হুয়াক্সি: চীনের যে গ্রামে সকলেই ধনী

গ্রাম বলতে আমরা সাধারণত বুঝি সবুজে ঘেরা এমন এলাকা যেখানে খেটে খাওয়া নিম্নবিত্ত বা মধ্যবিত্ত মানুষদের বসবাস। কিন্তু চীনের একটি গ্রাম রয়েছে যেখানে সকলেই ধনী! যার জন্য গ্রামটিকে বলাও হয়ে থাকে ‘পৃথিবীর সবচাইতে ধনী গ্রাম’। বলছিলাম চীনের ধনী ব্যক্তিদের গ্রাম ‘হুয়াক্সি’র কথা। যেখানে প্রত্যেক গ্রামবাসীর অন্ততপক্ষে ২,৫০,০০০ আমেরিকান ডলার করে রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। তবে এতো ধনসম্পদ থাকলেও হুয়াক্সি কিন্তু বেশ বিতর্কিত একটি গ্রাম। আসুন আজকে হুয়াক্সি সম্পর্কে জানা যাক।

কোনো পরিবার এখানে বসবাস করার সুযোগ পেলে তাদের এরকম একটি বাড়ি দেয়া হয়; Source: documentarytube.com

ইতিহাস

ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় যে, প্রথম দিকে গ্রামটি এতোটা সমৃদ্ধ ছিল না। বরং ১৯৬১ সালে প্রতিষ্ঠা লাভ করলেও, হুয়াক্সি সমৃদ্ধি লাভ করেছিল ১৯৯০ এর দিকে। প্রথমদিকে মাত্র ৬০০ জন বসবাস করতেন গ্রামটিতে। ১৯৯০ সালে ঊ রেনবাও গ্রামটিতে আসার পর দৃশ্যপট পুরো পাল্টে যায়। তিনি প্রথম সেখানে সার ছিটানোর বোতল তৈরি করার জন্য একটি কারখানা স্থাপন করেন। যার মাধ্যমে হুয়াক্সির পরিবর্তনেরও সূচনা হয়। রেনবাও ছিলেন সাবেক কমিউনিস্ট পার্টির নেতা। তিনি জানতেন কিভাবে এরকম ছোটখাটো গ্রাম পরিচালনা করা যায়। যার ফলে তার কারখানাটি স্থাপনের পর তাকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। কারণ প্রতি বছর শুধু কারখানাটি থেকেই তিনি প্রায় আড়াই লাখ ডলার করে মুনাফা অর্জন করা শুরু করেন। এতে ১৯৯০ সালের শেষের দিকে গ্রামটিতে তিনি ১২টি কর্পোরেশন এবং একটি শেয়ারবাজারের কার্যক্রম শুরু করেন। পাশাপাশি তিনি বস্ত্র এবং বিভিন্ন ধাতু তৈরির কারখানাও তৈরি করে ফেলেন।

Wu Renbao; Source: netease.com

২০১৩ সালে তিনি যখন মারা যান, গ্রামের সকলেই তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় উপস্থিত হয়েছিল। এজন্য তাকে ‘চীনের সবচাইতে জনপ্রিয়তম কৃষক’ উপাধিও দেয়া হয়। তিনি যখন গ্রামটিতে এসেছিলেন তার দলের পক্ষ থেকে, সেক্রেটারি হিসেবে; সাথে করে নিয়ে এসেছিলেন ২৫ হাজার চীনা মুদ্রা; যার মধ্যে ১৫ হাজারই ছিল ধার করা। কিন্তু তিনি তার লভ্যাংশ সবসময় পুনরায় বিনিয়োগ করতেন। যার ফলে আজ গ্রামটির এমন উন্নতি।

২০১২ সালে ঊ রেনবাওয়ের স্মরণে ‘Wu Renbao’ নামে একটি সিনেমাও তৈরি করা হয়েছিল, যেখানে রেনবাও এর জীবনকথা এবং তার অর্জনগুলো তুলে ধরা হয়েছে।

রেনবাওয়ের মৃত্যুর পর তার প্রতিষ্ঠা করে যাওয়া কারখানাগুলো থেকে কী পরিমাণ মুনাফা অর্জিত হচ্ছে, তা সম্পর্কে অনুসন্ধান করা হয়েছিল। তবে ২০০৮ সালে সর্বশেষ হুয়াক্সি গ্রামবাসীরা যে রিপোর্ট প্রদান করেছিল তাতে দেখা গেছে, কারখানা থেকে বিক্রিত পণ্যের মাধ্যমেই তারা প্রায় ৭.৮ বিলিয়ন ডলার নিজেদের ঘরে তুলেছে!

স্টীল ফ্যাক্টরিতে কর্মরত; Source: businessinsider.com

হুয়াক্সির লভ্যাংশের এক-তৃতীয়াংশই আসে তাদের স্টীল ফ্যাক্টরি থেকে। তারা বিশ্বের প্রায় ৪০টি দেশে দ্রব্য রপ্তানি করে থাকে। যার বিপরীতে মাত্র কিছু পণ্য আমদানি করে মূলত ভারত এবং ব্রাজিল থেকে।

বিতর্ক

কিন্তু এতোকিছুর পরেও গ্রামটি নিয়ে রয়েছে রহস্য, রয়েছে বিতর্ক। বাইরে থেকে হুয়াক্সিকে বলা হয় সমাজতান্ত্রিক গ্রাম। কিন্তু ভেতরে এটি আসলে পুঁজিবাদী সংগঠন। বর্তমানে পুরো গ্রামটিকে নিয়ন্ত্রণ করছে রেনবাওয়ের সন্তানেরা এবং প্রায় ২০০০ এর মতো শেয়ারহোল্ডার বা অংশীদারগণ। আর এই ২০০০ অংশীদারগণই হলেন সত্যিকারের ধনী। তারা নিজেরাই প্রায় আড়াই লাখ ডলার করে লভ্যাংশ পেয়ে থাকেন। তারা ছাড়াও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি থেকেও কারখানাগুলোতে প্রচুর বিনিয়োগ করা হয়ে থাকে।

হুয়াক্সির অভিবাসী শ্রমিক; Source: leslie-writes.com

হুয়াক্সিতে প্রায় ২৫,০০০ শ্রমিক রয়েছে। যারা প্রায় সবাই মূলত অভিবাসী। তবে তারা সকলেই উঁচুপদে চাকরি করলেও তাদেরকে সপ্তাহের সাতদিনই পরিশ্রম করতে হয়। কিন্তু তাদেরকে কত করে বেতন দেয়া হয় সে সম্পর্কে জানা যায়নি, কারণ বর্তমানে হুয়াক্সির কর্পোরেশন কত আয় করে সে সম্পর্কে কোনো তথ্যই প্রদান করা হয়না।

হুয়াক্সির যে দু’টি বিষয় এখনও বিতর্কিত, তার প্রথমটি হলো- তারা প্রচুর পরিমাণে সরকারি ভর্তুকি প্রদাণের মাধ্যমে আয় করে থাকে। যেখানে যুক্ত থাকে একটি নির্দিষ্ট হারে সুদ। যদিও হুয়াক্সির গ্রামবাসীরা এটা স্বীকার করেন না। দ্বিতীয়টি হলো- শারীরিক শ্রম। সকলপ্রকার শ্রম প্রদান করে থাকে সাধারণত হাজারেরও অধিক নিচুশ্রেণীর অভিবাসীরা। যদিও তারা পৃথিবীর অন্যান্য শ্রমিকদের থেকে বেশি বেতন পায় তবুও কর্পোরেশনের লভ্যাংশের কোনো অংশ তারা পায় না। এটা পেতে হলে তাদেরকে গ্রামের অধিবাসী হতে হবে, যা খুব সহজ নয়। কারন বাইরের কোন অভিবাসীকে তারা গ্রামে স্থায়ী ঠিকানা দিতে ইচ্ছুক নন। তাই কোনোভাবে এই শ্রমিকদের কেউ যদি চাকরিচ্যুত হয়, তাহলে তাদেরকে সরাসরি ফেরত পাঠিয়ে দেয়া হয়। ফেরত যাবার সময় তাদেরকে তাদের অর্জিত সম্পদ সাথে করে নিয়েও যেতে দেয়া হয় না।

জীবনব্যবস্থা

গ্রামবাসীদের বাড়ি; Source: ©China news

হুয়াক্সির গ্রামবাসীরা তাদের বাগানবাড়িতে থাকেন যেগুলা দেখতে পশ্চিমা জমিদারবাড়ির মতো। সকলেই নামিদামি ব্র্যান্ডের জিনিসপত্র ব্যবহার করেন। তবে সকল প্রকার জুয়াখেলা এবং নেশাদ্রব্য ব্যবহার নিষিদ্ধ হুয়াক্সিতে। পাশাপাশি সেখানে নেই কোনো ইন্টারনেট ক্লাব, মদের দোকান, নাইটক্লাব, এমনকি পার্টি করার জন্য কোনো রেস্তোরাঁও নেই। অর্থাৎ একজন ইউরোপীয় পর্যটকের কাছে মনে হবে, হুয়াক্সিতে চিত্তবিনোদনের কোনো উৎসই নেই!

অভিবাসী শ্রমিকদের মতোই কোনো গ্রামবাসী তাদের নিজেদের ধনসম্পদ নিয়ে হুয়াক্সির বাইরে যেতে পারেন না। তাই এটাও মনে হতে পারে যে তাদের অর্জিত সম্পদটা আসলে তাদের নিজেদের নয়, পুরোটাই কর্পোরেশনের! এমনকি তাদের কোনো পর্যটকের সাথে কথা বলারও অনুমতি নেই।

পর্যটন

হুয়াক্সির লভ্যাংশের এখন আরেকটি পথ হচ্ছে এর পর্যটনকেন্দ্র। গ্রামবাসীরা যেহেতু তাদের অর্জিত অর্থ বাইরে নিয়ে যেতে পারেন না, সেহেতু তারা তাদের নিজেদের ভেতরটার উৎকর্ষ সাধনেই বেশি মনোযোগ দিয়েছেন। যার ফলে তাদের নিজেদের বাসস্থানগুলোর পাশাপাশি পুরো হুয়াক্সি গ্রামটিকে রূপ দিয়েছেন অসাধারণ পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে।

তবে পর্যটকরা আসেন গ্রামটির রহস্যময় কর্মকাণ্ড লক্ষ্য করার জন্য। তারা দেখতে আসেন হুয়াক্সি গ্রামবাসীদের এই অভিজাত জীবনযাপনের রহস্যটা কী। আবার অনেকে আসে গ্রামটিতে স্থাপিত বিখ্যাত সব নিদর্শনের রেপ্লিকাগুলো দেখার জন্য। কারণ গ্রামবাসীরা নিজেদের অর্থ খরচ করে বিশ্বের বিখ্যাত কিছু স্থাপনার হুবহু রেপ্লিকা বানিয়ে রেখে দিয়েছে হুয়াক্সিতে।

গ্রামটিতে যেসব বিখ্যাত স্থাপনার রেপ্লিকা রয়েছে, সেগুলো হলো, ফ্রান্সের বিখ্যাত স্থাপনা ‘আরচ দে ট্রায়াম্পফ’। তার সাথে পর্যটকগণ চাইলে চীনের বিখ্যাত ‘দ্য গ্রেট ওয়াল’ এর রেপ্লিকায় হাঁটতেও পারেন। এর দৈর্ঘ্য আড়াই মাইল। এটি চীনের মূল ওয়ালের থেকে ১৩০০ মাইল ছোট।

দ্য গ্রেট ওয়াল অব চায়না’র রেপ্লিকা; Source: n.sinaimg.cn

দেখার মধ্যে ওয়াশিংটন ডিসির ‘ইউএস ক্যাপিটল হিল’ এর রেপ্লিকাও এখানে রয়েছে। বিখ্যাত ‘সিডনি অপেরা হাউজে’র রেপ্লিকাও দেখতে পাবেন হুয়াক্সিতে। হুয়াক্সির কাছের একটি গ্রামেই সগৌরবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় বিখ্যাত ‘স্ট্যাচু অব লিবার্টি’কেও।

হুয়াক্সির স্ট্যাচু অব লিবার্টি; Source: ssl.c.photoshelter.com/

তবে পর্যটকরা যে স্থাপনাটি দেখার জন্যই হুয়াক্সি ভ্রমণ করে থাকেন, তা হলো একটি হোটেল!

হুয়াক্সির ঝুলন্ত গ্রাম; Source: ©china news

গ্রামটির সাফল্যের শীর্ষে উঠার নিদর্শন স্বরুপ এই হোটেলটি নির্মাণ করা হয়েছিল ২০১১ সালে, যার উচ্চতা ৩২৮ মিটার; যা উচ্চতায় আইফেল টাওয়ার থেকেও বড়।

সোনার তৈরি ষাঁড়; Source: ©china news

হোটেলটির চূড়ায় সম্পূর্ণ স্বর্ণের তৈরি একটি ষাঁড়ের ভাস্কর্যও রয়েছে। এর ওজন ১ টন এবং মূল্য প্রায় ৩০ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি! বর্তমানে হোটেলটিকে বলা হয় ‘হুয়াক্সির ঝুলন্ত গ্রাম’, যা পর্যটকদের কাছে অন্যতম প্রধান আকর্ষণ।

ফিচার ইমেজ: static.soltana.ma

Related Articles

Exit mobile version