়। দেখা গেল, ১৮২৪ সাল নাগাদ দ্বীপটিতে শ্বেতাঙ্গ জনসংখ্যা প্রায় ১২,০০০-এ চলে গেছে। দখলদারদের সংখ্যা বাড়ার সাথে সাথে বাড়ছিল নিরাপত্তার নামে অস্ত্রশস্ত্রের মজুদ বৃদ্ধিও।
আদিবাসী জনগোষ্ঠীও প্রতিরোধ করে যাচ্ছিল। পাল্টা আক্রমণ হিসেবে তারাও শ্বেতাঙ্গ অধ্যুষিত এলাকাগুলোয় হানা দিচ্ছিল। মূলত ১৮২০ সাল থেকে তাদের প্রতিরোধের তীব্রতা বৃদ্ধি পায়। আর বাড়ছিল সম্ভাব্য এক ভয়ানক রক্তক্ষয়ের সম্ভাবনা। ১৮২৪ সালে জর্জ আর্থার উপনিবেশের নতুন গভর্নর হবার পর এক নতুন কৌশল নিলেন। পরোক্ষভাবে দখলদারিত্ব চালানোর পদ্ধতি হিসেবে তিনি সংঘাত কমানোর কৌশলে গেলেন। দুই আদিবাসী যুবককে হত্যার অপরাধে তার বিরোধী বলে কথিত তিন শ্বেতাঙ্গকে ফাঁসি দেওয়া হলো। এর মাধ্যমে হয়তো সংঘাত কমিয়ে দখলের পরিধি বাড়ানোর পরিকল্পনা ছিল।
![](https://assets.roar.media/assets/ctaylrbhQleq4eHQ_10133160-3x4-460x613.jpg)
১৮২৬ সালের মাঝামাঝি ও শেষ নাগাদ আদিবাসীদের প্রতিরোধ তীব্র আকার ধারণ করল। ইংরেজ উপনিবেশের দখলদাররা অস্ত্রশস্ত্রে এগিয়ে থাকলেও আদিবাসী যুদ্ধের কৌশল সম্পর্কে অজ্ঞ ছিল। ফলে শ্বেতাঙ্গদের মধ্যে হতাহতের সংখ্যা বাড়ছিল। আর বাড়ছিল আতংক। দখলদাররা তাদের এলাকা যেকোনো মূল্যে আদিবাসীমুক্ত করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠলো। নতুন আইন করে আদিবাসী হত্যার একরকম বৈধতা দেওয়া হলো।
১৮২৬ সালের জুলাই মাসে গ্রীষ্মকালে আদিবাসী ক্যাঙ্গারু শিকারীদের উপরে শ্বেতাঙ্গ দখলদাররা এক বর্বর আক্রমণ করে বসল। অগণিত নিরীহ আদিবাসী এই আক্রমণে প্রাণ হারায়। এই বছরের ৯ ডিসেম্বর কলোনিয়াল আর্মির ৪০ রেজিমেন্ট এক ঝটিকা হামলায় প্রায় ১৪ জন আদিবাসীকে হত্যা করে।
এদিকে আদিবাসীরাও বসে ছিল না। ১৮২৭ সালের মাঝামাঝি তাদের পাল্টা আঘাত তীব্র হয়ে উঠল। দখলদারদের পশুচারণভূমিতে তাদের হামলা বেড়ে চলল। কিন্তু শ্বেতাঙ্গ দখলদারদের আক্রমণ কৌশলগতভাবে বদলে গিয়েছিল। এপ্রিল মাসের এক হামলায় প্রায় ৭০ জন আদিবাসী পুরুষ, নারী ও শিশু নিহত হলো। হতাহতের সংখ্যা বেড়েই চলছিল, তবে আদিবাসীদের রক্তক্ষয় বেশি হচ্ছিল। অনেক ইতিহাসবিদ বলেন, শ্বেতাঙ্গদের নথিপত্রে বরং এসব মৃতের সংখ্যা অনেক কমিয়ে দেখানো হয়েছে। এছাড়া বেড়ে চলা সংঘাতের ফলে আদিবাসীরা খাদ্য সংকটে ভুগছিল। এদিক থেকে তাদের লড়াই ছিল আরো কঠিন।
![](https://assets.roar.media/assets/CA0DfgLbXhpqkSx3_P7RKEIMYGAZZ6J2ACYDNKQFZD4.jpg)
গভর্নর জর্জ আর্থার এবার নতুন পদক্ষেপ নিলেন। লন্ডনের কলোনিয়াল অফিস সেক্রেটারিয়েটে তিনি আদিবাসীদের জন্য সম্পূর্ণ আলাদা এলাকা বরাদ্দ করার সুপারিশ করে রিপোর্ট পাঠালেন। আর সেই আলাদা অঞ্চল হচ্ছে আজকের তাসমানিয়া দ্বীপের উত্তর-পূর্বাঞ্চল। এই অঞ্চলও ব্রিটিশ দখলদারদের থেকে মুক্ত ছিল না। রিপোর্টে বলপ্রয়োগের মাধ্যমে এই পৃথকীকরণকে বৈধতা দেওয়ার কথা বলা হয়। মজার ঘটনা হচ্ছে, রিপোর্টে ব্রিটিশ আগ্রাসনকে অস্বীকার করা হয়নি।
এর মধ্যে ১৮২৮ সাল চলে এলো। বোঝাই যাচ্ছিল, শান্তি বা সমঝোতার কোনো উপায় আর অবশিষ্ট নেই। বাঁচার লড়াইয়ে আদিবাসীরা মরিয়া হয়ে উঠছিল। আর ব্রিটিশদের তাগিদ ছিল উপনিবেশ বাড়ানোর। গভর্নর ১ নভেম্বর সামরিক আইন জারি করলেন। এই আইনে আদিবাসীদের হত্যা করার সবরকম স্বীকৃতি দেওয়া হলো। তাদের ব্রিটিশ রাজার শত্রু বলে গণ্য করা হলো। এমনকি হত্যা আর আটকের জন্য পুরষ্কারও ঘোষিত হলো। প্রতি আদিবাসী পুরুষের জন্য ৫ পাউন্ড আর শিশুর জন্য ২ পাউন্ড।
এদিকে দখলদার শ্বেতাঙ্গদের মধ্যেও আতংক ছড়িয়ে পড়েছিল। আদিবাসী আত্মরক্ষার লড়াই তাদের জন্য ত্রাস হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তারা সাধারণত রাতের বেলায় আদিবাসী এলাকাগুলোতে হামলা চালাত। আর শিকারক্ষেত্র কমে যাওয়ায় আদিবাসীরা খাবারের সন্ধানে উপনিবেশ এলাকায় আক্রমণ করতো। ১৮২৯ সাল নাগাদ সংঘাত আর হতাহতের ঘটনা রীতিমতো মাত্রা ছাড়িয়ে যায়।
![](https://assets.roar.media/assets/iFhA0GXI1biLpTGq_nla.obj-138420046-1-1400h.jpg)
১৮৩০ সালের মার্চ মাসে পরিস্থিতির গুরুত্ব খতিয়ে দেখতে ‘অ্যাবোরিজিন’স কমিটি’ গঠন করা হয়। এই রিপোর্টে শ্বেতাঙ্গদের শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রাখতে আদিবাসীদের আত্মরক্ষার লড়াইকে বর্বরতা আখ্যা দেওয়া হয়। আর এই বর্বরতা রুখতে সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগের নির্দেশনা দেওয়া হলো। ১ অক্টোবর পুরো ভ্যান ডেমিয়েন দ্বীপে সামরিক আইনের প্রসার করা হলো। ৭ অক্টোবর সকল সবল পুরুষদের নিয়ে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের প্রস্তুতির সমাবেশ করা হলো। এই সমাবেশ ইতিহাসে ‘ব্ল্যাক লাইন’ হিসেবে কুখ্যাত।
এবার শ্বেতাঙ্গদের আক্রমণ আরো তীব্র হলো। মাস্কেট আর কামানের সমন্বয়ে নিয়মিত সেনাবাহিনী ও স্বেচ্ছাসেবক দল যৌথ আক্রমণ চালাতে শুরু করলো। আদিবাসীরা প্রতিরোধে ব্যর্থ হয়ে হতাহতের শিকার হলো, কার্যত ছত্রভঙ্গ হয়ে গেলো। তাদের বিক্ষিপ্ত আঘাত ও হামলা উল্টো শ্বেতাঙ্গদের বর্বরতাকে একরকম বৈধতা দিয়েছিল। স্থানীয় পত্রিকা ‘দ্য কলোনিয়াল টাইমস’ ইউরোপের শ্রেষ্ঠত্ব ও আদিবাসীদের বর্বরতার বিবরণ দিয়ে শ্বেতাঙ্গদের দ্বারা ঘটে যাওয়া হত্যাকাণ্ডকে নৈতিক ও ধর্মীয় কর্তব্য হিসেবে সাব্যস্ত করেছিল।
এমতাবস্থায় অগাস্টাস রবিনসন নামের এক ইভ্যাঞ্জেলিক্যাল খ্রিস্টান ধর্মপ্রচারক এগিয়ে এলেন। তিনি আদিবাসীদের শান্তিপূর্ণ আত্মসমর্পণ ও স্থানান্তরের পক্ষে ছিলেন। উগ্র উপনিবেশবাদীদের মধ্যে কেউ কেউ তার বিরোধিতা করলেও সংঘাত ও হত্যাযজ্ঞ বন্ধে একে কার্যকর ভাবা হয়েছিল। ১৮৩০ সালের নভেম্বর নাগাদ প্রাথমিকভাবে ১৩ আদিবাসীকে গান ক্যারিয়েজ আইল্যান্ডে পাঠানো হয়। এই আত্মসমর্পণ চলার সময় আদিবাসীরা শেষবারের মতো প্রতিরোধ করে ব্যর্থ হয়। ১৮৩১ সালের ডিসেম্বর নাগাদ প্রায় ৩০০ আদিবাসীর আত্মসমর্পণ ও স্থানান্তরের মাধ্যমে এক দশকের সংঘাত কার্যত শেষ হয়।
![](https://assets.roar.media/assets/LRbBo6rl4ASCF9HS_black-war-ea9997e4-49df-4840-8d55-0cb2b6a8cf6-resize-750.jpeg)
এই সংঘাত অজস্র নিরীহ আদিবাসীর প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল। বলা হয়, শ্বেতাঙ্গদের নির্মমতায় তাসমানিয়ার আদিবাসীর সংখ্যা এক দশকের মধ্যেই এক-তৃতীয়াংশে নেমে এসেছিল। আগ্নেয়াস্ত্র ও কামানের আক্রমণ ছাড়াও সংঘাতের ফলে তৈরি হওয়া খাদ্যাভাব ও রোগের কারণে রাতারাতি তারা কার্যত বিলুপ্তই হয়ে যায়। এখনকার অধিকাংশ ঐতিহাসিকই একে অন্যতম নৃশংস গণহত্যা হিসেবে চিহ্নিত করে থাকেন।